এসো শব্দহীন পায়ে
পর্ব ১৪
মিশু মনি
রূপসা বাড়ি ফিরে কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে এলো। বারান্দা থেকে দাদী ও চাচী হা করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। অনেক্ষণ বাড়ির বাইরে ছিলো ও। কি জানি আজ কপালে কি আছে!
কিছুক্ষণ পরে মা রূপসার ঘরে এলেন। মেয়ের দিকে অনেক্ষণ অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তিনি। রূপসা মেঝের দিকে তাকিয়ে। ওর চোখ ভয়াবহ রকমের ফোলা। খুব কেঁদেছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মা রূপসার একদম কাছে এসে মৃদু স্বরে বললেন, ‘কই গেছিলি?’
রূপসা কোনো উত্তর দিলো না। মা আরো কঠাক্ষ দৃষ্টি দিলেন মেয়ের দিকে। কিন্তু জোরে কথা বলতে পারলেন না। ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বল কই গেছিলি?’
– ‘বাগানে।’
– ‘কোন ভাতারের সাথে দেখা করতি গেছিলি?’
রূপসার চোখে আবারও পানি আসতে শুরু করেছে। ও উত্তর দিতে পারলো না। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। উত্তর না পেয়ে মা রূপসার দুই গাল দুদিকে এমনভাবে টেন ধরলেন যে, এই বুঝি গাল ছিড়ে যাবে। প্রচন্ড টান লাগছিলো গালে। গাল দুভাগ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। রূপসা দুইহাতে মাকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে মা ওর কান এমনভাবে মলে দিলেন, রূপসার মনে হলো কান দিয়ে রক্ত বের হয়ে যাবে। মা পিঠের উপর ঠাস ঠাস করে দুটো মাইরও বসিয়ে দিলেন। রূপসা দুহাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
মা বললেন, ‘মাগী হইছিস তুই? কার সাথে পুন্দাপুন্দি করতে গেছিলি? বাড়িতে মেহমান আসছে। সবাই ওরে খুঁজতেছে আর ও উধাও। তোর বাপের মান সম্মান সব নষ্ট কইরা দেয়ার চিন্তা ভাবনা করতেছিস তাই না? সত্য কইরা বল কই গেছিলি?’
রূপসা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘বাগানে গেছিলাম। কারো সাথে দেখা করতে যাই নাই। আমার কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নাই।’
– ‘তাইলে কিসের পুট.. মারতে গেছিলি?’
– ‘এমনি গেছিলাম। বিয়ের আলাপ হইতেছে তাই আমার কষ্ট হইতেছে। তোমাদেরকে ফেলে যাইতে চাই না। তাই।’
মায়ের রাগ কিছুটা কমে এলো। উনি আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন। আবার ফিরে এসে বললেন, ‘এত কান্দোনের কিছু নাই। মেয়া হইয়া জন্মিছিস, বিয়া তো করতেই হবে। আমাদের কি বিয়া হয়নাই? সংসার করতিছি না? শোন, মন খারাপ করিস না। ছেলেটা তোর চাচার ঘরে আছে। ওকে নিয়া পুকুরপাড়ে যা। দুই চারটা কথাবার্তা বল। জানি বিয়াতে রাজি হয়।’
রূপসা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মাকে কিছু বলে লাভ নেই। এতে কষ্ট আরো দ্বিগুণ হবে। বুঝ হওয়ার পর থেকে এই রুক্ষ কঠিন মানুষটাকে দেখে রূপসা অভ্যস্ত। তাঁকে কখনোই মায়ের মত মনে হয় নি। মাঝেমাঝে রূপসার মনেহয় অন্যের সৎ মা ও এতটা মানসিক অত্যাচার করেন না। বিয়েটা হয়ে গেলেই ভালো হবে। অন্তত এই নরক থেকে মুক্তি মিলবে।
রূপসা ভালো করে মুখ ধুয়ে পাউডার মেখে প্রস্তুত হলো ছেলের সামনে যাওয়ার জন্য। চোখ দুটো এখনো অনেক লাল। মাথায় ওড়না টেনে যথাসম্ভব চেষ্টা করলো দৃষ্টি নিচের দিকে রাখতে।
ছেলেটা রূপসাকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কি অবস্থা?
রূপসা স্বাভাবিক হওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করে বলল, ‘ভালো’
– ‘মন ভালো হয়েছে এখন?’
– ‘হুম।’
– ‘আপনাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। সবাই খুঁজছিল। আমি তো ভাবলাম খুব মন খারাপ করে কোথাও বসে আছেন।’
ওকে চুপ থাকতে দেখে ছেলেটা বললো, ‘একটা পাখি চলে গেছে তাতে এত মন খারাপ করতে নেই। আবার একটা পাখি আনবেন। সে আপনার সব দুঃখ ভুলিয়ে দেবে।’
রূপসা বলল, ‘মা বলছে আপনাকে নিয়ে বাইরে হাঁটতে যেতে।’
– ‘আচ্ছা চলুন।’
পুকুরের পাশেই একটা টঙ। উপরে পেয়ারা গাছ। খুব গরমে সবাই এখানে বসে হাওয়া খায়। রূপসা ছেলেটাকে সেখানে বসতে বলে নিজে দাঁড়িয়ে রইলো। ছেলেটাও ভদ্রতার সহিত বসতে বললো রূপসাকে। রূপসা ইতস্তত করছিল। ছেলেটা বারবার অনুরোধ করায় বসতে হলো।
ছেলেটা বলল, ‘আমার নাম জানেন আপনি?’
রূপসা দুদিকে মাথা নাড়ালো।
ছেলেটা বললো, ‘সাহিল আহমেদ। আমি ব্যাংকে একটা চাকরিতে আছি। বেতন মোটামুটি। একটা সংসার ভালোভাবে চালিয়ে নেবার মত। আপনার সম্পর্কে তেমন কিছু ই জানিনা। আপনার কি এখনো বেশি মন খারাপ?’
রূপসা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘না’
– ‘পড়াশোনা কতদূর?’
– ‘ইন্টার পাশ করছি। ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। কেউ ভর্তি হইতে দেয়নাই।’
– ‘কেন?’
– ‘অত পড়িয়ে লাভ কি? আমি তো আর চাকরি করে বাপ চাচাকে খাওয়াবো না।’
– ‘ইন্টারের রেজাল্ট কি ছিল?’
– ‘৪.৬৭’
– ‘বাহ! চমৎকার রেজাল্ট। আর এসএসসি তে?’
– ‘৪.৯১’
সাহিল বেশ উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘এত ভালো রেজাল্ট করেছো তারপরও পড়তে দেয় নি? সরি, তুমি আমার অনেক ছোট তাই তুমি করে বললাম। কিছু মনে করছো না তো?’
– ‘না।’
– ‘তুমি যখন ক্লাস নাইনে পড় তখন আমার পড়াশোনা শেষ। আমি তোমার অনেক সিনিয়র।’
রূপসা প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে রইলো। পানিতে মাছ খেলা করছে। রূপসার ইচ্ছে করছে মাছ হয়ে যেতে। মানুষ ধরে মেরে ফেলতো, ব্যস সব কষ্ট শেষ।
সাহিল বলল, ‘তুমি আর পড়াশোনা করতে চাও না?’
– ‘না। যার পড়াশোনা হবেই না তার পড়তে চেয়ে লাভ কি?’
– ‘আমি যদি বিয়ের পর তোমাকে ভালো কোনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেই?’
রূপসা চমকে উঠলো। সাহিলের মুখের দিকে এই প্রথম ভালোভাবে তাকালো ও। সাহিল বলল, ‘যদি বিয়েটা হয় তবে আরকি। আমাদের আত্মীয় স্বজন সবারই তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। সবাই আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে।’
– ‘উত্তর দিয়ে দেন। আপনার কি পছন্দ হয় নাই?’
সাহিল লাজুক হেসে পুকুরের জলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল, ‘তুমি মেয়েটা অনেক ভালো। অনেক সংসারী একটা মেয়ে। মেধাবী। এরচেয়ে বেশি আর কি দরকার বলো? আমার দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই।’
রূপসা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো, ‘আমি একটা কথা বলবো?’
– ‘হ্যাঁ বলো।’
রূপসা বলল, ‘একটা ছেলে আমাদের এলাকায় আসছিল। আমার দিকে এমনভাবে তাকাইতো, আর এমনভাবে কথা বলতো। আমি ভাবছিলাম সে আমাকে পছন্দ করে। মনেমনে আমিও তাকে পছন্দ করে ফেলি। কেন জানি তার প্রতি আমার একটা মায়া কাজ করতো। যেদিন শুনলাম আমার বিয়ের সম্বন্ধ আসছে শহর থেকে, ভাবছিলাম ওই ছেলে টাই পাঠিয়েছে। আমি অনেক স্বপ্ন দেখে ফেলি। আজ যখন দেখলাম সে আসে নাই, আপনি আসছেন। তখন খুব কষ্ট হইছে আমার।’
সাহিল কি বলবে বুঝতে না পেরে রূপসার দিকে তাকিয়ে রইলো। রূপসা বলল, ‘তার সাথে আমার খুব একটা কথা হয় নাই। আসলে আমার মনের ভুল ছিল সব। আজকে শুনলাম সে নাকি বিদেশ চলে গেছে। আমাকে যদি পছন্দই করত, এভাবে না জানিয়ে বিদেশ যেত না। সে আসলে আমাকে একটা ভুলের মধ্যে ফেলে দিছিলো। এইজন্য কাঁদতেছি।’
সাহিল স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলো, ‘বুঝতে পেরেছি। দেখুন, কিছু মানুষ থাকে যারা ছোটখাটো ভালোলাগাকে পাত্তা দেয় না। আবার কিছু মানুষ থাকে যারা ভালোলাগার জন্য জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেয়। হয়তো সে প্রথমটাতে পড়েছে আর আপনি দ্বিতীয় টায়। এতে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। অনেকের পাঁচ সাত বছরের প্রেমও কোনো পূর্বাভাস ছাড়া ভেঙে যায়।’
রূপসার খুব ভালো লাগলো কথাটা শুনে। সহজ স্বাভাবিক গলায় বললো, ‘আমার জীবনে এই একটাই ভুল। তাও কথাবার্তা না বলেই। এ জীবনে পুরুষ মানুষদের সাথে কথা বলার সুযোগ আমি পাই নাই।’
– ‘এটা খুব সামান্য ভুল। ব্যাপারই না। আমি সহজভাবে নিয়েছি।’
– ‘কিন্তু আমার নিজের ভুলটাই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে জানেন? ওই মানুষটার জন্য আমি কষ্ট পাচ্ছি না।’
– ‘বাহ! তুমি অনেক বুদ্ধিমতী।’
– ‘আপনাকে এসব কেন বললাম জানেন?’
– ‘না তো। কেন?’
রূপসা মাথা উঁচু করে বললো, ‘কারণ আমি আপনাকে বিয়ে করবো। আপনার জানা দরকার ছিলো।’
চলবে..