এ শহর মেঘলা ভীষণ পর্ব – ১

0
4039

এ শহর মেঘলা ভীষণ
পর্ব – ১
জান্নাতুল ফেরদৌস মীম

পাশে থাকা মানুষটাও মাঝে মাঝে আমাদের ভেতরটা পড়তে জানে না। খুব কাছের মানুষটারও দূরত্ব থাকে অসীম। কখনো আবার হাজার মাইল দূরে থাকলেও মানুষটা সব সময় থাকে মনের মাঝে যত্নে রাখা সজ্জিত কক্ষটিতে। যেখানটার মালিকানা শুধু তার। যেখানটায় রোজ হাজারো স্বপ্ন সাজে তার জন্য। হাজারো ইচ্ছা জাগে তার জন্য। ভালোবাসায় টুইটুম্বুর করে থাকে দুজনার কল্পিত সোহাগে। দূরে থেকেও সে মানুষটির জন্য ক্ষণে ক্ষণে মন কাঁদে। যাকে একটু ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ভালোবাসার মানুষটিকে হাত বাড়িয়ে একটু স্পর্শ করতে। হ্যাঁ। ছায়াকে এই মুহূর্ত একটা বারের জন্য ছুঁয়ে দেখতে সৌরভের মন প্রাণ অস্থির হয়ে উঠছে। কি অসম্ভব সুন্দর লাগছে আজ মেয়েটিকে। বেগুনী আর কালোর মিশ্রণে একটি জামদানী শাড়ি পড়েছে আজ ছায়া। কপালে কালো ছোট টিপ। চোখে কাজল দিয়েছে। চুল গুলো এলোমেলো করে ছেড়ে রেখেছে পিঠের ওপর। ছায়ার মুখটা মলিন। গোলাপি ওষ্ঠদ্বয় শুকিয়ে আছে যেনো। তবুও তার এই মলিন মুখটা দেখতেও সৌরভের বেশ ভালো লাগছে। এই মেয়েটির মাঝে আলাদা কিছু আছে। যা সৌরভকে প্রতি মুহূর্তে তার দিকে টানে।

গাড়ি চালাতে চালাতে সৌরভ বার বার আড় চোখে ছায়াকে দেখছিলো। তার পাশের সিটেই ছায়া বসে আছে। দৃষ্টি জানালা ভেদ করে বাহিরের দূর কোন প্রান্তে। তাকে দেখতে আজ বড় উদাসীন লাগছে। সৌরভের কিছুটা খারাপ লাগছিলো। ছায়া মাঝে মাঝে ছোট খাটো বিষয় নিয়ে রেগে যায়। আবার কখনো দেখা যায় খুব বড় কিছু হয়ে গেলেও সে ঠান্ডা মাথায় বিষটা সামলায়। এই যেমন, কাল রাতে সে বায়না ধরেছিলো মায়ের বাসায় যাবে। কিন্তু সৌরভ এ সময় ছায়াকে কিছুতেই তার মায়ের কাছে পাঠাবে না। দুদিন পরই ছায়ার জন্মদিন। এখন মায়ের কাছে গেলে সে সহজে ফিরবে না। অথচ সৌরভ ঠিক করেছে এবারে ছায়াকে সে খুব বড় করে সারপ্রাইজ দিবে। তাই এ মুহূর্তে ছায়াকে কোথাও যেতে দেয়া যাবে না।  যদিও সে সারপ্রাইজের বিষয়টি বুঝতে না দিয়ে খুব শান্তভাবে বলেছে , ‘এখন কোথাও যাওয়া হবে না।’ তবে এটুকু বলাতেই হলো ঝামেলার শুরু। ছায়া রেগে গিয়ে পাশের রুমে শুয়ে পরেছিলো। সকাল থেকে সে সৌরভের সাথে কোন কথা বলেনি। এমনিতেও ইদানিং ছায়াকে কেমন উদাস উদাস লাগে। সেই উদাসীনতার কারণটা হয়তো সৌরভ বুঝতে পারে। সেজন্যই সে নিজেও ছায়াকে বেশি ঘাটায় না।

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
হাত বাড়িয়ে সৌরভ ছায়ার কোলের ওপর রাখা একটা হাত স্পর্শ করলো। ছায়া মুখ ঘুরিয়ে তাকালো সৌরভের দিকে। ম্লান হাসলো। সৌরভের কি হলো কে জানে। সে ছায়ার হাতটি এনে নিজের বুকের বা পাশটায় ধরলো। তার বুক তখন ঢিপ ঢিপ শব্দ তুলতে ব্যস্ত। ছায়া তখনো ম্লান হেসেই বললো,

– ‘এক হাতে ড্রাইভ করছো কেনো! হাত ছেড়ে সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করো।’

সৌরভ কিছুই বললো না। সে ছায়ার হাতটা বুকের মাঝে ধরে রেখেই গাড়ি চালাতে লাগলো। এই মেয়েটিকে সে ভীষণ ভাবে ভালোবাসে। অসম্ভব রকমের ভালোবাসা।  যেটা সে কখনো হয়তো বোঝাতে পারে না।

ছায়াকে তার অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে সৌরভ চলে গেলো নিজের অফিসে। নামার সময়ও ছায়া কিছু বললো না। তবে যেটা করলো সেটা সৌরভের মনটাকে মুহূর্তেই ভালো করে দিলো। ছায়া কিছুটা চলে যাবার পর আবারো ফিরে এসে সৌরভের গোছানো চুল গুলোতেই হাত বুলিয়ে যেন আরো একটু গুছিয়ে দিলো। সুন্দর করে হাসলো। তারপর আবারো চলে গেলো। সৌরভের মনে তখন হাজার রকমের প্রজাপতি রঙ ছড়িয়ে উড়ে গেছে। ঠিক যেমনটা হয়েছিলো যেদিন ছায়াকে সে প্রথম দেখেছিলো। মেয়েটাকে এই এতো গুলো দিনেও তার কাছে পুরোনো মনে হয়নি। বরং প্রতিটা মুহূর্তে সে নতুন ভাবে ছায়ার প্রেমে পড়েছে। নতুন ভাবে উপলব্ধি করেছে ছায়ার জন্য তার মনে তৈরী হওয়া ভালোবাসা।

সৌরভ ব্যাংকে জব করে। তার অফিসটা গুলশানে। ছায়ার অফিস থেকে খুব বেশি দূর না। মিনিট পাঁচেকের মতো লাগে। এদিকে অফিস টাইমও মিলে যায় দুজনের। তাই প্রতিদিনই দুজনে এক সাথে বাসা থেকে বের হয়ে যে যার অফিসে চলে যায়।  দিনটা ব্যস্ততায় কাটার পর এক রাশ ক্লান্তি নিয়ে যখন দুজন বাসায় ফিরে তখন একে অন্যের মুখটা দেখার সাথে সাথে যেন সমস্ত ক্লান্তি উধাও হয়ে যায়। ছায়ার অফিস যদিও চারটার মাঝে শেষ হয়ে যায়। তার কাজের চাপ সৌরভের মতো না। এদিকে সৌরভকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করেও এক্সট্রা কিছু সময় নিজের কাজ গোছাতে হয়।  বাসায় ফিরতে ফিরতে তার সন্ধ্যা পেরিয়ে মাঝে মাঝে রাতও হয়ে যায়। এ ব্যাংকের নিয়ম কানুন অনেক বেশি জটিল। সাধারন কর্মচারী থেকে শুরু করে ম্যানেজার, মালিক সকলের প্রতিটি নিয়ম মেনে চলতে হয়। অফিস টাইমে বাহিরের জগতের সকল চিন্তা বাদ দিয়ে কাজে মনোযোগ দিতে হবে বলে সে সময় প্রত্যেকের ফোন ব্যাবহার করা নিষেধ। খুব জরুরী কোন প্রয়োজনে অফিসে রাখা ল্যান্ডফোনে টেলিফোন করে নেয় সকলে। তাই রোজকার মতো সেলফোনটা বন্ধ করেই সৌরভ অফিসে নিজের রুমে গিয়ে বসলো।

কাজে মন বসছে না। বার বার ছায়ার মুখটা চেখের সামনে ভাসছে। ছায়ার সাথে তার বিয়েটা হয়েছে সম্পূর্ণ পারিবারিক ভাবে। তবে সেটা শুধু মাত্র সৌরভের চেষ্টার ফল। একটা চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে তাদের পরিচয়টা হয়েছিলো। সেদিন প্রথম দেখাতেই সৌরভ ছায়াতে মুগ্ধ হয়ে পড়ে। সেই মুগ্ধতা তার মাঝে জেকে থাকে অনেক গুলো দিন। তাই চাকরী পাবার পর পরই সৌরভের ফ্যামিলি থেকে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া হয়।  কেনো যেনো ছায়া নিজেও রাজি হয়ে যায় বিয়েতে। সেই যে মেয়েটার সাথে তার পথ চলা শুরু হয়। এখন তার প্রতিটি কাজে, পথে চলার সঙ্গী শুধু ছায়া। 

লাঞ্চ টাইমে সৌরভ নিজের সেলফোনটা ওপেন করে রাজিবের নাম্বারে কল করে।
– ‘হ্যাঁ দোস্ত, বল।’
– ‘কোথায় আছিস ?’
রাজিব ঠাট্টার ছলে বলে,
– ‘চান্দে আছি। অফিস টাইমে কই থাকবো আর?’
– ‘ও তাহলে অফিস শেষ করে অপেক্ষা করিস আমি আসবো। ছায়ার জন্মদিন উপলক্ষে কিছু শপিং করবো।’
– ‘ঠিক আছে।’

ফোন রাখার পর সৌরভ আবারো নিজের সেলফোনটা বন্ধ করে দেয়। আজ তাকে একটু তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। রাজিব নিজেও ব্যাংকে জব করে। তবে তার অফিসটা সৌরভদের বাসার কাছেই। বাড্ডা তে। তাই সৌরভের কাজ শেষ করে আবার রাজিবের অফিসে যেতে হলে তাকে দ্রুত কাজ শেষ করে বের হতে হবে। তা না হলে এ ছেলে আবার বড্ড অভিমানী। একটু দেরী হলেই রাগে চলে যাবে। রাজিব তার ইউনিভার্সিটি সময়কার বন্ধু। খুব কাছের বন্ধু বলে তাদের মাঝে এখনো খুব বেশিই ঘনিষ্ঠতা। কেউ কাওকে ছাড়া কোন কাজ করতে নারাজ। ছায়া আর সৌরভের বিয়েতেও অনেক হেল্প করেছে রাজিব। সৌরভের বাবা মারা যায় অনেক আগেই। মা আর বোনকে নিয়েই তার সংসার ছিলো। মা ও তাকে ছেড়ে চলে যায় বিয়ের এক বছর পরই। এখন সৌরভের পৃথিবীতে আপন বলতে ছায়া আর তার বোন তোহা। এদের বাহিরে যদি সৌরভের জন্য কেউ সব থেকে বেশি ভেবে থাকে সেটা হলো রাজিব। নিজের ভাইয়ের থেকেও বেশি আপন এই বন্ধুটি তার।

অফিস শেষে সৌরভ আর রাজিব গেলো যমুনা ফিউচার পার্কে । সৌরভ ঠিক করেছে ছায়ার জন্য আজ অনেক শপিং করবে। কিন্তু সমস্যা হলো প্রথমেই। শাড়ির দোকানে গিয়ে দেখা গেলো রাজিব বা সে কেউই শাড়ি পছন্দ করতে পারছে না। মেয়েদের জিনিস পত্রে সৌরভের কোন কালেই কোন চয়েজ ছিলো না। এসবে সে কম বুঝে। তাদের সাথে কোন মেয়ে থাকলে ভালো হতো। তখন মাথায় আসলো তোহার কথা। তোহাকে ফোন দিলেই তো হয়। সৌরভ নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে খেয়াল করলো অফিস থেকে বের হয়ে ফোন অন করা হয়নি। একটা শাড়ি দেখতে দেখতে ফোনটা অন করলো সৌরভ। তার প্রায় মিনিট খানিক পরই ফোনটা বেজে উঠলো। একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। সৌরভ নাম্বারটার দিকে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে নিয়ে কল রিসিভ করলো। কে জানতো তার জন্য সব চেয়ে বড় ধাক্কাটা অপেক্ষা করছে! ওপাশ থেকে একটা ভারী পুরুষ কন্ঠ বললো,
– ‘ছায়া আপনার স্ত্রী ?’
সৌরভের চোখে মুখে খেলে গেলো একরাশ বিস্ময়। লোকটা কে ? ছায়াকেই বা কী করে চিনে ? নিজেকে সামলে কোন ভাবে সে বললো,
– ‘জি।’
লোকটা হেয়ালি না করেই যেন বললো,
– ‘ আপনার স্ত্রী আর নেই। দ্রুত চলে আসুন।’
তারপর হসপিটালের ডিটেইলস বলে লোকটি ফোন কেটে দিলো।

কি যেনো একটা হয়ে গেলো ! সৌরভের পিঠ বরাবর শিরদাঁড়া হয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত লম্বা ভাবে নেমে গেলো। চারপাশটা স্তব্ধ লাগছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। নিশ্বাসটা যেন আঁটকে গেছে। কন্ঠনালী ভেদ করে আর কোন শব্দ বের হতে পারলো না।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে