ওগো বধু সুন্দরী পর্ব-২১

0
1111

#ওগো_বধু_সুন্দরী
পর্ব—-২১
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার তথাকথিত বাবা চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।আমি লক্ষ্য করলাম তার বাহুতে একটা ছুড়ি বিঁধে আছে।স্টোর রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শ্রেষ্ঠা আর নকল শ্রেষ্ঠার মা।সাথে নকল শ্রেষ্ঠাও আছে।তবে ছুড়িটা কার হাত থেকে ছুটে এসেছে বুঝতে পারছি না আমি…..

—-তোমার সমস্ত খেলা শেষ,আজ তোমায় নিজের হাতে শেষ করে ফেলবো আমি।

এই বলে নকল শ্রেষ্ঠা বাবার দিকে এগিয়ে গেলো।শ্রেষ্ঠা ওকে পেছন থেকে বাঁধা দেয়।

—নাহ,প্রজ্ঞাকে ওকে কিছুই করবে না তুমি।ওর যা ব্যবস্থা করার আইন করবে।আমরা আইন হাতে তুলে নিতে পারি না।

প্রজ্ঞা শ্রেষ্ঠার কথায় কিছুটা শান্ত হলো,এদিকে শ্রেষ্ঠা আমার দিকে এগিয়ে আসলো… তারপর আমার বাঁধন খুলে দেয়।

—তুমি ঠিক আছো তো,

—হ্যাঁ,আমি একদম ঠিক আছি।আমার কথা কথা চিন্তা করো না।

—নাহ,ও ঠিক নেই।দেখো শয়তানটা ওর মাথার কি অবস্থা করেছে,রক্তের দাগ এখনো শুকোয়নি,,(আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রজ্ঞার বক্তব্য)

আমি প্রজ্ঞাকে উদ্দেশ্য করে বলি…..

—-থামো থামো এক মিনিট,তোমাকে তো আটকে রেখেছিলাম আমি এই ঘরে।তারপরে তুমি একটা সিনক্রিয়েট করে ফাঁসিয়ে দিলে আমায়।আবার এখন এসে নাটক করছো।আর তোমাকে এখান থেকে মুক্ত করলো কে??

—নাহ,সৌহার্দ্য।তুমি ভুল ভাবছো।আসলে প্রজ্ঞা বাইরে গিয়ে ফোন করে আমাদের। যাতে আমরা যতোদ্রুত সম্ভব এখানে চলে আসি।আর আসল কার্লপিটকে হাতেনাতে ধরে ফেলতে পারি।(শ্রেষ্ঠা)

—-সে বুঝলাম,কিন্তু এখান থেকে ওকে মুক্ত করলো কে, আগে সেটা বলো আমায়।

—যখন তোমার বাবা স্টোররুমে ঢুকে পড়ে। আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে যায় সে।আমি তাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেই,বিনিময়ে সে ছেড়ে দেয় আমাকে।আমি জানতাম আজ অনেক বড়ো অনর্থ ঘটবে তোমার সাথে।তাই এই বুড়োর সাথে নাটক করে বাড়ির বাইরে গেলাম, কিন্তু ও নিজেও জানতো না ওর যম নিয়ে ফিরবো এই বাড়িতে আমি।(প্রজ্ঞা)

—একদম ভালো করলে না এটা তোমার সাথে আমরা।আমাকে ধোঁকা দেবার শাস্তি সবাই পাবে..একে একে সবাইকে শাস্তি দেবো আমি।
(মেঝে থেকে নিজের মাথা তুলে বাবা বলতে লাগলো)

—-একদম চুপ থাকো তুমি,তোমার এতোটুকু ভয় হচ্ছে না আমাদের সবাইকে একসাথে দেখে তোমার নিজের চোখের সামনে।যাদের সবাইকে নিজের হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছো তুমি।আমাদের সবাইকে ঠকিয়েছো তুমি,শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে।আজ তো নিস্তার নেই তোমার।দেখো কি করি তোমার সাথে আমরা….
(শ্রেষ্ঠা বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো,)

আমি দেখতে পাচ্ছি শ্রেষ্ঠার চোখে ক্রোধের আগুন,শুধু শ্রেষ্ঠা নয় প্রজ্ঞার চোখ বেয়ে যেন আগুনের লাভা বেরিযে আসবে।সত্যিই তো, আমার কথা বাদ দিলাম,ওদের দুজনের জীবন নষ্ট হয়েছে শুধুমাত্র এই একটা লোকের জন্য।পৃথিবীতে মানুষ সবকিছুর সাথে আপোষ করতে পারে,তবে নিজের জীবনের সাথে নয়।শ্রেষ্ঠা আর প্রজ্ঞাকে দেখে মনে হচ্ছে ওরা বাবাকে গিলে খাবে।
প্রজ্ঞার মাও পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।তার মুখে কোনো কথা নেই।

—তোমরা আমার কিছুই করতে পারবে না,আর আজকে যেটা সবাই মিলে করলে আমার সাথে এর ফল ভোগ করতে হবে তোমাদের।

—আগে নিজেকে তো বাঁচাও,তারপরে আমাদের কথা ভেবো।এমন অবস্থা করবো তোমাদের সারাজীবন জেলে পঁচে মরেও শাস্তির শেষ হবে না তোমার।তুমি নিজে জানো কতোগুলো অপরাধ করেছো তুমি,এর শাস্তি কি হতে পারে ধারণা আছে তোমার।

শ্রেষ্ঠার কথায় বাবা চুপ করে রইলো,কারণ সেই মুহূর্তে বলার মতো কিছুই ছিলো না তার।আমি তার মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।নিজের দূর্বলতা ঢাকতে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধামকি দিচ্ছে সবাইকে।আর কিছু না।এতো এতোকিছুর পরেও লোকটা এতোটুকু শুধরালো না,এটাই আফসোস।যে অপরাধ করেছে যদি তার ভেতরে অনুশোচনা বোধের জন্ম না হয়, আমরা কিই বা করতে পারবো,আর আইনই বা কি পারবে।

এরপর বাসায় পুলিশ ডাকা হলো,আমাকে বন্দী করে খুনের চেষ্টার অপরাধে পুলিশ গ্রেপ্তার করলো তাকে।তবে শুধু এটাই তার অপরাধ নয়।একটা মেয়েকে প্ররোচিত করে অন্ধকার জগতের দিকে ঢেলে দেওয়াও আইনের চোখে অন্যতম জঘন্য অপরাধ।এরও বিচার হবে বাবার।সব অপরাধের বিচার হবে,যা শুধু এখন সময়ের অপেক্ষা।।




এর দুইদিন পরে,তখন বিকেল বেলা।বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আমি।দেখতে পাচ্ছি মাথার ওপর থেকে ধবল বক সারিবেঁধে উড়ে যাচ্ছে।কতোটা শৃঙ্খলাবোধ ওদের সবার ভেতরে,যে যার জায়গায় স্থির থেকে উড়ে চলছে।দেখলে মন জুড়িয়ে যায়।পৃথিবীতে মানুষ নামক প্রানীর ভেতরেই বোধহয় ন্যায় আর শৃঙ্খলাবোধের বড্ড অভাব।

আমার তথাকথিত বাবা জেলে তার কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করছে,বাবার সমস্ত রহস্য আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার।এবার আমার মায়ের খুনির রহস্য ভেদ করার অপেক্ষা।জানিনা কখন আর কবে সেই সত্যি আমার সামনে আসবে।মায়ের মৃত্যুতে বাবার কোনো হাত আছে কিনা,এখন পর্যন্ত জানি না আমি।যদি সত্যি তাই থেকে থাকে তবে আমার কাজ আরো বেশী মুশকিল হয়ে যাবে।অন্যদিকে নকল শ্রেষ্ঠা অর্থাৎ প্রজ্ঞা সেও আমার সন্দেহর বাইরে ছিলো না কোনোদিন।কিন্তু সমস্যা হলো,যাকেই সন্দেহ করি না কেন।কারোর বিরুদ্ধেই উপযুক্ত প্রমাণ নেই আমার কাছে।জানিনা কিকরে মায়ের খুনি পর্যন্ত পৌঁছবো আমি।

হঠাৎ ফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো।পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই দেখি গেট দারোয়ানের কল।বেশ কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলো ও।গতকালকেই ফিরে এসেছে।কলটা রিসিভ করলাম,

—স্যার,একটু নিচে আসেন?

—কেন,কি হয়েছে?

—একটা পার্সেল এসেছে?

–পার্সেল এসেছে,কিসের পার্সেল?

—সেটা তো না খুলে বলতে পারবো না আমি। আপনি নিচে এসে নিয়ে যান।

—ঠিক আছে,তুমি ওয়েট করতে বলো আমি এক্ষুনি আসছি।

ফোনটা রেখে দ্রুত গ্রাউন্ড ফ্লোরের দিকে গেলাম।গিয়ে দেখি গেট দারোয়ান একটা খাম হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে আমার দিকে এগিয়ে এলো সে।

—স্যার, এই যে চিঠিটা?

—কি এটা,এটা পার্সেল?

—হ্যাঁ স্যার,এটাই তো দিয়ে গেলেন,

—দিয়ে গেলেন মানে,যে এটা নিয়ে এসেছে সে কোথায়,

—সে তো চলে গেছে স্যার,

—চলে গেছে,এভাবে হয় নাকি।পার্সেলের ডেলিভারির ক্ষেত্রে কিছু প্রটোকল থাকে তো,উনি সেগুলো না মিটিয়ে চলে গেলেন, অদ্ভুত!

—আমি বলেছিলাম তাকে,আর স্যার ওনাকে দেখে মনে হলো না উনি প্রফেশনাল কেউ।

—আচ্ছা যাই হোক,ছাড়ো।তবে তোমার তাকে চলে যেতে দেওয়া ঠিক হয়নি।

চিঠিটা দারোয়ানের সামনে বসে খুলতে মন চাইলো না,তাই আবারো চিঠিটা নিয়ে ছাদে গেলাম।

চিঠিটা খুলতে খুলতে বুকটা ধুকধুক করতে লাগলো।না জানি কি আছে এটার ভেতরে।তারোপর এরকম একটা উড়ো চিঠি।

চিঠিটা খুলে নিজের সামনে ধরলাম,তারপর চোখের সাহায্যে পড়তে থাকি…..

“কি ব্যপার,কেমন আছো?ভালো নেই নিশ্চয়ই।খুব চিন্তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছো,তাই না।আমি জানি কি নিয়ে এতো চিন্তা তোমার।এই চিন্তা মাথা থেকে দূর না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছো না তুমি।তবে জানো কি,আমার কাছে তোমার চিন্তার উপশম আছে।আজ রাতেই চলে আসো, ঠিক পৌনে দশটার পরে ।চিঠির অপর প্রান্তে ঠিকানা লেখা আছে। আশা করি জায়গা এখনো ভুলে যাওনি।আর ভুলে যাবারো কথা নয় ”

লেখাগুলো দেখে বেশ অবাক বনে গেলাম,বেশ আগ্রহভরে চিঠির অপর প্রান্তে চলে যাই।সেখানে মোটা কালিতে এখানে ঠিকানা লেখা আছে…

ঠিকানাটা দেখতেই চোখজোড়া কপালে উঠলো আমার, সারা শরীর যেন অদ্ভুত ঝাঁকুনি দিলো।এ আর অন্য কোনো জায়গা নয়,আজ থেকে এক বছরের বেশী সময়ের আগে যে জায়গায় আমার মায়ের খুন হয়েছিলো সেই জায়গার ঠিকানা।আর সময়টা….পৌনে দশটা।সেইরাতে পৌনে দশটার দিকেই আমার মায়ের খুন হয়েছিলো!!!
তার মানে এই চিঠির সাথে আমার মায়ের খুনের কোনো না কোনো যোগাযোগ আছে,তা না হলে এতোগুলো পয়েন্ট এভাবে মিলে যাবে কেন!?

