ওয়াদা ১০
তন্নি কোচিং এ ভর্তি হওয়ার পর থেকেই দেখা যেতো ও প্রায় সব সময় শুভর দিকে তাকিয়ে থাকতো, ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করতো। শুভ একা কোথাও দাড়িয়ে থাকলে তন্নি সবার মাঝখান থেকে উঠে শুভর কাছে চলে যেতো। আর শুভ ওকে এড়িয়ে চলতো আর মাঝে মাঝে ওকে বকাবকি করতো। সবাই বুঝতে পারছিলো ওদের মধ্য কোনো সমস্য হচ্ছে। নাশু শুভর কাছে জানতে চাইলে শুভ নাশুকে বলে যে তন্নির হাবভাব ওর ভালো লাগছে না তন্নি হয়তো ওকে পছন্দ করে। নাশু শুভর কথা বিশ্বাস করে না কারণ তন্নি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড আর ও জানে যে নাশু শুভকে ভালোবাসে। তাই তন্নি এমন কিছু করতেই পারে না। আর নাশু শুভকে বোঝায় যে ওর বুঝতে কোথাও ভুল হচ্ছে। কিন্তু তন্নি নাশুর কাছে বার বার শুভর ব্যাপারে জানতে চায়তো। ওরা দুজন যখন একসাথে থাকতো তখন তন্নি শুধু শুভর কথায় বলতো যেটা নাশুকে অন্য কিছু ভাবাতে বাধ্য করে। একদিন শুভ নাশুকে তন্নির দেওয়া কিছু মেসেজ দেখায়। মেসেজগুলো এমন ছিলো
-শুভ আমি তোমায় খুব ভালোবাসি প্লিজ আমায় ফিরিয়ে দিও না। আমি তোমায় ছাড়া বাচতে পারবো না।
-শুভ তুমি আমায় এইভাবে এড়িয়ে যাচ্ছো কেন আমার তোমার সাথে অনেক কথা আছে। কিন্তু শেষ মেসেজ টা পড়ে নাশু খুব কষ্ট পায়। মেসেজটা ছিলো,,,
-শুভ নাশু অনেক সুন্দরী তাই তুমি ওর পিছে ঘুরছো আর আমি ওর মতো ওত সুন্দরী নয় বলে আমায় এইভাবে অপমান করে ফিরিয়ে দিলে। আমি মন থেকে এটা মেনে নিয়েছি যে আমি তোমায় কখনো পাবো না কিন্তু একটা কথা মনে রেখ নাশুর জীবন থেকে আমি তোমাকে সরাবই। তার জন্য আমায় যা করতে হয় আমি করবো। এই মেসেজটা পড়ে নাশু খুব কাদে আর ঠিক তার একটু পরেই তন্নি আসে নাশুর কাছে আর ওকে শুভর ব্যাপারে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলে। শুভ নাকি নেশা করে, ওর নাকি অনেক মেয়ের সাথে রিলেশন আছে, ও নাকি তন্নিকে ইউজ করেছে এমন অনেক কথাই বলে তাও আবার সবার সামনে যার ফলে নাশু রেগে গিয়ে ওর গালে একটা চড় মারে আর অনেক অপমান করে। বেস্ট ফ্রেন্ড এর কাছ থেকে এমন বিশ্বাসঘাতকতা ও মেনে নিতে পারছিলো না। ও ভাতেই পারছিলো না যে তন্নি ওর সাথে এমনটা করতে পারে। ওতো খুব ভালো করেই জানতো যে নাশু শুভকে কতটা ভালোবাসে তারপরও নাশু আর শুভর মাঝে আসতে চাইছে। শুভর সম্পর্কে এতো বাজে বাজে কথা বলে ওদের সম্পর্ক নষ্ট করে দিতে চেয়েছে। ওই ঘটনার পর নাশু দুই-তিন দিন কারোর সাথে কথা বলে নি এমনকি শুভর সাথেও না। ওই দুই দিন খুব কান্না করে ও। পরে ওর খারাপ লাগে তন্নির গায়ে হাত তোলার জন্য। তন্নি যায় করুক না কেন ওর তন্নিকে সবার সামনে চড় মারাটা উচিত হয় নি। ওর ঠান্ডা মাথায় তন্নির সাথে কথা বলা উচিত ছিলো। এইসব ভেবে ও মেঘদের বাসায় যায় তন্নির সাথে কথা বলতে। কিন্তু মেঘদের বাসায় তন্নিকে পায় না অনু কাকিমার কাছ থেকে জানতে পারে তন্নি নাকি দু-দিন আগে কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে। নাশু অনু কাকিমাকে তন্নির মায়ের কাছে কল দিয়ে জানতে বলে যে ও আবার কবে ফিরবে। কিন্তু তন্নির মা জানায় যে তন্নি গতকাল রাতে ঢাকায় চলে গেছে। আর একটা মেস এ উঠেছে। ফোন নাম্বার চাইলে বললো তন্নি নাকি মানা করেছে কাওকে ওর নাম্বার দিতে যদি তাও ওর মা কাওকে নাম্বার দেয় তাহলে ও আবার ওর ফোন নাম্বার চেন্জ করবে আর ওর পরিবারের কারোর সাথে আর যোগাযোগ রাখবে না। এই কথা শুনে নাশু খুব কান্নাকাটি করে কারণ ও জানে তন্নি ওর উপর রাগ করেই এইসব করছে। তন্নি হয়তো কখনো নাশুকে ক্ষমা করবে না। নাশু অনেক চেষ্টা করে তন্নির সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু পারে না। কিছুদিন চেষ্টা করার পর নাশুও অভিমান করে ওর খোজ নেওয়া বন্ধ করে দেয়। আর আজ দুই বছর পর হঠাৎ করে তন্নি আবার ফিরে এসেছে।
নাশু বাড়ি ফিরে ওর মাকে আজকে কি কি হয়েছে সব বলে। তন্নি ফিরে আসাতে ওর মাও খুব খুশি হয়েছে। নাশু ওর মাকে নিষেধ করে অনু কাকিমাকে বলতে কারণ কাল ওরা কাকিমাকে সারপ্রাইজ দিতে চায়।
-ঠিক আছে দিস সারপ্রাইজ। এখন যা চেন্জ করে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নে।(মা)
-না মা। আমি এখন আর কিছু খাবো না। আজ অনেক কিছু খেয়েছি।(আমি)
-আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নে।(মা)
-ওকে।
তারপর ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। আর সাথে সাথে ঘুম মামা এসে হাজির। সন্ধ্যায় কাদের চেঁচামিচিতে ঘুৃম ভেঙে গেলো। আর সাথে সাথে মাও আসলো। তার আমার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললো
-তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বাইরে আয়। সবাই এসে গেছে।(মা)
-কিন্তু মা। এখন আবার কি?
-তোর জন্মদিন উপলক্ষে বাড়িতে ছোট একটা অনুষ্ঠানের আয়জন করেছি।(মা)
-এসবের কি দরকার ছিলো মা?
-আরে তেমন কিছু না। শুধু আমাদের কিছু নিকট আত্বীয়দের দাওয়াত করেছি। তুই আর কোনো কথা বলিস না। যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।
বলেই চলে গলো। আর আমি প্যাকেট খুললাম। লাল রং এর জরজেট কাপড়ের উপর গোল্ডেন রং এর স্টন বসানো একটা লেহেঙ্গা। খুব সুন্দর লাগছে। মায়ের চয়েস আছে বলতে হবে। আমি ফ্রেশ হয়ে লেহেঙ্গাটা পরে নিলাম। অনেক ভারী লেহেঙ্গাটা সামলাবো কি করে আল্লাহই জানে। চোখে হালকা করে কাজল, ঠোটে গাড়ো করে লাল লিপিস্টিক আর বড় একটা কানের দুল পরলাম। চুল গুলো একটু উচু করে সুন্দর করে খোপা করলাম আর সামনের একটু বড় চুল গুলো বের করে দিলাম। আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলাম। হুম সকালের মতই খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। তারপর বাইরে গেলাম। আমি বাইরে যাওয়ার সাথে সাথে সবাই আমার দিকে তাকালো কিন্তু আমি তাকালাম অনু কাকিমার দিকে নাহ্ ঠিক অনু কাকিমার দিকে নয় অনু কাকিমার পিছনে যেই লোকটা আসছে তার দিকে। আমিতো ভাবতেই পারছি না লাটসাহেবটা আমার বার্থডে পার্টিতে এসেছে। ওনার মাথা ঠিক আছেতো। কাকিমার কাছে জিজ্ঞাসা করতে হবে। সবার সাথে কথা বলছিলাম আর কাকিমাকে দেখছিলাম কখন উনি একা হবে। কাকিমা যখনই একা হলো আমি ওনাকে একটা কোনায় নিয়ে গিয়ে দারালাম।
-কি রে। কি হয়েছে। আমায় এখানে টেনে আনলি কেন?(কাকিমা)
-তোমার সাথে আমার একটা কথা আছে।
-কি কথা তাড়াতাড়ি বল।
-বলছি তোমার ছেলের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
-তুই এই কথা বলার জন্য আমায় এখানে এনেছিস?
-উফ্ বলো না।
-কেন। ও আবার কি করেছে?
-কি করেনি সেটা বলো। সকালে আমার জন্য পায়েস রাধলো এখন আবার আমার বার্থডে পার্টিতে এলো। তুৃমিই বলো মাথা ঠিক থাকলে কি এগুলো করতো?
-তুই থামবি?
-যায় বলো কাকিমা। তোমার ছেলে মানে ওই লাটসাহেবের মাথাটা সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে গেছে।(বলে একটু জোড়ে জোড়ে হাসছিলাম)
-আমার মাথা একদমি ঠিক আছে মিস মেহজাবিন নাশরাহ।
(কথাটা শুনে আমার হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। কারন এটা মেঘের কন্ঠ। আমি পেছন দিকে ফিরে দেখলাম ও কেমন রাগী লুক নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি যে ওকে লাটসাহেব বলেছি এটা শোনেনি তো। শুনলে আমার আজ খবর আছে। আল্লাহ বাচাও আমায়)
-লাটসাহেব আপনি,,,,(হায় আল্লাহ এটা আমি কি করলাম। যার জন্য ভয় পাচ্ছিলাম সেটাই করলাম আমি)
-কি বললে?
-কই। কিছু না,,,তো। কিচ,,,,,ছু বলিনিতো।
-আমি স্পস্ট শুনলাম তুমি আমায় কিছু একটা বলেছো।
-বলেছিতো, বলেছি।
-সেটাই জানতে চায়ছি কি বলেছো?
-বলেছি যে,,,,। আজ আপনার দিক থেকেতো চোখই সরানো যাচ্ছে না। অনেক সুন্দর লাগছে আপনাকে। একদম ডানাকাটা পরী।(বলেই মুখে হাত দিলাম। কি বললাম আমি। এবার কি করবো আমি)
-কি বললে? আমি ডানাকাটা পরী?(বলে আমার দিকে একটু এগিয়ে আসলো)
-নাহ্ আপনাকে বলিনিতো। আমি ডানাকাটা পরী সেটাই বলছিলাম।(বলে আমি একটু পিছিয়ে গেলাম)
-আমি লাটসাহেব?(আবার একটু এগিয়ে আসলো)
-নাহ্। আমি লাটসাহেব।(কাপা কাপা কন্ঠে বললাম)
-কিহ্। তুমি লাটসাহেব? মানে তুমি কি ছেলে?(বলে আরও এগিয়ে আসলো)
-আরে না। আমিতো লাটসাহেবেরর বউ।(বলেই পিছনে সরে গেলাম আর দেয়ালের সাতে ধাক্কা খেলাম আর সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেললাম ভয়ে। না একটা নয় দুইটা ভয়ে। একা দেয়ালের সাথে ধাক্কা খাওয়ার কারণে পেয়েছি আর একটা পেয়েছি নিজেকে লাটসাহেবেরর বউ বলায়। লাটসাহেব এর বউ মানে আমি মেঘের বউ হয়ে গেলাম। ছিঃ ছিঃ এ আমি কি ভাবছি। কিন্তু এখন আমার কি হবে। এই রাক্ষসটা আমায় কুচি কুচি করে কেটে মসলা মাখিয়ে খাবে। ভয়ে আমার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে। আল্লাহ তুমি আমায় বাচাও এই রাক্ষসের হাত থেকে। আমি এতো তাড়াতাড়ি মরতে চায় না। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। অনেক সময় ধরে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছি কিন্তু লাটসাহেবেরর কোনো সাড়া শব্দ নেই। এটা কি ঝড় ওটার আগের পূর্বাভাস? কিন্তু লাটসাহেবটা করছে কি। একটা কাজ করে একবার দেখি কি করছে। না দুটো চোখ খোলা যাবে না একটা চোখ খুলবো যাতে অল্প দেখতে পায়।)
তারপর একটা চোখ খুললাম লাটসাহেবকে দেখার জন্য। কিন্তু আমি ভুল দেখছি নাকি ঠিক দেখছি বুঝতে পারছি না। তাই চোখটা বন্ধ করে ভালো করে চোখ ডোলে এবার দুটো চোখই খুললাম। নাহ্ আগের বার যা দেখেছি এবারও তাই দেখছি। হাতে একটা চিমটি কেটে দেখি এটা সত্যি না মিথ্যে। তারপর হাতে একটা চিমটা কাটলাম। আহ্ অনেক জোড়ে লাগলো। তারমানে আমি যা দেখছি তা সত্যি। লাটসাহেব ধুর মেঘ আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আর আমার চিমটি কাটার কারণে অনেক জোড়ে জোড়ে হাসছে। গত দুই বছরে আমি ওকে একবারও হাসতে দেখিনি। আমায় বকাবকি করা ছাড়া ভালোভাবে কথাই বলেনি আর আজ ও আমার জন্য হাসছে। এটাও সম্ভব। আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পরছে। নাহ্ এটা কোনো ভয় বা কষ্টের না এটা আনন্দের কান্না। আমি ওর দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছি আর ও হেসেই যাচ্ছে।
চলবে,,,
#মেহজাবিন_নাশরাহ