#ওগো_বধু_সুন্দরী
পর্ব—-১৬
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
অবশেষে প্রজ্ঞার বাড়িতে উপস্থিত হলো শ্রেষ্ঠা।বাড়িতে তেমন কেউ নেই,শুধুমাত্র একজন ভদ্রমহিলা ছাড়া।যথারীতি ভদ্রমহিলা শ্রেষ্ঠাকে দেখে নিজের মেয়ে মনে করলো।নিজের মেয়েকে ভীষণ খুশি হয় সে।
বাবা শ্রেষ্ঠাকে প্রজ্ঞার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আবার নিজ বাড়িতে চলে আসেন।
এরপর সন্ধ্যাবেলা,,
বাড়ির বারান্দায় বসে আছে শ্রেষ্ঠা।একটু পরে ভদ্রমহিলা দুকাপ চা হাতে সেখানে উপস্থিত হলো।এককাপ শ্রেষ্ঠার হাতে,বাকিটা নিজে নিয়ে বসে পড়ল।শ্রেষ্ঠা বুঝতে পারছে না,কিভাবে কথা শুরু করবে এর সাথে,তাছাড়া সে সারাদিন কাজে এতো ব্যস্ত ছিলো কোনো প্রশ্ন করার সময় পায় নি।
—-তা,কি খবর বল তোর….??
(চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে….)
—এইতো চলে যাচ্ছে কোনোকরম,তোমার কি অবস্থা?
—-আমার অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছিস।তা, কোনোরকম চলে যাচ্ছে মানে,তুই কি ভালো নেই ঐবাড়িতে!?
—-ভালো থাকবো না কেন, ভালোই আছি…কি যে বলো না।
(শ্রেষ্ঠা ইচ্ছে করে একটু নেতিবাচক আচরণ করছে,যাতে ওর মা স্বামী,শ্বশুরবাড়ি,বিয়ে এসব নিয়ে বেশি করে প্রশ্ন করে।নয়তো এর পেট থেকে কথা বের করা মুশকিল)
—না,তোর গলার স্বর তো ভিন্ন কথা বলছে।তুই কি সৌহার্দ্যের সাথে ভালো নেই?আমায় খুলে বল মা।
শ্রেষ্ঠা প্রজ্ঞার মায়ের সামনে আমতা আমতা করতে লাগলো।
—আচ্ছা,ও তোর আসল পরিচয় জেনে গেলো না তো আবার,বা কিছু সন্দেহ করেছে নাকি?
—সন্দেহ করবে, সন্দেহ কেন করতে যাবে?
—সন্দেহ করবে না মানে…তুই যে আসল শ্রেষ্ঠা নস,এমনটাও তো হতে পারে সৌহার্দ্য সেটা খানিক আন্দাজ করতে পেরেছে।
—ভালোই গল্প বানাতে পারো তুমি মা…আচ্ছা আমি কি তোমায় এমন কিছু বলেছি।
—বলিসনি ঠিক, কিন্তু আমি বুঝতে পারি নিশ্চয়ই কিছু একটা তো চলছে তোর মনে।
—হ্যাঁ,চলছে তো।আর সেটা হলো তোমার পেট থেকে সত্যি কথাগুলো টেনে বের করে আনা।যা তুমি পরম যত্নে লুকিয়ে রেখেছো (বিড়বিড় করে বললো শ্রেষ্ঠা)
—কিছু বললি মা,,
—না কিছু না।একটা কথা বলি মা,
—-বল,আর দাঁড়া দাঁড়া, একটা প্রশ্নের জবাব দে, তুই তো সারাজীবন মম বলে ডেকে এসেছিস আমায়।এখন হঠাৎ করে মা বলছিস কেন?কি ব্যপার।
এই সেরেছে,প্রজ্ঞা যে এই মহিলাকে মম বলে ডাকতো সেটা কিকরে জানবে শ্রেষ্ঠা।যাই হোক, একটা উত্তর তো দিতে হবে এখন।
—আর বলো না,মম বলতে আর ভালো লাগে না, আমি যেখানে থাকি,ওখানে সবাই মাকে মা বলেই ডাকে।তাই ওদের দেখাদেখি নিজের হেবিট টা চেঞ্জ করে ফেললাম।তাছাড়া মা ডাকের ভেতরে আলাদা একটা ব্যপার আছে তাই না, এটা এতোদিন বুঝতে পারি না।
—তুই আসলে,বিয়ের পর অনেক পাল্টে গিয়েছিস।আমি যেন সম্পূর্ণ অন্য এক প্রজ্ঞাকে দেখছি।তবে মন্দো লাগছে না কিন্তু আমার।হুমম…এখন বল কি বলতে চেয়েছিলি?
—শোনো মা,ধরো এখন আবার আসল শ্রেষ্ঠা ফিরে আসলো।তখন আমার কি হবে…??
—-এসব কি বলছিস তুই,শ্রেষ্ঠা ফিরে আসবে মানে।ও আর কখনোই সৌহার্দ্যের জীবনে ফিরে আসতে পারবে না এই গ্যারান্টি সৌহার্দ্যের বাবা দিয়েছে আমাদের।তাহলে আমরা বৃথা টেনশন করছি কেন!
—না,যদি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফিরে আসে।হতেও তো পারে….
—-না,সেটা সম্ভব নয়।
—-কেন সম্ভব নয় মা??
—-কারণ,সৌহার্দ্যের বাবা ওকে তোদের জীবনে ফিরে আসার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন।আর তুই এখন এসব ভাববি না একদম,আর আসল নকল কি আবার।ঐ বাড়িতে একটাই পরিচয় তোর,আর সেটা হলো তুই শ্রেষ্ঠা।সৌহার্দ্যের সাথে সংসার করতে হলে প্রজ্ঞা পরিচয়কে মাটি চাপা দিয়ে রাখতে হবে চিরদিনের জন্য।যদি কোনোদিন আসল শ্রেষ্ঠা ফিরেও আসে তুই নিজের জায়গা থেকে সরে যাবি না,
প্রজ্ঞার মায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছে শ্রেষ্ঠা।কোনো মা নিজের মেয়েকে এভাবে মিথ্যা আর ছলনার রাস্তায় হাঁটতে শিখাতে পারে আগে জানা ছিলো না।যে মায়ের মনে এতো কুটিলতা, তার মেয়ে কিকরে সুবুদ্ধিসম্পন্ন হয়।কিন্তু সমস্যা হলো,এতো কিছু করেও এই মহিলার মুখ থেকে সেইরকম কোনো কথা বের করা গেলো না যা শ্রেষ্ঠাকে সত্য উদঘাটনে সাহায্য করতে পারে।শুধু এইটুকু বোঝা গেছে প্রজ্ঞার মা আর প্রজ্ঞা দুজনেই সৌহার্দ্যের বাবার ষড়যন্ত্রের একটা বড়ো অংশ।প্রজ্ঞার মা চায় তার মেয়ে সৌহার্দ্যের তাকে সংসার করুক।কিন্তু সে শ্রেষ্ঠাকে সরিয়ে নিজের মেয়েকে কেন সৌহার্দ্যের সংসারে ঢুকিয়ে দিলো,শ্রেষ্ঠা ফিরে আসুক এটা কেন চাইছে না এই ভদ্রমহিলা।শ্রেষ্ঠার সাথে তার আর তার মেয়ের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, এটা জানাটা বেশি জরুরী।তার জন্য অন্য একটা রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে।আর সেটা এই বাড়িতে বসেই।
এর কিছুক্ষণ পরে ভদ্রমহিলা উঠে কিচেনের দিকে চলে যায়।শ্রেষ্ঠা বাড়ির ভেতর এবং চারটাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছে।এক পর্যায়ে একটা স্টোর রুম চোখে পড়লো তার।জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলো ভেতরে অনেকগুলো আসবাব,ফাইল,কাগজপত্র, ইত্যাদি ইত্যাদি ফেলে রাখা হয়েছে।একবারের জন্য হলেও এই ঘরে যাওয়া চাই।কারন এইরকম জায়গায় অনেকসময় অনেক ধরনের পুরনো ডকুমেন্টের সন্ধান মেলে, এটা জানে শ্রেষ্ঠা।দরজার দিকে তাকাতেই হতাশ হলো সে।একটা বিশাল আকারের তালা ঝুলছে দরজায়।যেকরেই হোক চাবিটা ম্যানেজ করতে পারলে ঘরের ভেতরে ঢোকা যেতো।আর চাবিটাও নিশ্চয়ই প্রজ্ঞার মায়ের কাছেই আছে।এখন যেকরেই হোক,ঐ মহিলাকে বোকা বানিয়ে চাবিটা কব্জা করতে হবে।এই ভেবে একটা প্লান রেডি করে কিচেনের দিকে গেলো শ্রেষ্ঠা।মা তখন কিচেনে রান্না করছে।
—-মা,আমার চাবির থোকাটা দেখেছো, সন্ধ্যা থেকে খুঁজেই পাচ্ছি না।
—খুঁজে পাচ্ছিস না মানে,কোথায় রেখেছিলি?
–কোথায় রেখেছিলাম যদি মনেই থাকতো তাহলে তো আর খোঁজার দরকার পড়তো না। কি যে বলো না তুমি মা।
—ভালো করে খুঁজে দেখ কোথায় রেখেছিস?
—আচ্ছা,তুমি ভুল করে তোমার চাবির থোকার সাথে রেখে দাওনি তো।
—নাহ,আমি কোনো চাবির থোকা পাইনি।বললাম তো।
—তাহলে কোথায় গেলো,?
—আমি কি জানি,
—আমার তো মনে হয় তুমিই কিছু একটা করেছো,নিজের চাবি ভেবে হয়তো রেখে দিয়েছে।আচ্ছা তোমার চাবির থোকাটা কোথায়, আমি চেক করে দেখবো!
—তুই কি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছিস না।
—হ্যাঁ,পারছি।কিন্তু চাবি খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত মাথা ঠিক হবে না আমার।তাড়াতাড়ি বলো কোথায় তোমার চাবির থোকা।
—আমার বেডরুমে বাম টেবিলের ড্রয়ারের ভেতরে আছে।যা নিজের চোখেই দেখে আয় গিয়ে।যত্তোসব।
শ্রেষ্ঠা দ্রুত গিয়ে চাবির থোকাটা নিয়ে নিলো।তারপর সেটা নিয়ে স্টোর রুমের দিকে যায়।চাবিগুলো দিয়ে একে একে তালাটা খোলার ট্রাই করে।এক পর্যায়ে সফলও হয়ে গেলো।কিন্তু এখন ভেতরে ঢোকা যাবে না।মহিলা দেখে ফেললে গন্ডগোল হয়ে যেতে পারে।যা করার রাতেই করতে হবে।তালাটা খোলা রেখেই ওখান থেকে চলে যায় শ্রেষ্ঠা!
এরপর খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার রুমে শুয়ে পড়লো।শ্রেষ্ঠা উঠে পা টিপে টিপে স্টোর রুমের দিকে যায়।তখন বেশ রাত। প্রায় একটা বেজেছে।স্টোররুমের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলো শ্রেষ্ঠা।তারপর দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়।
একের পর এক সমস্ত জিনিস তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে…যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়।কিন্তু সেরকম কিছুই চোখে পড়ছে না।এভাবে আধাঘন্টার মতো চিরুনি তল্লাশি চললো।এরপর হঠাৎ একটা খাম এসে পড়ে শ্রেষ্ঠার হাতে।খামের ভেতরে বহু পুরনো কিছু ছবি।ছবিগুলোর ওপর একগাদা ধূলো জমে আছে,তারোপর অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।ফুঁ দিয়ে একটা ছবি পরিষ্কার করে সেটা ফোনের আলোর ওপরে ধরলো শ্রেষ্ঠা।
মূহুর্তেই চমকে উঠলো সে….এতো তার ছোটবেলার ছবি,ছোটবেলা বলতে অনেক ছোটবেলার।যে সময়ের কথা স্পষ্ট মনে নেই শ্রেষ্ঠার।সেই সময়ের একটা ছবি এখনো ওর কাছে আছে। কিন্তু এখানের ছবিতে খানিকটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।আর সেটা হলো, ছবিতে একজন নয়।তিন তিনজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। একজন এই ভদ্রমহিলা,সাথে দুটো মেয়ে।যাদের দেখতে হুবহু একই রকম।তবে জমজ নয়,বয়সের সামান্য ব্যবধান রয়েছে।যা ছবির ভেতরেই ফুটে রয়েছে।
তার মানে এটা শ্রেষ্ঠা আর প্রজ্ঞার ছোটবেলার ছবি।কিন্তু ওরা দুজন এক ছবিতে কি করে…??
তবে কি কোনো বিশেষ সম্পর্ক আছে এই দুজনের ভেতরে।নাকি তার থেকেও বেশী, হয়তো রক্তের সম্পর্ক রয়েছে এই দুজনের ভেতরে।কিন্তু তারপরেও একটা খটকা থেকেই যায়।যদি প্রজ্ঞা আর শ্রেষ্ঠার ভেতরে রক্তের সম্পর্ক থেকে থাকে তবে ওদের মা দুজনের সাথে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ কেন করছেন??
এক মেয়েকে নিজের কাছে রেখে দিয়ে,অন্য মেয়ের দূরে ঠেলে দিয়ে তার সর্বনাশ কোনো মা কিভাবে করতে পারে???
এইসমস্ত প্রশ্নের উত্তর ঘিরে ধরলো শ্রেষ্ঠার মনকে,এক অদ্ভুত আন্দোলন শুরু হলো ওর মনে!!!!
চলবে….