এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১৯
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
তোহার কান্নার তোর বেড়েই যাচ্ছে। রাজিব রুমে এসে তোহাকে এভাবে কাঁদতে দেখে দ্রুত এগিয়ে এলো তার দিকে। তোহার পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বললো,
– ‘ কী হয়েছে তোহা ! কাঁদছো কেনো তুমি।’
কাওসার ছেলেটা ততক্ষণে রুম থেকে বের হয়ে গেছে। রাজিব তাকে দেখতে পায়নি। কাঁধে রাজিবের হাতের স্পর্শ পেয়ে তোহার শরীর জ্বলে উঠলো। এতো দিনের পরিচিত সেই ভালোলাগার, সুখের স্পর্শ এই মুহূর্তের বিষের মতো লাগছে। যা শরীরে লাগতেই সমস্ত শরীরে যেন বিষ ছড়িয়ে পরতে লাগলো। তোহা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো রাজিবকে। টাল সামলাতে না পেরে রাজিব কিছুদূর সরে গিয়ে পরে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। তোহার এমন ব্যবহারে সে স্তব্ধ। তোহা হাঁটু মুড়ে বসে কাছে। রাজিব আবারো এগিয়ে এলো। তোহার পাশে বসে তাকে নিজের বাহুডোরে নিয়ে আসতে চাইলে তোহা চেঁচিয়ে উঠে বললো,
– ‘ ধরবে না তুমি আমাকে। একদম ধরবে না।’
– ‘কী হয়েছে বলবে তো ? এমন করছো কেনো ?’
– ‘ কী হয়েছে এখনো বুঝতে পারছো না ? খুনি তুমি। খুন করেছো আমার ভাবীকে। প্রতারণা করেছো আমাদের সাথে। সকলের বিশ্বাস ভেঙেছো। ‘
কান্নার কারণে কথা বলতে পারছিলো না তোহা। রাজিবের দিকে সে রক্তবর্ণ চোখে তাকালো। এই মুহূর্তে চোখের সামনে রাজিবকে দেখতেও ঘেন্নায় তার গা গুলিয়ে উঠছে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ রাজিব অদ্ভুত হাসলো। তার হাসি ক্রমশ প্রশস্ত হয়ে উচ্চ আওয়াজ ধারন করলো। কেমন বিচ্ছিরি হাসি ! এই মানুষটাকে তোহা চিনে না। এটা তার রাজিব না। হুট করে রূপ বদলে ফেলা যেন অন্য কেউ। রাজিবের হাসি দেখলে তার প্রাণ জুড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন এই হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে কুৎসিত একটা চরিত্র।
– ‘ তাহলে আমার প্রিয়তমা সব জেনেই গেছো ? ‘ বলেই আবার উচ্চ শব্দে হাসতে লাগলো রাজিব।
– ‘ কেনো করেছো তুমি এটা ? কি করেছিলাম আমরা তোমার সাথে ? ‘ ঝেঁজে উঠে বললো তোহা।
রাজিব অদ্ভুত হাসতে লাগলো। উত্তর না পেয়ে তোহা এগিয়ে গিয়ে রাজিবের শার্টের কলার চেপে ধরে বললো,
– ‘ বলো কেনো করেছো ? আমার ভাই তোমাকে সব থেকে ভালো বন্ধু ভাবে। নিজের ভাইয়ের মত দেখে তোমাকে। অথচ তুমিই তার পিঠে ছুড়ি বসালে! কিভাবে পারলে তুমি ? ‘
– ‘ বন্ধু মাই ফুট। তোমার ভাই একটা কাপুরুষ। তাই তার সাথে এমন হয়েছে। ‘
তোহা রক্তশুন্য চোখে তাকিয়ে আছে রাজিবের দিকে। কোন কথা তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। রাজিব আবার বললো,
– ‘ আমিও সৌরভকে নিজের বন্ধু ভাবতাম। এখনো ভাবি। তবে সে যে একটা কাপুরুষ তা সবাই জানে। ছায়াও জানতো। তাই সে সৌরভকে পছন্দ করেনি করেছে আমাকে। তাছাড়া তোমার ভাইয়ের থেকে বেশি মজা সে আমার সাথে থেকে পেয়েছে। ‘
রাজিবের বিদ্রুপ মাখা কথায় তোহা গর্জে উঠলো,
– ‘ রাজিইইব! মুখ সামলে কথা বলো। ‘
– ‘ বা রে। সত্য বললেও এভাবে রেগে যায় কেনো আমার প্রিয়তমা! ‘
– ‘ ছায়া কখনো এমন করার মেয়ে না। তুমি তার সাথে অন্যায় করেছো। তাকে নিশ্চই তুমি কোন কারণে ফোর্স করেছো। ‘
– ‘ আমি কেনো ফোর্স করবো! তোমার কাপুরুষ ভাই সুখ দিতে পারেনি তোমার ভাবিকে। তাই সে আমার কাছে এসেছে। ‘
রাজিবের দৃষ্টিতে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ দেখতে পাচ্ছিলো তোহা। আর সেই দৃষ্টি এতো বেশি নিচ যে তোহা তাকিয়ে থাকতে পারলো না।! সে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
– ‘ তারমানে তোমরা একটা অবৈধ সম্পর্ক চালাচ্ছিলে?’
– ‘ হ্যাঁ। বলতে গেলে আমি নিজেই ছায়ার প্রেমে পরেছিলেম। ঠিক প্রেম বলা যায় না তোমার ভাবির শরীরের প্রেমে পরেছিলাম আমি। সৌরভ এতো সুন্দরী একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিলো যাকে দেখার পরই আমার মাথা নষ্ট হয়ে যায়। একটা রাত হলেও তার সাথে কাটানোর ইচ্ছা ছিলো আমার। ‘
কথাগুলো বলার সময় রাজিবের ঠোঁটের কোণে সেই বিচ্ছিরি হাসিটা দেখতে পাচ্ছিলো তোহা। রাজিব বলতে লাগলো,
– ‘ সৌরভ নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারতো না। ছায়াকে তার ক্যারিয়ার গড়ার আগেই বিয়ে দেয়াতে সে বিয়েটা ঠিক ভাবে মানতে পারেনি তবুও মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলো। তারপর আবার যখন ছায়ার অফিসের বস তাকে বিভিন্ন ভাবে বিরক্ত করতে শুরু করে তখন সৌরভ তেমন কোন স্টেপ নেয়নি এ বিয়ষে। প্রথমে সামান্য শান্তনা তারপর চাকরী টাই ছেড়ে দিতে বলে কাপুরুষের মতো। কিন্তু জানোই তো। এখনকার মেয়েরা কোন কাপুরুষ স্বামী চায় না। সৌরভের এমন আচরণে ছায়া মনে মনে কষ্ট পায় আর সেই সুযোগটাই আমি নেই। সে সময় আমি গিয়ে দাঁড়াই তার পাশে। আস্তে আস্তে আমাদের মাঝে ঘনিষ্ঠতা হয়। ছায়া বিশ্বাস করতে শুরু করে আমাকে। ভালোবেসে ফেলে। ‘
– ‘ এতোই যখন দুজন দুজনকে চাইতে তাহলে মারলে কেনো তাকে ? ‘
রাজিব হাসছিলো। হেসে হেসে বললো,
– ‘কারণ তোমার ভাবিটাও ছিলো বোকা। বোকার মতো আমার প্রেমে পরে আমার বিছানায় চলে এসেছিলো। ‘
তোহা আর শুনতে পাচ্ছিলো না। সে দুহাত দিয়ে নিজের কান চেপে ধরে বিছানায় বসে কাঁদছে। রাজিব বললো,
– ‘ সমস্যাটা হলো এর পরই। ছায়া প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলো। তখন আমি তাকে বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেলতে বলি। কিন্তু সে রাজি হয় না। সে আমার কাছে বাচ্চাটার অধিকার চায়। বলে এই সম্পর্কের কথা সকলকে জানিয়ে দিতে। আর তখনি তোমার ভাই আমাকে জানায় তুমি নিজেও আমার প্রেমে পরে হাবুডুবু খাচ্ছো। সৌরভ বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমিও সুযোগটা লুফে নেই। তোমাকে বিয়ে করলে তোমার ভাইয়ের সব কিছু আমাদেরই হবে। সেই সাথে নতুন কাওকে টেস্ট করা হবে আমার। তবে ঝামেলা ছিলো ছায়া। সে না থাকলে সব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে নেয়া যাবে। সেজন্যই রাস্তা থেকে ছায়া নামের কাঁটাটা সরিয়ে দেই আমি। ছায়াকে সেদিন দেখা করতে বলে অফিস ব্রেক টাইমে এখানে নিয়ে আসি। তোমার ভাবিটা তখনো আমার সাথে বিছানায় মজা পেতো। তাই তাকে নিয়ে রোমান্স শেষে যখন সে ওয়াশরুমে যায় তার আগে ছয়াকে বলি তার ফোনের লক খুলে দিতে । বোকা মেয়ে সেটাই করে। তারপর ছায়ার ফোন থেকে সৌরভকে আমি ম্যাসেজ দিয়ে বলি বস ডিস্টার্ব করার কথাটা। আর ছায়া ফিরে আসতে আসতে ফোনটা আবারো লক হয়ে যায়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট হবার কারণে পরবর্তীতে সেটা আর কেউ খুলতে পারেনি। ছায়া আসলে তাকে নিজের পাশে শুইয়ে দিয়ে খুব সাবধানে বালিশ চেপে মারি তাকে। তারপর সতর্ক ভাবে সব প্রমান মুছে ফেলি। ‘
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
তোহা এসে রাজিবের গালে একটা স্ব- জোড়ে থাপ্পড় মারে। তার কলার চেপে বলে, ‘খুনি তুমি। সকলের সাথে বেইমানি করেছো। আমি ছাড়বো না তোমাকে।’
– ‘ কী করবে ? পুলিশ ডাকবে? যাও যাও ডাকো।’ ব্যাঙ্গ করতে করতে বলে রাজিব।
তোহা দরজার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই তাকে আটকে ধরে। বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলে,
– ‘ বেশি কথা বললে তোর অবস্থাও ছায়ার মতো হবে। চুপচাপ এখানে বসে থাকবি। ‘
– ‘ রাজিব! আমি ছাড়বো না তোমাকে। ‘
– ‘ এখান থেকে বের হতে পারলে তবে তো ছাড়বি! ‘
তোহা বিছানায় পরে কাঁদছিলো। ততোক্ষণে রাত হয়ে গেছে। একটা সুন্দর দিন কাটাতে এসেছিলো তারা। দুজন ভালোবাসার মানুষ। আর এখন সব ওলট পালট হয়ে গেছে। তার এতো দিনের চেনা মানুষটা হুট করে অচেনা হয়ে গেছে। এতোদিনের বিশ্বাস, ভালোবাসা সব মিথ্যা প্রমান হয়েছে। রাজিবের ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো। সৌরভ ফোন করেছে। রাজিব একটা বাঁকা হাসি দিলো। গলা খাকারি দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে ফোন রিসিভ করে বললো,
– ‘ হ্যাঁ দোস্ত বল। ‘
মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এলো রাজিব। তার চোয়াল শক্ত। চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। রাগে ফেটে পরছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। রুমে এসে রাজিব সরাসরি তোহার চুলের মুঠি ধরে বললো,
– ‘ তুই আমার সব প্ল্যান নষ্ট করে দিয়েছিস। এখানে তোকে নিয়ে আসাই ভুল ছিলো। ‘
ব্যাথায় তোহা কোঁকিয়ে উঠলো। রাজিবের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে বৃথা চেষ্টা করছে সে। রাজিব আরো জোড়ে তোহার চুল টেনে ধরে বললো,
– ‘ তোর ভাই আবারো বিয়ে করতে চাচ্ছে। কাল তোকে নিয়ে যেতে বলেছে বাড়িতে। কাকে বিয়ে করবে জানিস ? মিলিকে। সব সুন্দরী মেয়েরা তোর ভাইকে কি দেখে পছন্দ করে বলতো ? ‘
তোহা ব্যাথায় কিছু বলতে পারছে না। সে নড়েচড়ে কোন ভাবে বললো,
– ‘ লাগছে আমার। ছাড়ো। ‘
– ‘ লাগুক। এবার তোদের লাগারই সময়। এ বিয়ে তো হতে দিবো না আমি। ‘
– ‘ কী করবে তুমি! ‘
– ‘ তোর ভাই একা সব ভোগ করবে তা তো হতে দিবো না আমি। আচ্ছা আমার বিছানায় মিলিকে কেমন লাগবে বলতো ? ‘
তোহা চমকে উঠলো। অবাক হয়ে তাকালো সে রাজিবের মুখের দিকে। রাজিব তার নেশাতুর চোখ নিয়ে তাকিয়ে বিশ্রী ভাবে হাসছে। তোহার চোখে মুখে ভয়। সে কাঁপা কাঁপা হাত নিয়ে রাজিবের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
– ‘ তুমি এটা করবে না রাজিব। আমি কাওকে কিছু বলবো না। তবুও তুমি আর কোন ক্ষতি করো না প্লিজ। ‘
রাজিব তোহাকে তুলে আবার বিছানায় ছুড়ে ফেলে দিলো।
– ‘ তোর সাথে থেকে আর মজা পাচ্ছি না। এবার আর তোর দরকার নেই আমার। এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করবি না। তাহলে খুব খারাপ হবে। ‘ বলেই চলে যেতে লাগলো রাজিব। তোহা নিজের ফোনটা আশেপাশে পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো। তারপর লক্ষ্য করলো তার ফোনটা হাতে নিয়েই রাজিব বের হয়ে যাচ্ছে। যাবার আগে পেছন ঘুরে বললো,
– ‘ ওওও, ছায়াকে নদীকে নিয়ে গিয়ে ফেলার সময় আমার সাথে আরো একজন ছিলো। কে বলতো ? ‘
তোহা শূন্য চোখে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রইলো রাজিবের দিকে। রাজিব ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বললো,
– ‘ বাদল। ‘
রাজিব বেরিয়ে যেতেই তোহা পাগলের মতো বিছানায় পরে কাঁদতে লাগলো। বাহির থেকে রাজিব দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। রুম থেকে বের হবার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না তোহা। সে উঠে আবারো এদিক সেদিক দৌড়ে খুঁজতে লাগলো কোন পথ পাওয়া যায় কী না। কিন্তু কোন লাভ হলো না। রুম থেকে বের হবার অন্য কোন রাস্তা নেই। নিজেকে অসহায় লাগছে। শরীর অসাড় হয়ে ঢলে পরলো মেঝেতে। সেখানে পরেই তোহা কাঁদতে লাগলো।
চলবে….