#ওগো_বধু_সুন্দরী
পর্ব—-০৭
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
মাথাটা ভনভন করে ঘুরতে লাগলো আমার।যা অনুমান করেছিলাম তাই সত্যি হলো।বাবার সাথে যোগাযোগ আছে মেয়েটার।তা না হলে, তার গ্যালারিতে ওর ছবি থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়।
কিন্তু বাবার সাথে ওর সম্পর্ক কি এটা আগে জানতে হবে আমাকে,আর তার জন্য আমাকে যতদূর যেতে হয় তাই যাবো আমি।
এরপর ডক্টর আমাকে রিলিজ করে দেন, সবাইকে নিয়ে নিজের বাসায় ফিরে এলাম আমি।ডাক্তার কিছুদিন রেস্ট নিতে পরামর্শ দিয়েছেন আমাকে,তাই কয়েকদিনের জন্য অফিস ছুটি নিয়েছি।ড্রয়িং রুমে বসে বসে মিছিলের সাথে টিভি দেখছি।হঠাৎ একটা বোল এগিয়ে আসলো আমার দিকে।
—এই যে, আপনার জন্য চিকেন স্যুপ…!(শ্রেষ্ঠা আমার দিকে বোলটা এগিয়ে দিয়ে বললো)
—চিকেন স্যুপ,তুমি তৈরী করেছো এটা?(আমি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করি)
—হ্যাঁ, আমি তৈরি করেছি,কেন কি হয়েছে তাতে?
—এটা শিখলে কবে তুমি…,তুমি তো স্যুপ তৈরী করতে জানতে না।
—বা..রে….কে বললো আপনাকে??
—অদ্ভুত ব্যপার,,বিয়ের আগে শ্রেষ্ঠা আমায় নিজেই বলেছে ও স্যুপ তৈরী করতে পারে না,এই কয়েকদিনের ভেতরে ভুলে গেলো কিকরে?
(চিন্তিত মনে ভাবলাম আমি)
—কি হলো,কি চিন্তা করছেন?
—তুমি আমায় বলেছিলে একবার মনে আছে,তুমি স্যুপ তৈরী করতে পারো না।বিয়ের আগে তোমার বাসায় যখন গিয়েছিলাম আমি।তখন বলেছিলে,মনে আছে তো?
—আমি,আর আপনি কবে গেলেন আমার বাসায়….(হাহাহাহা!)কি বলছেন এসব আ……..এই পর্যন্ত বলেই থেমে গেলো শ্রেষ্ঠা।এমন মনে হচ্ছে,কথাটা ভুল করে মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে ওর।তাই নিজেকে গুটিয়ে নিলো সে।
—কি হলো,থেমে গেলে কেন??
—নাহ,কিছু না??(ইতস্তত করে উত্তর দিলো)
–তুমি এতো তাড়াতাড়ি এতো কিছু ভুলে গেলে কিকরে,অদ্ভুত তো।আচ্ছা,এটা তো নিশ্চয়ই মনে আছে তার পরেরদিন একবার একটা টেডি টাইগার নিয়ে গিয়েছিলাম তোমার জন্মদিনে!তুমি ভয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছিলে।তারপর আমি কি করেছিলাম….??
—টেডি,কিসের টেডি!!
—তুমি কি আমার সাথে মজা করছো শ্রেষ্ঠা, এগুলো কেমন ছেলেমানুষী,একটা মানুষ এভাবে এতো ঘটনা ভুলে যেতে পারে।এটা হয় কখনো?
—আমি জানি না,জানি না কিচ্ছু।আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।(এই বলে উঠে দৌড়ে কিচেনের দিকে চলে গেলো শ্রেষ্ঠা!)
আমি হতবাক হয়ে চেয়ে আছি ওর যাওয়ার দিকে,,শ্রেষ্ঠার সাথে বিয়ের কয়েকটা দিন আগের ঘটা ঘটনাগুলো ও এভাবে ভুলে গেলো কিকরে।শ্রেষ্ঠা বরাবর ভীতু প্রকৃতির মেয়ে।বাঘের পুতুল দেখে ভয়ে যে কান্ডটা করেছিলো, বাধ্য হয়ে সেটা ফেরত দিতে হয়েছিলো আমায়।এতো বড়ো একটা ঘটনা,এটাও ভুলে গেলো ও!!
নাহ!দুয়ে দুয়ে যেন চার মিলছে না কিছুতেই।তাছাড়া ওকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করতেই কেমন জানি ভয়ে চুপসে গেলো,এমন মনে হলো কিছুই জানে না ও।তাই আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে ভয় হচ্ছে।কিন্তু এমনটা তো হবার কথা নয়,শ্রেষ্ঠার সাথে বিয়ে হয়েছে আমার এক সপ্তাহ আগে।এটা ঠিক।কিন্তু ওকে আমি তারো সামান্য কয়েবছর আগে থেকেই চিনি।ওর সাথে একটা ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো আমার।হয়তো ওর আর আমার বয়স,আচার-ব্যবহার, প্রকৃতি কোনোকিছুই তেমন ম্যাচ করে না।কিন্তু ওর শিশুসুলভ আচরণ,ওর উড়ন্তপনা ওর প্রতি আকৃষ্ট করে আমায়।তাই আমি শ্রেষ্ঠাকে ভালোবেসে ফেলি।শ্রেষ্ঠার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত জলের মতো পরিষ্কার এখনো আমার কাছে,শ্রেষ্ঠার এই অদ্ভুত ব্যবহারে সত্যি বিচলিত না হয়ে কোনো উপায় নেই।এ সত্যি আমার শ্রেষ্ঠা তো,নাকি অন্য কেউ….??
–
–
–
–
দুপুরবেলায় আমি বেডরুমে বসে কিছু অফিসের কাজ করছি।শ্রেষ্ঠা নিচে ড্রয়িং রুমে।কাজ করতে করতে,একটা কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসলো আমার।আমার অফিস থেকে এক কলিগ এসেছে বাসায়,,যদিও ফোন করে আগেই ইনফর্ম করে রেখেছিলো ও আমায়।এমন পরিস্থিতি কাজটা ফেলে যেতেও পারছি না।ও কি বলছে সেটা শোনার চেষ্টা করছি।
—ভাবি, সিধান্ত কোথায়,ওর সাথে একটু দেখা করার ছিলো?
(আমার ডাকনাম সিধান্ত,অফিসে এই নামেই বেশিরভাগ সময় ডাকা হয় আমায়,নিশ্চয়ই ও শ্রেষ্ঠাকে উদ্দেশ্য করে বলছে)
—সিধান্ত,সিধান্ত কে….??(নাম শুনে আকাশ থেকে পড়ার মতো ভাব করে শ্রেষ্ঠার প্রশ্ন)
—আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন ভাবি, এখন বলবেন,নিজের হাসবেন্ডকেই চিনতে পারছেন না।(হাহাহা)
—ও হ্যাঁ,হ্যাঁ,আসলে নামটা মাথায় ছিলো না আমার।আপনি বসুন,আমি ওনাকে ডেকে দিচ্ছি।
—আচ্ছা।ঠিক আছে।
শ্রেষ্ঠা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসতে লাগলো, আবারো একটা খটকা!!আমার ডাকনাম সিধান্ত জামান।অফিসের কলিগসহ অনেকেই এই নামেই ডাকে আমায়।এমনকি বিয়ের আগে শ্রেষ্ঠাও এই নামে ডাকতো।আমার নামটা শুনে এভাবে চিনতে না পারটা এবার সত্যিই আরো বেশী ভাবিয়ে তুলছে আমায়।একটা মানুষ সবকিছু ভুলে যেতে পারে,কিন্তু কারোর নাম… সেটা কিকরে ভুলে যায়?এবার মনে হচ্ছে, টেনশনে মাথা ছিড়ে যাবে আমার।এসব কি হচ্ছে আমার সাথে,একের পর এক জটিল থেকে জটিলতর প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি।যার উত্তর জানা নেই আমার।সকাল বেলা শ্রেষ্ঠার বিয়ের আগের ঘটনাগুলো মনে করতে না পারা,এখন আবার আমার নাম ভুলে যাওয়া, আমি শ্রেষ্ঠার হাসবেন্ড হই।বিয়ের আগেও বহুদিন পরিচয় ছিলো আমাদের। যদিও ওইরকম ঘনিষ্ঠতা ছিলো না আমাদের,শ্রেষ্ঠা এখনো আমাকে আপনি করে ডাকতে অভ্যস্ত।তাই বলে কেউ নিজের স্বামীর নাম ভুলে যায়!!!
ভাবনার রেশ না কাটতেই শ্রেষ্ঠা রুমে ঢুকে পড়লো,আমি ওর সাথে নিচে গেলাম।তারপর কলিগের সাথে কথা বলতে বলতে একটু বাইরে বের হলাম।বাড়ি ফিরতে ফিরতে একটু লেট হলো।ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখি মিছিল বসে বসে মোবাইল ঘাটছে।
—কি হলো,সারাদিন মোবাইল নিয়ে এতো ডুবে থাকলে হবে?তোর ভাবি কোথায়?
—জানি না,
মিছিল বিরক্তিসূচক উত্তর দিয়ে আবারো মোবাইলের দিকে মনোযোগ নিবেশ করে।আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে।
—কি হলো,কি দেখছিস মনোযোগ দিয়ে এতো ?
—একটা গল্প পড়ছি,প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ ভাইয়া ‘proদ্বীপ stories’ নামে একটা নতুন পেইজ খুলেছেন।ওখান থেকেই তার গল্প পড়ছি।
—ও এই কথা,আমি BLACKAUI গ্রুপে তার গল্প পড়েছি।তোকে সময় এড করে দিবো।খুব ভালো একটা গ্রুপ।
—ঠিক আছে,,
—হুম,তা ভাবি কোথায় জানিস না।
—না বললাম তো,,
আমি শ্রেষ্ঠাকে নিচের ফ্লোরে খুঁজে না পেয়ে ওপরে চলে গেলাম।আমার ডাকের সাড়া দিচ্ছে না শ্রেষ্ঠা,কি হলো বুঝতে পারছি না।হঠাৎ দেখতে পাই বাথরুমের দরজাটা ভেতর থেকে লক করা।তার মানে শ্রেষ্ঠা ভেতরেই আছে।কিন্তু ও সাড়া দিচ্ছে না কেন।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বাথরুমের দরজাটা প্রেসার দিতেই ভেতর থেকে শ্রেষ্ঠা বেরিয়ে এলো। আমি হুমড়ি খেয়ে শ্রেষ্ঠার ওপরে গিয়ে পড়লাম, মেঝেতে লুটিয়ে পড়ি দুজনে।শ্রেষ্ঠা গোসল করে বেরোচ্ছিলো,গায়ে একটা টাওয়াল জড়ানো ওর।
শ্রেষ্ঠা আমার নিচে,আর আমি ওর ওপরে।আমার আর শ্রেষ্ঠার চোখ এই মূহুর্তে একই সমান্তরালে অবস্থান করছে।ওর শরীর থেকে সাবান আর শ্যাম্পুর সুগন্ধি নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে আমার।হঠাৎ আমার চোখজোড়া শ্রেষ্ঠার ঘাড়ের পেছনের দিকে যায়।মুহুর্তেই চমকে উঠলাম আমি..!!শ্রেষ্ঠার ঘাড়ের নিচে একটা জন্মদাগ ছিলো,ও নিজেই আমার সাথে এই দাগের কথা শেয়ার করেছে,এমনকি বিয়ের আগে একবার ছেলেমানুষি বশত দেখিয়েওছিলো আমায়।বিয়ের পরে শ্রেষ্ঠার সাথে সেইরকম অন্তরঙ্গতা হয়নি কখনো,ও সবসময় এড়িয়ে চলতো আমায়।আমাদের ভেতরে শারিরীক সম্পর্ক হলেও সেটা জাস্ট অন্ধকার ঘরে দায়সারাভাবে।তাই ওর কোনোকিছুই দৃষ্টিগোচর হয়নি আমার।কিন্তু আজকে এটা কি দেখছি আমি,শ্রেষ্ঠার ঘাড়ের ওপর থেকে জন্মদাগটা গেলো কোথায়!??
আমাকে ঠেলে দিয়ে উঠে পড়লো শ্রেষ্ঠা,তারপরে বাথরুম থেকে দ্রুত প্রস্থান করে।আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে।না এটা আমার শ্রেষ্ঠা হতে পারে না কিছুতেই,,!!!!এই কারণেই এতোটা দূরত্ব!এবার সবকিছু পরিষ্কার হচ্ছে আমার চোখে।আসল শ্রেষ্ঠা সে নয়তো যার সাথে এর আগে দুদুবার পথে দেখা হয়েছে আমার,তার মানে ওরা দুজন এক নয়,সম্পূর্ণ আলাদা সত্ত্বা।আমি যাকে এতোদিন শ্রেষ্ঠা ভেবে আসছি সে শ্রেষ্ঠা নয়,যে আমার বাবার সাথে হাত মিলিয়ে আমার ক্ষতি করতে চাইছে সেই আসল শ্রেষ্ঠা…..!!!!
এটা ভাবতে ভাবতে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো আমার,যদিও আমি জানি না আমার ভাবনা কতোটুকু সত্য,নাকি পুরোটা মনের ভুল….??
চলবে,,,,