একপ্রকার আশ্চর্যরকমের উত্তেজনা কাজ করতে লাগলো আমার ভেতরে,এক্ষুনি শ্রেষ্ঠার সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে হবে।এই ভেবে শ্রেষ্ঠার রুমের দিকে ছুটে গেলাম।আমি জানি ও আমার মতোই অবাক হয়ে যাবে চিঠিটা দেখে।আর তাছাড়া আমার মায়ের খুনিকে শনাক্ত করতে পারলে আমার থেকে শ্রেষ্ঠাই বেশি খুশি হবে আমি জানি।ওর থেকে বড়ো শুভাকাঙ্ক্ষী আমার জীবনে আর কে আছে….

কিন্তু এসে দেখতে পাই শ্রেষ্ঠা নেই ওর রুমে,পুরো বাসা তন্নতন্ন করে খুঁজলাম,কেউ কোথাও নেই ।

—কি হলো ব্যপারটা বুঝলাম না,শ্রেষ্ঠা আমাকে না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার পাত্রী তো নয়।ওর এই আচরণে অবাক না হয়ে পারছি না।
একটা কাজ করা যায়,ও বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে গেট দারোয়ানের নিশ্চয়ই তো জানার কথা,ওকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো কিছু জানতে পারবো।শ্রেষ্ঠার ফোনে একটু সমস্যা করছে,তাই ফোন দিয়ে লাভ হবে না।তাছাড়া প্রজ্ঞা আর ওর মা একটু বাইরে গিয়েছে দুপুরের পর।

গ্রাউন্ড ফ্লোরে যাবার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ালাম,ঠিক তখন শ্রেষ্ঠা ঘরে ঢুকে পড়লো।আমাকে আচমকা সামনে দেখেই যেন অবাক হয়ে গেলো ও।

—কি হলো শ্রেষ্ঠা,কোথাও গিয়েছিলে?সেই কখন থেকে খুঁজে মরছি তোমায়।

—একটু বাইরে গিয়েছিলাম,কাজ ছিলো।….(ইতস্ত করে)

শ্রেষ্ঠার এই আচরণে কারণ বুঝতে পারছি না, কেমন জানি একটা ভয় পেয়ে আছে আমাকে দেখে।তাছাড়া কিছু একটা লুকোচ্ছে এমন মনে হলো আমার।

—কি হলো শ্রেষ্ঠা,ঠিক আছো তো তুমি,তোমাকে বিচলিত লাগছে কেন?

—কি যে বলো না,আমি ঠিক আছি।

—আচ্ছা বসো,একটা জরুরী কথা বলার আছে তোমাকে?

—কি জরুরী কথা,বলো।

—এই চিঠিটা দেখো,এই চিঠির লেখাগুলোর সাথে আমার মায়ের মৃত্যুর একটা অদ্ভুত কানেকশন আছে।পড়ে দেখো এটা তুমি….এইমাত্র চিঠিটা হাতে এলো আমার।মনে হচ্ছে মায়ের খুনিকে খুব তাড়াতাড়ি ধরে ফেলতে পারবো আমরা,

এই বলে চিঠিটা শ্রেষ্ঠার দিকে এগিয়ে দিলাম, কিন্তু এ যেন খুব একটা অবাক হলো না চিঠিটা দেখে যতোটা হবার কথা ছিলো।আমার এমন মনে হচ্ছে এই চিঠির ব্যপারে ও আগে থেকেই অবগত।তাই এতোটা স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছে….কিন্তু সেটা কিকরে সম্ভব..??

কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো অতিরিক্ত টেনশন আর উত্তেজনাবশত আমি বোধহয় একটু বেশিই ভাবছি শ্রেষ্ঠাকে নিয়ে,আর যাই হোক,পৃথিবী উল্টে গেলেও আমার মায়ের খুনের ব্যপারে শ্রেষ্ঠাকে সন্দেহ করতে পারি না আমি।আসলে পাশের মানুষদের সন্দেহ করতে করতে আমার মনে সন্দেহর বীজ দানা বেঁধে আছে।যাকে তাকে যখন খুশি সন্দেহ করে ফেলছি।
তবে যাই হোক না কেন,এটা ঠিক আজ রাতে ঐ জায়গায় কিছু একটা ঘটতে চলেছে আমার সাথে,হয়তো ভালো কিছু,নয়তো অন্যরকম।কিছু একটা তো অপেক্ষা করছে……

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে