#ঐশ্বর্যের_উপাখ্যান
#পর্ব-০৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
দুপুরের পর একজোট হলো চারজন। তুর ঐশ্বর্যের বাবার বন্ধুর মেয়ে। পরিচয় না দিলে যারা চিনেনা তারা বোনই মনে করে। তাছাড়া তুর রুদ্রকে বড়ো বাবা ও তটিনীকে বড়ো মা বলে ডাকে।
সাদা কলেজ ড্রেসে আবরিত ঐশানী বেনী দুলিয়ে হেঁটে চলেছে ভাইয়ের হাত ধরে। ঐতিহ্য বোনের চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে মুছে আবার পড়িয়ে দিলো। ঐশানী হেসে ভাইয়ের হাত জড়িয়ে ধরলো।
গাড়ি অফিসে রেখে এসেছে ঐশ্বর্য। তারা চারজন এবার দুপুরের খাবার খাবে একটি রেস্টুরেন্টে। খাবার খেতে বসে কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে ঐশানী বলল, ‘তোমাকে তো বলাই হয়নি আগামীকাল আমাদের কলেজে অনুষ্ঠান আছে। সেখানে অনল শিকদার আসবে।
ঐশ্বর্য খাবার খেতে খেতে বলল, ‘তো?’
ঐশানী অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি খুশি হওনি?’
‘দেখ সে কোথায় গেলো নাকি গেলে না সেটা খুঁজ রাখার দায়িত্ব আমার না। আর না আমি তার এমন কেউ লাগি।’
‘তুমি তাকে পছন্দ করো না?’
ঐশ্বর্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘পছন্দ করলেই যে পিছনে ঘুরতে হবে তার কোনো মানে নেই। আমার তাকে পছন্দ ছিলো বলেছি। এবার তাকে পাবো কি না বা সে আমাকে পছন্দ করে না সেটা তার বিষয়। সবসময়ই যে ভালোবাসা বা পছন্দ দুপাক্ষিক হবে এমন কোনো মানে নেই ঐশানী।
তুর খাবার চিবাতে চিবাতে বলল, ‘সে যদি বিয়ে করে নেয় তোর কষ্ট হবে না?’
ঐশ্বর্য চমৎকার করে হেসে বলল, ‘কষ্ট হবে কেন? ভালোবাসার মানুষ তার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে সুখে থাকবে। আমি তো অনেক খুশি হবো।’
তুর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘দীর্ঘ পাঁচ বছর একটা মানুষকে ভালোবেসে একা কাটাচ্ছিস। অথচ সে কখনো তোর দিকে চেয়েও দেখেনি। অনেক তো হলো এবার নিজের কথা একটু ভাব না।’
ঐশ্বর্য জবাব দিলো না। তুর জানে কোনো জবাব আসবে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ঐতিহ্য বলল, ‘একটা মেয়েকে দেখে ক্রাশ খেয়েছি আপ্পি। পটাবো কেমনে?’
‘তুই যার উপর ক্রাশ খেয়েছিস তারও ক্রাশ আছে গিয়ে দেখ।’
তুরের মাথায় চাপড় মেরে ঐতিহ্য বলল, ‘নেই, তার বিষয়ে আমি সব জেনে নিয়েছি।’
তুর মাথায় হাতে রেখে বলল, ‘বাহ ভালো তো।’
হ্যাঁ সবাই তোর মতো না, যে অনল শিকদারের পিছে দৌড়াদৌড়ি করবে।’
‘আমি অনল শিকদারের পিছে দৌড়াদৌড়ি করি?’
ঐতিহ্য ভাব নিয়ে বলল, ‘তা নয়তো কি? তুই আপ্পির সাথে অনল শিকদারের পিছে দৌড়াদৌড়ি করিস না?’
তুর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘দৌড়াদৌড়ি করলেও পাত্তা পাবো না, পেলে ঐশ্বর্য পেতে পারে। আমার কোনো চান্স নেই।’
ঐতিহ্য হেসে বলল, ‘সমবেদনা ডেয়ার।
ঐশ্বর্য বিরক্ত হয়ে বলল, ‘চুপ কর। অন্য কিছু নিয়ে কথা বল।
খাওয়া শেষ করে চারজন রিকশা নিলো। চিরপরিচিত জলাশয়ের কাছে পৌছালো। জলাশয়টা অনেক ছোট। পদ্মফুলে ভরপুর জলাশয়টা চারজনের অনেক প্রিয়। কারে মন খারাপ হলে কাউকে খুঁজে বের করতে হয়না। কারণ তাদের চারজনেরই মন খারাপ থাকলে এখানে এসে বসে থাকে। যা তাদের মা বাবা থেকে শুরু করে পুরো গোষ্ঠী জানে।
জলাশয়ের জলে পা ভিজিয়ে বসলো চারজন। ঐশ্বর্য জলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে জানেনা তার ভবিষ্যতে কি অপেক্ষা করছে। অনল শিকদারকে ছাড়া হয়তো সে মরে যাবে না। কিন্তু অনুভুতি মরে যাবে হয়তো। এতোটা ডুবে যাবে সে নিজেও জানতো না। মানুষটার সাথে তার কখনো সামনাসামনি কথা হয়নি। চোখে চোখ পড়েনি কখনো। গতকালই তাদের প্রথম কথা হলো। অনল শিকদার যদি একবার বুঝতে পারতেন একজন বাবার রাজকন্যা কি নিদারুণ দুঃখ পুষে চলেছে বছরের পর বছর, শুধু তারই জন্য! বুকে ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে আছে একটি ইশারার।
*
সন্ধ্যার দিকে চারজন অফিস থেকে গাড়ি করে বারে পৌঁছালো। রঙ বেরঙের আলোয় একে অপরের সাথে ডান্স করতে লাগলো। কেউ এখানে আসে আনন্দ করতে। কেউ আসে দুঃখ ভুলে থাকতে। কেউ বা অভ্যাস বসত।
লাল পানি গলায় ঢেলে ঐশ্বর্য থম মেরে বসে রইলো। মাথা ঝিমঝিম করছে। সে মাতাল হয়নি। কিন্তু আরেকটু গিললেই হয়ে যাবে। অগত্যা ঐশ্বর্য ড্রিংক রেখে দিলো। হেলেদুলে দাড়িয়ে নাচতে লাগলো গানের তালে তালে।
বারে মানুষের অভাব নেই। নাচতে নাচতে কোমড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কারো স্পর্শ পেয়ে থমকে গেলো ঐশ্বর্য। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে হাতের মালিকের দিকে তাকালো।
হুডি পড়ার কারণে মুখ অস্পষ্ট। ঐশ্বর্য মুখ দেখতে চেষ্টা করতেই হাতের মালিকটি ঐশ্বর্যের হাত টেনে বাহিরে নিয়ে যেতে লাগলো। ঐশানী, ঐতিহ্য ও তুর তখন ডান্সে মগ্ন। হুডি পড়া ব্যক্তিটি বাহিরে এসে থামলো। ভিতরের থেকে বাহিরে আরও অন্ধকার বিরাজ করছে। সোডিয়ামের আলো এদিকে নেই বললেই চলে। ব্যক্তিটি হুডি মাথা থেকে ফেলে দিলো। অন্ধকারের জন্য মুখ দেখতে পারছে না ঐশ্বর্য। ব্যক্তিটা ধীরে ধীরে ঐশ্বর্যের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিলো। ঝিমঝিম ভাব থেকে তখন নেশা হয়ে গেছে। ঐশ্বর্য চোখে দুটো করে দেখতে লাগলো। ব্যক্তিটি বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘এতো পাগলামি? কবে থেকে এতো ভালোবাসলে?’
ঐশ্বর্য জবাব দিতে পারলো না। ব্যক্তিটি কপালে দীর্ঘ চুম্বন করলো৷ কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আর কখনো ড্রিংক করবে না। আমি কিন্তু অনেক রাগ করবো, হুম?’
ঐশ্বর্য জড়িয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘হু আর ইউ ম্যান?’
ব্যক্তিটি হেসে বলল, ‘জেনে যাবে খুব শীগ্রই।
ঐশ্বর্যকে গাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে ব্যক্তিটি ঐশ্বর্যের ঘড়িতে চাপ দিলো। লক খুলে কানেক্টে হলো ঐতিহ্যের সাথে। সাথে সাথে আবার ডিসকানেকটেড করে দিলো। হঠাৎ করে ঐশ্বর্যের কল পেয়ে ঐতিহ্য তুর ও ঐশানীকে নিয়ে বের হয়ে আসলো। বারে না পেয়েই মূলত বের হয়ে এসেছে তারা। গাড়িতে ঐশ্বর্যকে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো তিনজন। ঐতিহ্য ড্রাইভ করতে লাগলো। তুর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঐশ্বর্যকে ধরে বসে আছে। ঐশানী ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘আপ্পির তো পুরো নেশা হয়ে গেছে। মাম্মি জানতে পারলে মে*রেই ফেলবে।’
ঐতিহ্য মৃদু ধমক দিয়ে বলল, ‘চুপ কর। আমরা কি জানতাম আপ্পি ওসব খাবে? কখনো তো খায় না।
তুর মনে মনে বলল, ‘হাঁদারাম! তোর বোন তোর সামনে খায় না বলে কি কখনো খায়নি? আমার সাথে যখন যায় তখন তো দেদারসে গিলে। শালী নিজেও দেবদাসী হচ্ছে, সাথে আমাকেও বানাচ্ছে!
তুরের মনের কথা কেউ শুনলো না। কিন্তু ঐতিহ্য গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, ‘তুই কি আমাকে গালি দিচ্ছিস?’
তুর হতভম্ব হয়ে বলল, ‘কখন দিলাম?
ঐতিহ্য লুকিং গ্লাসে এক পলক তাকিয়ে বলল, ‘তোর মুখের রিয়েকশন দেখে মনে হচ্ছে।’
ঐশানী চোখের চশমা ঠিক করে বলল, ‘দেখে গাড়ি চালাও ব্রো, আজ কপালে শনি রবি মঙ্গল সব আছে।
ঠিক তখনই ঐশানীর মুঠোফোন বেজে উঠলো। স্কিনে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘মাম্মি কল দিয়া ব্রো।’
ঐতিহ্য কল লাউডে দিতে বলল। কল লাউডে দিতেই অপাশ থেকে ভেসে এলো তটিণী-র চিন্তিত স্বর, ‘কোথায় তোরা? সবকটা একসাথে কিসের পার্টি করছিস? তিশাপু কল দিচ্ছে বার-বার। তুর তোদের সাথে তো?’
ঐশানী মিনমিন স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ মা আপুও আমাদের সাথে। আমরা প্রায় চলে এসেছি। তুমি চিন্তা করো না।
ফোন রেখে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ঐশানী। তাদের গাড়িকে ওভারটেক করে গেলো একটি কালো টয়েটো কার। কারে বসা ব্যক্তিটি মনে মনে হেসে বলল, ‘তুমি অনেক বোকা ঐশ্বর্য। নাহলে কি এমন করো? এতো পাগল কেন তুমি? তোমার পাগলামি বাড়ুক, কিন্তু সেটা আমার সামনে। সবার সামনে তোমার অসম্মান আমি মানতে পারি না ঐশ্বর্য। খুব শীগ্রই তোমার যতটুকু অসম্মান হয়েছে তা ফেরত পাবে। আমি কথা দিলাম!
(চলবে)