#ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি
#মারিয়া মীম ( ছদ্মনাম)
পর্ব -৪
.
সূর্য পূর্বাকাশে উদিত হওয়ার পূর্বেই জেগে উঠে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় কিছু পাখপাখালি। প্রতিটি পাখির আলাদা সূরের কলকাকলীতে মেতে উঠে পুরো ধরনী। কখনো তা মিষ্টি মধুর সূর হয়ে মানব মনে একচিলতে প্রশান্তির ছোয়া ফেলে যায়। তো কখনো তা বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়ায়। তবে ভোরের পাখির মিষ্টি কলধ্বনিতে ঘুম থেকে জাগ্রত হলাম আমি। দুবার চোখ কচলে ভালো করে তাকালাম। শরীরের মাঝে চিটচিটে একটা অনূভুতি হলো। জ্বর সেরে যাওয়ায় ঘাম ছেড়েছিল বোধহয়। তার দরুন এ অবস্থা। এর মাঝে আজকেও নিজেকে প্রিয়কের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ পেলাম। আমি নড়েচড়ে উঠতেই তারও ঘুম ভেঙে গেল। খুব দ্রুত উঠে আমার কপালে হাত ছুঁইয়ে বলল,
“কেমন লাগছে এখন? দেখি জ্বর আছে কি না? যাক জ্বরটা নেই এখন।”
“ভালো।”
“খারাপ লাগলে আজ কলেজে যাওয়ার দরকার নেই। বাসায় বসে রেষ্ট নে।”
“আমি ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।”
বলেই বিছানা থেকে নেমে আলমারী থেকে একসেট থ্রি-পিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। একবারে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখি প্রিয়ক টেবিলের উপর গরম দুধ রাখছে। এলোমেলো ঘরটাও পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখেছে। ভাইয়া বরাবরই এমন। সবসময় সবকিছু পরিপাটি করে রাখাই পছন্দ করে। অগোছালো থাকলে তা নিজেই গুছিয়ে রাখে। আর আমি বরাবরই তার উল্টা। গুছানো জিনিসকেও অগুছালো করে ফেলি। প্রিয়ক আমাকে দেখে বলল,
“দুধ টা খেয়ে নে। উইকনেস থাকলে তা কেটে যাবে। আর একবারে রেডি হয়ে নিচে আছিস। আমি ড্রপ করে দেবো। ”
“আমি একাই যেতে পারব। ”
“জানি। দুবছর তো গেলিই। এবার না হয় আমিই দিয়ে আসলাম। ”
বলে বেরিয়ে গেল। আমি একবারে রেডি হয়ে নিচে নামতেই দেখা পেলাম ফুফার। টেবিলে বসে আজকের পেপার পড়ছে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চায়ের কাপেও চুমুক বসাচ্ছে। আমাকে নামতে দেখে পেপারটা পাশে রেখে বলল,
“আরে আমার মামনিটা যে। এতো তাড়াতাড়ি উঠলি কেন বলতো।”
“কলেজে যাব। তার জন্য ফুফা। ”
“প্রিয়ক বলল জ্বর এসেছিল নাকি রাতে? তা এখন কেমন লাগছে, মামনি?”
“এখন ঠিক আছি৷ ”
“তাও। আজ না গেলেই পারতি। দুদিন হলো না বিয়ের। এখনি যাওয়ার দরকার ছিল না। ”
“না ফুফা। কতদিন হয়ে গিয়েছে যায় না। পরে পিছিয়ে যাবো আমি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। বাট না খেয়ে যেতে পারবি না।”
“না খেয়ে যেতে দিলে তো।”
মামনির কথায় আমি আর ফুফা পেছনে তাকালাম। মামনি তার হাতের নাস্তার প্লেট ডাইনিং টেবিলের উপর রাখতে রাখতেই বলল,
“হ্যারে প্রিয়তা। হুট করে জ্বর বাঁধালি কি করে বলতো। প্রিয়ক রাতে যে পরিমান টেনশন করছিল তা বলার বাহিরে। বারবার বলছে ওর জন্য নাকি তোর জ্বর। তুই বলতো এমনটা হয়? কারো জন্য কেউ জ্বরে পড়ে? সে যায় হোক এখন আয় খেয়ে নে। ”
প্রিয়কের প্রতিটা কাজ আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে। মানুষটা আজও আমার কষ্ট সহ্য করতে পারে না। তাহলে কেন ভীনদেশে পাড়ি দেওয়ার আগে আমাকে কলঙ্কিত করে গেল? কেন কষ্টের গভীর সমুদ্রে আমাকে ফেলে গেল? সবকিছুতে শুধুই প্রশ্ন! বাট উত্তর কোথায়? প্রিয়ক এমন বিহেভ করে যেন সে কিছুই জানে না। আসলেই কি তাহলে সেদিন ভাইয়া ছিল না? না আর কিছু ভাবতে পারছি না। মাথাটা ভারভার লাগতে শুরু করে৷ এলোমেলো লাগে নিজেকে। একপা সামনে বাড়াতেই হেলে পড়ি আমি। তবে পড়ার আগেই দুহাত শক্ত করে আমাকে ধরে ফেলে। নিজেকে সামলে তার দিকে তাকাতেই দেখি সে চিম্তিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“ঠিক আছিস? সাবধানে যাবি তো। এখনি তো পড়ে যাচ্ছিলি। ”
ফুফা আর মামনির সামনে এমন করায় অসস্থিতে পড়ি আমি্। তা বুঝতে পেরে আমাকে ছেড়ে দেয়। তবে তা পুরোপুরি না। হাত ধরে নিয়ে চেয়ারে বসায় আমাকে। নিজেও আমার পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। আজ পুনমের স্কুল বন্ধ থাকায় এখনও ঘুমাচ্ছে বার্ডটা। নয়তো তার কিচির-মিচির আওয়াজে মেতে থাকতো পুরো বাড়িটা। শেষ হতেই প্রিয়ক মামনিদের কাছে বিদায় নিয়ে বের হয়ে যায়। আসার আগে আমাকে উদ্দেশ্য করে “বাইরে আছি আমি। ” বলতে ভুলে না। আমিও নাস্তা শেষ করে বের হয়ে আসি। মামনি আর ফুফার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে আসতেই দেখলাম প্রিয়ক গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কিছু দেখছে। আমি নজরে আসতেই ফোন রেখে গাড়ির অপর দিকের ডোর খুলে দেয়৷ জানি এখন কিছু বললেও কাজ হবে না। তাই চুপচাপ উঠে বসলাম গাড়িতে। প্রিয়ক ও গাড়িতে উঠে আমার সিট বেল্ট লাগিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। ১৫মিনিট পরই গন্তব্যে পৌছে যায় আমরা৷ গাড়ি বের হবো তখন প্রিয়ক বলল,
“আবির কে? প্রিয়তা।”
তার কথায় থমকে গেলাম। আবিরের কথা প্রিয়ক জানলো কি করে? আজ নিজের চেয়েও বেশি খারাপ ওর জন্য লাগছে। মানুষটা পাগলের মত ভালোবাসে আমাকে। প্রিয়কের দিকে তাকাতেই দেখলাম প্রশ্ন মাখা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি কিছু না বলেই বের হতে নেই। তখন প্রিয়ক আমার হাত ধরে। কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল,
“কে এই ছেলে? কি সম্পর্ক তোর সাথে? কেন ফোন দিয়েছিলিস তুই? ”
“ভালোবাসে ও আমাকে। ”
“আর তুই?”
করুণ শোনালো তার কন্ঠস্বর। তবে এ প্রশ্নে কিছু সময় চুপ থেকে দৃঢ় গলায় বললাম,
” আমিও ভালোবাসি ওকে। শুনেছে তুমি, ভালোবাসি আবিরকে।”
দৃঢ় গলায় বলে তার দিকে তাকালাম। তার চোখে রাগের বদলে সেখানে আকুলতা দেখতে পেলাম। নিরবে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে স্টিয়ারিং এ হাত রাখে সে। বুঝলাম না কোনোরুপ প্রতিক্রিয়া কেন করল না।
তবে খুব বেশি কিছু না ভেবেই নেমে চলে এলাম ক্যাম্পাসে।
ক্লাসে যেতে যেতে ভাবতে থাকি আবিরের কথা। কি জবাব দিবো আমি ওকে। আজ থেকে প্রায় ১বছর আগে পরিচয় হয়েছিল ওর সাথে। কলেজের কালচারাল প্রোগ্রামে খুব বড় বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিল আমাকে। তারপর টুকটাক মাঝে মাঝে দেখা হতো। সৌজন্যেতার খাতিরে দু একটা কথা বললেও তা ধীরে ধীরে রুপ নেই বন্ধুত্বতে। একসময় আবিরই প্রপোজ করে। তখন তাকে নিজের সবকিছু জানায়। সে কোনো রুপ আপত্তি না করেই বলেছিল,
“প্রিয়, তুমি যদি সত্যি সত্যি ও ধর্ষণের শিকার হতে, তবুও ভালোবাসতাম তোমায়। আর যা কিছু হয়ে যাক না কেন সারাজীবন ভালোবাসবো। ”
সেদিনের কথায় মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি। ধীরে ধীরে নিজেও দূর্বল হয়ে পড়ি ওর প্রতি। অথচ আজ! সবটা জানার পর কি হবে ভাবতেই বুক কেঁপে উঠছে আমার।
ক্লাস শেষ করে বের হতেই দেখলাম আবির আমার দিকে দৌড়ে আসছে। আমার সামনে এসে আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে থাকে কোনো এক জায়গায়। জায়গাটা আমার পরিচিত। প্রায় প্রায় এখানে এসে আমি আর আবির বসে থাকি। এখানে এসেই আমার হাত ছেড়ে দিয়ে আমার গালে নিজের দুহাত রেখে কাঁপানো কন্ঠে বলল,
“প্রিয়তা এসব কি শুনছি আমি? যা শুনছি তা কি সত্যি? বললা প্লিজ। তুমি নাকি তোমার ওই ভাইকে বিয়ে করেছো? এসব মিথ্যা। তাই না বলো। বলনা সব মিথ্যা! যে অমানুষটা তোমার জীবন নষ্ট করলো তাকে তুমি কিছুতেই বিয়ে করতে পারো না। বলো না প্রিয়তা, বলো না। ”
আবিরের প্রতিটা প্রশ্ন আমাকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিচ্ছে। কি জবাব দিবো আমি? এই ভয়টাই যে পাচ্ছিলাম আমি। আবির যে আমাকে কতটা ভালোবাসে তা খুব ভালো করে জানি আমি। যেখানে কেউ আমাকে বিশ্বাস করেনি সেখানে ও আমার একবার বলাতেই সবকিছু বিশ্বাস করেছিল।
“এই প্রিয়তা, চুপ করে কেন আছো? বলোনা গো সব মিথ্যা? বলো না। ”
“আবির আমার কথা শুনো। শান্ত হও প্লিজ। ”
আবির দুহাতে আমাকে ধরে বলল,
“আগে বলো যা শুনেছি সব মিথ্যা। ”
“যা শুনেছো সব সত্যি আবির। ”
মাথা নিচু করে নিলাম আমি। তখনি আবির আমাকে ধাক্কা দিল। আমি কয়েক কদম দূরে চলে গেলাম। অবাক হয়ে তাকালাম আমি ওর দিকে। ও দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে রেখেছে। বুঝতে পারলাম নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্ঠা করছে। আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। মাথা থেকে হাত নামিয়ে ওকে বসতে বললাম। ওখানের ঘাসের উপরই বসল ও। আমি ও ওর পাশে বসলাম। ওর হাত ধরে বললাম,
“শান্ত হও প্লিজ। তুমি এমন করলে আমি কি করবো বলো? আমি ও তো ভেঙে পরবো নাকি। এমনিতেই এতকিছু সহ্য করতে করতে ক্লান্ত আমি। এক তো তুমিই ছিলে যে আমাকে বুঝতে। আজ কেন বুঝছো না। ”
“কি বুঝবো আমি? বলো কি বুঝবো? চারদিন ধরে ক্লাসে আসছো না তুমি। তিনদিন আগে তোমাকে ভার্সিটিতে না পেয়ে তোমার নাম্বারে কল করি। বাট তুমি রিসিভ করো না। রিসিভ করে তোমার কোন ভাই। সে বলল তুমি অসুস্থ। কিছুদিন আসতে পারবে না। মেনে নিলাম। তারপর থেকে রোজ ফোন করি বাট তোমার ফোন বন্ধ। আর কাল শুনছি তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। জানো যখন তোমার বিয়ের কথা শুনলাম তখন আমার অবস্থা কী হয়েছিল? জানো না তুমি। আর এখন বলছো বুঝতে? বলো এখন কি শুনবো আমি? কি বুঝবো?”
“পাঁচদিন আগে ভাইয়া বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে, আবির। সেদিন ক্লাস শেষ করে বাসায় যাওয়ার পর তাকে আমাদের বাসায় দেখি আমি। সেই সাথে শুরু হয় আমাদের বিয়ের কথা বার্তা৷ আমি মানা করলেও কেউ শুনে না। রাগারাগি করে রুমে চলে আসি আমি। তখন রাগের মাথায় কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। তোমাকে বলবো সেটাও মাথায় আসে নি। গোসল করে বের হয়ে তোমাকে জানানোর জন্য ফোন খুজতে যেয়ে কোথাও পায় না। আম্মুর ফোন চাইলে দেয় না। তাদের মনে হলো আমি পালাতে পারি। তাই ঘর বন্দি করা হলো আমাকে। না ছিল ফোন আর না ছিল বাইরে যাওয়ার উপায়। কাউকে আমার সাথে দেখা করার অনুমতি ও দেওয়া হলো না। আর তুমি তো চিনোই আমার বাবা কাকাকে। একজন ধর্ষিতা অপবাদের মেয়েকে যে তার ভাগ্নে বিয়ে করতে চেয়েছে এটাই বা কম কি? ধর্ষিতাকে কে বিয়ে করবে বলো? এসবের মাঝে কি করে জানাতাম আমি তোমাকে? কাঠের পুতুলের মতো আমাকে বিয়ে দেওয়া হলো। এবার তুমিই বলো কী করতে পারতাম আমি? ”
“আই ম সরি, প্রিয়তা৷ আমারই বোঝা উচিত ছিল। তোমার অসুস্থতার কথাও মনে হয় ওই অমানুষটা বলেছিল। বাট তুমি চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ধর্ষিতা হও কিংবা বিবাহিত। আমি তোমাকে ছাড়তে পারবো না। খুব ভালোবাসি যে তোমাকে।”
চলবে..???