এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ৭
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
আরো দুদিন চলে যায়। কিন্তু মোজাম্মেল শিকদার এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত আর কোন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু ছায়ার দেয়া ম্যাসেজ আর তাকে মোজাম্মেল শিকদারের বিরক্ত করার মাধ্যমে প্রমাণ হয় না যে, হত্যাটা তিনিই করেছিলেন। যদি হত্যা মোজাম্মেল শিকদার না করে অন্য কাওকে দিয়ে করান সেটাও প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু পুলিশ আর কোন ক্লু খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে মোজাম্মেল শিকদার তার জবাবে অটল। তিনি কিছুতেই হত্যা কান্ডের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করছেন না। পুলিশ পরেছে মহা ঝামেলায়। উপর মহল থেকে চাপ আসছে দ্রুত এ মামলার তদন্ত করে কোর্টে চালান দিতে। প্রমাণ ছাড়া আসামীকে কোর্টে তুললে তারপর দেখা যাবে আসামী পক্ষের উকিল তাকে খুব সহজে ছাড়িয়ে নিবে। তখন মিডিয়া পুলিশদের নিয়ে রসালো খবর ছাপাবে আনন্দের সাথে। পুলিশ ভুল ভাল লোকদের ধরে খুনি সাজাতে চায়, এ ধরনের খবর নিয়ে দেশের পত্রিকা গুলোতে রসালো নাটক সাজানো খুব সহজ। তাই যত দ্রুত সম্ভব পুলিশকে কিছু করতে হবে। এদিকে মোজাম্মেল শিকদার বড় মাপের মানুষ। ঢাকা শহরে তার বিজনেস আছে কয়েকটা। এমন একটা লোককে লকাপে আটকে রাখাও সহজ কথা নয়। তিনি এ নিয়ে সৌরভের সাথে কথা বলেছেন। সৌরভ নিজেও এ বিষয় নিয়ে টেনশনে আছে। তার অবচেতন মন বিভিন্ন কথা চিন্তা করে যাচ্ছে। কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না নিজেকে। রাতে ঠিক ভাবে ঘুম হয় না। বার বার চোখের সামনে ছায়ার মুখটা ভেসে উঠে। মনে হয় ছায়া ভালো নেই। সে কষ্ট পাচ্ছে। তার ছায়ার জন্য কিছু করা উচিত। ছায়ার খুনিকে খুঁজে বের করলেই ছায়ার আত্মা শান্তি পাবে। এ ধরনের হাজারো চিন্তা সৌরভের মাথায় ঘুর ঘুর করে সারাক্ষণ। অস্থির লাগে। মনকে শান্ত করা জরুরি। নিজেকে সময় দিতে হবে। সৌরভ রাজিবের নাম্বারে ডায়েল করলো।
– ‘ হ্যাঁ বল দোস্ত।’
– ‘ কাল ছুটি নিয়ে নে অফিস থেকে। ‘ স্পষ্ট ভাবে বললো সৌরভ।
– ‘ কেনো ? ‘ রাজিবের কন্ঠে কৌতুহল।
– ‘ ভালো লাগছে না কিছু। ভাবছি গাজিপুরের দিকে যাবো। একটু ঘুরে আসবো।’
– ‘ ঠিক আছে। ‘
মোহন আর মিলি বসে কথা বলছিলো আমেনা বেগমের সাথে। তিনি বিছানায় বসে আছেন। তার কোলে মাথা রেখে ফ্লোরে বসা মিলি, মোহন। যেন ছোট পাখির ছানা দুটো তার মায়ের কোলের সাথে লেপ্টে আছে। ছায়া থাকলে এখন দু ভাইবোন কে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে তাদের মাঝে এসে বসতো। আমেনা বেগম ছেলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
– ‘ এবার তো আমাদের ফিরে যেতে হয়। আর কতদিনই বা এখানে থাকবো। ‘
মোহন মৃদু স্বরে বললো,
– ‘ হ্যাঁ মা। আমি টিকিট কেটেছি। কাল কুমিল্লা ফিরে যাচ্ছি আমরা। ‘
– ‘ বুঝলি মোহন। সৌরভের মুখের দিকে তাকাতে পারি না আমি। কষ্টে বুকটা ফেঁটে যেতে চায়। ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেছে। ঠিক মতো খায় না, না ঘুমিয়ে চোখের নিচে কালি জমিয়ে ফেলেছে। থানায় ছুটে যায় বার বার। এভাবে কতদিন চলবে ? ‘
– ‘ সময় যেতে দাও মা। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। ‘
আমেনা বেগম কিছু বলেন না। ঢুকরে কেঁদে উঠেন। মোহন এতে বিরক্ত হয়ে বলে,
– ‘ আহ মা! তুমি কিছু হতেই এভাবে কাঁদবে না তো। সৌরভ এসব দেখলে ঠিক হবে কিভাবে! বার বার চোখের সামনে আমাদের ভেঙে পড়তে দেখলে সে নিজে ঠিক থাকবে ?’
মোহনের কথার মাঝে দরজায় নক পরে। ওপাশ থেকে বলে,
– ‘ আসবো মা ?’
সৌরভ এসেছে। তার কন্ঠ পেয়ে আমেনা বেগম দ্রুত চোখ মুছেন।
– ‘ এসো বাবা, এসো। ‘
মিলি আর মোহন উঠে বসে বিছানায় মায়ের পাশে। সৌরভ এগিয়ে এসে তাদের পাশে বসে।
– ‘ আপনার শরীর কেমন মা ? ‘ তার কন্ঠ শান্ত।
আমেনা বেগমের আবারো কান্না পায়। তিনি কান্না চেপে হাসি হাসি মুখ করে বলেন,
– ‘ ভালো বাবা। ভালো আছি এখন। ‘
– ‘ আপনারা নাকি কাল চলে যাচ্ছেন! আমি তো বলেছিলাম আরো ক’টা দিন থাকতেন। আমরা দু ভাই বোন একা বাসায়। আপনারা থাকলে ভালো লাগতো। ‘
আমেনা বেগম জোড় করে নিজের হাসিটা বজায় রেখেই বললেন,
– ‘ সেখানেও তো যাওয়া দরকার। সব দিক সামলাতে হবে। তুমি ভেবো না বাবা। আমরা মাঝে মাঝেই চলে আসবো। মিলি আসবে, মোহন আসবে। ‘
মায়ের কথার পিঠে মোহন বললো,
– ‘ হ্যাঁ। আমাকে তো ঢাকায় কাজে আসতেই হবে মাঝে মাঝে। এদিক হয়ে যাবো। সুবর্ণা, মিলি ওরাও এসে মাঝে মাঝে থাকলো। আর তুমিও সময় পেলেই তোহাকে নিয়ে চলে যাবে। ‘
-‘ আপনারা কি কাল সকালেই বের হবেন ?’
মোহন সৌরভের কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিয়ে বললো,
– ‘ হুম। এদিকের কি হচ্ছে সব কিন্তু আমাদের জানাবে। আর কোন প্রয়োজন হলে অবশ্যই ফোন দিবে। ‘
– ‘ আচ্ছা ভাইয়া। ‘
দেলোয়ার হোসেনের ফোন আসলো রাত্রি বেলা। তিনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
– ‘ প্রমাণ পাওয়া গেছে মোজাম্মেল শিকদার ঘটনার দিন নিজের বাড়িতেই ছিলেন। তিনি সেদিন বাহিরে বের হয়েছেন রাত আটটার দিকে। তবুও সাথে স্ত্রী, পুত্র ছিলো। ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া সারাদিন বাসা থেকে বের হননি। এমনকি সেদিন অফিসেও যাননি তিনি। ‘
সৌরভ অবাক হলো। মাথাটা কেমন ঝিম ধরে গেছে তার। যদি মোজাম্মেল শিকদার সারাদিন বাসায় থাকেন তাহলে খুনটা করলো কে! নাকি অন্য কাওকে দিয়ে খুন করিয়েছেন তিনি। প্রশ্নটা মনে আসতেই করে ফেললো সৌরভ।
– তাহলে খুনটা কি অন্য কাওকে দিয়ে করিয়েছেন তিনি ?
– ‘ হতে পারে। তবে নিশ্চিত না। ‘
– ‘ কিন্তু সেদিন ছায়ার দেয়া ম্যাসেজে তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো মোজাম্মেল শিকদার তাকে ডিস্টার্ব করছে। যদি সারাদিন বাসায় থাকে তাহলে ডিস্টার্ব করলো কিভাবে ? স্ট্রেঞ্জ! ‘
– ‘ ঝামেলাটা সেখানেই। মোজাম্মেল শিকদার অতি চালাক ব্যক্তি। তিনি নিজেও বিষয়টা চাপা দেয়ার জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। সবই সম্ভব। তবে আমাদের চোখে কিছু ধরা পরছে না। তদন্তটা আরো জটিল হয়ে যাচ্ছে। ‘
সৌরভ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিছু না বলেই ফোন কেটে দিলো সে। ভালো লাগছে না আর। কি হয়েছিলো সেদিন ছায়ার সাথে, কে তাকে হত্যা করলো কিচ্ছু জানা যাচ্ছে না। কেমন পাগল পাগল লাগছে নিজের কাছে।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
পরদিন সকালে মোহনরা সকলে চলে গেলো। মিলি যাবার আগে অনেক কেঁদেছে তোহাকে জড়িয়ে ধরে। আমেনা বেগমও কাঁদছিলো। এখানেই তার মেয়ের শেষ স্মৃতিটা রেখে ফিরতে হচ্ছে। আহা! কি সুখ ছিলো মেয়ের। কি শান্তি! জামাই টা কে দেখলেই নয়ন জুড়িয়ে যায়। আর সেই সংসারের মায়া ছেড়ে চলে যেতে হলো তাকে।
সকলে চলে যাবার পর সৌরভ বের হলো রাজিবের সাথে। তারা আসলো ঢাকার বাহিরে গাজিপুরের কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টটা একদম নিরিবিলি একটা জায়গায় তৈরী করা হয়েছে। শহরের কোলাহল নেই সেখানে। গাছ পালার ছায়ায় চারপাশ শান্ত, নির্মল দেখায়। লোক জনের খুব বেশি ভীর নেই বললেই চলে। শহর থেকে হঠাৎ হঠাৎ কিছু লোক ঘুরতেও আসে এখানে। সৌরভ প্রায়ই ছায়াকে নিয়ে এখানটায় আসতো। অনেকটা সময় কাটাতো নিজেদের মতো। কেনো যেনো এই জায়গাটায় আসতে ভালো লাগে সৌরভের। আজ ছায়া নেই। সব কিছুতে অস্থির লাগছে। নিজের মতো একটু সময় কাটাতে ইচ্ছে করছিলো সৌরভের। তাই ঠিক করলো এখানটায় আসবে। তাছাড়া জায়গাটা ছায়ার খুব পছন্দের ছিলো। সে কারণেই আসা।
রেস্টুরেন্টের বাহির দিকটায় খোলা আকাশের নিচে একটা টেবিলে বসলো রাজিব আর সৌরভ। রাজিব চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে বললো,
– ‘ জায়গাটা কিন্তু অনেক সুন্দর দোস্ত। ভাবতেছি বিয়ের পর বউ নিয়ে মাঝে মাঝে আসবো। ‘
সৌরভ হালকা হাসলো। কিছুক্ষণ পর একজন অল্প বয়সি ওয়েটার আসলো। সে সৌরভকে দেখা মাত্র সালাম দিয়ে বললো,
– ‘ অনেক দিন পর আসলেন স্যার। আগে তো রেগুলার মাসে একবার হলেও আসতেন। ‘
সৌরভ হালকা হেসে বললো,
– ‘ হ্যাঁ। লাস্ট কয়েক মাস ঝামেলায় ছিলাম বলে আসা হয়নি। ‘
ছেলেটা মেনু কার্ড এগিয়ে দিয়ে হাসি মুখে বললো,
– ‘ তবে ম্যাডাম এসেছিলো কিছুদিন আগে। অনেক্ষণ ছিলো। আপনারা হলেন এখানের রেগুলার কাস্টমার। এখন না আসলেও মনে মনে খুঁজি। ‘
ছেলেটা কথা শেষ করে হাসলো। মনে হলো এ কথা বলাতে সে নিজেই বেশ খুশি হয়েছে। তাদের কাজ হলো কাস্টমারদের খুশি রাখা। তাদের ভালো ভালো কথা বলা যাতে খুশি হয়ে বেশি বেশি কাস্টমার আসে। তবে সৌরভ খুশি হতে পারলো না। সে চমকালো। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
– ‘ ম্যাডাম এসেছিলো মানে ! কবে এসেছিলো? ‘
ছেলেটার মুখের হাসি সরলো না। সে সৌজন্যতা বজায় রেখেই বললো,
– ‘ সপ্তাহ দুয়েক আগে এসেছিলো। গত মাসে। উনার সাথে আরো একজন ছিলো। ‘
এবারে সৌরভ আর রাজিব দুজনই বেশ বিস্মিত হলো। রাজিব অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলো,
– ‘ কে ছিলো ? ‘
– ‘ লম্বা করে একজন ছেলে। মনে হলো ম্যাডামের পরিচিত কেউ। ‘
অবাক হলো সৌরভ। তার জানা মতে ছায়ার কোন ছেলে বন্ধু ছিলো না। তাছাড়া ছায়ার কোন রিলেটিভ ঢাকায় থাকে না। ছেলেদের সাথে তেমন মেলামেশা করতে ছায়াকে কখনোই দেখেনি সৌরভ। তাহলে কে ছিলো ছায়ার সাথে যাকে নিয়ে এখানে আসতে হলো তার!
চলবে…