এসো শব্দহীন পায়ে
পর্ব ৯
মিশু মনি
.
তিতাস খেতে বসেছে। সাথে মন্তাজ মাস্টার ও তার ভাইও রয়েছেন। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মন্তাজ মাস্টারের স্ত্রী। ওনার মুখে চিন্তার রেখা স্পষ্ট। তিতাস নিঃশব্দে খাচ্ছিলো। খাবারের এক পর্যায়ে মাস্টার সাহেব বলতে আরম্ভ করলেন, ‘দেখেন বাবা আমরা গ্রামের মানুষ। অত ঘোর প্যাঁচ আমাদের মধ্যি নাই। আপনারা শহরের মানী গুণী ব্যক্তি। আপনাদের উপর তো কথা চলতি পারে না। আমার মেয়ারে যখন না করেই দিয়েছেন, না ই থাকুক। আবার বন্ধুর সাথে বিয়েশাদির আলাপ নাই বা টানলেন।’
তিতাস নিশ্চুপ। এর উত্তরে চুপ থাকাই শ্রেয়। তাছাড়া মুরুব্বি এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছেন। ওনাকে আর আঘাত দেয়াটা উচিৎ হবে না।
এমন সময় কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়ার শব্দ হলো। বিকট শব্দ। সবাই খাবারের প্লেট থেকে মুখ তুলে বাইরে তাকালেন। মাস্টার সাহেবের স্ত্রী দরজা খুলে বাইরে দেখার চেষ্টা করলেন। বিয়ের বিষয়টা আপাতত এখানেই স্থগিত রয়ে গেলো। হাত ধুয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন মাস্টার সাহেব ও তার ভাই। কোথায় বাজ পড়লো, কারো কিছু পুড়লো কি না দেখা দরকার। আজকাল বাজ পড়ার কারণে বহু লোকের প্রাণহানি হচ্ছে।
তিতাসও আর খেতে পারলো না। কোনোমত খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে বসে রইলো। মাস্টার সাহেবের স্ত্রী ওকে ভেতরে যেতে বললে তিতাস বলল, ‘আমি কি একটু বাইরে যেতে পারি?’
– ‘অবশ্যই যাইতে পারবেন। আপনারে কে বাঁধা দিবে? যান। তয় সাবধানে থাকবেন।’
তিতাসকে একটা ছাতাও দেয়া হলো। মাস্টার সাহেবের স্ত্রী অনেক গোছানো মহিলা। প্রত্যেকটা কাজে যত্নের ছাপ। একটা টর্চও দিয়েছিলেন। তিতাস টর্চ নেয় নি।
বাজ কোথায় পড়েছে তা নিয়ে তিতাসের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ওর হাতে এটাই সুযোগ। একবার রূপসাদের বাড়িতে যেতে হবে। বাড়ির প্রধান ফটক খুব সম্ভবত বন্ধ আছে। এত রাতে গেট খোলা থাকার কথা নয়। তবুও একবার চেষ্টা করা যেতে পারে। মন থেকে কিছু চাইলে নাকি পাওয়া যায়। রূপসার সাথে একবার দেখা করতেই হবে।
টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝেমাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিজলীর আলোতে পথ দেখে এগোচ্ছে তিতাস। রূপসাদের বাড়ির গেট বেশ ভালোভাবেই আটকানো। প্রাচীর টপকে ভেতরে যেতে হবে। কিন্তু ভেতরে গিয়ে ধরা পড়লে এ জন্মের মত মান সম্মান ধূলায় মিশে যাবে। তাছাড়া অনুমান ঠিক নাও হতে পারে। অনেক ভাবনা চিন্তা করার পর বাড়ির চারিদিকে একবার পায়চারি করে এলো তিতাস। চারিদিকেই প্রাচীর। হাল ছেড়ে দিয়ে তিতাস আবারও মাস্টার সাহেবের বাড়িতে ফিরে এলো।
ঝড় বৃষ্টির রাতটা বলতে গেলে নির্ঘুমই কেটে গেলো। রাত জেগে মনেমনে খুব রাগ জন্মেছে তিতাসের। মেজাজ ভীষণ রুক্ষ। রূপসার সাথে দেখা করার জন্য যে আগ্রহটা ছিল, সেটা একেবারেই দমে গেছে। এখন বাবা মায়ের উপরও রাগ হচ্ছে। সারা রাত জেগে জেগে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, সকাল হলেই এখান থেকে চলে যাবে। আর কোনোদিনও এই গ্রামে আসবে না। রূপসার সাথে কখনো দেখাও করবে না। রূপসার অধ্যায়টা এখানেই সমাপ্ত হয়ে যাক।
সকালের রোদ উঠেছে। আকাশ বেশ পরিষ্কার। প্রকৃতির সতেজতা খানিক বেড়েছে। সকালে উঠে নাস্তা করেই বিদায় নিয়েছে তিতাস। গতকাল থেকে আর একবারও ওয়ামিয়ার সাথে দেখা হয় নি।
মানব মন বড়ই বিচিত্র। যার সাথে দেখা করার জন্য সেই দূর থেকে ছুটে এসেছে, এখন তার সাথে কথা না বলেই চলে যাচ্ছে। যাবার বেলায় একবার ফিরেও তাকালো না। কেন যেন নিজের উপর রাগ জন্মাচ্ছে।
১০
রূপসা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে চুপিচুপি বের হয়ে পুরো গ্রাম হেঁটে এসেছে। মনেমনে চাইছিলো একবার যেন মানুষটার সাক্ষাৎ পায়। এক বুক হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। আজকে গেটের একটা পাল্লা খোলা রেখে বারবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছিল। সারাদিন অপেক্ষার প্রহর গুণলো কিন্তু আজ আর কেউ এলো না। যেদিন প্রথম প্রেম ভালোবাসা বুঝতে শিখেছে, সেদিন থেকেই মনেমনে এক রাজকুমারের প্রতীক্ষা করতো রূপসা। তিতাসকে দেখার পর মনে হয়েছিল এই সেই রাজকুমার। কিন্তু আজ সারাদিন অপেক্ষা করেও যখন কেউ এলো না, তখন হতাশা ছাড়া প্রাপ্তির কোঠায় আর কিছুই নেই।
রাতে ঘুমাতে গিয়ে রূপসার ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো। যাকে চেনেনা, জানেনা, তার প্রতি এ কেমন দরদ। তাকে দেখার জন্য মন উচাটন করে, তার কথা শোনার জন্য ব্যকুল হয়ে থাকে। এসব কেন হচ্ছে! ক্ষণিকের পরিচয়ে এ কোন মোহে ফেলেছে সে। প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না রূপসা। আর যে ভালো লাগে না। মনের মাঝে অশান্তি শুরু হয়ে গেছে।
তিতাস বাসায় ফিরলে মামা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো দেখা হয়েছে কি না? তিতাস একটা নিশ্বাস ফেলে শুধু উত্তর দিলো, ‘হয়েছে। কিন্তু কিছুই বলা হয় নি।’
ঘুমানোর আগে ছোটমামা তিতাসের রুমে এসে জেঁকে ধরলো। কি কি ঘটেছে সব শোনার জন্য। তিতাস বিরক্তি নিয়ে সব খুলে বললো।
মামা আফসোস করে বললো, ‘এটা কোনো কাজ করলি ভাগ্নে? গিয়ে কিছু না বলেই ফিরে এলি?’
– ‘কি করার ছিল মামা? রাতে রিস্ক নিয়ে ওর বাড়ির চারপাশে ঘুরে এলাম। প্রাচীর টপকে বাড়িতে ঢুকলে যদি আটকে যেতাম, কি হতো ভাবতে পারছো?’
– ‘তা ঠিক। কিন্তু আজকে আসার আগে একবার দেখা করে আসা যেত না?’
– ‘মামা আমি অত ছেঁচড়া নই। জীবনেও এরকম কাজ কখনো করিনি।’
মামা হেসে বললো, ‘জীবনে এভাবে কারো প্রেমেও তো পড়িস নাই ভাগ্নে।’
– ‘চুপ থাকো। এটাকে প্রেম বলবা না। এটা শুধুমাত্র ভালো লাগা।’
– ‘আচ্ছা বুঝলাম। তো এত রেগে যাচ্ছিস কেন তুই?’
– ‘তাহলে কি ধেই ধেই করে নাচবো?’
মামা হাসলো। তিতাস ক্যামেরার লেন্স ঠিকঠাক করছে। কিছুক্ষণ পর মামার কাছে এসে চোখে চোখ রেখে বললো, ‘ভালোলাগাকে সবসময় পাত্তা দিতে নেই। ভালোলাগা তাহলে মাথায় উঠে নাচে।’
– ‘তোর বড্ড বদরাগ তিতাস।’
– ‘সে যাই বলো, ফিরে আসার পর ইচ্ছে হলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। ইচ্ছে না হলে চ্যাপ্টারটা আর ওপেন করবো না। তুমিও আর এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলবা না।’
– ‘বিদেশে যাচ্ছিস, এরমধ্যে মেয়েটা যদি কারো প্রেমে পড়ে যায়?’
– ‘এতকিছু ভাবলে জীবনে কিছু ই করা যায় না মামা। ওর বর্তমানে কোনো প্রেমিক যে নেই, তার নিশ্চয়তা আছে? মরিচিকার পিছনে ছুটে লাভ নেই। ডাইরেক্ট বিয়ে।’
মামা হাসতে হাসতে বললো, ‘বিদেশে গিয়ে আবার কাউকে বিয়ে করে আনিস না যেন।’
রূপসার বান্ধবী তিথি গল্প করতে এসেছে। দু বান্ধবী বিছানায় পাশাপাশি উপুড় হয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে আর গল্প করে। আজকে কথায় কথায় তিথি বললো, ‘জানিস ওয়ামিয়ার ভালো সম্বন্ধ এসেছিলো। শহরের ছেলে। শুনলাম ছেলেটা দেখতে নায়কের মত সুন্দর। লম্বা, কোঁকড়ানো চুল, গায়ের রং আবার ফর্সা নয়, উজ্জ্বল শ্যামলা।’
রূপসা নির্বিকার গলায় বললো, ‘ছবি তোলে?’
তিথি ঝলমলে গলায় বললো, ‘হ্যাঁ ছবি তোলে। তুই শুনেছিস তাহলে?’
রূপসা উত্তরে শুধু একটা নিশ্বাস ফেললো। মলিন মুখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো।
তিথি বললো, ‘কিন্তু ওরা নাকি ওয়ামিয়াকে পছন্দ করে নাই। বলি, সারা গ্রামে ওয়ামিয়ার রূপের প্রশংসা। ওয়ামিয়ার নিজেরও তো ভাবের শেষ নাই, নিজে ফর্সা বলে একেবারে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। কাউকে দাম দেয় না। কিন্তু শহরের মানুষের কাছে এইসব ধলা রংয়ের কোনো দাম নাই বুঝলি? ওদের কাছে গুণটাই আসল।’
– ‘আমার কি কোনো গুণ আছে?’
– ‘কেন রে? এ কথা কেন বলছিস?’
– ‘বল না তিথি, আমার কি কোনো গুণ আছে?’
– ‘তুই আমার কাছে এই গ্রামের সবচেয়ে ভালো মেয়ে। লক্ষী মেয়ে। তুই শ্যামলা হলে কি হবে, তোর ফেসে একটা মায়া আছে। চোখ দুটা কি সুন্দর। কেন জিজ্ঞেস করছিস এসব?’
রূপসা উপুড় হওয়া থেকে চিৎ হয়ে শোয়। মুখটা বড় মলিন। করুণ স্বরে বলে, ‘আমার অন্তরে বড় যন্ত্রণা রে তিথি। আমার শরীরে বিষ ঢেলে দিয়ে গেছে। বিষের জ্বালায় দিনরাত ছটফট করছি। দেহমনে এ কেমন আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেলো।’
– ‘কি বলিস এইসব? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’
– ‘আর সহ্য হয় না রে। মনে কি যে যন্ত্রণা, শরীরে কি যে কষ্ট।’
তিথি মুচকি হেসে বললো, ‘এই বয়সে এমন হয় রে। কারো আদর সোহাগ পেতে ইচ্ছে করে?’
রূপসার বুকটা ধুকধুক করে ওঠে। তিথির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি এসব কখনোই ভাবি না। আমার কি হয়েছে নিজেও জানিনা রে।’
– ‘আমি বুঝছি। আমারও এমন হয়।’
দুষ্টুমি হাসি হাসলো তিথি। রূপসা বললো, ‘তুই যা ভাবছিস তা নয়। আমার মন বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। খুব মন খারাপ লাগছে। তুই যা, আমি এখন একটু কাঁদবো।’
তিথি অবাক না হয়ে পারলো না। রূপসার গায়ে হাত রেখে বললো, ‘তোর কি হইছে রুপু?’
– ‘আমার মরণ হয়েছে রে তিথি। তুই যা, আমি কাঁদবো।’
– ‘কেন কাঁদবি আমাকে বল?’
– ‘যা তিথি, চলে যা। আমাকে দুঃখ পোহাতে দে।’
তিথি আর কথা বাড়ায় না। ধীরপদে খাট থেকে নেমে আসে। রূপসা বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শোয়। তিথির খুব জানতে ইচ্ছে করছে রূপসার হঠাৎ কি হয়েছে। কিন্তু আর প্রশ্ন করার সাহস পায় না। নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।
চলবে..