ঐশ্বর্যের উপাখ্যান পর্ব-০৪

0
604

#ঐশ্বর্যের_উপাখ্যান
#পর্ব-০৪
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

দরজার সামনে অগ্নিশর্মা হয়ে দাড়িয়ে আছে তটিনী। ঐশানী ভয়ে কুঁকড়ে তুরের এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ঐশ্বর্য ঐতিহ্যের কাঁধে ভর দিয়ে দাড়িয়ে আছে। তটিনী অর্ধ হুশ হীন ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার এতোটা অধঃপতন ঘটছে ভাবতে পারিনি। আমি সবাইকে বড়ো মুখ করে বলতাম, আমার ছেলেমেয়েরা আর যাই হোক কখনো নেশা করেনা! কিন্তু তুমি? যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলছো। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা কি খুব জরুরি ঐশ্বর্য?’ জড়ানো গলায় ঐশ্বর্য বলল, ‘এটা ২০৪৫ সাল মাম্মি। এখন সবাই এগুলো…

ঐশ্বর্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই তটিনী থাপ্পড় বসালো। ঐশ্বর্য মেঝেতে ঢলে পড়ে গেলো। বাকি তিনজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমরাও কি তার মতো ওসব গিলে এসেছো?’

ঐতিহ্য ও ঐশানী দ্রুত মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। কাঁদো কাঁদো স্বরে ঐশানী বলল, ‘আমি কখনোই ওসব খাবো না মাম্মি। ওসবে যাবো ও না।’

ঐতিহ্যও গলা মিলিয়ে বলল, ‘কখনো যাবো না মাম্মি।’

‘দুজন নিজেদের ঘরে যাও, আর তোমাদের মাতাল আপ্পিকেও নিয়ে যাও।’

ঐশানী ও ঐতিহ্য তাদের আপ্পিকে ধরে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। বাঘিনীর সামনে একা দাড়িয়ে আছে তুর। হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘বড়ো মা..

‘তুমি ঐশ্বর্যের সবসময়ের সঙ্গী তুর। অফিস টাইম ছাড়া ও সবসময়ই তোমার সাথে ঘুরাফেরা করে। ও আগে থেকে ড্রিংক করে রাইট?’

তটিনীর কর্কশভাবে করা প্রশ্নে তুর ঘাবড়ে গেলো। কিন্তু সত্যি না বলে উপায় নেই। অগত্যা স্বীকার করলো, ‘হ্যাঁ।’

তটিনী দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, ‘তুমি নিজেও ওর সাথে ড্রিংক করো?’

তুর তড়িঘড়ি করে মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘না বড়োমা আমি কখনো করিনি।’

‘তাহলে ওর সাথে যেতে কেন?’

তুরের চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। বেচারি ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে বলল, ‘আমি ওকে সবসময়ই মানা করতাম। ও ড্রিংক করতো তবে ততোটা না যতোটা করলে নেশা হয়ে যায়। কখনো যদি নেশা হয় তো আমি ম্যানেজ করে নিতাম।’ ঐশ্বর্য এজন্যই আমাকে সবসময়ই নিজের সঙ্গে রাখতো।’

তটিনী হাত তালি দিয়ে বলল, ‘বাহ্ তালিয়া! কি মহৎ কাজ করে বেড়াচ্ছো তুমি। তোমার মা বাবাকে তো তোমার এরকম মহৎ কাজ সম্পর্কে জানানো উচিত। তারা অভিভাবক তাদেরও তোমার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানার রাইট আছে তাই না?’

তুর কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘আর হবেনা এরকম বড়ো মা। প্লিজ মা বাবাকে বলো না, প্লিজ!

তটিনী গম্ভীর স্বরে বলল, ‘তোমার পার্টনারের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আজ সবার খাওয়া বন্ধ!’

তুর তড়িৎ গতিতে জায়গা ত্যাগ করলো। তটিণী রাগে গজগজ করতে করতে রুমে ঢুকলো। রুদ্র তখনও বাসায় ফেরেনি। এই একটা মানুষ ছাড়া তাকে কেউ সামলাতে পারে না। রাত দশটার পর রুদ্র বাড়িতে আগমন করলো। আজ অনেক ধকল গিয়েছে বেচারার উপর। ক্লান্ত মুখ দেখে তটিনী কিছু বলতে পারলো না। মানুষটা জানলে নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পাবে?’

রাতে খাবার টেবিলে ছেলেমেয়েদের না দেখতে পেয়ে অবাক হলো রুদ্র। প্লেট সামনে নিয়ে অপেক্ষা করলো। কিন্তু না তার সন্তানেরা আজ খাবার টেবিলের ছায়াও মারালো না। তটিনী পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলল, ‘ওরা বাহিরে থেকে ঘুরেফিরে খেয়ে এসেছে। আপনি খেয়ে নিন।’

‘তুমি খেয়েছো?’

‘না!

অগত্যা রুদ্র প্লেটে বেশি করে ভাত নিলো। চেয়ার টেনে তটিনীকে বসিয়ে দিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলো। তটিনী খাবার চিবাতে চিবাতে স্বামীর কাঁধে দুহাত রাখলো। কাঁধে মাথা রেখে বলল, ‘এতো ভালোবাসেন কেন?’

রুদ্র হেসে বলল, ‘তুমি ভালোবাসো বলে আমিও ভালোবাসি ঐশি।’

‘আপনি একদম পাল্টাননি রুদ্র ভাই!’

রুদ্র খাবার চিবাতে পারলো না। তার গলায় খাবার আটকে গেলো। কাশতে কাশতে নাজেহাল অবস্থা হলো। তটিনী পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে সেটা পান করলো। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘প্লিজ! ছেলেমেয়ে বড়ো হয়ে গেছে। এবার তো ভাই ডাকা বন্ধ করো!

তটিনী খিলখিল করে হেসে বলল, ‘আমি তো ইচ্ছে করে ডাকি মাঝে মধ্যে। আমাদের প্রণয়ের শুরুর কথা মনে পড়ে? তখনের সময় গুলো কতো সুন্দর ছিলো তাই না?

রুদ্র পুনরায় খাবার মুখে তুলে দিয়ে বলল, ‘এখন কি সুন্দর নয়?’

‘সুন্দর, তবে আগের মতো আমরা আর নেই। কয়েকদিন পর মেয়ে বিয়ে দিয়ে বুড়ো হয়ে যাবো।’

রুদ্র বলল, ‘যে সময়ে যেটা মানায়। আমাদের শরীর ফুরিয়ে যাবে। যৌবন শেষ হবে। চামড়া কুঁচকে যাবে। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা বেঁচে থাকবে। ভালোবাসা কখনোই ম*রে না আমার বোকা ঐশি!

খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে উঠে পড়লো রুদ্র। রুমের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘জলতি আসো আ’ম ওয়েটিং ফর ইউ বেবি!’

তটিনী মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘বুড়ো বয়সে ভীমরতি!

রাত গভীর থেকে গভীর হলো। তটিনী ভালবাসার চাদরে মুড়িয়ে গেলো সবসময়ের মতো। রুদ্র চোখ বন্ধ করার আগে ফিসফিস করে বলল, ‘ঐশি? আমার ভালোবাসাময় সুন্দরী বউ! তুমি সবসময়ই আমার কাছে সুন্দরী থাকবে।’

*
সকালে সব ঠিকঠাক। ঐশ্বর্যের রাতের কথা তেমন মনে নেই। তুরের থেকে সবকিছু শুনে সে নিজে হতভম্ব হয়ে গেলো। তওবা করলো জীবনে আর কখনো ওসব ছুয়ে দেখবে না। নাস্তার টেবিলে বসে ফিসফাস করতে লাগলো চারজন। আলোচনার বিষয় কিভাবে তটিণী-র কাছে ক্ষমা চাইবে ঐশ্বর্য?’

রুদ্র অফিসিয়াল পোশাকে তৈরি হয়ে টেবিলে বসলো। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে গুড মর্নিং বললো। তুরকে দেখে বলল, ‘মামনি দিনকাল কেমন যাচ্ছে?

তুর হেসে বলল, ‘ফাস্ট ক্লাস ইয়াং ম্যান!

রুদ্র চুলে হাত ভুলিয়ে হাসলো। তটিনী আড়চোখে নিজের স্বামীকে দেখে নিলো। চুলে বিদেশি প্রডাক্ট ইউজ করার কারণে রুদ্রের চুল বরাবরের মতোই কালো। থাকবে না কেন? মাথায় একটাও সাদা চুল কারো চোখে পড়ার আগে রুদ্র চুলে বিদেশি প্রডাক্ট ইউজ করে। তাও জেন্স পার্লারে গিয়ে। ভাবা যায় এসব!

ঐশানী বলল, ‘আজ কলেজে অনুষ্ঠান পাপা। তোমরা যাবে না?’

রুদ্র খেতে খেতে উত্তর দিলো, ‘অফকোর্স! কেন নয়?’

ঐশানী উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘কে কে যাবে তাহলে?’

রুদ্র খেতে খেতে জবাব দিলো, ‘আমরা সবাই!

ঐশানী হাত তালি দিয়ে বলল, ‘অনেক মজা হবে। জানো পাপা আমি গান করবো! আপ্পির থেকে যে গানটা শিখেছিলাম কয়েকদিন আগে? ওটা।

রুদ্র মেয়ের মাথায় হাত ভুলিয়ে দিলো। ‘কনগ্রেচুলেশন বেটা।’

তটিনী জেলি লাগাতে লাগাতে বলল,, ‘আপনার না অফিস?’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তো? দু ঘন্টার ভিতরে অফিস থেকে ফিরবো। তারপর একসাথে আমার মামনির কলেজে যাবো। হবে তো?’

ঐশানী হাত তালি দিয়ে বলল, ‘খুব হবে।’

তটিনী মুচকি হেসে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। এই লোকটার দিকে তাকানো যাবে না। দেখা যাবে ছেলেমেয়েদের সামনে কোনো অকাজ করে বসবে। হলোও তাই। তটিনীর চোখে চোখ পড়তেই রুদ্র চোখ মারলো সবার আড়ালে। ‘

তটিনী লজ্জায় লাল হয়ে গেলো সেই প্রেম হওয়ার সময় যেরকম ভাবে হয়েছিল। লজ্জায় লাল হওয়া তটিণী-র লজ্জা বাড়িয়ে দিতে রুদ্র ছেলেমেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘বাচ্চারা? তোমাদের মা ও আমার প্রেম কিভাবে হয়েছিল জানো?’

ঐশ্বর্য তুমুল আগ্রহ দেখালো, ‘কিভাবে পাপা?’

সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। রুদ্র টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে বলল, ‘তোমাদের মা আমার প্রেমে পড়েছিল উপন্যাস পড়ে। তাই না ঐশি?’

তটিনী আচমকা কিছু মনে পড়তেই রেগে বলল, ‘আপনি সে-ই ব্যক্তি যে আমার উপন্যাসের বই ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। মনে আছে সব আমার। বদলোক কোথাকার!

রুদ্র অবাক হয়ে বললো ‘সব ছেড়ে তোমার এটা মনে পড়লো? আরে আমাদের প্রেম কিভাবে হয়েছিল সেটা ওদের বলো!

তটিনী চোখে কৌতুক নিয়ে তাকালো। হালকা হেসে বলল, ‘বাচ্চারা তোমাদের বাবার নাম আমার ফোনে ‘বায়ুদূষণকারী রুদ্র ভাই’ নামে সেভ করার মাধ্যমে আমাদের প্রেম হয়েছিল!

রুদ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। সে ভাবতে পারেনি তার এতো সুন্দরী আহ্লাদী বউ তাকে এভাবে বাঁশ দিবে! ঐশ্বর্যসহ বাকিরা মুখ টিপে হাসছে। রুদ্র চটজলদি বের হয়ে গেলো। ছেলেমেয়েদের সামনে এমন অপমান মানা যাচ্ছে না। গাড়িতে বসে নিজের বাঁশময়ী বউয়ের ফোন বার্তা পাঠালো, ‘তোমাকে আমি দেখে নিবো সুন্দরী!’

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে