কখনো বা দেখা হবে পর্ব-০৯

0
2435

#কখনো_বা_দেখা_হবে
#পর্বঃ৯
#লেখিকাঃদিশা_মনি

সিনথিয়া কবুল বলতে যাবে এমন সময় ঘটে যায় এক অদ্ভুত ঘটনা। সিরাজুল হক বলে ওঠেন,
‘থামাও এসব। কোন বিয়ে হবে না।’

সাথে সাথে পুলিশও চলে আসে। এসে গ্রেফতার করে রায়হান ও তার বন্ধুদের। লুবনা আক্তার দাত কটমট করতে থাকেন। সিরাজুল হকের পিতৃত্ব হঠাৎ এভাবে জেগে ওঠায় তার সব পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে গেল।

সিরাজুল হক সিনথিয়ার কাছে আসেন। সিনথিয়ার মাথায় হাত রেখে বলেন,
‘আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি সিনথিয়া। তোর সাথে, তোর মায়ের সাথে অনেক বেশি অন্যায় করেছি। আমি নিজের ভুলটা এখন বুঝতে পেরেছি। তুই দয়া করে পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস।’

সিনথিয়া অশ্রুসজল চোখে তার বাবাকে বলে,
‘আমি হয়তো নিজের প্রতি করা সব অন্যায়ের জন্য তোমাকে ক্ষমা করতে পারব কিন্তু আম্মুর সাথে তুমি যে অন্যায় করেছ তার জন্য আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারবো না। কারণ তার কোন ক্ষমা হয়না। তবুও তুমি আমার আব্বু, আমি চাই তুমি আমাকে দোয়া করো যেন আমার ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হয়।’

সিরাজুল হক বলেন,
‘আমি চাই তুই সুখী হ। আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনাই করব যেন তোকে সুখী করে। আমার করা অন্যায়ের জন্যও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইব। এখন থেকে আমি সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাবো দেখিস।’

সিনথিয়া আচমকা তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে। সিরাজুল হকও নিজের মেয়েকে বুকে আগলে নেন। লুবনা আক্তারের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকে এই দৃশ্য দেখে। কিন্তু তার কিছু করারও ছিল না। তাই দাতে দাত চেপে সব সহ্য করে। এমনিতেই আজকে সিনথিয়া এমনিই চলে যাবে। এটাই তার কাছে অনেক।

বাবার থেকে বিদায় নিয়ে সিনথিয়া আসে লুবনা আক্তারের সামনে। তার সামনে এসে বলে,
‘জানি আপনি কখনো আমার ভালো চান নি। এখনো চান না। আসলে কিছু মানুষ জীবনে কখনো বদলায় না। তবু আমি চাই আপনিও আব্বু মতো নিজেকে বদলে ফেলার চেষ্টা করুন। অনেক অন্যায় তো করেছেন এখন আল্লাহর কাছে মাফ চান। অন্তত কিছুটা সওয়াব সঞ্চয় করুন জীবনে। আপনার ভালোর জন্যই এই পরামর্শ দিলাম। আল্লাহ কিন্তু পরম দয়ালু। তার বান্দাদের ক্ষমা করে দেবেন নিশ্চয়ই।’

লুবনা আক্তারকে কতোটা প্রভাবিত করল কথাগুলো সেটা বোঝা গেল না৷ সিনথিয়া নিজের পৈত্রিক ভিটা ত্যাগ করল। রাজীবের বাইকে উঠে পড়ল। এখন তার গন্তব্য স্থল অভির নিকট। যাকে সাথে নিয়েই জীবনের বাকি দিনগুলো পার কর‍তে চায় সিনথিয়া।

১৭.
মাঝরাস্তায় আচমকা বাইক থামিয়ে দেয় রাজীব। সিনথিয়া জিজ্ঞেস করে,
‘এখানে থামলেন কেন? আপনি না বলছিলেন অভি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

রাজীব কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
‘আজ থেকে তো চিরকালের জন্য তুমি অভির হয়ে যাবে। তার আগে কিছু সময় কি আমি তোমার থেকে পেতে পারি সিনথিয়া। ‘

রাজীবের কাতর আবেদন। সিনথিয়ার মনকে যা নাড়া দিয়ে যায়। কিন্তু সিনথিয়া কি বলবে সেটা বুঝতে পারছিল না। রাজীব পুনরায় বলল,
‘চিন্তা করো না। বেশি সময় নেবোনা৷ পাচ মিনিট দাও আমাকে। আমি শুধু মিনিট পাচেক তোমার হাট ধরে একটু হাটতে চাই।’

সিনথিয়া নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়। রাজীব তৃপ্তির হাসি হাসে। অতঃপর সিনথিয়াকে সাথে নিয়ে ফুটপাত ধরে হাটতে থাকে। ইচ্ছা ছিল এই হাতে হাত রেখে আজীবন কাটিয়ে দেবে। কিন্তু ঐ যে ভাগ্যে নেই। রাজীবের ভাগ্য যে অনেক বেশি নিষ্ঠুর। ছোট বেলা থেকেই এই ভাগ্যের জন্য তাকে বিভিন্ন কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়।

সিনথিয়াও অনুভব করতে পারছিল রাজীবের কষ্টটা। কিন্তু সেই বা কি করবে? ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যেটা মন থেকে আসে৷ জোর করে কাউকে ভালোবাসা যায় না৷ আমাদের মনও যে বড়ই অদ্ভুত। কখন কাকে ভালোবেসে ফেলে সেটা বোঝা বড় দায়!

রাজীব আর নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। সিনথিয়ার কাছে আবদার করে বসে,
‘আমি কি তোমাকে জড়িয়ে ধরে একটু কাদতে পারি?’

সিনথিয়া ফেলতে পারে না এই আবেদন। অনুমতি দিয়ে দেয়। রাজীব তখন সিনথিয়াকে জড়িয়ে ধরে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে। এপর্যায়ে সিনথিয়াও নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। সেও ডুকরে কেদে ওঠে। কান্নারত অবস্থায় বলে,
‘কেন এত ভালোবাসলেন আমায়? আমাকে ভালোবেসে কি পেলেন আপনি? শুধুই কষ্ট। এই কষ্ট তো আপনি ডিজার্ভ করেন না।’

‘আমি কখনো মনে করব না আমি ভালোবাসা পাই নি। কারণ আমি তো তোমাকে ভালোবেসতে পেরেছি। তুমি আমায় ভালোবাসতে পারো নি।'(রাজীব)

সিনথিয়া বলে,
‘কি লাভ হলো এই ভালোবেসে? আমাকে ভালোবাসা কি তাহলে আপনার ভাগ্যের দোষ?’

‘তুমি আমার মনে আছো কিন্তু ভাগ্যে নেই। ভাগ্যকে দোষ দেব না আমি কারণ দোষ আমার মনের।’

সিনথিয়া এপর্যায়ে রাজীবের থেকে দূরে সরে আসে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে চিৎকার করে বলে,
‘আমার জীবনের সবথেকে বড় আফসোস থেকে যাবে যে আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারিনি।’

রাজীব তৎক্ষনাৎ সিনথিয়াকে টেনে তোলে। নিজের কষ্ট ভুলে, অশ্রু মুছে, সিনথিয়ার চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,
‘তুমি ভালোবাসো নি তো কি হয়েছে? আমি তো বাসি। ডুবে ডুবে ভালোবাসি। তুমি না বাসলেও আমি বাসি।’

১৮.
নিজের বাইকে উঠে সিনথিয়াকেও উঠতে বলে রাজীব। সিনথিয়া বাইকে ওঠে। রাজীব বাইক স্টার্ট দেয়। সিনথিয়া রাজীবের কাধে স্পর্শ করে বসেছিল৷ এই স্পর্শের মাধ্যমে রাজীব অনুভব করার চেষ্টা করে সিনথিয়াকে।

সিনথিয়ার প্রতিটা স্পর্শ আজ থেকে অন্য কারো নামে হবে। কথাটা ভাবতেই রাজীবের ইচ্ছা করছে ভাগ্য বদলে দিতে। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে যদি ভাগ্যের লেখা পরিবর্তন করা যেত তাহলে সে যেন এক্ষুনি সিনথিয়াকে নিজের করে নিতো। কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয়। তাই একবুক না পাওয়ার গ্লানি নিয়েই থাকতে হবে রাজীবকে।

গাড়ি এসে থামে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে। সিনথিয়ার চোখে তখনো অশ্রুবিন্দু লেগে ছিল। রাজীব টিস্যু এগিয়ে দেয় সিনথিয়ার দিকে। অতঃপর বলে,
‘আর কেদোনা তুমি। আমার জন্য কষ্ট পেতে হবে না। আমি তোমার সাথে কা’টানো স্মৃতিগুলো নিয়েই আজীবন কা’টিয়ে দিতে পারব।’

রাজীব অভিকে ফোন দেয়। অভি ফোনটা রিসিভ করলে রাজীব বলে,
‘কোথায় তুমি? আমি সিনথিয়াকে নিয়ে এসেছি।’

‘আমি দেখেছি তোমাদের। রাস্তার বিপরীত দিকে আছি। যাচ্ছি।’

অল্প সময়ের ব্যবধানে অভি তাদের কাছে চলে আসে। সিনথিয়াকে দেখে তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলে,
‘শেষ পর্যন্ত তুমি আমার কাছে আসলেই। আমি খুব খুশি হয়েছি।’

রাজীব সিনথিয়ার হাত ধরে তাকে অভির হাতে তুলে দিয়ে বলে,
‘অনেক ভরসা করে আমার জীবনের সবথেকে দামী মানুষটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। তুমি কিন্তু ওর কোন অযত্ন হতে দেবে না। আশা করি, সিনথিয়া তোমার কাছে ভালো থাকবে।’

অভিও আশ্বাস দিয়ে বলে,
‘আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে সিনথিয়াকে সুখে রাখার চেষ্টা করব।’

রাজীব এক পলক সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘চলো কাজী অফিসে যাই। তোমাদের বিয়ের সাক্ষী নাহয় আমি হবো।’

সিনথিয়া জানে রাজীব এই দৃশ্য সহ্য করতে পারবে না। তাই সে বলে,
‘আপনি আমাদের জন্য অনেক করেছেন। এর জন্য আপনার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব। কিন্তু আপনাকে আর কিছু করতে হবে না। আমরা আমাদের কিছু বন্ধু-বান্ধবক্র ডাকব। তারা নাহয় সাক্ষী হবে।’

রাজীব বুঝল সিনথিয়া তাকে আর কষ্ট দিতে চাইছে না তাই এমন কথা বলছে। কিন্তু সিনথিয়াকে হারিয়ে তো এমনিই যথেষ্ট কষ্ট পেয়ে গেছে সে। আর কোন কষ্ট তার কাছে কিছু নয়। তবুও সিনথিয়ার মন রাখতে রাজীব বলে,
‘আচ্ছা তোমরা ভালো থেকো। তোমাদের ভবিষ্যৎ জীবন সুখের হোক। আমি তাহলে যাচ্ছি।’

রাজীব চলে যায়। যাওয়ার আগে একবারও ফিরে দেখে না। কারণ সে যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছে। আর পিছনে ফিরে তাকাতে চায় না।

সিনথিয়া মনে মনে বলে,

‘আল্লাহ তুমি রাজীব ভাইয়ের জীবনে এমন কাউকে এনে দিও যে তাকে ভালোবাসবে যে তাকে সুখে রাখবে। নাহলে যে আমাকে চিরকাল আফসোস করে যেতে হবে। তাকে ভালো বাসতে না পারার আফসোস।’


রাজীব রাতের নিশ্চুপ রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছে। আজ তার পুরো জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। জীবনের সবথেকে দামী মানুষটাকে যে আজ সে হারিয়ে ফেলেছে।

এক ব্যর্থ প্রেমিকের কষ্টে আজ রাজপথেও যেন কষ্টের মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছে।

❝জিসকে আনে সে মুকাম্মাল হো গেয়ি থি জিন্দেগী।
দাস্তাখে খুশিও নে দিথি
মিট গেয়ি থি হার কামি
কিউ বে বাজা দি এ সাজা
কিউ খোয়াব দেকে ও লে গেয়া
জিয়ে জো হাম লাগে সিতাম
আজাব এসে ও দে গেয়া।❞

গানটি বলে নিজের মনের সব দুঃখ প্রকাশ করে রাজীব। সিনথিয়া যে তার জীবনের অনেক বড় একটি অংশ জুড়ে ছিল। যা আজ সে হারিয়ে ফেলল।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে