#ঐশ্বর্যের_উপাখ্যান
#পর্ব-০৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
গ্রীষ্মের দুপুরে রৌদ্রজ্বল দিনে রুদ্রের হাত ধরে ছোট কন্যা ঐশানীর কলেজে প্রবেশ করলো তটিনী। পিছনে ঐশ্বর্য, ঐতিহ্য ও তুর কথা বলতে বলতে আসছে। ঐশানী সকালেই কলেজে এসেছে। তাকে আপাতত দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। তটিনীর দিকে তাকিয়ে হাসলো রুদ্র। তটিণী ভ্রু কুঁচকে বলল ‘হাসছেন কেন?’
রুদ্র কানে ফিসফিস করে বলল, ‘এই বয়সে এসে ছেলেমেয়ের বয়সী বাচ্চাদের পটাতে এমন সেজে এসেছো নাকি? আমিই তো বারবার কাৎ হচ্ছি!
তটিনী বাহুতে ঘুষি মেরে বলল, ‘ফাজিল।’
রুদ্র হেসে সামনে পা বাড়ালো। তখনই ঐশানীকে দৌড়ে আসতে দেখা গেলো একঝাঁক বন্ধুদের সাথে। তটিনী পিছে পড়ে গেছে। রুদ্রকে সব মেয়েরা ঘিরে ধরলো। বলাবাহুল্য তার মেয়ের বান্ধবীরা আজ প্রথম রুদ্রকে দেখছে। ঐশানী সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা আমার..
‘তোর ভাই?’
ঐশানী হতভম্ব হয়ে জিহ্ব কাটলো। পুনরায় আরেকজন বলল, ‘তোর এমন হট ইয়াং ভাই আছে বলিস নি তো!
তটিনীরা তখন চলে এসেছে। তুর মুখ টিপে হেসে বলল, ‘বললে কি করতেন?’
মেয়েটি নিজের কালার করা চুল গুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘একটা চান্স নিতাম আরকি।
তটিনী দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা তাই নাকি? তাকে এতো পছন্দ হয়েছে আপনার?’
‘অফকোর্স, হি ইজ ভেরি থ্রিলড এন্ড হ্যান্ডসাম বয়!
রুদ্র হতভম্ব! মেয়ের জন্য কলেজে পা রেখে এভাবে বউয়ের চোখে অপরাধী হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি। এমনিতেই তার বউটা সকাল থেকে চটে আছে। কি হবে এবার?’
তটিনী দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি জানেন আমি তার কে হই?’
মেয়েটি ভাবুক স্বরে বলল, ‘কি আর হবেন? হয়তো বোন বা বন্ধু!
তটিনী এবার মারাত্মক রেগে গেলো। রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আরও লাগান চুলে বিদেশি প্রডাক্ট! আরও হ্যান্ডসাম হোন। রূপবতী ভাই আমার!
রুদ্র অসহায় চোখে তাকালো। তটিনী জায়গা ত্যাগ করলো তুরকে সাথে নিয়ে। মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘উনি এমন রেগে গেলেন কেন?’
এবার কথা বলল ঐশ্বর্য, ‘দ্যাট উইমেন্স ইজ দিস হট এন্ড হ্যান্ডসাম বয় কি ওয়ান এন্ড অনলি ওয়াইফ!
মেয়েটি অবাক হয়ে তাকালো। রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হোয়াট!
রুদ্র কিছু না বলে বউয়ের পিছু ছুটলো। ঐশানী মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘শেষ পর্যন্ত তুই আমার মাম্মি পাপার দিকে নজর দিলি? মাম্মি তো এবার মারাত্মক কষ্ট পেয়েছে। তুই বাহিরে ছেলেদের সাথে ফ্লাট করিস কর, কিন্তু আমার পাপার সাথে করবি কেন? তোর বাবার বয়সী সে লুজার গার্ল!
মেয়েটি চোখমুখ অন্ধকার করে তাকালো। দুঃখীত স্বরে বলল, ‘আমি বুঝতে পারিনি ইয়ার।
ঐশানী সেটা কানে তুললো না। সে বাকিদের নিয়ে চলে গেলো। ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্যের সামনে মেয়েটি একা দাড়িয়ে আছে। ঐশ্বর্য হাত গুটাতে গুটাতে বলল, ‘কি যেনো বলছিলে?’
মেয়ে ভয় পেয়ে বলল, ‘স্যরি আপু আমি বুঝতে পারিনি।’
ঐতিহ্য এগিয়ে এসে বলল, ‘আর করবে ছেলেদের সাথে ফ্লাট?’
মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে না করে দৌড় দিলো গেইটের দিকে। ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্য একসাথে হু হা করে হেসে উঠলো। ঠিক তখনই গেইট দিয়ে ঢুকলো দুটো টয়েটো কার। ঐশ্বর্য সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মঞ্চের দিকে চলে গেলো।
*
অনল শিকদারের কার কলেজের গেইট দিয়ে ঢুকতেই হুলস্থুল পড়ে গেলো। পুরো কলেজের স্টুডেন্ট ভীড় জমালো গেইটের কাছে। গাড়ি পার্ক করার পর গাড়ি থেকে বের হলো অনল শিকদার। উঁহু আর সব নেতাদের মতো মুজিব কোর্টে নয়! কালো শার্ট ও ডেনিম প্যান্ট পড়োনে। হাতে কালো কোর্ট ক্যারি করে চোখে রোদচশমা পড়ে গটগট করে হেঁটে আসছে সে। পাশ দিয়ে আসছে দুজন সিকিউরিটি। মঞ্চের দিকে আসতেই দুজন ছাত্রী ফুল দিয়ে আমন্ত্রণ জানালো। প্রিন্সিপাল স্যার ফুলের মালা গলায় পড়িয়ে দিলেন। ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত সমস্ত ছেলেরা চিল্লিয়ে বলতে লাগলো,-
‘আমার ভাই তোমার ভাই
অনল ভাই অনল ভাই!
আমার নেতা তোমার নেতা
অনল শিকদার অনল শিকদার।’
‘অনল শিকদার মঞ্চের সামনের চেয়ারের মধ্যে একটিতে বসলেন। সাইডে বসা কলেজের স্যার-ম্যামরা।
প্রিন্সিপাল স্যারের কানে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ক স্যার ফিসফিস করে বললেন, ‘কি যুগ আসলো। আগে নেতারা মুজিব কোর্ট পড়ে চলাফেরা করতেন। আর এখন!
প্রিন্সিপাল গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘আগের যুগ আর নেই। এখন ২০৪৫ সাল, সবকিছু পাল্টে গেছে। নেতারা মুজিব কোর্ট পড়বে না কেন? পড়ে তবে সবসময় না। এখানে তো আর ভাষণ দিতে তাকে ডাকা হয়নি। আমন্ত্রণ জানানে হয়েছে প্রধান অতিথি হিসাবে। সে ছাত্র ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কথা বলবে। রাজনীতি নিয়ে নয়!
ফিসফাস বন্ধ হলো। অনুষ্ঠানে উপস্থাপকের কাজ করছেন এই কলেজেরই একজন ম্যাম। তিনি মাইক হাতে নিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলেন। একে একে সবাই নিজেদের পারফরমেন্স করতে লাগলো। রুদ্র ও তটিণী বসেছে দ্বিতীয় সারির চেয়ারে। তুর, ঐতিহ্য সবাইকে দেখা গেলেও ঐশ্বর্যকে দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য এখন দেখা যাবেও না। তাকে ঐশানী জরুরি দরকারে নিয়ে গেছে।
একেক জনের পারফরম্যান্সের পর একেকজন ব্যক্তব্য দিচ্ছেন। পঞ্চম জনের ব্যক্তব্যের পর আসলো ঐশানীর গান গাওয়ার পালা। মাইকে ঐশানীর নাম ঘোষণা করতেই ধুতিশাড়ি পড়া ঐশানীকে গ্যালারিতে দেখানো হলো। অসম্ভব মায়াবতী মেয়েটি মঞ্চে উঠে প্রথমে সবার দিকে তাকিয়ে নিজের গ্যাঁজ দাঁত বের করে হাসলো। চোখের চশমা ঠিক করে গান গাওয়ার প্রস্তুতি নিলো।
দু মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন ঐশানী গান গাইলো না তখন সবার ফিসফাস করা শুরু হলো। ঐশানী বারবার চারিদিকে তাকাচ্ছে। উপস্থাপিকা ম্যাম মাইক হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এনি প্রব্লেম?’
‘হ্যাঁ ম্যাম। আপ্পিকে ছাড়া গাইতে পারবো না। কারণ আপ্পি ভায়োলেন বাজাবে।’
ঠিক তখনই দেখা গেলো ঐশ্বর্যকে। ভায়োলেন হাতে নিয়ে মঞ্চের উপরে উঠে এসেছে সে। মুহুর্তের মধ্যে সবার নজর কেড়ে নিলো ঐশ্বর্য। কেউ একবার অনলের দিকে তাকাচ্ছে তো কেউ ঐশ্বর্যের দিকে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন দুদিন আগে যে দুজনকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠলো সেই দু’জনই আজ সামনাসামনি। কিন্তু কতো নির্লিপ্ত!
রুদ্র ও তটিণী অল দ্যা বেস্ট জানালো। ঐশ্বর্য মঞ্চের পেছনে চলে গেলো। সেখান থেকেই ভেসে আসতে লাগলো ভায়োলেনের সুমধুর স্বর। তার তালে তালে গান গাইতে লাগলো ঐশানী। ভায়োলেনের স্বর যেনো সবাইকে বশ করে নিয়েছে। সবার মধ্যে এক ধরনের নিস্তব্ধতা। অনল শিকদার চোখ থেকে রোদ চশমা খুলে নিলেন। গান শেষ হতেই ঐশ্বর্য মঞ্চে উঠে আসলো। অনলের সাথে চোখাচোখি হতেই দেখতে পেলো নেতা সাহেবের ঠোঁটের কোণে উঁকি দিচ্ছে এক ঝলক হাসি। যা নিমিষেই মিলিয়ে গেলো। ঐশ্বর্য মঞ্চ থেকে নেমে গেলো। স্যার ম্যামরা ঐশানীর গানের প্রশংসা করলেন। সাথে ঐশ্বর্যের অসম্ভব সুন্দর ভায়োলেন বাজানোর ও।
রুদ্রকে মেসেজ দিয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলো ঐশ্বর্য। তার প্রচুর হাসফাস লাগছে। অনল শিকদারকে চোখের সামনে দেখে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। যার সামনে কখনো পড়তে চায় না তার সামনেই তাকে পড়তে হচ্ছে বার-বার। এ কেমন নিয়তি?’
ঐশানীর গান শেষ হতেই ব্যক্তব্য রাখেলন অনল শিকদার। ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলেই সংক্ষিপ্ত ভাবে ব্যক্তব শেষ করলেন তিনি। তার ব্যক্তব্যের পরই অনুষ্ঠান শেষ। সম্বর্ধনা জানিয়ে অনল শিকদারকে সম্মানের সাথে বিদায় দিলো পুরো কলেজ চত্বর। মোড়ে ঐশ্বর্যের গাড়ি দাড় করানো। অনল শিকদারের টয়েটো গাড়ি তার গাড়িকে অতিক্রম করে গেলো। ঐশ্বর্য স্পষ্ট দেখতে পেলো গাড়ির কাচ নামিয়ে অনল শিকদার তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে চলে গেলো।
এসব কিসের ইঙ্গিত? বুঝতে পারে না ঐশ্বর্য।
শুধু সে জানে অনল শিকদার আর যাই হোক তাকে অন্তত পছন্দ করবে না। যেখানে অল্প বয়সী সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়েরা এর জন্য পাগল, সেখানে তার মতো সাতাশ বছরের তরুণীর চান্স পাওয়া তো বড়োই দুষ্কর।
(চলবে)