#ঐশ্বর্যের_উপাখ্যান
#পর্ব-০২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
ভোরের আলো ফুটে গেছে। নামাজ পড়ে তটিনী নিজের কন্যার রুমের দিকে অগ্রসর হলো। ঐশ্বর্য তখন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছে। তটিনী দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। মেয়ে বড়ো হয়েছে কিন্তু আজও দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে শিখেনি। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলো তটিনী। গতকাল অনেক রেগে গেছিলো সে। কি বলতে কি বলেছে মনে নেই। মেয়েটা নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে! তটিনী জানে তার মেয়ে সব বুঝে। যা করে বুঝেশুনে করে। কিন্তু সমাজের কথাও আমাদের ভাবতে হয়। মেয়েটা বিয়ে করছে না। ভালো পরিবারের সন্তান সেজন্য অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসে। ওইরকম একটা ঘটনা নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর আর কি ভালো পাত্রের খুঁজ পাবে তারা?
তটিনীর ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ঐশ্বর্য ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, ‘মাথায় হাত ভুলিয়ে দাও মাম্মি।
তটিনী হাত ভুলিয়ে দিতে দিতে মেয়ের কপালে চুমু খেলো। বলল, ‘অফিসে যাবে না আজ?’
ঐশ্বর্য লাফিয়ে উঠে বসলো। তটিনী হেসে বলল, ‘ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও। নাস্তার টেবিলে তোমার পাপা অপেক্ষা করছেন।’
ঐশ্বর্য মাথা নাড়িয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো। তটিনী মেয়ের রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ডাইনিং টেবিলে তখন তার দুই সন্তান ও স্বামী অপেক্ষায় বসে আছে।
তটিনীকে আসতে দেখেই রুদ্র এক পলক তাকালো। নারীটির বয়স বেড়েছে। চামড়ায় ভাজ পড়েছে। কিন্তু আজও তার কাছে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। এই অদ্ভুত সুন্দর লাগাটা হয়তো ভালোবাসা!
বাটার খেতে খেতে ঐশানী চোখের চশমা ঠিক করে বলল, ‘আপ্পি কোথায় মাম্মি?’
তটিনী মেয়ের পাশে বসে বলল, ‘ফ্রেশ হয়ে আসছে।’
ঐতিহ্যকে তখন হেলেদুলে আসতে দেখা গেলো। কানের হেডফোন গলায় ফেলে দিয়ে ‘গুড মর্নিং’ বলে রুদ্রের পাশে বসে গেলো। তটিনী বাচ্চা ও স্বামীর প্লেটে নাস্তা তুলে দিতে লাগলো। রুদ্র নিজের প্লেট থেকে প্রথমে একটু খাইয়ে দিলো তার ছোট রাজকন্যা ‘ঐশানী ইরফানকে। তারপর খাওয়ালো ‘ঐতিহ্য ইরফানকে। তখনই বাবার অপর পাশে এসে বসলো ঐশ্বর্য। রুদ্র হেসে নিজের বড়ো রাজকন্যার মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিলো। তটিনী তখন ঐশ্বর্যের প্লেটে নাস্তা তুলে দিতে ব্যস্ত। রুদ্র উঠে গিয়ে নিজের বউয়ের মুখে নাস্তা তুলে দিলো।
এইতো এটাই তাদের পরিবার। আর এই দৃশ্যটা তাদের বাড়ির প্রতিদিনের দৃশ্য। তটিনী সবাইকে নাস্তা দিয়ে নিজেও বসে পড়লো। প্লেটে খাবার নিতে গিয়ে তার মনে পড়লো তিনজন মানুষকে।
বউয়ের মন খারাপ দেখে রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কি হলো?’
তটিনী মন খারাপ করে বলল, ‘মা-বাবা কবে আসবেন বলুন তো?
রুদ্র মুচকি হাসলো। খাবার চিবাতে চিবাতে বলল, ‘রাজের বউয়ের ডেলিভারির পর আসবেন।’
তটিনী মুখ গুমড়া করে বলল, ‘একেক জন একেক জায়গায়! সবাই একসাথে থাকলে ভালো হতো। রাজটাও না চাকরি নিয়েছে তো নিয়েছে তাও চট্টগ্রামে! আপনার ব্যবসাতে ওরে ঢুকিয়ে দিন। নিজেদের ব্যবসা থাকতে পরের হসপিটালে চাকরি করবে কেন?’
রুদ্র পানি পান করে জবাব দিল, ‘তোমার আদরের দেবর সেটা মানলে তো। তিনি চাকরি করবেন নিজের যোগ্যতায়। তারপর শখ মিটে গেলে ব্যবসাতে আসবেন কি না ভেবে দেখবেন।
*
রাজ ইরফান। বিয়ের পনেরো বছর পর বাবা হচ্ছে। প্রব্লেম কারোরই ছিল না। সেজন্য ডাক্তার বলেছিলেন ধৈর্য ধরতে। সেই ধৈর্যের পর আরও কয়েকটা দিন। তারপর বাবা হওয়ার খুশি লাভ করতে চলেছে তারা।
তুরফান ইফফাত ঐক্য! তটিনীর একমাত্র ছোট্ট ভাইটি আজ দুই সন্তানের পিতা। ছেলের বয়স বারো ও মেয়ের বয়স আট। আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে ঈশানী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান। তুরফান আজও নিজের কাছে তার মায়ের লেখা সেই ডায়েরি যত্ন করে রেখে দিয়েছে। মায়ের বয়স হয়েছিল। সেজন্য চলে গেছেন। মনকে বুঝ দিতে পারলেও মাঝে মধ্যে মানতে পারে না তুরফান। আল্লাহ আরও কিছু দিন তার মাকে বাচিয়ে রাখলে পারতেন।
কারো মৃত্যুর উপর আমাদের হাত থাকে না। সবাইকেই একদিন চলে যেতে হয়। কেউ কারো জন্য থেকে যায় না, কখনো না!
ঢাকার একটি হসপিটালে ডাক্তার হিসেবে কর্মরত তুরফান। তার সংসার চলে যাচ্ছে এভাবেই। রাজও চট্টগ্রামের একটি হসপিটালে ডাক্তার হিসবে কর্মরত। দু’জন একসাথে বড়ো হয়েছে। একসাথে পড়েছে। আজ দুজনেই ডাক্তার দুই শহরের।
*
ঐশ্বর্য অফিসিয়াল ড্রেসে নিজেকে আবরিত করে নিলো। সাদা শার্ট ও কালো প্যান্টে একজন বিজনেস উইমেন্স লাগছে। অবশ্য সে একজন সফল বিজনেস উইমেন্স!
হাইহিল পড়ে নিয়ে হাতে কোর্ট নিয়ে হ্যান্ড ব্যাগ ক্যারি করে গাড়িতে বসলো ঐশ্বর্য। সে নিজেই ড্রাইভিং করতে পারে। তার পাপা অনেক আগেই বের হয়ে গেছেন অফিসের উদ্দেশ্যে। আজ বিশেষ একটা মিটিং রয়েছে দশটার দিকে। সেজন্য তাড়াহুড়ো না করে ধীরেসুস্থে বের হচ্ছে সে।
ঐশ্বর্য গাড়ি স্টার্ট দিবে তখনই দুজন এসে বসলো তার গাড়ির পিছনের সিটে। ঐশ্বর্য লোকিং গ্লাসে তাদের দেখে নিলো। তাদের আলাদা আরও তিনটে গাড়ি রয়েছে। ওরা চাইলেই আলাদা গাড়ি করে ভার্সিটি বা কলেজে চলে যেতে পারে। কিন্তু না! ঐতিহ্য বাইক বা কার নিয়ে সবসময় যাতায়াত করলেও মাঝে মধ্যে ঐশানীকে নিয়ে ঐশ্বর্যের গাড়িতে উঠে পড়ে। তাদের নাকি মাঝে মধ্যে বোনের থেকে লিফট নিতে ভালো লাগে।
এবং বড়ো বোন হিসাবে ঐশ্বর্যের উচিৎ প্রতিদিনই তাদের কলেজ বা ভার্সিটিতে পৌঁছে দেওয়া!
ঐশ্বর্য এক মনে গাড়ি চালাচ্ছে। ঐশানী কলেজ ড্রেসের ফিতা ঠিক করতে করতে বলল, ‘কলেজ শেষ হলে আমাকে নিতে আসবে কিন্তু আপ্পি।’
ঐতিহ্য গেইম বাদ দিয়ে বলল, ‘আমাকেও!
ঐশ্বর্য হেসে বলল, ‘মিটিং তাড়াতাড়ি শেষ হলে দুটোকেই গাড়িতে তুলে নিবো। তারপর…?
ঐতিহ্য ও ঐশানী একসাথে বলল৷ ‘পার্টি হবে!’
ঐশানীকে তার কলেজে নামিয়ে দিয়ে তারপর ঐতিহ্যকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিলো ঐশ্বর্য। ঘড়িতে সময় দেখে নিলো, দশটা বাজতে আর মাত্র বিশ মিনিট বাকি আছে।
হাতের স্মার্ট ওয়াচে হাতের একাধিক স্পর্শ দিয়ে কানেক্টে হলো তার বাবার সাথে। রুদ্র ফাইল দেখতে দেখতে স্কিনে এক পলক তাকিয়ে বলল, ‘কুইক চলে আসো।’
‘আ’ম কামিং পাপা।’
ঐশ্বর্য হাতের ওয়াচে আবারও চাপ দিলো। রিসিভ হতেই শুনা গেলো তুরের ঘুম জড়ানো কন্ঠস্বর।
‘কি ইয়ার এতো সকালে কি চাই তোর?’
ঐশ্বর্য সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বলল, ‘দুপুরে ঐশানীর কলেজের সামনে চলে আসিস।’
ডিসকানেকটেড হতেই তুর ঘুম ভুলে লাফিয়ে উঠে বলল, ‘ইয়া হু পার্টি হবে।’
ঐশ্বর্য পনেরো মিনিটের মাথায় অফিসে পৌঁছালো। লিফটে চড়ে বারো তলায় পৌছে গেলো দুমিনিটে। বাকি তিন মিনিটে পিএর কাছ থেকে ফাইল নিয়ে গটগট করে পৌছালো কনফারেন্স রুমে।
এইবারের মিটিংটা হচ্ছে অনল শিকদারের বাবার কোম্পানির সাথে। যদিও সেটাতে অনল শিকদার নিজেও যুক্ত আছে। ঐশ্বর্য ভাবছে নিশ্চয়ই অনল শিকদারের জানা নেই যে ডিলটা হতে চলেছে সেটা ঐশ্বর্যেরই কোম্পানির সাথে! বা অনল শিকদার কখনো ভাবেনি যে ঐশ্বর্যের মতো ছ্যাচড়া ও প্রেম নিবেদন করে বেড়ানো মেয়ে কখনো বিজনেস উইমেন্স হতে পারে!
ঐশ্বর্য অনিক শিকদারের সাথে ডিলে সাইন করে বাঁকা হাসলো। পাখি নিজ থেকে বারবার জড়িয়ে যেতে চাইছে। সে সুযোগ কেন নিবে না?’
মিটিং থেকে বেরিয়ে আসতেই অনিক শিকদার পিছন থেকে ডাকলেন। ঐশ্বর্য দাড়িয়ে রইলো। অনিক শিকদার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কালো ফ্রেমের সানগ্লাসে ঢাকা চোখের মেয়েটিকে এক পলক দেখে নিলেন। তারপর বিনিময়ের সাথে বললেন, ‘তুমি সে-ই যে গতকাল আমার ছেলের সমাবেশে বিয়ের প্রস্তাব রেখেছিলে!
ঐশ্বর্য কিছু বললো না, অনিক শিকদার হেসে মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আরও সফল হও। তুমি যাদের পিছনে ঘুরছো একদিন তারা তোমার পিছনে ঘুরবে। বেস্ট অফ লাক মামনি।’
(চলবে)