এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব-২০ ( শেষ পর্ব )

0
1566

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব-২০( শেষ পর্ব )
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

বৃষ্টির প্রকোপ বেড়েছে। সন্ধ্যার অন্ধকারটা যেন বৃষ্টির কারণে আরো জেঁকে বসেছে। চার দিকে শুধু বাসা বাড়িতে জ্বলতে থাকা হলুদ সাদা আলো ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার পাশের টং দোকান গুলো বন্ধ করে রাখা হয়েছে। দোকানের সামনে কয়েকটা ভেজা কুকুর দাঁড়িয়ে আশ্রয় নিয়েছে। মিলির মনটা খুব ফুরফুরে। সৌরভ তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে সোজা ফুলের দোকানে গেছে। কালই নাকি তাদের বিয়ে হবে। এই বৃষ্টির মাঝে ভিজে এসব কোন পাগল ছাড়া কেউ করতে পারে!
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

সৌরভের সাথে আজ এক সাথে ভিজেছে সে। গায়ে মেখেছে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা। তার জীবন সার্থক। আর কী চাই জীবনে ! প্রিয় মানুষের থেকে এটুকু পাওয়াই অনেক।
বারান্দায় বসে বাহিরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখছিলো মিলি। আজ মনটা বড্ড ভালো। সৌরভ এভাবে তাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে, বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে সেটা সে ভাবতেও পারেনি। সব যেন কল্পনা!
কিছুক্ষণ পর রহিমা ঘরে ঢুকলো। মিলির পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
– ‘ আফা বৃষ্টি কমছে। এখন আমি যাই তাইলে।’
– ‘ আজ থেকে যাও। আকাশের অবস্থা ভালো না। যে ভাবে মেঘ ডাকছে একটু পর পর সারা রাতই বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।’
– ‘ আচ্ছা আফা। ‘
রহিমা চলে যেতে নিচ্ছিলো তখন মিলির ফোনটা বেজে উঠলো। বিছানা থেকে ফোনটা নিয়ে এসে মিলিকে দিলো রহিমা।  রাজিবের নাম্বার থেকে কল এসেছে দেখে কিছুটা অবাক হলো মিলি। সে সাধারণত মিলিকে ফোন দেয় না। তেমন কথাও হয়নি তাদের মাঝে। সব সময় তোহাই ফোন করে খোঁজ নিতো। তাহলে কোন বিপদ হয়নি তো আবার!  বুকের মাঝে হঠাৎ ভয় ঢুকে গেলো। দ্রুত ফোন রিসিভ করলো মিলি। ওপাশ থেকে শোনা গেলো রাজিবের ভীত কন্ঠ,
– ‘ হ্যালো। মিলি ?’
– ‘ হ্যাঁ। কিছু হয়েছে ভাইয়া ? ‘
– ‘ তোহার শরীরটা হঠাৎ খারাপ করেছে। কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। বৃষ্টির কারণে ডাক্তারও আসতে পারছে না। এখন কী যে করবো ভেবে পাচ্ছি না আমি। ‘

মিলি আঁতকে উঠলো,
– ‘ হঠাৎ কী হলো ?’
– ‘ বুঝতে পারছি না। আমার খুব ভয় করছে।’
– ‘ আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এখনই আসছি।’

বলেই ফোন রেখে দিলো মিলি। তখন খেয়াল করে দেখলো ফোনের চার্জ একদম শেষ। মিলি রহিমাকে বললো,
– ‘ আমার ফোনটা চার্জ দিয়ে রাখো। আমি একটু বের হচ্ছি।’
– ‘ এতো রাইতে কই যাইবেন ? ‘
– ‘তোহার শরীর ভালো না। ওর বাসায় যাবো।’
– ‘ভাইজান আসুক। একলা কেমনে যাইবেন ?’
– ‘চিন্তা করো না। আমি যাচ্ছি। তুমি বাসায় থাকো।’

তারপর দ্রুত বের হয়ে গেলো মিলি। বাহিরে গিয়ে একটা রিক্সা ডেকে উঠে পরলো। ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। আকাশ এখনো মেঘাচ্ছন্ন। তবে বৃষ্টি কমেছে। রিক্সা ছুটে চলছে তোহার বাসার দিকে। অথচ মিলি নিজেও বুঝতে পারছে না সে কত বড় ফাঁদে পরতে যাচ্ছে ! 

মিলিকে বলা রাজিবের সব গুলো কথাই দরজার ওপাশ থেকে তোহা শুনেছে। সে খুব অস্থির হয়ে পরেছে আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা করে। তার জন্য মিলির জীবনে নেমে আসতে যাচ্ছে এক ভয়ানক রাত্রি। মিলিকে ফোন করার পর আরো একজনকে কল করলো রাজিব। তাদের কথা স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে না। রাজিব কী বলছে সেটা শুনার জন্য উঠে এসে দরজার সাথে কান ঘেঁষে দাঁড়ালো তোহা। রাজিব বেশ ঠান্ডা গলায় বলছে,
– ‘ মিলির ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমি যাচ্ছি বাসায়। এদিকটা তুই সামলে নে বন্ধু। ‘
উল্টো পাশ থেকে কিছু শুনে রাজিব আবারো বললো,
– ‘ না। কোন ঝামেলা হবে না। ‘

তারপর ফোন রেখে রুমের দিকে রাজিব আসছে বুঝে দ্রুত দরজার পাশ ছেড়ে বিছানায় গিয়ে আবারো বসে পরলো তোহা।  রাজিব তোহার সামনে এসে তার সব ক’টা দাঁত বের করে হাসলো। কাঁটা কাঁটা স্বরে বললো,
– ‘ আমার বউটার জন্য মায়া হচ্ছে।  ইশ আর কেঁদো না। তৈরী হয়ে নাও।’

– ‘ কী করতে চাচ্ছো তুমি ? ‘ চোখ মুখ খিঁচে প্রশ্ন করলো তোহা।
– ‘ তোমার কাছে একজন মেহমান আসছে। তাকে আদর যত্ন করে খুশি করার দায়িত্ব তোমার। কে আসছে বলো তো?’

তোহা কপাল কুঁচকে তাকালো রাজিবের দিকে।
– ‘ বাদল আসছে। তার আবার তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। ‘
তোহা স্তব্ধ হয়ে গেলো। রাজিব তার সাথে এটা করবে সে ভাবতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত নিজের সেই নোংরা বন্ধুর কাছে স্ত্রীকে তুলে দিচ্ছে! তার একটুও বিবেকে বাধছে না! এখন কী করবে এখন সে ? কিভাবে বাঁচাবে নিজেকে এদের হাত থেকে ? কিচ্ছু মাথায় আসছে না। রাজিব বেরিয়ে যেতেই রুমের এক কোণায় বসে কাঁদতে লাগলো তোহা।

তোহার ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে দিলো রাজিব। বাসায় এসে সে চেঞ্জ করে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরেছে। একদম ফ্রেশ লাগছে। এদিকে টেনশনে মিলির এই ঠান্ডার মাঝেও চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। শরীর হালকা ঘামছে। রাজিব দরজা ছেড়ে দাঁড়াতেই মিলি ওড়না দিয়ে মুখ মুছে ভেতরে প্রবেশ করলো। রুমের ভেতর শুনশান নিরবতা। কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। যদিও এ বাসায় রাজিব আর তোহা ছাড়া কেউ নেই। তাই বাসা নিরব থাকারই কথা। মিলি ড্রইং রুমে প্রবেশ করে বললো,
– ‘ তোহা কোথায় ? ‘
– ‘ ওর রুমে আছে। ‘

মিলি আর কথা না বাড়িয়ে ভেতরের রুমে চলে গেলো। রাজিবও গেল তার পেছন পেছন। তোহার রুমে এসে কাওকে দেখতে না পেয়ে মিলি একটু বিরক্ত হলো। সেই সাথে এক অজানা ভয় তাকে পেয়ে বসলো। বাহিরে তখন শব্দ তুলে মেঘ ডাকছে। মিলির বুঁকের ভেতরটা খচখচ করতে লাগলো। সে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো রাজিব দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। মিলির শরীরের উপর থেকে নিচ বরাবর চোখ বুলাচ্ছে সে। মিলি চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,
– ‘ এসব তামাশার মানে কী ? ‘
রাজিব মিলির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
– ‘মানে কী তা এখনই বুঝবে। ‘

রাজিব বের হবার পরই কাওসার এসে দরজা খুলে দিলো। তোহা দ্রুত রুম থেকে বের হতেই সে বললো,
– ‘ আপনাকে এখনি পালাতে হবে। আমি সব শুনেছি তারা কি বলছিলো। তাড়াতাড়ি যান। ‘
– ‘ তুমিও চলো আমার সাথে। তুমি এখানে থাকলে বিপদে পরবে। ‘
কাওসার ছেলেটা কিছু একটা ভেবে দ্রুত তোহাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো রিসোর্ট থেকে।

বৃষ্টির কারণে কোন যানবাহন নেই রাস্তায়। এক রকম দৌড়ে ছুটছিলো ওরা দুজন। এখান থেকে তোহাদের বাসায় যেতে হলে অনেকটা পথ যেতে হবে। ততোক্ষণে না কোন বিপদ হয়ে যায় ! সৌরভকে যে করেই হোক সব জানাতে হবে। তোহা শুধু আল্লাহর নাম নিয়ে দৌড়াচ্ছিলো। হঠাৎ একটা গাড়ির সামনে এসে পরে ওরা দুজন। গাড়িটা দ্রুত ব্রেক কষে থেমে যায়। অদ্ভুত ভাবে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে সৌরভ। তোহা মাটিতে লুটিয়ে পরে। ভয়ে তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে। কোন কথা বলতে পারছে না। সৌরভ তোহাকে এ অবস্থায় দেখে আঁতকে ওঠে। এগিয়ে এসে কোলে তুলে নেয়। গাড়িতে উঠিয়ে মুখে পানি দেয়। বেশ কিছুক্ষণ তোহা সৌরভের কোলেই শুয়ে থাকে। কাওসার সৌরভকে সব খুলে বলে। সব শুনে সৌরভের ভিতরে এক অদৃশ্য কম্পন শুরু হয়েছে। যে ভয়টা মন থেকে সরে গিয়েছিলো হুট করেই আবারো মিলির বিপদের কথা চিন্তা করে শরীর মন ভয়ের ঠান্ডা স্রোতে ভেসে যেতে লাগলো। তোহাকে পেছনের সিটে বসিয়ে তার পাশে বসলো কাওসার। সৌরভ দ্রুত ড্রাইভ করে যেতে লাগলো রাজিবের বাড়ির দিকে। ইতোমধ্যে অফিসার দেলোয়ার হোসেনকে টেক্সট করে সব জানিয়ে দিয়েছে সে।

রাজিব মিলির সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটা হাত মিলির গালে আলতো করে স্পর্শ করলো। রাজিবের স্পর্শে মিলির শিরা উপশিরা পর্যন্ত ঝেঁজে উঠলো। মিলি বা হাত দিয়ে পেছনের সেলফে থাকা কাঠের একটা শো-পিস নিয়ে জোড়ে আঘাত করলো রাজিবের মাথায়। প্রথম বারেই রাজিব কোঁকিয়ে উঠলো। মাথায় হাত চেপে ধরে ব্যাথায় সে মাটিতে লুটিয়ে পরলো। মিলি তখন দ্বিতীয় বারের মতো আঘাত করলো। নিস্তেজ হয়ে পরে গেলো রাজিব। তার সাদা পাঞ্জাবী তে টপ টপ করে রক্ত ঝরে পরতে লাগলো। দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে গেলো মিলি। ড্রইং রুম  থেকে সদর দরজা দিয়ে বের হতেই সে ধাক্কা খেলো সৌরভের সাথে। নিজের দেহে যেন প্রাণ ফিরে পেলো। সৌরভকে নিজের সাথে জাপটে ধরে কাঁদতে লাগলো মিলি।

দেলোয়ার হোসেন দুজন ফোর্স নিয়ে চলে এসেছে। রাজিবের মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে দেখে সকলেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। পাছে না কোন ঝামেলা হয়ে যায় ! তবে অফিসার চেক করে জানায় এখনো বেঁচে আছে। মারা যাবার মতো আঘাত লাগেনি। তবে এক জায়গায় দুবার আঘাত করায় প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
রাজিবকে দ্রুত হাসপাতে নেয়া হলো। বাকি সব দায়িত্ব দেলোয়ার হোসেন নিজের কাঁধেই নিলেন। ছায়ার খুনের বিষয়ে তোহা আর কাওসারের স্টেটমেন্ট নিয়ে নিলেন তিনি । যাক এবার একটা বড় কেইসের তদন্ত করতে পেরেছেন বলে উপর মহল থেকে বেশ সুনাম কামানো যাবে ভেবে শান্তি পেলেন তিনি।

আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হবার নাম নেই। এ শহরের মেঘ গুলো আজ তোহার মতোই কাঁদতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। তোহা কাঁদার জন্য একটা ভরসার কাঁধ চায়। যেখানে মাথা রেখে সে সব দুঃখ ভুলে যেতে পারবে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে সে। তার চোখ নির্জীব, নিষ্প্রাণ। মিলি তোহার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে ডাকলো তোহাকে,
– ‘ তোহা সোনা। একটু তাকাও এদিকে। ‘
তোহা তাকালো না। কোন কথাও বললো না। মিলি আবারো বললো,
– ‘ তোমার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। ‘
তোহা কোন উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলো না। সে আজকাল পাথরের মূর্তির মতো থাকে। কারো সাথে কথা বলার কোন দায় যেন তার নেই। তোহাকে এভাবে দেখতে বাড়ির সকলের কষ্ট হয়। মিলির চোখ ভারী হয়ে আসছিলো। সে তোহার সামনে কাঁদতে চায় না বলে দ্রুত রুম ছেড়ে চলে গেলো।

কিছু সময় পর কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তোহার বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করা শব্দটা বাড়তে লাগলো। পেছন ফিরে তাকালো তোহা।  দিপু দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ জোড়া টকটকে লাল । কেঁদেছে কী ? তোহার হঠাৎ করে কী যেন হলো। চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পরলো দু ফোঁটা অশ্রু । ঝাপিয়ে পরলো সে দিপুর বুকের উপর। নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে কাঁদতে লাগলো । দিপু কোন কথা বললো না। তোহার মাথায় আলতো করে হাত রেখে পরম যত্নে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। বাহিরের মেঘ গুলো ততোক্ষণে বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। সে দিকে তোহার কোন খেয়াল নেই। খেয়াল করতেও চায় না। সে এখন কাঁদবে। ভীষণ ভাবে কাঁদবে। কাঁদার জন্য যে ভরসার একটা কাঁধ পেয়েছে।

( সমাপ্ত )

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে