#কখনো_বা_দেখা_হবে
#পর্বঃ১০ এবং শেষ।
#লেখিকাঃদিশা_মনি
কাজি অফিসে এসে উপস্থিত হয়েছে সিনথিয়া ও অভি। মিরাজ এবং ঝর্ণাও এসেছে তাদের বিয়ের সাক্ষী হতে। অবশেষে অভি ও সিনথিয়ার বিয়ে সম্পন্ন হয়। সিনথিয়া বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বিয়েটা করে নেয়। অভিকে যেন এই অল্প সময়েই তার মনের বিশাল স্থান দিয়ে ফেলেছে। অভিও নিদ্বিধায় বিয়ে করে নিল সিনথিয়া। অতঃপর দুজনে মিলে রওনা দিল অভির বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে। না জানি সেখানে কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
সারা রাস্তায় সিনথিয়ার ভয়ের সাথেই অতিবাহিত হয়। ভয় শুধু একটাই। অভির পরিবার যদি এই বিয়ে মেনে না নেয় তাহলে কি হবে। সিনথিয়ার মনে হতে লাগল,
‘আমার জন্য সব সময় কি অন্যরা কষ্ট পাবে? রাজীব ভাইকে তো যথেষ্ট কষ্ট দিয়েছি। এখন আমার জন্য যদি অভির সাথে তার পরিবারের সম্পর্ক খারাপ হয়৷ আমি কিভাবে এতটা স্বার্থপর হলাম? নিজের কথা ভাবতে গিয়ে আমি পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি একটু বিবেচনাতেও আনলাম না। হায় আল্লাহ কি হবে এবার।’
মনে অজানা ভয় নিয়ে অভির বাড়ির সামনে উপস্থিত হয় সিনথিয়া। সারা রাস্তা তার অতিবাহিত হয়েছে উদ্বিগ্নতার সাথে। এখনো তার মনে নানা রকম চিন্তা ভাবনা ঘুরছে।
এমন সময় অভি সিনথিয়ার হাত শক্ত করে ধরে মৃদু হেসে বলে,
‘কোন চিন্তা করো না। দেখবে সবকিছু ঠিক থাকবে।’
অভি ভরসা দিলেও সিনথিয়া সেই কথায় খুব একটা ভরসা পায় না।
অভি বাড়ির সামনে এসে কলিং বেল বাজায়। যার ক্ষণিক সময় বাদে, তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে অভির সাথে বেনারসি পরিহিতা একটি মেয়েকে দেখে সে চিৎকার করে দেয়। চিৎকার করে বলে,
‘খালাম্মা দেখে যান আপনার ছেলের কাণ্ড।’
অভির মা সুলতানা বেগম চলে আসেন সেই ডাক শুনে। তবে তিনি এই দৃশ্য দেখে অবাক হন না। বরং সিনথিয়াকে বরণ করার প্রস্তুতি নিতে যান। সিনথিয়া বেশ অবাক হয়। অভি বলে,
‘আমি আম্মুকে আগে থেকেই তোমার ব্যাপারে সব বলে রেখেছিলাম। আম্মুর থেকে ভরসা পেয়েই তো আমি তোমাকে বিয়ে করেছি।’
অতঃপর সুলতানা বেগম সিনথিয়াকে বরণ করে ঘরে তোলেন। অভির ভয় করছিল তার বাবা আব্দুর রহমানকে নিয়ে। কারণ তাকে এই ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি৷ তাই তিনি এই বিয়ে কিভাবে নেবেন সেটা নিয়েই মূল চিন্তা।
আব্দুর রহমান বাড়িতেই ছিলেন। অভির এভাবে হঠাৎ বিয়ে তাকে না জানিয়ে বিয়ে করায় তিনি রাগারাগি করেন। সাথে এও বলেন,
‘আমি কিছুতেই এই বিয়ে মেনে নেবো না।’
এই সব ঘটনায় সিনথিয়ার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। সুলতানা বেগম আব্দুর রহমানকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। অভি সিনথিয়াকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। সিনথিয়াকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
‘দেখবে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
১৯.
