এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১১
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম
সৌরভ আর তোহা কুমিল্লা আসাতে সব থেকে বেশি খুশি হয়েছেন আমেনা বেগম। তিনি মেয়ে জামাইকে দেখেই আনন্দে কেঁদে দিয়েছেন। এই ছেলেটা তার নিজের পরিবারের একজন। নিজের সন্তানের মতো। আজ কাল ছেলেটাকে দেখলেই মেয়েটার কথা মনে পরে। তবে খুব একটা কষ্ট হয় না। তার কাছে মনে হয় তার থেকে বেশি কষ্ট হয়তো সৌরভের হচ্ছে। আমেনা বেগম সৌরভ আসাতে বিভিন্ন রান্না করতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। সচরাচর তিনি এখন রান্না ঘরে যান না। বয়স হওয়াতে বাড়ির কাজ লোক জনকে ভাগ করে দিয়েছেন। কিন্তু মেয়ের জামাই এসেছে। তার আরেকটা ছেলে। সেজন্য তিনি আজ রান্না ঘর ছাড়ছেনই না। একটু পর পর এটা সেটা বানিয়ে সৌরভ তোহার সামনে নিয়ে দিচ্ছে। কথা বলার জন্য বাড়িতে যেন এখন একমাত্র সৌরভই আছে তার। মেয়ে জামাই এর সাথে সারাক্ষণ এটা সেটা নিয়ে কথা চলছেই। সৌরভের নিজের কাছেও ভালো লাগছে। কিছু সময়ের জন্য মানুষ গুলোর পাশে এসে যেন নিজের দুঃখ কষ্ট আড়াল হয়ে গেলো। প্রিয় মানুষ গুলোর সান্নিধ্যে থাকার চেয়ে বড় সুখ বুঝি আর কিছুতে নেই! তোহা পেয়েছে মিলির সঙ্গ। বেশ জমিয়ে আড্ডা দেয় তারা। দুজন বন্ধুর মতো। তাদের সাথে যোগ দেয় মায়া। মায়ের কাছে আজ কাল থাকতে ভালো লাগে না তার। মা সারাক্ষণ বাবার সাথে লেগেই থাকে। বিষয়টা খারাপ লাগে মায়ার। সে ফুপির সাথেই বেশ আছে।
সন্ধ্যায় সকলে মিলে ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছিলো। আমেনা বেগম প্রফুল্লতার সাথে সৌরভের প্লেটে বিভিন্ন পিঠা সাজিয়ে দিয়েছেন। সামনে রাখা আছে চা। সৌরভ সে সব আয়েশ করে খাচ্ছে। তোহা চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,
– ‘ ভাইয়া কাল আমরা ঘুরতে বের হবো। আশপাশটা দেখবো। তুমিও যাবে আমাদের সাথে। ‘
সৌরভ বললো,
– ‘ আমি যেতে পারবো না রে। আমার কালই ঢাকায় ফেরত যেতে হবে। ‘
আমেনা বেগম বিস্ময় নিয়ে বললেন,
– ‘ কাল ! তুমি কিছুদিন থাকবে বাবা। ‘
– ‘ তোহা থাকবে মা। আমি আবার আসবো ওকে নিয়ে যেতে। কিন্তু কাল যেতেই হবে। দিপু ছেলেটাকে একটা কাজ দিয়েছিলাম। সেটা হয়ে গেছে। আমাকে গিয়ে দেখতে হবে সবটা। ‘ সৌরভ ইচ্ছে করেই তুহিনের বিষয়টা আমেনা বেগমকে বললো না। ছায়ার মা এসব জানুক সেটা সৌরভ চায় না। তবে এ বিষয়ে সে মিলি আর মোহনের সাথে আলোচনা করেছে।
আমেনা বেগমের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তিনি আর কিছু বললেন না। মোহন বললেন,
– ‘ আমিও তোমার সাথে যাবো সৌরভ। এদিকটায় আমার কোন কাজ নেই আপাতত।’
– ‘ ঠিক আছে ভাইয়া। ‘
সৌরভ আর মোহন রাতে বসে ছায়ার কেইসটা নিয়ে আলোচনা করলো। মোহনের বেশ বড় বড় কিছু জানা শোনা লোক আছে। রাজনৈতিক দলের সাথেও খাতির রয়েছে তার। দেশ বিদেশে ব্যবসার জন্য খাতির রাখতে হয়। পরদিন সকালেই তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। তোহা রইলো মিলিদের সাথে কুমিল্লা। সৌরভ আর তুহিন প্রথমেই গেলো পুলিশ স্টেশন। সেখানে গিয়ে পুলিশের সাথে কথা বললো। তদন্ত আগানোর দিকে পুলিশের আর কোন আগ্রহ দেখতে পেলো না তারা। দেলোয়ার হোসেনের কথা,
– ‘ থানায় আরো অনেক মামলা আছে। সেসব আমাদের দেখতে হয়। যে মামলার কোন ক্লু নেই সেটার পিছনে পরে থাকলে তো আর থানা চলবে না। তাছাড়া উপর মহল থেকে চাপ থাকলে বা আসামী পক্ষের কোন সন্দেহজনক লোক থাকলে তখন মামলা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু মোজাম্মেল শিকদার উপর মহলকে টাকা খাইয়ে তাদের চুপ করিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া আপনাদের ও সন্দেহজনক আর কেউ নেই। এ হত্যার পিছনে কে আছে তা জানা যায়নি। এখন পুলিশের আর কিছু করার নেই। মামলা করা আছে। কখনো কোন ক্লু পেলে কেইস ফাইল আবার ওপেন হবে। ‘
সৌরভের রাগ হলো। কিন্তু সে রাগটা নিয়ন্ত্রণ করে নিলো। পুলিশের কোন কর্মকর্তার সাথে রাগ দেখিয়ে কোন লাভ হবে না। বরং হিতে বিপরীত হতে পারে।
মতিঝিলে তুহিনের বাসাটি খুঁজে পেতে কষ্ট হলো না তাদের। দিপুর বন্ধু বাসাটির ডিটেইলস নিয়ে দিয়েছে তাদের। সৌরভের সাথে দিপু আর মোহনও এসেছে। বিশাল বড় একটা অ্যাপার্টমেন্টের তিন তালার ডান দিকটায় থাকে তুহিনের ফ্যামিলি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেল চাপতেই ভেতর থেকে একজন বয়স্ক মহিলা এসে দরজা খুলে দিলো। মোহন উনাকে চিনে। তুহিনের মা। তাদের পাশের এলাকায় বাসা। তুহিনকেও ছোট থাকতে দেখেছে সে। তারপর অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ায কারো সাথে আর যোগাযোগ নেই । তুহিনের মা মোহনকে দেখে শুরুতে হয়তো চিনতে পারেননি। খানিক সময় তাকিয়ে থেকে তিনি বললেন,
-‘ তুমি মোহন না ? ‘
মোহন হালকা হেসে বললো,
– ‘ জি চাচী। এখানে একটা কাজে এসেছিলাম। শুনেছি আপনারা এখানেই থাকেন। ভাবলাম আপনাদের সাথে দেখা করে যাই। ‘
– ‘ আসো বাবা ভিতরে আসো। ‘ নিজের গ্রামের লোকদের দেখে তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে পরলেন।
মোহন ভিতরে গিয়ে বসে। দিপু আর সৌরভের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো তুহিনের মায়ের। তারপর বেশ কৌশল করে বললো,
– ‘ চাচী তুহিন কোথায় আছে ? তাকে দেখছি না যে! কত দিন হলো ছেলেটাকে দেখি না। সেই স্কুলে পড়তো সময় দেখেছিলাম। ‘
– ‘ তুহিন তো ডাক্তার হইছে বাবা। বিদেশ গেছে কি সব ডিগ্রি আনতে। আমি তো এসব বুঝি না। ‘ তুহিনের মা খুব গর্বের সাথে কথাগুলো বললেন। কথা বলার সময় তার চোখ জোড়াও হাসছিলো। ছেলের সাফল্যে তিনি যে কতটা খুশি তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। পৃথিবীর সব বাবা মা’ই তো এমন।
– ‘ তুহিনের নাম্বার দিয়েন চাচী। ছেলেটার সাথে কথা বলবো একটা সময় ফোন দিয়ে। ‘
মোহনের টোপ টা কাজে লাগলো। তুহিনের মা বেশ খুশি খুশি মনে ফোন নিয়ে এলেন। ছেলে তাকে ফোন চালানো শিখিয়েছে। একা থাকার কারণে একটা মেয়েকেও রেখে দিয়েছে। সে মেয়ে সব দেখিয়ে দেয় তাকে। মেয়েটি এসেই তুহিনের নাম্বার বের করে দিলো তাদের। মোহন নাম্বারটা চট করে নিজের ফোনে সেভ করে নিলো। তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে, নাস্তা করে চলে এলো তারা। বাসায় ফেরার পথে সৌরভ বাজার করে নিলো। রহিমা তাদের বাসায় কাজ করে। কুমিল্লা যাওয়ার সময় তাকে বলা হয়েছিলো কয়েকদিন পর আসবে। সে ক’দিন ছুটি তার। এখন হুট করে সৌরভের চলে আসাতে মুশকিল হলো। খবর পাঠানো হলো রহিমাকে। রাতে এক সাথে খাওয়া দাওয়া হবে। সৌরভ দিপুকে বললো,
– ‘ দিপু। রাতে কিন্তু তুমিও আমাদের সাথে থাকছো। রাজিব কে বলবো ভেবেছিলাম। সে অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গেছে। সেখানে থাকতে হবে দিন কয়েক। তুমি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চট করে চলে এসো। ‘
দিপু হেসে মাথা নাড়ালো।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ঠিক করা হলো তুহিনের নাম্বারে কল দেয়া হবে। সৌরভ, দিপু আর মোহন একসাথে বসে ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে কল দিলো। দুবার কল হবার পর ওপাশ থেকে বললো,
– ‘ হ্যালো। ‘
সৌরভ গলা খাকারি দিয়ে বললো,
– ‘ রাশেদুল রহমান তুহিন বলছিলেন ? ‘
– ‘ জি। আপনি কে ? ‘
সৌরভ একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লো। এতো খোঁজা খুঁজির পর তাহলে তুহিন কে পাওয়া গেলো! সে শান্ত ভাবে বললো,
– ‘ আমি ছায়ার হাজব্যান্ড। সৌরভ। ‘
তুহিন বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
– ‘ হেই। কেমন আছেন ? ‘
– ‘ ছায়া খুন হয়েছে। আপনি জানেন ? ‘
– ‘ কিহ! ‘ বেশ অবাক হলো তুহিন। বেশ খানিকটা সময় সে চুপ করে রইলো। তারপর বললো,
– ‘ কিভাবে কি হলো ! এখানে আসার আগেও তো তার সাথে আমার দেখা হলো। ‘ বিস্ময় যেন কাটছে না তুহিনের।
– ‘ হ্যাঁ। আমরা সেটা জেনেছি। তাই আপনাকে ফোন করা। ছায়াকে কেউ হত্যা করেছে। পুলিশ এখনো আসামী খুঁজে পায়নি। এ বিষয়ে আপনার একটু সাহায্য লাগবে। ‘
তুহিনকে খুব বিচলিত মনে হলো। বুঝা যাচ্ছে সে বেশ বড় একটা শকড পেয়েছে। নিজেকে সামলাতে পারছে না। কোন রকমে বললো,
– ‘ আমি আমার সব ধরনের চেষ্টা করবো। যদি আপনাদের উপকারে আসতে পারি। ‘
সৌরভ বললো,
– ‘ ছায়াকে আপনি কিভাবে চিনেন ? ‘
– ‘ আমাদের পাশের এলাকায় ছায়াদের বাসা। ‘
– ‘ শুধু পাশের এলাকায় বাসা বলে তার সাথে খাতির ছিলো? এক সাথে কফি শপে বসতেন ? আমার জানা মতে আপনারা তো বন্ধু ছিলেন না। ‘
সৌরভের খুঁচাটা তুহিন বুঝতে পারলো। সে খুব সতর্কভাবে বললো,
– ‘ আমি ছায়াকে পছন্দ করতাম। ‘
উপস্থিত সকলে একে ওপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। সৌরভের কথা গুলো শুনতে খারাপ লাগছিলো তবুও সে চুপ করে শুনতে লাগলো তুহিনের কথা। ছায়া তো আর নেই। এখন যত কঠিন কাজই হোক, যত কষ্টের কথাই হোক সব শুনতে হবে তাকে। তুহিন আবারো বললো,
– ‘ ছায়া আর আমার মাঝে কোন সম্পর্ক ছিলো না। ওকে খারাপ ভাববেন না প্লিজ। ছায়া খুব ভালো মেয়ে ছিলো। তবে আমি বুঝতাম আমার জন্য তার মনে একটু হলেও জায়গা ছিলো। কিন্তু সে আবেগের বসে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো মেয়ে ছিলো না। আবেগ কে প্রশ্রয় দিয়ে রিলেশনে জড়ায়নি। বরং বাবা মায়ের পছন্দ করা ছেলে আপনাকেই বিয়ে করে নিয়েছে। ভালোবেসে সংসার করেছে। ‘
– ‘ তাহলে সেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা করলেন কেনো আপনারা ? কি কারণে দেখা করা যদি কোন সম্পর্ক না থাকে। ? ‘ সৌরভ ভারী কন্ঠে বললো।
তুহিন বেশ নরম সুরে বললো,
– ‘ ছায়ার একটা হেল্প দরকার ছিলো আমার থেকে। সে কারণেই সে দু’বছর পর যোগাযোগ করে দেখা করতে বলেছিলো আমাকে। ‘
চলবে…..