#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
“০৬”
——————————–
– আসতে পারি?
সবে নিচে থেকে নাস্তা করে রুমে আসলো যীনাত। কারো কন্ঠ শুনে পছে ফিরে তাকায় এবং দেখে জাইফ একটা কিউট হাসি দিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। যীনাত তাড়াতাড়ি মাথায় ওড়না দিয়ে বলে,”জ্বী আসুন। কিছু বলবেন?”
– উমম… হ্যাঁ কিছু বলার জন্যই মূলত আপনার রুমে আসা।
– বলুন।
– অফিস যাচ্ছি নিজের খেয়াল রাখবেন আসতে আসতে ৭-৮টা বাজবে।
যীনাত অবাক হয়ে বলে,”আ.. আমায় কেন বলছেন?”
– কারণ আপনি এখন আমার সহধর্মীনি। তাই আপনার সবকিছু জানার অধিকার আছে আর আপনাকে বলাটাও আমার দায়িত্ব। সে যাইহোক দুপুরে সময়মতো খেয়ে নিবেন। একা ফিল হলে মা অথবা মিনিকে ডেকে আনবেন তাদের সাথে সময় কাটালে ভালো লাগবে। যাইহোক বাই।
– আল্লাহ হাফেজ।
– ওহ সরি আল্লাহ হাফেজ।
বলেই মুচকি একটা হাসি দিয়ে জাইফ চলে গেলো৷ যীনাতও হেসে দিলো। ২ দিনও হলো না তবুও এতোটা কেয়ারিং, সত্যিই অনেকটা দায়িত্ববান জাইফ। কিন্তু তাদের বিয়েটা পরিস্থিতির চাপে পড়েই হয়েছে তবুও জাইফ এতো স্বাভাবিক কি করে হলো? যীনাতও কি আদৌ স্বাভাবিক হতে পারছে নাকি জাইফ নিজেই তার ব্যবহারের মাধ্যমে তাকে বাধ্য করেছে সবটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে? এসবই আকাশ পাতাল ভেবে চলেছে যীনাত।
তারপর এতোকিছু না ভেবে নিজের বাবার চিঠিটা নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো আর বারবার পড়তে থাকে। হঠাৎ কাল রাতের কথা মনে পড়ে।
– আচ্ছা আমাকে কে প্যারালাইজড করেছিলো? আর ওই ছেলেটাই বা কে চেহারা কেন স্পষ্ট মনে পড়ছে না আমার? আদৌ কি এটা স্বপ্ন? আর ‘ওয়ারদূন আসরার’ কি? হুজুরের থেকে যতোটুকু আরবি ভাষা শিখেছি তার মাঝে এইটুকু অর্থ বুঝতে পারছি যে ওয়ারদূন মানে গোলাপ আর আসরার মানে রহস্য। এটা আবার কেমন রহস্য? গোলাপের রহস্য? গোলাপের সাথে কিসের সম্পর্ক? সব কেমন ঘোলাটে লাগছে। না মাথায় প্রেশার দিতে পারছি না। আচ্ছা কোনো ভাবে যদি হুজুরের সাথে সবটা বললে কেমন হয়? কিন্তু তার সাথে কথা কি করে বলবো আমার তো একটা ফোনও নেই। কি করা যায় এখন?
যীনাত ভাবছে আর দাঁত দিয়ে নখ কাটছে আবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ মাথায় আসলো দাদুকে বললে তো মন্দ হয়না কারণ সে প্রথম থেকেই সবটা জানেন আর হুজুরের সাথেও যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবেন।
যেই ভাবা সেই কাজ! যীনাত দেবনাথ দেবের ঘরেএ দিকে যান। দেবনাথ দেবের রুমে দাঁড়িয়ে কয়েকবার উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখলো দেবনাথ দেব ভেতরে নেই। এবার যীনাত হতাশ হলো কি করবে এখন সে? হতাশ হয়ে পিছে ফিরে দেখে কমলা দেবী মুখে পান চিবুচ্ছে আর যীনাতের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। এবার যীনাত শেষ!
– কি ছোকড়ি তুই আর দাদার ঘরের সামনে কিয়ারোস? তোর মতলব তো আমার ভালো ঠেকতাসে না।
– ঠাম্মি আমি আসলে…
– রাখ তোর তোতলাইন্না কথা। কিল্লাই হ্যানে আইসোস হেইডা ঠিক কইরা কো নইলে তোরে ডবাতে নিয়া চুবামু।
– আমি দাদুকে খুঁজতে আসছি।(এক নিশ্বাসে বলে ফেলে)
– এএএএএএহ দরদ উতলায় পড়ে রে! তোর দাদু কি তোর ল্যাইগা বইয়া থাকবো? এহন ক দাদারে ক্যান বিসরাস?
– এমনি।
– অ এমনি কইলে সব অইবো না। বাড়িত জায়গা দিসি বইল্লা এই না যে কাউয়ার মতো সারাদিন ঘুরঘুর করবি। এই বাইত থাকতে হইলে কাম কইরা খাওন লাগবো।
– কি করতে ঠাম্মি?
– হো এহন আয়সোস তুই লাইনে। হুন পুরা বাড়ি ধোয়া মুছা করবি নইলে দুপুরকার খাওন খাইতে পারবি না।
যীনাত কোনোরকম দ্বিমত না জানিয়ে হ্যাঁ বলে। কমিলা দেবীর কথার নড়চড় হলে খবর আছে সেটা যীনাত বেশ ভালো জানে। পাশ থেকে মিনি বলে,”ঠাকুমা আই যাই দিদিমনিরে দিয়া কাম কেন করাইবেন হেতি তো আমাগো অতিথি।”
– এএএএএহ অতিথি! ঘোড়ার ল্যাজের অতিথি। তুই যা নইলে বাশি খাওন পাক্কা ৭দিন খাইবি।
মিনি একটা ঢোক গিলে আর কিছু বলতে পারে না। অসহায় দৃষ্টিতে যীনাতের দিকে তাকাতেই যীনাত আশ্বাস দেয় সে পারবে। যীনাতকে এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কমলা দেবী চিল্লিয়ে বলে,”এই ছ্যামড়ী কাম কর যাইয়া হেনে খাম্বার মতো দাড়াইয়া আছোস কি আমার রূপ দেখতে?”
যীনাত কোনো কথা না বাড়িয়ে কাজে লেগে পড়ে। এভাবে দুপুর ২টা বেজে যায়। তবুও যীনাত শেষ করতে পারেনি। এতো বড় বাড়ি তার কি এতো সাধ্য আছে যে পুরো বাড়ি একা মোছামুছি করার? অনেক সার্ভেন্ট রা সাহায্য করতে চাইলেও পারে না কারণ কমলা দেবীর কড়া হুকুম যীনাতকে সাহায্য করা যাবে না। যীনাতের জান যায় যায় অবস্থা তবুও ধৈর্য্য ধরে করছে। কমলা দেবীর জন্য যীনাত নামাজটাও পড়তে পারে না। কারণ এই বাড়ির সবাই মুসলিম জানলেও কমলা দেবী জানে না। সে জানলে বাড়িতে আগুন লাগাতেও দ্বিধাবোধ করবে না তাই কেউ কিছু বলেনি। যীনাতের যেনো সবকিছু অন্ধকার লাগছে তবুও কোনোরকম অভিযোগ করলো না।
কমলা দেবী পায়ের উপর পা তুলে চা খাচ্ছে আর যীনাত ফ্লোর মোছায় ব্যস্ত এমন সময়ই বাসায় দেবনাথ দেব আর জাইফ বাসায় প্রবেশ করলো। তাদের দুইজন কে দেখে কমলা দেবী একপ্রকার লাফ দিয়ে উঠতে নেয় ওমনি গরম চা তার হাতে গিয়ে পড়ে আর সে “ঠাকুর গোওওওও” বলে চেঁচিয়ে উঠে। জাইফ দৌড়ে আসে কমলা দেবীর কাছে এবং যীনাতকে কাজ করতে দেখে তার মাথায় আগুন ধরে গেলো সাথে দেবনাথ দেবেরও। দুইজনই বেশ ভালো করে জানে কমলা দেবী ছাড়া আর কারো সাহস নেই এভাবে যীনাতকে দিয়ে কাজ করানোর। দেবনাথ দেব একপ্রকার হুংকার ছেড়ে বলে,”কমলা!! তোর সাহস কি করে হয় মেয়েটাকে দিয়ে কাজ করানোর!!”
– দাদু সেসব পরে দেখা যাবে আগে তোমার কমলা ফুলটুশির ব্যবস্থা করো। অনেক টুকু পুড়ে গেছে।(জাইফ)
যীনাত চটজলদি রান্নাঘরে গেলো আর একটা বরফের ব্যাগ নিয়ে কমলা দেবীর কাছে আসে। কমলা দেবীর হাত ধরতেই কমলা দেবী চিল্লিয়ে বলে,”ওই ছ্যাড়ি তোর ওই অপবিত্র হাত দিয়ে আরে ছুবি না। নইলে…”
বলেই যেই জাইফের দিকে তাকালো ওমনি সে ভয়ে চুপসে গেলো। এই বাড়িতে কমলা দেবী একমাত্র জাইফকেই ভয় পায় কারণ জাইফ তার চেয়েও হাজারগুণ ত্যাজি এবং বদমেজাজি। যতোই শান্তশিষ্ট থাকুক না কেন একবার রেগে গেলে আর রক্ষে নেই। আপাতত জাইফের চোখের রঙ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে তাই কমলা চাইলেও কিছুই বলতে পারছে না। যীনাত কোনোদিকে খেয়াল না করে চুপচাপ কমলা দেবীর হাতে বরফ ডলতে ব্যস্ত। এর মাঝে মিনি কমলা দেবীর কুকীর্তি সব বলে দিয়েছে জাইফ আর দেবনাথ দেবকে। দুজনে এসব শুনে আরও রেগে গেলো। মিনি যেনো আবার শান্তি পেলো সবটা তাদের বলে। মিনিকে যে আপু বলেছে বোন ধরে নিয়েছে তার প্রতি কি করে মিনি অন্যায় অবিচার সহ্য করবে? কখনোই করবে না।
যীনাত খুবই যত্ন সহকারে বরফ ডলে দেয় এতে করে কমলা দেবীর জ্বালাটা অনেকাংশই কমে গেলো তবুও কোনোরকম কথা বললো না এবং যীনাতের প্রশংসাও না। তার মনে যে যীনাতের জন্য আরও হাজারটা ক্ষোভ জম্মে গেছে কারণ যীনাতের জন্যই আজ তার হাত পুড়েছে এবং জাইফের চোখে খারাপ হয়েছে৷ এটা সে কিছুতেই মেনে নিবে না কিছুতেই না! যীনাত ডলতে ডলতে বলে,”এখন কেমন লাগছে ঠাম্মি?”
কমলা দেবী জাইফের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,”ভালো!”
কমলা দেবীর ভালো বলতে দেরি কিন্তু জাইফের কড়া কথা বলতে দেরি নেই। জাইফ চোখদু’টো রক্তবর্ণ করে বলে,”যীনাত আপনি ঘরে যান।”
– কিন্তু আমার কাজ….
– নো মোর এক্সকিউজ! আপনাকে রুমে যেতে বলেছি যাবেন এক্সট্রা কথা আমার পছন্দ না।
জাইফের কঠিন সুর শুনে যীনাত একপ্রকার বাধ্য হয়েই উপরে চলে গেলো। এদিকে কমলা দেবী ভয়ে চুপ করে আছে আর বারবার ঢোক গিলছে। জাইফ প্রচন্ড শান্ত সুরে বলে,”তা কমলা রানী তুমিই কি ওরে এই বাড়িতে জায়গা দিয়েছো? এই বাড়ি কি তোমার নাকি তোমার শশুড়ের যে তোমার নামে দলিল করে গেছে?”
জাইফের শান্ত সরের কথাগুলো যেনো কমলা দেবীর গা জ্বালিয়ে ছাড়লো। সে একপ্রাণ রেগে বলে,”এইডি তুই কি কস? আই আর ভাইয়ের বাইত থাহি তবুও তোরা আরে খোডা দিয়া কথা কস?”
– তোমার কাছে খোটা মনে হলে খোটাই বুঝে নাও। তোমার সাহস কি করে হয় ওই মেয়েটাকে দিয়ে এতো কাজ করানোর? ওকে কি তুমি কামাই করে খাওয়াচ্ছো যে হুকুমগিরি বসাইসো বাড়িতে?
– আই কামাই করি না কিন্তু তোরা তো করোস! তোগো কষ্টের পয়সা দিয়া ওই মাইয়া পায়ের উপ্রে পা তুইল্লা বইয়া খাইবো ক্যান?
– আর এই টাকা দিয়ে তুমিও তো বসে বসে খাচ্ছো তুমি কি এমন কাজ করো এই বাড়িতে?
– মানেহ!! এই কথা তুই কইতে পারলি? ও ঠাকুর গো কি দিনকাল দিলা গো ভাইয়ের বাড়িতে থাকতে গেলেও এমন খোডা হুনতে হয়।(ন্যাকা সুরে)
– ওই একদম ন্যাকামি করবা না নিজেকে এতোটাও চালাক ভাবিও না। তুমি যেমন বসে বসে খাবা ওই মেয়েটাও বসে বসেই খাবে। আমাদের এতো টাকার অভাব পড়েনি যে একজন কে বসিয়ে খাওয়াতে পারবো না আর তুমি তো একজন বাচ্চা হাতির সমান! তুমি একাই ৫জনের ঘাড়ে চেপে খাও।
– এই তুই কি কইলি আই হাতি!! এত্তো বড় কথা তুই কইতে পারলি?? ওই দাদা দেখ তোর নাতি আমারে এইডি কি কয় তুই এরে কিছু কো!!
– আমি আর কি বলবো কমলা তুমি নিজে যা করেছো আমার তোমার দিকে তাকাতেই অসহ্য লাগছে! একটা এতিম মেয়ের সাথে কিভাবে এমন আচরণ করতে পারলা তুমি হ্যাঁ?
– আরে তোরা যারে নিয়া এতো দৌড়াইতাসোস দেখ গা এর জম্মের ঠিক আছে কিনা তারপর আরে কইতে আইবি সবগুলা নিম্ন জাতের খারাপ তোরা সব!!
এবার জাইফের রাগ চরম মাত্রই চলে গেলো। আজ যদি কমলা দেবী জাইফের গুরুজন না হতো তাহলে জাইফ যে তারে কি করতো সেটা জাইফ নিজেও ধারণা করতে পারছে না। চোখ বন্ধ করে এবং হাত দু’টো মুঠিবদ্ধ করে জাইফ রাগ কমানোর বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারপর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে একয়াতা শয়তানি হাসি দিয়ে কমলা দেবীকে বলে,”তাহলে তোমার সখের জামাই তোমারে ঠ্যাঙের নিচে কেন রাখতো কমলা?”
কমলা দেবী আরও রেগে বলে,”ওই চুপ কর কি কস তুই এইডি?”
– উহু আমি চুপ করবো না! আচ্ছা কমলা রানী তোমার ওইদিনের কথা মনে আছে?
– কোন্ডা?
জাইফ হাত দিয়ে কিছু ইশারা করতেই কমলা দেবী সেইরকম ঘাবড়ে গেলো এবং প্রচন্ড তৃষ্ণায় বলে উঠলো,”মিমিনি আরে পানি খাওয়া তো!”
——————————–
চলবে!!!
(গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।)