এসো শব্দহীন পায়ে
শেষ পর্ব
মিশু মনি
.
একটা নতুন সকালের সূচনা। পাখির কিচিরমিচির শব্দে চারদিক মুখর। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মা রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে রূপসা এখন ঘুমের অতলে ডুবে আছে। সকালের আলো ফুটলেও চোখে এখনো এক শহর ঘুম। মাঝখানে একবার ঘুমটা হালকা হয়ে এলো। দরজা টানার শব্দ মস্তিষ্কে কিঞ্চিৎ নাড়া দিয়ে গেলেও রূপসা চোখ মেললো না। মনে হলো কেউ একজন দরজা ঠেলে নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করেছে। চোখ মেলতে মেলতেই আবারও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো রূপসা।
মানুষটা রূপসার কাছে এসে দাঁড়ালো। রূপসার ঘুমন্ত মুখ যেন পরীদের রাজ্য থেকে ধার করে আনা কোনো পরীর মুখোশ। মেয়েটা বাস্তবে যতটা সুন্দর, ঘুমন্ত অবস্থায় তারচেয়েও দ্বিগুণ সুন্দর হয়ে গেছে। কিংবা হতে পারে এ চোখের ভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। দীর্ঘদিন পর দেখা, তাই হয়তো একটু বেশি অপূর্ব লাগছে।
বাড়িতে চলছে কোলাহল। রূপসার ঘুমটা আবারও হালকা হয়ে আসে। এত শান্তির ঘুম বহুদিন ওর চোখের ত্রীসামানায় ভর করে নি। চোখ দুটো কিঞ্চিৎ মেলতেই কিছু একটা দেখে বুকটা ধক করে উঠলো। স্বপ্ন ভেবে উড়িয়ে দিতে গিয়েও এড়িয়ে যেতে পারলো না রূপসা। এক লাফে বিছানার উপর উঠে বসলো। তিতাস!
তিতাস নিচু হয়ে এগিয়ে এলো। রূপসা রীতিমতো কাঁপছে। ভয়, আনন্দে আর সুখের উত্তেজনায় ও খেই হারিয়ে বসে আছে। তিতাস ভ্রু দুটো নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘খুব অবাক হয়েছো?’
রূপসা কথা বলতে পারলো না। ওর চক্ষু চড়কগাছ। তিতাসের অপ্রত্যাশিত আগমণ ওকে যেমন চমকে দিয়েছে, তেমনই এত সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরে প্রবেশ করতে বাঁধা না পাওয়াটা ওর কাছে আরো বেশি আশ্চর্যের মনে হচ্ছে।
তিতাস রূপসার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘বিছানা থেকে নামো। একটা কথা বলবো।’
রূপসা নামতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। তিতাস খপ করে ধরে ফেলে ওকে। হাত ধরে নামায় বিছানা থেকে। রূপসার চোখে মুখে, গালে এখনো ঘুম লেগে আছে। তিতাস দ্রুত মনেমনে ঠিক করে ফেললো, ওকে নিয়ে একটা ছবির এলবাম করবে। এলবামের নাম হবে, অপ্সরীর চোখে ঘুম।
রূপসার মেঘের মত ঘন কেশগুলো ঘাড়ে ও পিঠে লেপ্টে আছে। এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবকটা চুল। কিছু চুল গালের উপর এসে বিস্তৃত হয়ে কিছুটা গাল দখল করে রেখেছে। রূপসা একহাতে চুলগুলো সরিয়ে ওড়না ঠিক করে শান্ত হয়ে দাঁড়ালো। রূপসার সামনে হাঁটুগেরে বসে তিতাস পকেট থেকে একটা আংটি বের করে এগিয়ে দিলো রূপসার দিকে। জানালা গলে সকালের সোনালী আলো তখন সরাসরি ঘরে ঢুকে পড়েছে। সেই আলোয় চিকচিক করে উঠলো স্বর্ণের আংটি টা।
তিতাস সেটা এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘আমায় বিয়ে করবে?’
রূপসা ঠিক বুঝতে পারছে না, ও স্বপ্নে আছে নাকি বাস্তবে। এও বুঝতে পারছে না ওর এখন হাসা উচিত নাকি কান্না করা। স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও ওর অনুভূতিরা বলছিলো, ‘পা কাঁপছে কাঁপুক। মেয়ে দ্রুত বল, বিয়ে করবো।’
তিতাস রূপসার হাত ধরে এক আঙুলে আংটি পরিয়ে দেয়। তারপর বলে, ‘মাথায় ঘোমটা দিয়ে আমার সাথে আসো।’
রূপসা কিছুই বুঝতে পারে না। ওর কাছে সমস্ত ব্যাপারটাই ঘোর ঘোর লাগছে। তিতাস রূপসাকে নিয়ে আসে বারান্দায়। এতক্ষণ যেখানে কোলাহল চলছিলো সেই জায়গাটা স্তব্ধ হয়ে যায় হঠাৎ করেই। সেখানে বসে আছেন রূপসার বাবা ও অপরিচিত অনেকেই। কেউ একজন বলে ওঠেন, ‘এসো মা এসো।’
রূপসা অবাক হয়ে দেখে ইনি হচ্ছেন সেই রূপবতী মহিলা যার ছবি তিতাসের ফোনে দেখেছিলো। অসম্ভব স্মার্ট। সেদিন ওর খুব জানতে ইচ্ছে করেছিলো এই রূপবতী মহিলাটি কে?
