ওয়াদা ২৭
পুরো রাস্তা এইসব আবল তাবল ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ির সামনে এসে গেছি বুঝতেই পারিনি।
-নামো(মেঘের কথায় হুশ ফিরলো)
-হুম। নামছি।
গাড়ি থেকে নেমে সোজা মেঘদের বাসায় চলে এলাম।
-কি রে এতো দেরি হলো কেন তোর। কতবার ফোন করেছি ধোরছিলিনা কেন? আমার কত টেনশন হচ্ছিলো জানিস।(মা)
-মা আমি আসলে,,,,,,
-মা ও আমার সাথেই ছিলো। আমরা একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম।(মেঘ)
-কিন্তু নাশুতো বলেছিলো ও ওর বান্ধবির বাসায় যাচ্ছে।
-আসলে ও তোমায় বলতে লজ্জা পাচ্ছিলো তাই মিথ্যে বলেছে।(মেঘ)
-তোরা দুজন ঘুরতে যাবি এটা বলতে আবার লজ্জা কিসের পাগলি। যা ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।
-না মা। আমরা বাইরে থেকে খেয়েই এসেছি।(মেঘ)
কি মিথ্যুক রে বাবা। আমরা কখন খেয়ে আসলাম।
-ও আচ্ছা ভালো করেছিস। কাল থেকে মেয়েটা কেমন মন মরা হয়ে আছে। এমন মন মরা হয়ে থাকলে ভালো লাগে। মাঝে মাঝে ওকে একটু এমন বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাস তাহলে ভালো লাগবে।
-হুম যাবো। নাশু রুমে চলোতো কাজ আছে।(মেঘ)
-হুম চলুন।
উনি রুমে চলে গেলেন আর ওনার পিছু পিছু আমিও গেলাম।
-থ্যাংকস।(আমি)
-কেন?(মেঘ)
-মাকে মিথ্যে বলে আমায় বাচানোর জন্য।
কিন্তু খাওয়ার কথা কেন মিথ্যে বললেন? মাতো জানে আমরা খেয়ে এসেছি কিন্তু আমরাতো আসলে খেয়ে আসিনি। এবারতো আর আমি মাকে গিয়ে বলতে পারবো না আমার খিদে পেয়েছে। আপনিতো জানেন আমি না খেয়ে থাকতে পারি না।
-মাকে মিথ্যে কথা আমি আমার প্রয়োজন এ বলেছি তোমায় বাচানোর জন্য নয়।
-মানে?
-বান্ধবিদের বাড়ি থেকে আসতে এতো দেরি হলো কেন এটা নিয়ে মা তোমায় অনেক প্রশ্ন করতো আর তোমায় অনেক দেরি করে ছাড়তো তাই।
-আমায় দেরি করে ছাড়লে আপনার কি?
-আমারইতো সব।(বলতে বলতে দরজা লাগিয়ে দিলো)
-আপনার সব মানে?
-আমার সব মানে আমার সব।(বলে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো)
-আপনি আমার দিকে এইভাবে এগিয়ে আসছেন কেন।(আমি পেছতে লাগলাম)
-তুমি বুঝতে পারছো না আমি কেন তোমার দিকে এগিয়ে আসছি।(ওনার চোখ মুখ দেখে অন্য রকম লাগছে)
-কেন?(কিছুটা ভয় পেয়ে)
-তুমি আমার বিয়ে করা বউ। তোমার উপর আমার অধিকার আছে।
-কিসব বলছেন আপনি? আর আমার দিকে এগিয়ে আসছেন কেন?(বলতে বলতে দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খেলাম) আর সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। উনি ওনার দুই হাত দেওয়ালে রেখে আমার অনেক কাছে চলে এলেন।
-দেখুন আপনি কিন্তু আমার সাথে এমনটা করতে পারেন না।(কাঁদতে কাঁদতে)
-বললাম না তুমি আমার বিয়ে করা বউ আর তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। তোমার সাথে আমি যা ইচ্ছা করতে পারি।(বলে আমার খুব কাছে এলো)। ও আমার হাত দুটো দেওয়ালের সাথে ঠেসে ধরলো। আমি ওর গরম নিশ্বাস অনুভব করতে পারছি। আমার পুরো শরীর শিহরিত হচ্ছে। আমি চোখ খুলে দেখি মেঘের ঠোট দুটো একদম আমার ঠোটের কাছে। আমি বুঝতে পারছি কি হতে চলেছে। কিন্তু আমি মেঘকে আটকাতে পারছি না। কোন এক অদৃশ্য শক্তি আমায় আটকিয়ে দিচ্ছে। আমার চোখ দুটো আবার বন্ধ হয়ে গেলো। আমার হৃৎস্পন্দন খুব দ্রুত চলছে।
-তোমার সাহস হয় কি করে আমার পারমিশন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়ার।(ধমক দিয়ে দাতে দাত চেপে আমার হাতটা খুব শক্ত করে চেপে ধরে কথাটা বললো।) সাথে সাথে আমি চোখ খুলে দেখলাম মেঘ আমার দিকে অনেক রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। যেন এখনি আমায় খেয়ে ফেলবে। আমি ভয়ে ভয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।
-আমি তোমার কাছে কিছু জানতে চেয়েছি?
এবার আমারও অনেকটা রাগ হলো।
-আমি কোথায় যাবো কি যাবোনা সেটা কি আপনায় কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি?
-আমি আগেও বলেছি আমার মুখে মুখে তর্ক করবে না।(বলে আমার হাতে খুব জোড়ে চাপ দিলো) এবার আমার খুব ব্যাথা লাগছে। ব্যাথায় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরলো। ও সেটা দেখে আমার হাত ছেড়ে দিলো। আমি হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা হাত লাল হয়ে আছে আর অন্য হাতে ঘড়ি থাকায় কালসিটে হয়ে গেছে। আমি ওখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাদছি। ও রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর আমি ওখানেই বসে পরলাম। বসে বসে কাদছি। একটু পর মেঘ আবার রুমে এলো হাতে কিছু একটা নিয়ে। আমার সামনে বসে বললো
-হাত দাও।
-(আমি কেদেই যাচ্ছি)
-হাতটা দিতে বলেছি আমি।(ধমক দিয়ে)
-কেনো আরও কষ্ট দিতে চান আমার। এতো কষ্ট দিয়েও আপনার স্বাদ মেটে নি বুঝি?(রাগি গলায় বললাম)
-মেহজাবিন নাশরাহ একবার কোন কথা বললে তোমার মাথায় যায় না বুঝি? আমি যখন তোমায় কিছু জিজ্ঞাসা করবো তখন শুধু উত্তর টুকুই দিবে। বাড়তি কোনো কথা বলবে না। আমি বাড়তি কথা বলা একদমি পছন্দ করি না।
-আপনার পছন্দ অপছন্দ দেখার দ্বায়িত্ব আমার না।
-আবার,,,,,?(খুব রাগি ভাবে তাকালো। আমি ভয় পেয়ে চুপ করে গেলাম)
-হাতটা দাও।
আমি আমার হাতটা খুব শুক্ত করে মুট করে রেখেছি।
-হাতটা দিতে বলেছি কিন্তু।(অনেক রেগে বললো)
আমি ভয়ে হাতটা সামনের দিকে এগিয়ে দিলাম। ও ওর হাতে মলমের কৌটা থেকে মলম বের করে আমার হাতে লাগিয়ে দিলো। হাতে দেওয়ার সাথে সাথে আমার হাতটা জ্বলে উঠলো আর আমি এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে নিয়ে ফু দিতে লাগলাম। খুব জ্বালা করছে। আমার চোখ দিয়ে পানি পরছে। ও আবার জোড় করে আমার হাতটা ধরলো তারপর আলতো করে মলমটা ফু দিয়ে দিয়ে লাগিয়ে দিতে লাগলো। এখন আর আগের মতো জ্বালা করছে না। ও খুব যন্ত সহকারে আমার হাতে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। ওর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমার হাতে ব্যাথা পাওয়াতে ও খুব কষ্ট পাচ্ছে। মেঘকে মাঝে মাঝে আমি বুঝতেই পারিনা। না মাঝে মাঝে নয় আমিতো আজ পর্যন্ত ওকে একটুও বুঝতে পারিনি। ও কখন কি করে, কখন কি বলে আমি কিছুই বুঝতে পারি না। একটু আগেই নিজেই ব্যাথা দিলো আর এখন নিজেই মলম লাগিয়ে দিচ্ছে তাও আবার ধমক দিয়ে। ও এমন অদ্ভুদ ব্যবহার করে কেন বুঝতে পারি না। জানি না ওর মাথায় সব সময় কি চলে।
-আমাকে দেখা শেষ হলে তুমি এবার উঠতে পারো।(মেঘের কথায় হুশ ফিরলো)
-কিহ্?
-হুম। আর একটা কথা আজকের পর থেকে আমার পারমিশন ছাড়া এই বাড়ির বাইরে যাবে না।
-কিন্তু,,,,
-আমি আর কোনো কিন্তু শুনতে চাইনা।
-আমার খুব খিদে পেয়েছে।
-আজ রাতে তুমি খাবার পাবে না। এটা তোমার শাস্তি।
-শাস্তি মানে? আমি আবার কি করলাম?
-ওই যে আমায় না বলে বাইরে গেছো তার শাস্তি।
-দেখুন এবার কিন্তু আপনি বাড়াবাড়ি করছেন।
-আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়ো।(বলেই উনে শুয়ে পরলেন)
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। এদিকে খিদেয় আমার পেটে ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করছে। কিছু না বলে আমিও শুয়ে পরলাম। খিদের জন্য সারা রাত ঠিক মতো ঘুমাতে পারি নি। খুব ভোরেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। চোখ খুলে দেখি মেঘের একটা হাত আমার পেটের উপর আর ও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ভালো করে তাকিয়ে দেখি ও ওর জায়গাতেই আছে। কিন্তু আমি ওর দিকে অনেক সরে এসেছি। তাই আর কিছু বললাম না কারণ বললে উল্টা আমাকেই বকা শুনতে হবে ওর পাশে আসার জন্য। আস্তে আস্তে আমার পেটের উপর থেকে ওর হাতটা সরিয়ে নিলাম। আযান দিচ্ছে তাই উঠে পরলাম। আযানের শব্দ শুনে মেঘও উঠে পরলো। ও উঠে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে মসজিদে চলে গেলো নামাজ পড়তে। তারপর আমিও ওযু করে নামাজ পড়ে নিলাম। নামাজ শেষে মায়ের কাছে গিয়ে কোরান পড়লাম আর শুনলাম। কোরান তেলওয়াত শেষে মায়ের সাথে রান্না ঘরে গেলাম তাকে সাহায্য করতে। আর তাছাড়া আমারও খুদায় অবস্হা খারাপ। যত তাড়াতাড়ি রান্না শেষ হবে তত তাড়াতাড়ি খেতে পারবো।
এভাবেই কয়েকটা দিন কেটে গেলো। কিন্তু শুভর কোনো খোজ পেলাম না। কেউ বলতে পারলো না শুভ কোথায়। জানি না শুভ কোথায় আছে কেমন আছে কি করছে। ওর সাথে কি আমার এজীবনে দেখা হবে না। আমি কি কোনো দিনও শুভর দেখা পাবো না। আমি কি ওর কন্ঠ শুনতে পারবো না কোনোদিন। প্লিজ শুভ একবার অন্তত আমার সামনে আসো। আমি যে তোমায় না দেখে আর থাকতে পারছি না। আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই কয়দিনে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া না করায় কিছুটা দুর্বল হয়ে পরেছি। শুভর টেনশনে গলা দিয়ে খাবার নামতেই চাইনা। এতো দিন হয়ে গেলো অথচ ওর একটা খবরও পেলাম না। একটা মানুষ কেমন করে এমন উধাও হয়ে যায়। আল্লাহ তুমি দেখ শুভর যেন কোন বিপদ না হয়। ও যেন সুস্হ থাকে। তুমি ওর সাথে একবার আমার দেখা করিয়ে দাও। প্লিজ শুধু মাত্র একবার ওকে দেখতে চাই। দেখতে চাই ও ভালো আছে কিনা। সুস্হ আছে কিনা। এসব ভাবছি তখনই মেঘ রুমে এসে বললো
-তোমার সব ভাবনা চিন্তা শেষ করে দশ মিনিটের মধ্য রেডি হয়ে নিচে এসো।
-কেন?
-তুমি হয়তো জানো না ভার্সিটিতে আজ থেকে তোমাদের ক্লাস শুরু হবে।
-ওহ্। আসলে আমি জানি না মানে খোজ নেওয়া হয়নি।
-হুম তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে আসো।
-আপনি যান আমি আসছি।
উনি চলে গেলেন। আমিও তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে মাকে বলে নিচে গেলাম। উনি গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছেন। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। উনি গাড়ি স্ট্রাট দিয়ে চালাতে শুরু করলেন। আমি বাইরের দিকে আনমনে তাকিয়ে শুভর কথা ভাবছি। কেন জানিনা আজ সকাল থেকেই শুভর কথা খুব বেশি মনে পরছে। মনের ভেতর কেমন একটা ভয় ভয় কাজ করছে। মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হতে চলেছে। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমরা ভার্সিটি যাওয়ার রাস্তা দিয়ে নয় তার বিপরীত রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। তারমানে মেঘ আমায় ভার্সিটি না অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ও আমায়। আমি ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবো তখনই ও বললো।
-একটু পরেই বুঝতে পারবে আমরা কোথায় যাচ্ছি। তার আগে কোনো প্রশ্ন করবে না।(মেঘ)
এই কয়দিনে মেঘের এমন অদ্ভুদ ব্যাপারগুলো আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর ওর এমন কাজে অবাক হই না। আর তাছাড়া ওকে জিজ্ঞাসা করে কোনো লাভও নেই কারণ এখন ও আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিবে না।
-তোমার সব প্রশ্নের উত্তর তুমি একটু পর ওখানে গেলেই পাবে। নিজের মনকে শক্ত করো কারণ তুমি একটু পর এমন সত্যির মুখোমুখি হতে চলেছো যেটা শোনার পর হয়তো তোমার পার নিচ থেকে মাটিটায় সরে যাবে।
আমি ওর কথা কিচ্ছু বুজলাম না। কি বোঝাতে চাইছে ও কোন সত্যির কথা বলছে। আবার কোন সর্বনাশ হতে চলেছে আমার জীবনে। হঠাৎ করে গাড়িটা একটা জায়গায় থেমে গেলো। জায়গাটা দেখে সত্যি আমার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। ও এখানে কেন গাড়ি থামালো।
চলবে,,,
#মেহজাবিন_নাশরাহ