আজ বিয়ের পর অভি ও সিনথিয়ার প্রথম রাত। যদিও অশান্তির কারণে কোন কিছুই ঠিকভাবে হচ্ছে না। তবুও তাদের এই প্রথম রাতকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য অভি নিজেই ফুল কিনে এনে সাজিয়েছে বিছানা। অতঃপর খুব সুন্দরভাবে আজকের রাত তারা কা’টায়। সিনথিয়ার মনে নানা দ্বিধা কাজ করছিল। সে মানসিক ভাবেও প্রস্তুত ছিল না। তাই অভি সিদ্ধান্ত নেয় আজ তারা বাসর করবে না। প্রথম রাতটা নাহয় গল্প করেই অতিবাহিত হোক।
সারারাত গল্প করে অতিবাহিত করার পর সকালে উঠে সিনথিয়া চলে যায় সুলতানা বেগমের কাছে। সুলতানা বেগম নিজের কিছু শাড়ি গহনা দিয়ে সিনথিয়াকে বলে,
‘বিয়েটা তো কোনভাবে হয়ে গেল। আজ তোমাদের বৌভাত হওয়ার কথা। এখন তো বড় অনুষ্ঠান করে কিছু করা সম্ভব নয়। তবে একেবারে কিছু না করলেও নয়। তাই আমাকে তোমার বাবার ফোন নম্বর দেও। আমি তাদের ফোন করে ডাকছি।’
সিনথিয়া সুলতানা বেগমকে নিজের বাবার ফোন নম্বর দেয়। সুলতানা বেগম কল করেন। সিরাজুল হক ফোনটা রিসিভ করতেই সালাম বিনিময় করেন। অতঃপর তাদের আসতে বলেন। সিরাজুল হক যদিও রাজি ছিল না কিন্তু সুলতানা বেগম এমনভাবে বললেন যে রাজি না হয়েও থাকতে পারলেন না।
ক্ষুদ্র পরিসরেই বৌভাতের আয়োজন চলছে। আব্দুর রহমান এখনো নাখোশ রয়েছেন। সুলতানা বেগমের একার তৎপরতায় চলছে সব আয়োজন। এই অব্দি সব ঠিকই ছিল।
দুপুরে সিরাজুল হক আর লুবনা আক্তার চলে আসেন এই বাড়িতে। লুবনা আক্তারের তো চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় এত বড় বাড়ি দেখে। অপরদিকে সিরাজুল হক এই বাড়িতে এসে চমকে যান। কারণ এটা যে তার প্রথম স্ত্রী সেলিনার বাপের বাড়ি। এই বাড়ি থেকেই গাড়ি পাঠানো হয়েছিল তাদের আনার জন্য। তাই আসার আগে পর্যন্ত সিরাজুল হক কিছু বুঝতে পারেন নি।
তবে বাড়িতে ঢোকামাত্রই সিরাজুল হক আব্দুর রহমানের মুখোমুখি হন। এতদিন পর সিরাজুল হককে দেখে আব্দুর রহমান ছুটে আসেন। বলেন,
‘তুমি! আমার বোন কোথায়? সেও কি এসেছে?’
সিরাজুল হক আমতা আমতা করতে থাকেন। লুবনা আক্তার চুপচাপ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। একটু পরেই সিনথিয়া এসে উপস্থিত হয় সেখানে। সিরাজুল হককে দেখে বলে,
‘আব্বু তুমি এসেছ।’
সিনথিয়া সিরাজুল হককে আব্বু ডাকায় হতবাক হয়ে যান আব্দুর রহমান। সিরাজুল হক তখন বলেন,
‘আপনি আমার সাথে একটু ভেতরে চলুন আমি আপনাকে সবকিছু বলব।’
অতঃপর সিরাজুল হক আব্দুর রহমানকে সবকিছু বলেন। যে সিনথিয়া আসলে আব্দুর রহমানের বোন সেলিনারই মেয়ে। এছাড়া তিনি সেলিনা ও সিনথিয়ার সাথে কি কি অন্যায় করেছেন সেটাও বলেন। সাথে এও বলেন যে তিনি সবকিছুর জন্য অনুতপ্ত।
আব্দুর রহমান রেগে গিয়ে সিরাজুল হকের গায়ে হাত পর্যন্ত তোলেন। তখন অভি, সিনথিয়া এসে তাকে থামায়। সবার সামনে আব্দুর রহমান সিনথিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
‘তুই আমার বোনের মেয়ে। আমার বোন সেলিনার মেয়ে তুই।’
মুহুর্তেই একটি আবেগঘন মুহুর্তের তৈরি হয়। অভিও জানতে পারে যে সিনথিয়া তার ফুফাতো বোন। সিনথিয়াও এতদিন পর তার মামাকে পেয়ে খুশি হয়। সাথে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানায় তাকে সবকিছু ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।
২০.
সিনথিয়ার আসল পরিচয় জানার পর আব্দুর রহমান এই বিয়েটা মেনে নিয়েছেন৷ তাই আজ আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে সিনথিয়া ও অভির রিশেপসন হতে চলেছে। পুরো বাড়িতে চলছে অনেক বেশি আয়োজন। হরেক রকমের রান্না ও সাজসজ্জা চলছে বাড়িজুড়েই।
সিনথিয়াকে খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে। সিনথিয়াকে এনে একটি চেয়ারে বসানো হয়েছে। তার পাশেই বসে আছ অভি। সিনথিয়াকে দেখে অভি মৃদু হেসে বলে,
‘তোমাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে।’
বিনিময়ে সিনথিয়াও মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। রিশেপসনে অনেকে আমন্ত্রিত ছিল। তাদের সাথে আলাপচারিতায় সিনথিয়ার সময় যাচ্ছিল। অনেক মানুষের সাথে পরিচিতও হয়ে নিচ্ছিল সে। এভাবেই সময় কাল অতিবাহিত হয়।
আচমকা রিশেপসনে একজনকে দেখে অবাক হয়ে যায় সিনথিয়া। কারণ রাজীবও এসেছে। রাজীব হাতে একটি উপহার নিয়ে সিনথিয়া ও অভির কাছে আসে। সিনথিয়ার হাতে উপহারটি তুলে দিয়ে,
‘মেনি মেনি কংগ্রাচুলেশনস। খুব সুন্দর মানিয়েছে তোমাদের। আশা করি অনেক ভালো আছ।’
‘হুম। কিন্তু আপনি,,,’
রাজীব সামান্য হেসে বলে,
‘বিনা দাওয়াতে আসিনি আমি। তোমার হাজবেন্ড আমাকে আসতে বলেছে তাই এসেছি। তাইনা অভি?’
‘হুম। তোমাকে তো দাওয়াত দিতেই হতো রাজীব ভাইয়া। তুমি ছিলে জন্যই তো আমি সিনথিয়াকে পেয়েছি।’
অভির কিছু বন্ধুবান্ধব চলে আসায় সে তাদের সাথে একটু কথা বলতে যায়। সিনথিয়া রাজীবকেই দেখছিল। রাজীবকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে মন থেকে কতটা কষ্টে আছে। তবুও সিনথিয়া জিজ্ঞেস করে,
‘কেমন আছেন রাজীব ভাই?’
‘যেমন রেখেছ।’
সিনথিয়া আর কিছু বলতে পারে না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রাজীব বলে ওঠে,
‘আমি আজ চলে যাচ্ছি এই শহর থেকে। তুমি ভালো থেকো। তোমার নতুন জীবন সুখের হোক।’
সিনথিয়া আনমনে বলে দেয়,
‘আমাদের কি আর দেখা হবে না?’
‘ভাগ্য যদি সহায় থাকে, কখনো বা দেখা হবে।’
সমাপ্ত ✨