তিতাস বললো, ‘ইনি আমার মা।’
রূপসা কাছে গিয়ে ওনাকে সালাম জানায়। হঠাৎ খেয়াল করে দেখে রূপসার মা দূর থেকে নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে রূপসার দিকে। রূপসার ইচ্ছে করছিলো হাতের আংটি টা লুকিয়ে ফেলতে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আংটিটা লুকানোর বদলে রূপসা সেটা আরো উজ্জ্বল করে তুলে ধরে। হাতটা এমন ভাবে মেলে ধরে যেন এটা ওর গর্ব। সবাই দেখুক। রূপসা দূর হতেই বুঝতে পারে মায়ের নির্বিকার দুটো চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আবার ঝাপসা হয়ে যায়।
রূপসা তিতাসের মায়ের পাশে বসে মাটির দিকে চেয়ে থাকে। ভাবে, এই পর্বের আগের অধ্যায়গুলোতে ওর জীবনটা এমন ছিলো না। দুর্বিষহ এক জীবন হয়ে উঠেছিল ওর। ইচ্ছে করছিল জলে ডুবে মরতে।
বিয়ে ভেঙে গেছে আজ পাঁচদিন হলো। ক’দিন ধরে পুরো বাড়ি জুরে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিলো। নিজের ঘর, নিজের আপন বাড়ি আর বাড়ির মানুষ গুলো সবকিছু কেমন অচেনা হতে শুরু করে। এখনো চোখের সামনে ভাসছে দুঃস্বপ্নের মত এই চারটা দিন। বাবা মা কেউই রূপসাকে সহ্য করতে পারছেন না। মা কথায় কথায় তিরিক্ষি মেজাজ দেখাচ্ছেন। যেন বিয়ে ভেঙে যাওয়ার দোষটা রূপসারই। অথচ রূপসা এসবের কিছুই চায় নি। চায় নি সাহিলকে বিয়ে করতে, আবার চায়নি বিয়েটা ভাংতে।
রূপসার ছোট ছোট কাজেও মা ওকে বিশ্রী ভাষায় গালাগাল করতেন। এরই মাঝে একবার সাহিল ফোন দিয়ে রূপসার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো। সেটা নিয়েও বড়সড় একটা গোলমাল বেঁধে যায়। মা ছুটে গিয়ে অকারণে রূপসার চুল টেনে ধরে জিজ্ঞেস করেন, ‘ ওর সাথে তোর কিসের এত পিরিতি? কি করছোস ক? পুরুষ মানুষ দেখলে শইল্যে জ্বালা ওঠে না?’
এরকম অসংখ্য বিশ্রী কথা শুনতে শুনতে মেজাজ তিক্ত হয়ে ওঠে রূপসার। জীবনে যেন শকুনের ছায়া নেমে আসে। ঘরের দরজা লাগিয়ে নীরবে অশ্রুপাত করতে থাকে। দরজা বন্ধ করে কান্না করার পেছনেও মা একটা কারণ খুঁজে বের করেন আর গালাগাল করতে থাকেন রূপসাকে।
বাবার মুখের দিকে তাকানো যায় না। বাড়ির অশান্তিটাও বিরাট পর্যায়ে নেমে আসে। মেজো চাচা নতুন করে আলাদা টিউবওয়েল বসানোর ব্যবস্থা করেছেন। একদিকে মিস্ত্রিরা কাজ করে আর অন্যদিকে মেজো চাচী বকবক করছেন। গ্রামের দু/চারজন মহিলা চাচীর বকবকানি শুনছেন। মনে হচ্ছে তারা ঝগড়া পরিদর্শক। কার কতটা দোষ, কোন পক্ষ কি করেছে, কি জবাব দিয়েছে সবকিছু নোট করে নিয়ে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে দেয়াটা ওনাদের একমাত্র কাজ।
সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যাপার হচ্ছে, রূপসার বিয়ে ভাঙা নিয়ে গ্রামে একটা হইহই রৈ রৈ ব্যাপার ঘটে গেলো। বিয়ে ভাঙাটা যেন মজার কোনো ব্যাপার। মহিলারা জটলা বেঁধে গল্প করার সময় হঠাৎ করেই একজন বলে ওঠে, ‘রূপসার নাকি বিয়া ভাইঙা গ্যাছে? মাইয়ারে জীবনেও কারো লগে কথা কইতে দেয় নাই। বিয়া ভাঙে ক্যা?’
আরেকজন মহিলা ফোড়ন কেটে উত্তর দেয়, ‘মেয়ারে সিন্ধুকে তুইলা রাখার জন্যি বাপে বিয়া ভাইঙে দিছে। ছেলেপক্ষ চাইছিল পাঁচটা লাখ টেকা। দিলে কি হইতো? সরকারি চাকরি করে। ওরকম লাখ লাখ টেকা মেয়া সারাজীবন নষ্ট করতে পারতো। অত জমাজমি, টেকা পয়সা দিয়া লাভ কি? মেয়ার বিয়া না হইলে ঘরে বুড়ি হইয়া পইড়া থাকবে। বুড়ি হইলে কে আর বিয়া করবে?’
এরকম আলোচনা সমালোচনা সারাক্ষণ চলছে ই। একটা মেয়েকে মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ করার জন্য এই এক অস্ত্র ই যথেষ্ট। কথাগুলো রূপসার কানে আসে মেজো চাচীর মাধ্যমেই। চাচী বারান্দায় বসে বিলাপ করতে করতে এসব বলেন, রূপসা নিশ্চুপ হয়ে শোনে। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে ঘরের দরজা বন্ধ করে বিষ খেয়ে মরে যেতে।
গতকাল দিনের বেলা সবাই উঠোনে কাজে ব্যস্ত ছিলো। বাড়ি ছিলো একদম ফাঁকা। কোনো এক অজানা কারণে রূপসা খাতার পাতা উল্টে তিতাসের ফোন নাম্বার বের করে। বাবার মোবাইলটা চুপিচুপি নিয়ে এসে কল দেয় উক্ত নাম্বারে। প্রথমবার রিং হতেই যখন তিতাস রিসিভ করে, বুকটা ধক করে ওঠে রূপসার।
রূপসা প্রথমেই ওকে যে কথাটা জিজ্ঞেস করে, ‘ আপনি নাকি বিদ্যাশ?’
‘আমি তো বিদেশ থেকে চলে এসেছি।’
এই একটা বাক্যই রূপসার জীবনের সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। এক পশলা বৃষ্টির পর আকাশটা যেমন ঝকঝকে রোদে ভরে ওঠে, তেমনই এক সোনালী আলোর আভাস দেখতে পায় রূপসা। তিতাস শত শত প্রশ্নে রূপসাকে পাগল করে দিচ্ছিলো। রূপসার মন থেকে বাঁধ ভাঙা জলের স্রোতের মত বেরিয়ে আসতে থাকে সব কষ্টের কথা। কিন্তু তিতাস সবকিছু শুনতে চায় না। রূপসাকে কথার মাঝপথে আটকে দিয়ে বলে, ‘ওয়েট ওয়েট, একটা কথা বলি আগে? জানো আমি এই কয়েকটা দিন একটা রাতও তোমাকে না ভেবে ঘুমাই নি?’
তিতাসের কথাগুলো রূপসাকে যেন মহাসাগরে ডুবন্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করে আনে। তিতাসের জন্য কত কিছু ভেবে রেখেছিলো, সব ভাবনা বুকের ভেতর থেকে ভেসে ওঠে। সেও তো আকাশের কাছে কতবার বার্তা পাঠিয়েছিলো, তিতাস তাহলে বার্তাগুলো পেয়েছে।
কিন্তু কাল কথা বলতেই আজ সকালেই এমন হঠাৎ করে তিতাস পুরো পরিবার নিয়ে এসে হাজির হবে এ যেন রূপসার কল্পনারও অতীত। ও মাটির দিকে তাকিয়ে এসবই ভেবে চলেছে।
তিতাসের মা বাবাকে দেখে ছুটে আসে রূপসার মেজো চাচা। রূপসার বাবার সাথে তাদের ঝগড়া চলছে চলুক, তিতাসের বাবা মায়ের আতিথেয়তাকে উপেক্ষা করতে পারবেন না তিনি। সেবার তাদের বাসায় গেলে কত আদর সম্মানটাই না করলেন। ওদের মত মানুষ হয় না।
তিতাসের বাবা সরাসরি রূপসার বাবাকে বললেন, ‘আমার ছেলে আর আপনার মেয়ে দুজন দুজনকে পছন্দ করে। আমরা সব শুনেছি। ওসব নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। কথা হচ্ছে, আমরাও যৌতুক চাই, তবে যৌতুক হিসেবে আপনার মেয়েটাকে আমার মেয়ে হয়ে থাকতে হবে। মেয়ে হতে না পারলে কিন্তু মশাই আমিও বিয়ে ভেঙে দেবো।’
বলেই তিনি হেসে উঠলেন। তিতাস সামনের চেয়ারে বসে মুরুব্বি দের কথা শুনছে। বিয়েটা আজকেই করতে পারলে ভালো হয়। তবে বিয়ে যেদিনই হোক, রূপসাকে না নিয়ে এখান থেকে এক পা ও এগোবে না তিতাস।
সমাপ্ত