এ পথচলা | ছোট গল্প গল্প পোকা

0
2901

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০

ছোটগল্প: “এ পথচলা”
কলমে: যারিন সুবাহ
ক্যাটাগরি: সেড এন্ডিং
তারিখ: ১০/১১/২০

“ঘন কালো মেঘের আড়ালে আমি হারিয়ে যাচ্ছি। নিস্তব্ধতা ভর করছে সবখানে…দিনশেষে আমি এক একলা পথিক!”

বেলা ১২টা,
মাত্র বাসায় ফিরছিলো সাবা, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে তার মনে কথাটি নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে উঠলো। তিনজন মেয়ে মিলে এক ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে সাবারা। বাকি দু’জন নিজেদের কাজে চলে গিয়েছে। বাসায় আপাতত সে একাই! তালা খুলে ভিতরে ঢুকে সাবা। ক্লান্ত শরীরটা নিমিষেই যেন আরো ক্লান্ত হয়ে উঠে। জুতো জোড়া খুলে সাবা খালি পায়ে এগিয়ে যায় নিজের রুমের দিকে। শরীরটা এতোই ক্লান্ত যে একগ্লাস পানিও হাতে তুলে নিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে না। সিঁড়ি বেয়ে
যখন উপরে উঠছিল তখনও ক্ষুধায় তার হাত পা কাঁপছিল।
বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সাবা, সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে। চোখ বরাবর ফ্যানের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে সাবা, চোখের সামনে মেলে ধরে নিজের বাম হাত। আঙুলগুলো তুলে ধরে সে, হাত টানটান করে আঙুলগুলো একনাগাড়ে দেখতে থাকে। হঠাৎ তার মনে হলো, সে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, বেশ শুকিয়ে যাচ্ছে। নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সাবা। মাত্রই সে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে, ডাক্তার আজকে তার হাতে রিপোর্ট ধরিয়ে দিল। রিপোর্টটা আবার দেখতে সাবা ব্যাগে হাত দিবে, মুহূর্তেই ব্যাগের ভেতর থেকে ফোনের রিং বেজে উঠলো। ফোন বের করতেই সাবা দেখলো, মায়ের ফোন এসেছে। দ্রুত ফোন রিসিভ করে কানের কাছে ধরে সাবা।

ওপাশ থেকে সাবার মা বলে উঠলো,
__”কী রে, কই তুই? তোকে কতক্ষণ আগেও ফোন দিলাম। কী করিস?”
শান্ত কণ্ঠেই সাবা বলল,
__”কাজ করছিলাম মা। তোমরা কেমন আছো? বাবার শরীরটা ভালো আছে তো?”
আজকে আর সাবার কণ্ঠে অন্যদিনের মতো বাবা মায়ের সাথে কথা বলার উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পায় না। বাকি দিনগুলোর মতো সে আজ মায়ের সাথে কথা বলতে উৎফুল্লতা বোধ করছে না। তার কাছে আজ সব‌ই বিরক্তিকর!
ওপাশ থেকে মা বললেন,
__”হ্যাঁ, আমরা তো ভালোই আছি। কিন্তু শোন না? অনেক জরুরী কাজে ফোন দিলাম রে। তোর বাবার ওষুধ তো শেষ। হাতের জমানো টাকাও শেষ। এই মাসে বেতন পেয়েছিস? বাড়ি আসবি কবে? কিছু টাকা দিতে পারবি এখন?”
আবারও সাবা বড়ো সরো এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। নিজের কণ্ঠ যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখেই সে বলল,
__”আচ্ছা আমি টাকা পাঠাচ্ছি। একটু অপেক্ষা করো!”
মা ফোন রেখে দেয় ওপাশ থেকে।

ফোন রেখেই সাবা হতাশ ভঙ্গিতে জানালার বাহিরে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ তার মনে হলো, টাকা তো নেই হাতে! এখন কোথা থেকে টাকা আনবে সে?
মাথা ধরে যাচ্ছে সাবার। ক’দিন আগেও তো ফ্ল্যাটমেট দু’জনের থেকে টাকা ধার নিলো সে। এইতো মাত্র ক’দিন আগে! আবার চাইবে সে এখন? সাবার এই মুহূর্তে নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। আসলেই, ঢাকা শহরে একা চলতে বড্ড কষ্ট! অনেক বেশি কষ্ট!
তার আবার মনে পড়লো, তার স্টুডেন্ট সেলিমার কথা। আজকে তাহলে একটু আগে আগে পড়াতে যাবে, তখন তার মায়ের কাছ থেকে এডভান্স টাকা আনার চেষ্টা করবে সাবা। এরপর বাবার জন্যেও টাকা পাঠাতে পারবে আবার নিজের জন্যেও কিছু রাখবে। ফোন হাতে তুলে সাবা আবারও মাকে ফোন দেয়। ফোন রিসিভ হতেই সাবা বলল,
__”মা, বিকেলে টাকা পাঠাই? এখন সম্ভব না। পড়াতে যাচ্ছি!”
ওপাশ থেকে মা বললেন,
__”আচ্ছা, তবে জলদিই পাঠাস। বেশি দেরি করিস না!”

