#ওগো_বধু_সুন্দরী
পর্ব—২৩(অন্তিম পর্ব)
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
সেই রাতে এই ব্রিজের নিচে একটা বড়ো বইমেলা হচ্ছিল।আমিও এসেছিলাম সেই মেলায়।কোনো কারণে আমার বেশ দেরী হয়ে যায়!তাই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে পারি নি।একপর্যায়ে বুঝতে পারি কেউ বা কারা পেছন থেকে ফলো করছে আমায়।ভীষণ অস্বস্তিকর পরিস্থিতির ভেতরে পরে গেলাম আমি।যদিও তখন আমি নিশ্চিত ছিলাম না পুরোপুরি এই বিষয়ে।
যখন বাসায় ফেরার জন্য নিজের মনস্থির করলাম,তখন আমার ধারণা সত্যি প্রমাণিত হয়..দেখতে পাই চার পাঁচজন লোক পেছন থেকে আমার ওপরে নজর রাখছে।তখন মেলা শেষের পর্যায়ে।একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছিল।বেশীরভাগ মানুষ সেই অনুষ্ঠান দেখতে ব্যস্ত ছিলো।
যখন আমি মেলা থেকে বেরিয়ে আসতে যাবো ঠিক তখন আমায় কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই লোকগুলো ধাওয়া শুরু করলো,আমি আদৌ জানতাম না,তারা কারা,আর ঠিক কোন কারণে ধাওয়া করছে আমায়….
এরপর,দেখতে পাই সেই গুন্ডাদলের সাথে একজন মহিলাও আছেন।যদিও অন্ধকারে তার ফেইসটা সেইভাবে দেখতে পাই নি আমি।
গুন্ডাগুলোদের ভেতরে একজন আমায় উদ্দেশ্য করে একটা ছুড়ি ছুড়ে মারলো, যদিও একটুর জন্য তাদের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়। সাথে সাথে ছুড়িটা কুড়িয়ে নেই আমি..
তারপর ছুটতে ছুটতে এক পর্যায়ে একটা ঢিবির পেছনে লুকোই।আমি বহুবার চেষ্টা করেছি মেলার শো এর স্টেজের জায়গায় যেতে,কিন্তু গুন্ডাগুলো কিছুতেই যেতে দেয়নি আমায়।
এক পর্যায়ে সবার পায়ের আওয়াজ থেমে গেলো,আমি ভাবলাম হয়তো সবাই সরে পড়েছে।তাই ধীরে ধীরে ঢিবির পেছন থেকে বেরিয়ে আসি…অমনি একটা মহিলার সাথে ধাক্কা লাগে আমার।ভয় আর আতংকে সেই সময় মাথা কাজ করছিলো না আমার।আর কোনোকিছু না ভেবে ছুড়িটা সোজা সেই মহিলার পেট বরাবর চালিয়ে দিলাম।মূহুর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে।
তারপরেই বুঝতে পারি আমি,কতো বড়ো একটা ভুল হয়ে গেছে আমার দ্বারা,ইনি আসলে সে নন যে ঐ গুন্ডাদের দলে ছিলো।সে ছিলো তোমার মা।এই ঘটনা হতবিহ্বল করে দেয় আমায়।কি করবো বুঝতে পারছিলাম আমি,কিছুতেই মানতে পারছিলাম না আমার হাতে আমার হবু স্বামীর মায়ের খুন হয়ে গেছে।
এভাবে অনেক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দে ভোগার পরে সিধান্ত নিলাম আমি পালিয়ে যাবো,কারণ সেই মুহূর্তে সত্যটার মুখোমুখি হবার মতো সাহস হচ্ছিলো না আমার।যে ভাবনা সেই কাজ।তোমার মায়ের লাশ ফেলে রেখে পালিয়ে গেলাম আমি।কাউকে কিছু জানতে দেয় নি বুঝতে দেই নি।এই সত্যটা দীর্ঘ একটা বছর লুকিয়ে রেখেছি আমি।আমি জানি,সজ্ঞানে না হলেও তোমার মায়ের খুনটা আমার হাতেই হয়েছে,আমিই সেই অপরাধী।সকল শাস্তি শুধু আমার প্রাপ্য।
এতোক্ষণ অবাক হয়ে শ্রেষ্ঠার কথাগুলো শুনছিলাম,এতোক্ষনে বুঝে গেছি আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আর কেউ নয়,শ্রেষ্ঠা নিজেই।তার মানে আমার মায়ের খুন শ্রেষ্ঠার হাতেই হয়েছিলো সেদিন।হে সৃষ্টিকর্তা এ আবার কোন কঠিন পরিস্থিতির মুখে দাঁড় করালে তুমি আমায়।আমি জানি না,আর কোন কোন কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে হবে আমায়।
শ্রেষ্ঠার মুখে এতোকিছু শোনার পরেও একটা খটকা থেকেই যায়।আর সেই খটকাটা হলো,সেদিন রাতে আমিও মাকে নিয়ে বই মেলায় এসেছিলাম।হঠাৎ করেই মাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না।তাই তাকে খোঁজার জন্য শোএর স্টেজ এর বাইরে বেরিয়ে গেলাম।খুঁজতে খুঁজতে যখন ব্রিজের এখানে আসি তখন দেখতে পাই কেউ আমার মাকে ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দিচ্ছে…অন্ধকারে নিজের মাকে চিনতে ভুল করিনি আমি।অমনি ছুটে যাই ব্রিজের দিকে।ততক্ষণে ওরা ওদের কাজ করে দিয়েছে।আমাকে দেখে সবাই পালিয়ে গেলেও ব্রিজের ওপরে একটা মেয়েকে ধরে ফেলি আমি।তার সাথে প্রচন্ড ধস্তাধস্তি হয় আমার।এক পর্যায়ে মেয়েটি আমায় আঘাত করে পালিয়ে যায়,কিন্তু ধস্তাধস্তির জের ধরে তার একটা কানের দুল থেকে যায় আমার কাছে।
শ্রেষ্ঠার কথা যদি সত্যি হয়,তবে সেখানে সেইরাতে কার সাথে ধস্তাধস্তি হয়েছিলো আমার,কার কানের দুল চলে এসেছিলো আমার হাতে।এদিকে শ্রেষ্ঠা নিজের মুখে স্বীকার করছে খুনটা ওই করেছে,অন্যদিকে আমি নিজের চোখে যেটা দেখেছি সেটাও বা অস্বীকার করি কিকরে!?সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে…. না শ্রেষ্ঠার কথা অবিশ্বাস করতে পারছি,না নিজের চোখকে।
—কি হলো সৌহার্দ্য,এতো কি ভাবছো,এখনো কেন দাঁড়িয়ে আছো?শেষ করে দাও আমায়।তুমি কথা দিয়েছিলে আমায় আমি সত্যটা স্বীকার করার পরে আমার দেয়া শর্ত পালন করবে তুমি…
—এতো বড়ো পরীক্ষা কেন নিচ্ছো আমার তুমি শ্রেষ্ঠা…আমি জানি তুমি আমার মাকে খুন করেছো।কিন্তু সেটা নিজের ইচ্ছেতে নয়।মানুষ নিজের অজান্তে অনেক কাজ করে,কিন্তু সেটা পাপ বা অন্যায় নয়,সেটা ভুল।তুমি কোনো অন্যায় করো নি,ভুল করেছিলে।তোমায় খুন করে আমি আমার মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাই না!!
—তোমার কথায় সত্যিটা পাল্টে যাবে না,এই অসহ্য যন্ত্রণার বোঝা আর বয়ে বেড়াতে পারছি না।মৃত্যুদন্ড দাও আমায়, নিস্তার দাও আমায়… প্লিজ,তোমার পায়ে পড়ি…
—না,এটা হয় না শ্রেষ্ঠা,তুমি অযথা জেদ করো না।এইভাবে শাস্তি দিও না আমায়।
—তুমি কি চাও আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে দেই,তবে তাই হবে। দাও আমাকে পিস্তলটা দাও,তোমাকে কিছু করতে হবে না।
হঠাৎ আমাদের দুজনের ভেতরে ছেদ পড়লো।একটা টর্চের আলো ফেললো কেউ আমাদের ওপরে।মূহুর্তে ঝলমল করে উঠলো চারপাশ।আমি দেখতে পাচ্ছি আমার সামনে প্রজ্ঞা এসে দাঁড়ালো।ওর অনেকটা পেছনে শ্রেষ্ঠা।প্রজ্ঞাকে এই সময়ে এখানে দেখে অবাক হলাম আমি,
—প্রজ্ঞা তুমি….!!
—হ্যাঁ,আমি।তোমাদের দুজনের সকল কথা শুনেছি আমি।
—তুমি এখানে আসলে কিকরে?
—তোমায় ফলো করতে করতে এসেছি…
আমি জানি শ্রেষ্ঠার কথাগুলো শোনার পরে ঠিক কোন কোন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তোমার মনে। সেদিন ব্রিজের ওপর তোমার সাথে যার ধস্তাধস্তি হয়,সে আর কেউ নয় আমিই ছিলাম। আমার কানের দুল ছিড়ে চলে গিয়েছিলো তোমার হাতে…
—-এটা কি বলছো তুমি, সেদিন বইমেলাতে তুমিও এসেছিলে??(বিষ্ময়ের সাথে প্রশ্ন)
—শুধু আমি নই,আমার সাথে আমার মাও এসেছিলো।সাথে একদল গুন্ডা।কিন্তু আমরা বইমেলায় আসলেও বই দেখতে বা কিনতে আসিনি সেদিন।এসেছিলাম খুন করতে…..!!
—খুন….!!!??তার মানে শ্রেষ্ঠাকে তোমরাই….
—-হ্যাঁ,আমরাই।আমি আর আমার মা চেয়েছিলাম শ্রেষ্ঠাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে।যাতে ওকে খুন ওর জায়গায় আমি বসতে পারি।ওর সকল সম্পত্তি আমরা আমাদের কুক্ষিগত করতে পারি।সেদিন মা গুন্ডা নিয়ে ধাওয়া করে শ্রেষ্ঠাকে।এরপর ওখানে দূর্ভাগ্যক্রমে তোমার মা চলে আসে,আমার মা ভেবে শ্রেষ্ঠা তোমার মাকে খুন করে ফেলে,আর সেটা মা এবং তার দলবল দেখে ফেললো।সাথে আমিও ছিলাম।
শ্রেষ্ঠা চলে যাবার পরে মা লক্ষ্য করে তার হ্যান্ডব্যাগটা খুঁজে পাচ্ছে না।হয়তো ছুটতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছে।এখন পুলিশ এই জায়গায় খুন হয়েছে এটা জানতে পারলে নিশ্চয়ই তল্লাশি চালাবে,তখন মায়ের সেই জিনিসটা খুঁজে পেলে বিশাল ঝামেলা হতে পারে,এমনিতেও আমরা চাই নি শ্রেষ্ঠা জেলে যাক, কারণ ও জেলে গেলে আমাদের বিশেষ কোনো লাভ হতো না।দেখতে যেহেতু এক রকম ছিলাম আমরা দুজন তাই ওকে সরিয়ে নিজে শ্রেষ্ঠা সেজে সকল সম্পত্তি হস্তগত করতে চেয়েছিলাম,যা ও জেলে গেলে কখনোই সম্ভব হবে না।এই ভেবে আমরা সিধান্ত নেই লাশটা নদীতে ফেলে দেবো,যাতে কেউ এই খুনের ঘটনার কথা জানতে না পারে।
লাশ ফেলে দেবার সময়ে তুমিও কাকতালীয়ভাবে সেই জায়গায় এসে হাজির হলে,তারপরের ঘটনা আর কি বলবো,সবটাই জানা তোমার।।
—-এতো বড়ো একটা কথা তোমরা লোকালে কেন আমার থেকে,তখন তোমার মাও কিছু বললো না কেন আমায়,,
—ভয়ে,ভয়ে আমরা সবটা লুকিয়েছিলাম তোমার থেকে।আইনের ভয়ে আমরা লুকিয়েছিলাম,তবে এখন আর সেই ভয়টা নেই আমাদের।অন্যের ক্ষতি চাইলে যে সেটা শাস্তি হয়ে নিজের দিকেই ফিরে আসে সেই শিক্ষা তোমার বাবার থেকেই পেয়েছি আমরা।তুমি আর শ্রেষ্ঠা জীবনের মানে শিখিয়েছো আমাদের, তোমাদের ক্ষমাই আমাদের ভুলটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছে।জীবনে যা পাপ করেছি তার শাস্তি পাবার সময় হয়েছে আমাদের সৌহার্দ্য।এমনিতেই সেদিনের ঘটনার পরে আমরা মা মেয়ে মিলে ঠিক করে নিয়েছিলাম তোমায় আর শ্রেষ্ঠাকে সকল ঘটনা খুলে বলবো,তারপর নিজেরাই আইনের হাতে ধরা দেবো।কিন্তু আজ এই মুহুর্তে আমি এখানে উপস্থিত না থাকলে হয়তো আরো একটা অনর্থ ঘটে যেতো।সেটা কিকরে হতে দেই আমি।
প্রজ্ঞার কথাগুলো যেন পাথর করে দিয়েছে শ্রেষ্ঠাকে।ওর মুখে কোনো কথা নেই…দীর্ঘ এক বছর ধরে মায়ের মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে আসছি আমি,আজকে তার মৃত্যুর আসল রহস্য জানতে পারলাম।জীবনে নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরোতে পেরেতো নিজের মনটাও অজান্তে কখন যে পাথরের ন্যায় শক্ত পদার্থে রুপান্তরিত হয়েছে,বুঝতেই পারি নি।তাই হতো এতো নিষ্ঠুরতা নিজের কানে শোনার পরেও স্থির হয়ে থাকতে পারছি,প্রজ্ঞার প্রতি এখন আর কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই আমার।ও আর ওর মা নিজেদের ভুলটা বুঝতে পেরেছে,ওরা নিজেদের আইনের হাতে সোপর্দ করে দিয়েছে।ওদের দুজনের এই শোধরানোর পেছনে আমার আর শ্রেষ্ঠার ভূমিকা রয়েছে।এতো লোভী আর নিষ্ঠুর দুজন মানুষকে বদলে দিতে পেরেছি মন থেকে এর থেকে বড়ো প্রাপ্তি আর কি হতে পারে।
–
–
–
–
এর বেশ কয়েকমাস পরে…..
জেল গেট থেকে আমি আর শ্রেষ্ঠা বেরিয়ে এসেছি।আমাদের হাতে এক মাসের একটি বাচ্চা…কি ভাবছেন বাচ্চা নিয়ে জেল গেট থেকে কেন বের হলাম?
সমস্ত অপরাধ স্বীকার করার পরে আদালত প্রজ্ঞা আর ওর মায়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড জারি করে।এর কিছুদিন পরেই জানতে পারি প্রজ্ঞা প্রেগন্যান্ট।আমার সন্তান বড়ো হচ্ছে ওর গর্ভে।প্রজ্ঞা আমাদের অনুরোধ করে ওর বাচ্চা যেন আমরা দুজন প্রতিপালন করি,তাতে কিছুটা হলেও ওর পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে।সত্যি বলতে, বাচ্চাটা যে আমারই অংশ।ওর মা যেমনই হোক না কেন,আমি নিজের ঔরসকে অস্বীকার করতে পারি না।প্রজ্ঞার সাথে ডিভোর্সের পরে শ্রেষ্ঠাকে বিয়ে করে আমার ঘরের বৌ করে নিয়েছি অনেক আগেই।ও মন থেকেই মেনে নিয়েছে আমার সন্তানকে।আমাদের ছেলে সন্তানের নাম ‘পরিবর্তন’রেখেছি আমরা।নামটা অবশ্য আমার দেয়া নয়,ওর নতুন মায়ের দেয়া….😁
(শুভ সমাপ্তি)