কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১১+১২
আরশি ঘরে ঢুকে কার্টন টা রেখে বসলো। পরক্ষণেই কী মনে হতে জানালার কাছে গেলো। লুকিয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে নিচে তাকালো। কাব্য এখানো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কী যেন ভাবছে আর মুচকি হাসছে। আরশি যখন তাকে আঙ্কেল বলে ডাকলো তখন তার চেহারাটা হয়েছিল দেখার মতো। আরশি সে দৃশ্য ভাবছিলো আর মিটিমিটি হাসছিলো। আরশি কাব্যর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
“নিজেকে খুব চালাক ভাবা হয় তাইনা? এখন কেমন লাগছে?”
আরশি চলে যাওয়ার পরেও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো কাব্য৷ আরশি বেশ জ্ঞানী ও বুদ্ধিমতী সেটা সে আন্দাজ করেছিলো তাই বলে এতোটাও আশা করেনি! অবশ্য এভাবে বোল্ড আউট হয়ে তার প্রচন্ড ভালো লাগছে। অবশেষে কাউকে তো পাওয়া গেলো যে তাকে বোল্ড করার ক্ষমতা রাখে৷ যদিও তারা দুজন দু প্রান্তের মানুষ। এক হওয়া অসম্ভব তবুও কোনো ছ্যাঁচড়ামি না করতেই আরশি যখন সব বুঝেই গেছে এবার কাছাকাছি আসাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। সেই কবে থেকে ফেসবুক আইডি থাকা স্বত্তেও সে একটা মেসেজ বা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিতে পারেনি এতোদিন। ফোন নাম্বার থাকা স্বত্তেও একটা কল করতে পারেনি। এই কাজগুলো করা তার জন্য খুবই কঠিন। তারচেয়ে সামনাসামনি কথা বলা হাজারগুণ সহজ। মনে মনে বললো,
“আরশি যতোই তুমি আঙ্কেল বলো কোনো সমস্যা নেই। আমি বিশেষ কিছু চাইনা, শুধু তোমার ব্যাপারে একটু জানতে চাই।”
ঘরে ঢুকে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বিড়বিড় করে বললো,
“তোর আর আমার মাঝে আরকোনো বাধা রইলো না রে৷ আরশি আর যাই হোক কখনো তোর সতীন হবে না।”
সন্ধ্যায় রশ্নির সাথে দেখা করতে গেলো আরশি। রশ্নির এতো প্রিয় সব খাবার পেয়ে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলো। বললো,
“এতোকিছু কীভাবে একা করলি? মাঝেমাঝে ভাবি তুই আমার ননদ না আমার শ্বাশুড়ি! এতো লক্ষী কেন তুই?”
“তুমি যে আমার মায়ের মতো ভাবী। কতোকিছু করেছো আমার জন্য। তাই তোমার এই সময়ে তোমার জন্য কিছু করতে ই আমার কষ্ট হয়না।”
আরশি নিজ হাতে রশ্নিকে খাইয়ে দিলো। সাহিল এতক্ষণ এ ঘরেই ছিল। কিন্তু এখন বের হয়ে কোথাও গেলো। সেই সুযোগ টাই কাজে লাগালো আরশি। হুট করেই জিজ্ঞেস করে বসলো,
“আচ্ছা ভাবী তিরা আর আমার মধ্যে কে বেশি সুন্দরী?”
ভাবী বললো,
“তোরা দুজন দুরকম সুন্দর।”
“না এমন কূটনৈতিক উত্তর দিলে হবে না। একদম স্ট্রেইটকাট বলো। তোমার উত্তরে আমি কষ্টও পাবো না, আনন্দিতও হবো না। একটা কনফিউশন ক্লিয়ার করা দরকার তাই জিজ্ঞেস করছি।”
“কীসের কনফিউশন?”
আরশি বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলো,
“তা তোমার না জানলেও তো হবে তাইনা?”
রশ্নি হেসে বললো,
“বলতে না চাইলে বলতে হবে না।”
“ঠিকাছে। তাহলে এবার বলো কে বেশি সুন্দরী?”
“তিরা বেশী সুন্দরী। কারণ সে নিজেকে সুন্দর রাখে। তুই যদি নিজেকে সুন্দর রাখার চেষ্টা করতি তাহলে তোদের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী তা বলা কঠিন হয়ে যেতো।”
“এটাও স্ট্রেইটকাট উত্তর হলো না ভাবী।”
রশ্নি হেসে বললো,
“তিরা বেশি সুন্দরী।”
আরশি বললো,
“থ্যাংকস এবার এটা বলো তো কোনো ছেলের কাছে যদি দুটো অপশন থাকে। একটা তিরা আরেকটা আমি তাহলে কি তিরাকে না পছন্দ করে আমাকে পছন্দ করা সম্ভব?”
ভাবী অবাক হয়ে বললো,
“ওহ মাই গড! হুজ দ্যা লাকি বয়? আমার ননদের মুখে প্রথম কোনো ছেলের কথা শুনলাম।”
“ধ্যাত ভাবী বেশি ভেবে ফেলছো। যা জিজ্ঞেস করলাম তা বলো না।”
“অবশ্যই সম্ভব। তিরা শুধু সুন্দর। আর তুই গুণী বুদ্ধিমতী। এখন যার যেটা লাগবে সে তো সেটাই বেছে নেবে তাই না?”
“আমার কেন যেন বিশ্বাস হয়না কেউ তিরাকে রেখে আমাকে পছন্দ করবে!”
“বলনা ছেলেটা কে? প্রোপোজ করেছে?
“না করেনি। তবে পছন্দ করে সেটা বুঝতে পেরেছি। আর এটাও বুঝিয়ে দিয়েছি তাকে আমার পছন্দ না।”
“পছন্দ না মানে? কি বলছিস? এবাড়িতে এসে কতটুকু পেয়েছি তোকে আমি। কখনো কোনো ছেলের কথা শুনলাম না। আর আজ শুনছি তাও অপছন্দের কারো কথা? এটা সম্ভব না। পছন্দ না হলে আমাকে তুই সেই ছেলের কথা কখনো বলতি না আরশি, আমি তোকে ভালো করে চিনি। সত্যি কথা বল।”
“তাই? কিজানি বুঝতে পারছি না। তবে সে আমাকে পছন্দ করে এটা জানার আগে আমি তাকে নিয়ে এক সেকেন্ডও ভাবিনি৷ অথচ সে আমাকে পছন্দ করে এটা জানার পর থেকে আমি প্রতিটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে শুধু তার কথাই ভাবছি!”
ভাবী খুশিতে লাফিয়ে উঠে বললো,
“আরশি তুই তো প্রেমে পড়ে গেছিস!”
আরশি খানিক লজ্জা পেয়ে বললো,
“ইশ না। অমন ছেলেকে আমি কখনো ভালোবাসতে পারবো না।”
“কেমন ছেলে দেখতে ভালো না?”
“না দেখতে মনে হয় ভালোই।”
“মনে হয় মানে? ভালো করে দেখিসনি?”
“ভালো করে কীভাবে দেখবো সরাসরি তাকাতে লজ্জা করেনা আমার?”
“আচ্ছা দেখতে ভালো হলে আর কী সমস্যা? ব্যবহার খারাপ?”
“না না।”
“আনস্মার্ট?”
“না বরং বেশি স্মার্ট, তার পাশে আমিই বেমানান। তিরা হলে ঠিক ছিলো।”
“ধুর ধুর। যেটা বলছি সেটা শোন ছেলে কি ছ্যাঁচড়া?”
“একদম না, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আর..”
“আর?”
“খুব ট্যালেন্টেড। তার কিছু লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। এত সুন্দর ভাবনা আজকালকার ছেলেদের থাকতে পারে আমার জানা ছিলো না।”
“তাহলে তো হয়েই গেলো।”
“কিচ্ছু হলো না ভাবী। আমরা দুজন দুই প্রান্তের মানুষ। তাছাড়া তাকে আমার ভালো লাগে না।”
“এতো গুণগান গাইছিস আর বলছিস ভালো লাগে না?”
“সম্ভাবত জীবনে প্রথম আমাকে কেউ পছন্দ করেছে বলে আমার উত্তেজিত মস্তিষ্ক তাকে ভাবাচ্ছে। তাই সারাক্ষণ তাকে ভাবছি। তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সামনে যেতে ভয় পাচ্ছি। এরকমটা হয় ভাবী আমি পড়েছি।”
রশ্নি কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। আরশি এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ না হলেও তারচেয়ে অনেক বুদ্ধিমতী, নিশ্চয়ই সঠিক সিদ্ধান্তই নেবে। তবে সে চায় আরশি কারো প্রেমে পড়ুক, সুখ দুঃখের অনুভূতির সাথে পরিচিত হোক। ওর সব বিষন্নতা নীরবতা কেটে যাক আজীবনের জন্য।
তিরা ড্রয়িংরুমে বসে টিভিতে সিনেমা দেখছিলো। হঠাৎ তিরার বাবা মনোয়ার সাহেব এসে মেয়ের পাশে বসলেন। তার হাতে একটা খাম ছিল সেটা পাশেই রাখলেন। তিরা খেয়ালও করলো না। মনোয়ার সাহেব বললেন,
“মামনি টিভি দেখছিস?”
তিরা চমকে উঠে বললো,
“ও বাবা তুমি।”
“ভয় পেলি কেন?”
তিরা দাঁত কেলিয়ে বললো,
“ভূতের সিনেমা দেখছি তো এজন্য।”
“মামনি সকালে আমি বেরিয়ে যাওয়ার আগ তো তুই ঘুম থেকেই উঠিস না। তাই ভাবলাম কথাটা এখনই সেড়ে ফেলি।”
“কি কথা বাবা বলোনা।”
“মেয়ে একটু বড় হলেই সব বাবা মায়েরা বিয়ে দেয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়।”
“ঠিক বাবা। আমার অনেক বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।”
“আমরা তো আর অমন বাবা মা নই।”
তিরা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তোমরা তো সেরা বাবা মা।”
“কিন্তু মামনি দারুণ একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে তোর জন্য।”
তিরা চমকে সরে গেলো। মনোয়ার সাহেব বললো,
“ছেলে নেভিতে চাকরি করে। তোর মতোই অল্প বয়স, একটু বড়। বাবা মা এখনই বিয়ে দিয়ে দিতে চাচ্ছে।”
তিরা রেগেমেগে বললো,
“বাবা তুমি এই কথা বলার জন্য এতক্ষণ ধানাই পানাই করেছো! ছি বাবা।”
মনোয়ার সাহেব নরম স্বরে বললেন,
“আহা রেগে যাচ্ছিস কেন মা? ছেলেটাকে আমাদের দারুণ পছন্দ হয়েছে। তুই একবার সবকিছু দেখ, তোরও পছন্দ হবে।”
“আমি এখন বিয়ে করবো না।”
মনে মনে বললো,
“বিয়ে করলে বাকী ক্রাশগুলো খাবো কীভাবে বাবা?”
মনোয়ার সাহেব বললেন,
“একবার ছবি তো দেখ।”
তিরা চিৎকার করে বললো,
“আমি এখন বিয়ে করবো না করবো না করবো না।”
তিরার চিৎকারে মনোয়ার সাহেবের কানের পর্দা ফাটার জোগাড়। তিনি দ্রুত নিজের ঘরে চলে গেলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর খামটা তিরার চোখে পড়লো। খামটা খুলে একটা বায়োডাটা আর কয়েক কপি ছবি পেলো। তিরা তার পরবর্তী ক্রাশটা সেখানেই খেয়ে ফেললো। তার ধারণা সে এত সুন্দর ছেলে জীবনেও দেখেনি৷ বয়সও একদম কম। তিরা দ্রুত সব আবার খামে ঢুকিয়ে যেখানে ছিলো সেখানেই রেখে দিলো। এরপর বাবার কাছে গেলো। গিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
“সরি বাবা তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে আমার এখন খুব খারাপ লাগছে।”
মনোয়ার সাহেব মৃদুস্বরে বললেন,
“ঠিকাছে মামনি কোনো সমস্যা নেই। আমার তো অভ্যাস আছে। তুই যতদিন খুলনা থাকিস আমি সবসময় প্রস্তুত থাকি।”
“আমি সত্যিই সরি বাবা। আচ্ছা তুমি ছেলের ছবি দেখাও। বায়োডাটা দাও। আমি সব দেখে ভেবেচিন্তে কাল সিদ্ধান্ত জানাবো।”
মনোয়ার সাহেব খুশি হয়ে ছবি আর বায়োডাটার খাম খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু মনে করতে পারলেন না কোথায় রেখেছেন। তিরা যে মনে করিয়ে দেবে তাও তো সম্ভব না তাহলে তো বাবা বুঝেই ফেলবে যে ছেলেকে দেখে তার মেয়ের মাথা ঘুরে গেছে। তিরা বললো,
“ঠিকাছে বাবা তুমি খুঁজে রেখো আমি সিনেমাটা শেষ করি।”
তিরা ড্রয়িং রুমে গিয়ে হঠাৎ খামটা দেখার ভান করে বললো,
“এই খামটা কীসের বাবা? এটাই কি বায়োডাটা?”
মনোয়ার সাহেব এসে দেখলেন সে খামটা এখানেই ফেলে গিয়েছিলেন।
“হ্যাঁ হ্যাঁ এটাই তো। নে মা সব দেখে একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবিস।”
“ঠিকাছে। তুমি রাগ করোনি তো বাবা?”
“না মা রাগ করিনি।”
মনোয়ার সাহেব এবার নিজেই মেয়ের সাথে সিনেমা দেখতে শুরু করলেন। তিরার কপাল ঠুকে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কেন সে সিনেমা দেখতে বসেছিলো। উফফ কখন সিনেমাটা শেষ হবে আর সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটাকে প্রাণভরে দেখতে পারবে?
দুপুরবেলা আরশি গোসল করে বেরিয়েছে। তার পরপরই কলিং বেল বেজে উঠলো। আরশি বারান্দায় গিয়ে দেখলো গেটে কেউ নেই৷ ঘরে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কে?”
দরজার ওপাশ থেকে কাব্যর গলা পাওয়া গেলো,
“আমি।”
আরশি অস্বস্তিতে পড়ে গেল। বাসায় কেউ নেই যাকে দিয়ে দরজা খোলানো যায় বা কাব্যর সাথে কথা বলতে দেয়া যায়। এই মুহুর্তে বাসায় আরশি একদম একা। দরজা খোলাটা কি ঠিক হবে? অবশ্য কাব্যকে আর যাই হোক খারাপ তো মনে হয়না। তাছাড়া কাব্য নিশ্চয়ই কোনো দরকারে এসেছে নাহয় দোতলা পর্যন্ত আসতো না। অগত্যা তার নিজেরই খুলতে হলো। আরশি দরজা খুলে বের হলে কাব্য তাকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। দিন দুনিয়া ভুলে হা করে চেয়ে রইলো। সদ্য গোসল করে বের হওয়া আরশিকে অন্যরকম লাগছে। মুখটা স্নিগ্ধতায় ভরে আছে। ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পিঠময়। আরশি অস্বস্তি কাটিয়ে বললো,
“বলুন কি দরকার?”
কাব্য বললো,
“সরি অসময়ে বিরক্ত করতে এসেছি। আসলে একটু পানি ছাড়তে হবে। অফিস ফিরে দেখি পানি নেই৷ গোসল করা জরুরি।”
“সেকি! পানি আছে তো। আমি তো মাত্রই গোসল করে এলাম।”
“নিচে তো পানি নেই।”
“আচ্ছা দাঁড়ান ছাদে গিয়ে নিচের পাইপের চাবি চেক করি।”
“আচ্ছা।”
আরশি ছাদে গেলো, কাব্য গেলো পেছন পেছন। ছাদে গিয়ে দেখে সত্যিই নীচের চাবি বন্ধ। আরশি চাবি খুলে দিয়ে বললো,
“সরি চাচার বাসা থেকে বাচ্চারা এলে ছাদে খেলে তো অনেক সময় না বুঝেই চাবি ঘুরিয়ে রাখে।”
“ইটস ওকে, কোনো সমস্যা নেই।”
আরশি আর কথা বাড়ালো না, দোতলায় নেমে গেলো। কাব্যও চলে গেলো নিচে।
আরশি ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তার শরীর কাঁপছে। কাব্যর সামনে গেলে এমন লাগে কেন? ফ্রিজ থেকে বোতল বের করে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেলো আরশি। তারপর যেন হঠাৎই তার মনে পড়লো গত দুদিনের মধ্যে চাচাতো ভাইবোনেরা তো কেউ ছাদে খেলতে আসেনি! তাহলে চাবি কে বন্ধ করলো? হায় আল্লাহ! কাব্য নিজেই কি চাবি বন্ধ করেছিল পানি না থাকার ছুঁতোয় আরশির সাথে দেখা করতে? আগের ভাড়াটিয়া থাকতে চাচাতো ভাইবোনেরা প্রায়ই এই কাজ করতো তাই আরশি স্বাভাবিকভাবে সেটাই ধরে নিয়েছিলো। অথচ কাব্য ওকে এভাবে ঘোল খাইয়ে গেল? আরশির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মনে মনে বললো,
“অসভ্য ছেলে কোথাকার। তোমাকে এর দ্বিগুণ ঘোল খাওয়াবো আমি!”
চলবে…
কনফিউশন
লেখকঃ মৌরি মরিয়ম
পর্ব ১২
তিরা ঘরের দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে খামটা খুলে বসলো। ছেলেটা লম্বা ৬ ফিট, ফরসা গায়ের রঙ, দেখতে বলিউডের নায়কদের মতো। হাসিটা এত সুন্দর যে তিরার মনে হলো এই হাসি দেখতে দিলে ভাত খেতে না দিলেও হবে। এত সুন্দর একটা ছেলেকে বাবা তার বিয়ের জন্য দেখছে! মনে মনে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো তিরা। ছেলেটার নাম যাদিদ। বয়স ২৪। তিরার মাথায় একটা দুষ্টুমি এলো। যাদিদকে ফোন করে একটু দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু ওর নাম্বার থেকে ফোন করা যাবে না, ওর নাম্বার নিশ্চয়ই তাকে দেয়া হয়েছে বা হবে। তিরার একটা এক্সট্রা সিমের বিশেষ বক্স আছে। সেখান থেকে এক্সট্রা সিম নিয়ে মোবাইলে ঢুকিয়ে নিলো। এরপর যাদিদের নাম্বার খুঁজতে গিয়ে বেকুব হয়ে গেলো। নাম্বারের পাশে ব্রাকেটে লেখা বাংলাদেশে যখন থাকে তখন সে এই নাম্বার ব্যবহার করে। মিশনে থাকাকালীন তাকে বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়াতে পাওয়া যাবে। সবগুলোর লিংক দেয়া আছে। তিরা ঝটপট সোস্যাল মিডিয়াগুলোতে ঢুকে যাদিদের প্রফাইলের প্রতি ইঞ্চি ঘেঁটে ফেললো। তিরা আরো মুগ্ধ হলো। তিরা জানেনা যাদিদ এখন কোথায় তবুও কল করে ফেললো, দেখা যাক পাওয়া যায় কিনা। রিং হতে লাগলো। তার মানে সে এখন বাংলাদেশেই আছে। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলো,
“হ্যালো..”
এক হ্যালোতেই তিরার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো, ছেলের কন্ঠস্বরও দেখি সুন্দর! তিরা বললো,
“হ্যালো যাদিদ।”
“কে বলছেন প্লিজ?”
তিরা ঢং করে বললো,
“আমাকে চিনতে পারছো না?”
“আপনার সাথে এর আগে আমার কথা হয়নি। সুতরাং আপনাকে আমার চেনার কথা নয়, পরিচয় দিন।”
“আমি তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ড। ব্রেকাপ হয়েছে বলে এভাবে ভুলে গেলে? আমার সাথে কাটানো সব মধুর মধুর স্মৃতি তুমি ভুলে গেছো!”
“আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের ভয়েস আমি চিনি। আমার বাবা বিয়ের জন্য যেসব জায়গায় বায়োডাটা ছড়িয়েছে আপনি সম্ভাবত তাদের মধ্যে কেউ হবেন!”
তিরা অবাক হবে না কষ্ট পাবে বুঝতে পারলো না। যাদিদের গার্লফ্রেন্ড ছিলো? পরক্ষণেই আবার নিজেকে বোঝালো, ‘তোরও বয়ফ্রেন্ড ছিলো তিরা। বিয়ের আগে এগুলো কোনো ব্যাপার না।’ যাদিদ বললো,
“বিয়ের ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত আমার বাবা মা নেবেন৷ সুতরাং আমাকে বিরক্ত না করলে খুশি হবো। বিরক্ত করতে খুব বেশি ইচ্ছে করলে তাদেরকে করুন। তাদের ফোন নাম্বারও দেয়া আছে।”
যাদিদ লাইনটা কেটে দিলো। তিরা তখনো ফোন হাতে বসে রইলো।
আরশি চা খেতে খেতে বই পড়ছিলো। তিরার ফোন এলো তখনই। আরশি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে তিরা বললো,
“জানেমান! আমি তো মরে গেছি। তুই যে তিরার সাথে কথা বলছিস সে মৃত তিরা।”
আরশি হেসে বললো,
“আবার ক্রাশ খেয়েছিস?”
“শুধু ক্রাশ না, এবার আমি ক্রাশ, আকাশ, বাতাস সবকিছু খেয়ে ফেলেছি!”
আরশি হেসে বললো,
“ছেলেটা কে?”
“যাদিদ। আল যাদিদ ইব্রাহিম।”
“বাহ সুন্দর নাম।”
“আরু আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলে।”
“তুই যার উপর ক্রাশ খাস তাকেই তোর সবচেয়ে হ্যান্ডসাম মনে হয় তিরা।”
“নো আরু নো, এবার ব্যাপার ভিন্ন। বাবা এক ছেলে দেখেছেন আমার বিয়ের জন্য। ছবি আর বায়োডাটা দেখেই আমি শেষ! ছেলে নেভি অফিসার। অথচ বয়স মাত্র ২৪। আমি তার উপর ভীষণভাবে ক্রাশ খেয়েছি!”
আরশি বললো,
“ওয়াও! ফ্রুটফুল ক্রাশ!”
“একদম। একটু আগে কথাও বলেছি। যদিও আমার পরিচয় দেইনি। উফফ কন্ঠটা এতো সুন্দর! এতো সুন্দর করে কথা বলে! জীবনে যত ক্রাশ খেয়েছি তার মধ্যে সেরা ক্রাস যাদিদ। ওকে তো বিয়ে করতেই হবে আরু।”
“পড়াশোনার কী হবে?”
“সে আমি জানিনা। আর আমি তো তোর মতো ভালো স্টুডেন্টও নই। এতো পড়াশোনা করে কী হবে?”
আরশি তিরার কথায় হাসতে লাগলো।
হঠাৎ সাহিলের ফোন পেয়ে আরশি হাসপাতালে গেলো। রশ্নির ব্যথা উঠেছে। রশ্নির বাড়ির লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়েছে। সাহিল অফিস থেকে এসেছে। হাসপাতালে সারাদিন অপেক্ষা করতে হলো। সন্ধ্যার পর রশ্নির মেয়ে হলো। সবাই বলছে মেয়ে দেখতে নাকি তার ফুপীর মতো হয়েছে। এ কথা শুনে আরশির লজ্জা লাগলো। সদ্য জন্মানো বাচ্চাদের দেখলে বোঝা যায় না সে কার মতো হয়েছে, একটু বড় হলে বোঝা যায়। তবুও আরশি মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো, দেখতে ওর মতো হয়েছে হোক কিন্তু ওর মতো ইন্ট্রোভার্ট যাতে না হয়। ইন্ট্রোভার্ট মানুষদের অনেক রকম জ্বালা থাকে।
আরশির ঘুম আসছিলো তাই ক্যান্টিনে গেলো কফি খেতে। কফি খেয়ে ফিরে আসতেই সাহিল বললো,
“আরশি আমার তো যেতে অনেক রাত হবে। তুই বরং বাসায় চলে যা।”
“তোমার সাথেই নাহয় গেলাম।”
“আমার দেরি হবে। আবার ঠিক নেই আজ নাও যেতে পারি। তুই অনেকক্ষণ ছিলি ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তুই বরং চলে যা।”
“ঠিকাছে ভাইয়া। আমি তাহলে ভাবীর সাথে আরেকবার দেখা করে আসি।”
আরশি ভাবীর সাথে দেখা করতে কেবিনে ঢুকতেই কাব্যর মুখোমুখি পড়ে গেলো। আরেকটু হলেই ধাক্কা লেগে যেতো। কাব্য আরশিকে বাঁকা চোখে দেখতে দেখতে বেরিয়ে গেলো। আরশি ভাবীকে বললো,
“এ কালা চণ্ডীদাস আবার এখানে কেন এসেছে?”
রশ্নি খিলখিল করে হেসে উঠলো। তারপর বললো,
“বাবুকে দেখতে এসেছে। একী নামে ডাকিস তুই ওকে? দেখতে পারিস না কেন?”
“তিরা থাকলে দেখতে কেমন ক্ষেপে যেতো।”
রশ্নি হেসে দিল। আরশি বললো,
“অবশ্য সে রিসেন্টলি আবার ক্রাশ খেয়েছে।”
রশ্নি আবারো হেসে বললো,
“সেকী! ওর চণ্ডীদাসের কী হবে?”
আরশি হেসে বললো,
“চণ্ডীদাস বাদ। এবারেরটা অবশ্য ফ্রুটফুল ক্রাশ। ফুপাজান ওর বিয়ের জন্য ছেলে দেখেছেন, সেই ছেলের ছবি দেখেই ক্রাশ খেয়েছে।”
“উফ পারেও মেয়েটা!”
“আচ্ছা ভাবী আমি আজ উঠি। কাল সকাল সকাল চলে আসবো।”
“আচ্ছা সবধানে যাস। চাচীকে অলরেডি ফোনে বলে দিয়েছি বাসায় যেতে। তোর ভাইয়া না ফিরলে চাচী আমাদের বাসাতেই থাকবে।”
“আচ্ছা।”
আরশি কেবিন থেকে বের হতেই সাহিল বললো,
“আরশি তোর একা যেতে হবে না। কাব্য বাসায় যাচ্ছে, ওর সাথেই চলে যা।”
“আমি একা যেতে পারবো ভাইয়া।”
“কাব্য তো বাসায়ই যাচ্ছে। তুই একা কেন যাবি? ওর সাথে গেলে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো। রাত একদম কম হয়নি।”
“ঠিকাছে।”
আরশি আর কথা বাড়ালো না৷ কে জানে বেশি আপত্তি করলে সাহিল কি না কি ভেবে বসে! আরশি কাব্যকে বললো,
“চলুন।”
কাব্য বললো,
“হ্যাঁ চলুন।”
সাহিল কাব্যকে বললো,
“এই কাব্য তুই আরশিকে আপনি আপনি বলিস?”
কাব্য আমতা আমতা করে বললো,
“হ্যাঁ।”
“কেন? ওকে তুই করে বলবি। অবশ্য হঠাৎ করে তুই বলতে সমস্যা হতে পারে সেক্ষেত্রে তুমি বল। ছোটো একটা মেয়েকে আপনি বলিস এটা কেমন কথা!”
কাব্য বললো,
“আসলে ভাইয়া সেভাবে কথাই হয়নি কখনো।”
“একই বাসায় থাকিস আর পরিচয় নেই! কি আজব তোরা। যা পরিচয় হতে হতে বাসায় যা।”
আরশি ও কাব্য লিফটে উঠলো। লিফটে আপাতত আর কেউ নেই। আরশি দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, লিফটের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাব্য। আরশির মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঝিমঝিম করছে। কেন যেন কাব্যর সাথে যাওয়াতে ওর ভালো লাগছে। আবার কাব্যর সাথে যাওয়াতেই খুব অস্বস্তি লাগছে। হাত পা কাঁপছে। কাব্য সরাসরি তাকিয়ে আছ আরশির দিকে। আরশির এই অবস্থা দেখে কাব্য ঠিক করলো আজ পুরো রাস্তা ও আরশির দিকে তাকিয়ে থাকবে। এতোদিন লুকিয়ে দেখতো। ধরা তো পড়েই গেছে, এখন আর লুকোচুরির কোনো দরকার নেই। এখন বেহায়া হবে, চরম বেহায়া।
কাব্য উবার কল করেছে। গাড়ি এখনো এসে পৌঁছয়নি। হাসপাতালের সামনেই গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলো তারা। কাব্য টিস্যু বের করে আরশির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“আপনি ঘামছেন।”
আরশি টিস্যু নিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। এর মধ্যেই গাড়ি এসে গেলো। ওরা গাড়িতে উঠলো। গাড়ি চলতে শুরু করতেই কাব্য আরশিকে বললো,
“পানি খাবেন?”
“নো থ্যাংকস।”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। কাব্য আরশির দিকে তাকিয়ে ছিলো আর আরশি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। কাব্য আবার বললো,
“সাহিল ভাইয়া অবশ্য জানেনা, আমি অনুমতি ছাড়া কাউকে তুমি করে বলিনা। সে বড়ই হোক আর ছোটো!”
আরশি যেদিকে তাকিয়ে ছিলো সেদিকেই তাকিয়ে বললো,
“আপনার ইচ্ছে হলে বলবেন। সবারই বাক স্বাধীনতা আছে, আমি তো কাউকে আটকে রাখিনি।”
“তোমার অনুমতি দেয়ার কৌশল টা কিন্তু দারুণ লাগলো।”
আরশি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে রাখলো। হাসলেই ধরা পড়ে যাবে। আবারো কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। কাব্যই আবার বললো,
“শুনলাম তিরা বিয়ের প্রস্তাব আসা পাত্রের উপর ক্রাশ খেয়েছে!”
আরশি স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
“কার কাছে শুনলেন?”
“তিরার কাছেই শুনলাম।”
“আপনার তিরার সাথে কথা হয়?”
“হ্যাঁ। আমরা তো বন্ধু।”
“হুম আপনারা তো আবার আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ের মতো ভালো বন্ধু।”
কাব্য হো হো করে হেসে দিলো। আরশি একটা কথাও কাব্যর দিকে তাকিয়ে বলছে না। কিন্তু কাব্য আরশির দিকেই তাকিয়ে আছে। কাব্য জিজ্ঞেস করলো,
“ওটা বিশ্বাস হয় তোমার?”
“আমার বিশ্বাসে কী যায় আসে?”
“তবু বলো।”
“যার নিজেরই বয়স ২০/২১ তার মেয়ের বয়স কীভাবে ১৯ হয়?”
“মেয়ে নয়, এক্স গার্লফ্রেন্ডের মেয়ে!”
আরশি এবার মুচকি হাসলো। কাব্য বললো,
“আমার বয়স ২২।”
“আন্দাজ কাছাকাছিই করেছি।”
“তা ঠিক।”
আরশি এবার ড্রাইভারকে বললো,
“ভাইয়া এসিটা বন্ধ করে দিন, জানালা খুলবো।”
ড্রাইভার এসি বন্ধ করতেই আরশি জানালা খুলে দিলো। কাব্য খানিক ভেবে বললো,
“সিগারেটের গন্ধে সমস্যা হচ্ছিলো?”
আরশি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। কাব্য বললো,
“বাবু দেখতে যাব বলে হাসপাতালে ঢোকার আগে খাইনি। তুমি সাথে আছো বলে বের হয়েও খাইনি।”
আরশি এবারো কাব্যর দিকে তাকালো না। বললো,
“হাসপাতালে বোঝা যাচ্ছিলো না। কিন্তু এখানে বন্ধ জায়গায় কাছাকাছি বসে আছি তো, গন্ধটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো।”
কাব্য হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো। বাড়ি পৌঁছতে আর পাঁচ মিনিট লাগলো। এই পাঁচ মিনিটে কাব্য আর একটা কথাও বললো না। দুজনে চুপচাপ গাড়ি থেকে নামলো। সিঁড়ি পর্যন্ত একসাথে এলো। আরশি দোতলায় চলে গেলো। কাব্য নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলো। এই এতক্ষণ দুজন মানুষ আর একটি কথাও বললো না।
চলবে…