ফোন রাখতেই আবার একদলা দীর্ঘশ্বাস পালাক্রমে নাক দিয়ে বেরিয়ে যায় সাবার। মায়ের কথা বলার ধরণ কেমন যেন ছিল। ভারী ছিল কণ্ঠ! সাবা বুঝে মায়ের এ কণ্ঠের পিছে কতো অজানা কথা লুকিয়ে ছিল। পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ায় বাবার অসুস্থতার জন্যে সাবাকে মাত্র ২০ বছর বয়সে পুরো পরিবারের চাপ মাথায় নিয়ে পথে নামতে হয়। আপাতত পড়ালেখার পাশাপাশি চারটে স্টুডেন্ট পড়ায় সাবা। মাসে এই যা ইনকাম। হয় না, চলে না এইটুকু টাকায়। তবুও লবণ ভাত তো খেতে পারে? তাতেও তো সুখ আছে! অন্তত বাবাকে, মা’কে তো কষ্ট করতে হচ্ছে না!
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সাবা। সময়ের অপচয় করা হচ্ছে তার। একটু পরেই তো বের হতে হবে। নিজেকে ফ্রেশ করে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে সাবা। গরম করে খেতে বসে, প্রথম লোকমা হাতে তুলে মুখে পুরতে নিবে তখনই সাবার পেট গুলিয়ে আসে, বমি পায়। সাবার হাতের অঞ্জলি থেকে গড়িয়ে পড়ে খাবার। বাজে খাবার, পানি খেয়ে উঠে যায় সাবা, এই খাবার খাওয়ার যোগ্য না!

ক্ষুধা পেটে নিয়েই বেরিয়ে পড়ে সাবা। স্টুডেন্টের বাসায় গিয়ে কিছু একটা খাওয়া যাবে। দিবে তো কিছু একটা হলেও!
ক্ষুধায় মোড়ানো পেট নিয়ে ছাত্রকে পড়াতে বসায় সাবা। অপেক্ষার পালা ভারী হয়, সাবার ক্ষুধার্ত শরীর আরো কাতর হয়ে উঠছে। হাত পা ভীষণ রকমের কাঁপছে। শেষে না পেরে সাবা তার ছাত্রকে বলেই বসলো,
__”তোমার আম্মু কোথায়?”
ছাত্রের সোজা জবাব,
__”আম্মু তো বাইরে, সন্ধ্যায় আসবে।”

ঠিক সে মুহূর্ত! ঠিক এই মুহূর্তে সাবার কাছে মনে হলো, এর থেকে লজ্জার বিষয় আর কিছু হতে পারে না। না পারছে ক্ষুধা সহ্য করতে আর না পারছে কিছু চেয়ে খেতে। বেচারি সাবা পেটের ক্ষুধা নিয়েই পড়ানো শেষে বেরিয়ে পড়ে। বিল্ডিং এর থেকে নেমে দ্রুত হাঁটা ধরে সাবা। আরেকজনকে পড়াতে হবে এখন, দেখা যাক! তার বাসায় গিয়ে কিছু অগ্রীম টাকা পাওয়া যায় কি-না আর যদি পেটের ক্ষুধা মেটানো যায়! সাবার মাথায় বুদ্ধি আসছে, যদি এখানেও কিছু খেতে না দেয়, টাকা পেলে কোনো হোটেলে গিয়ে সে এক প্লেট ভাত খেয়ে নিবে।

__”আন্টি, একটা কথা ছিল। আমাকে কি এই মাসের বেতনটা অগ্রিম দেওয়া যাবে?”
__”হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই! তুমি একটু বসো মা আমি নিয়ে আসছি।”

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন সাবা, এমন ভঙ্গিমায় নিঃশ্বাস ছাড়লো। প্রত্যেকটা স্টুডেন্টের বাসায় আজকে কোনো না কোনো সমস্যা ছিলই। শেষবেলায় এসে যেন সে তার পুরো সুখ খুঁজে পেলো। পেটে খাবারও পড়লো আর হাতে টাকাও পেলো।
বিকাশে টাকা পাঠিয়েই সাবা মা’কে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয়।

বেলাশেষে ঘরে ফিরে সাবা। এটা সম্ভবত তার রোজকার রুটিন হয়ে যাচ্ছে। বিরক্ত লাগছে তার এই জীবন। খেতে পারছে না, উঠতে পারছে না, একটু ঘুমোতে পারছে না ঠিক মতো! এভাবে ক’দিন?

রাতেরবেলা ফ্ল্যাটমেট দু’জনের সাথে সাবা আড্ডায় বসে। দু’জনই জানে সাবার অসুস্থতার কথা! দিন দিন তার দুর্বলতা আর ক্রমশ এভাবে চুল পড়া, শুকিয়ে যাওয়া, চোখ বেরিয়ে আসা দেখে তারা দু’জনই সাবাকে জোর করে হাসপাতালে পাঠায়। গত সপ্তাহের শুরুতে টেস্ট করেছিল। আজকে ড. এর কাছে যায় রিপোর্ট নিয়ে। ড. সাফ জানিয়ে দিয়েছে সাবাকে, ওর ব্লাড ক্যান্সার। প্রতি মাসে মাসে রক্ত বদলাতে হবে। আর বাকি স্টেজগুলো তো পড়েই আছে। ওদের দু’জনকে জানাতেই ওরা বলল,
__”কী করবি এখন?”
সাবার কাটকাট জবাব,
__”কিছুই করার নেই! যতদিন বেঁচে আছি, বাবা মায়ের জন্যে করে যাই। যেটুকু পারি অল্প হলেও জমিয়ে যাই।”
__”এভাবে ক’দিন সাবা?”
__”জানি না!”

ধীরে ধীরে রাত ঘনিয়ে আসছে। ঘুমন্ত সাবা এই মুহূর্তে বেশ শান্ত, বেশ!
রাত পেরিয়ে আবার শুরু হবে নতুন ভোরের খেলা, আবার শুরু হবে সময়ের স্রোতের ঢেউয়ের তালে ছুটে চলা…কিন্তু ক’দিন শুধু! ক’দিন পর শেষ হয়ে যাবে সাবার পথচলা। শেষবেলায় এসে হাহাকার উঠবে একটি পরিবারের!
পথচলা…একাকী পথচলা খুব কঠিন, খুব!

__সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে