#এসো_আমার_গল্পে
#পর্ব_০২
#আয়ানা_আরা (ছদ্মনাম)
হেমন্তের সকালে যখন হালকা কুয়াশায় সবকিছু ঢেকে যায় তখন প্রকৃতিকে অপূর্ব সুন্দর মনে হয়। কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্য যখন উঁকি দেয় তখন স্নিগ্ধ আলােয় ঝলমল করে কুয়াশায় ভেজা প্রকৃতি। সাধারণ দিনের চেয়ে ঘুম অতি দ্রুতই ভেঙ্গে গেলো। উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে যেয়ে দেখলাম মলিন মুখে সবাই বসে আছে!অবশ্য তাদের এই মলিনাতার কারণটাও আমার অজানা নয়। আমাকে আসতে দেখে যেনো তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসলো!
আম্মু আমার কাছে এসে বললেন,”তুই টেবিলে বস তোর জন্য ব্রেকফাস্ট আনছি।”
মাথা নাড়িয়ে টেবিলে যেয়ে বসলাম ভ্রুজোড়া কুচকে সবাইকে একবার পরখ করলাম। সবার মুখেই গম্ভির,মলিন ভাব বিরাজমান!হবেই না কেনো? কালকের যেই ঘটানা ঘটলো এইরকম মুখ করে রাখাটাই স্বাভাবিক।
নাস্তা সেরে লিলির পাশে বসলাম। ও নিজেও চুপচাপ বসে আছে খোঁচা দিয়ে বললাম,”কি হয়েছে তোর লিলি?এইভাবে বসে আছিস কেনো?”
লিলি স্বাভাবিক গলায় বলল,”কিছু না।”
আমি জবাবে কিছু বললাম না। সবার নিরবতার মাঝে ফুপি বলে উঠলো,”আজকে চলে যাবো আমি!ভাবছিলাম বৌভাত খেয়ে তারপর যাবো কিন্তু যেইখানে জামাই’ই চলে গেছে সেইখানে আর থেকে লাভ কি?”
ফুপির কথার আসল মানে বুঝতে আমাদের কারো’ই বোধগম্য হলো না!বাবাও আর জোর করলেন না থাকার জন্য!বললেন,”আচ্ছা!”
আমি উঠে বাবার পাশে বসে বললাম,”তোমার মন খারাপ কালকের ঘটনা নিয়ে?”
উনি জবাবে কিছু বললেন না শুধু আড়চোখে একবার তাকালেন। বললাম,”যা হয়েছে তা তো ফিরে পাওয়া যাবে না তাই না?এখন ভবিষ্যত নিয়েই চিন্তা করতে হবে!”
আব্বু ধীর গলায় বললেন,”আমি যদি জানতাম এইভাবে তোর ফুলের মতো জীবণটা নষ্ট হয়ে যাবে তাহলে বিভোরের সাথে কখনোই বিয়ে দিতাম না।”
আলতো হাসলাম আমি!বললাম,”এটাকে অতীত ভেবে ভুলে যাও মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করো!”
উঠে চলে আসলাম। তাফিদা বেগম স্বামীর কাঁধে হাত রেখে বলেন,”বুঝেছো কি বলল স্পর্শী?”
আফতাব সাহেব প্রতুত্তরে কিছু বললেন না চুপ করে রইলেন। তিনি মনে করেন তার জন্যই তার মেয়ের ফুলের মতো জীবণটা নষ্ট হয়েছে।
কিছুদিন পর_
কারো জন্য জীবণ থেমে থাকে না!আমার জীবণও থেমে নেই। ভার্সিটি যাওয়া আসা করি!পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষা দিতেই ভার্সিটি এদিক সেদিক যাওয়া আসা। আব্বু এই কয়দিন আমার শশুড়ের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ!উনি ইচ্ছে করেই যোগাযোগ করতে চান না কারণ যোগাযোগ করতে গেলেই আমার ও বিভোরের ডিভোর্সের কথা উঠবে যা মনে হয় না তিনি চান।
৩.
১ বছর পর
পুকুরের পাশে বসে আছি আমি। মনটা একদম ফুড়ফুড়ে লাগছে কেনো জানি!এর মাঝেই কোত্থেকে ছুটে এলো স্পর্শ আমার ছোট ভাই। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে অস্পষ্ট স্বরে বলল,”আ-পু,আম্মু ডেকেছে তোমাকে দ্রুত যাও।”
ভ্রুকুঞ্চন করে তাকালাম। ডেকেছে তো কি হয়েছে এতো হাঁপানোর কি হলো এতে?উঠে বাড়ির ভিতরে ঢুকে এক দফা চমকালাম!তাদের চিনতে মিনিট খানেক লাগলো!চিনতে পেরেই মাথায় যেনো এক প্রকার বাজ পড়লো!এইখানে কেনো এরা তাও আবার এক বছর পর?আমাকে নিতে আসেনি তো?এইরূপ হাজারো ভাবনার মাঝে আম্মুর শীতল গলায় বেশ চমকালাম।
“স্পর্শীতা!মাথা ঘোমটা দিয়ে শশুড়-শাশুড়ির সামনে যা। সালাম দিস!”
আম্মুর কথামতো মাথায় ঘোমটা দিয়ে উনাদের সামনে উপস্থিত হলাম। মিষ্টি করে সালাম দিলাম। শাশুড়ি শক্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন যেনো আমাকে দেখে বেশ বিরক্ত উনি!তাতে কি?আমি কি তাদের ফের আসতে বলেছিলাম নাকি তারা সেধে এসেছে! শশুড়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি হাসি খুশি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বললেন,”বউমা!দাঁড়িয়ে আছো কেনো বসো বসো!”
আমি মুচকি হেসে বসলাম। যাক উনি তো আর শক্ত চোখে শাশুড়ির মতো তাকান নি!
ভদ্রতা বজিয়ে দুইজনকেই জিজ্ঞেস করলাম,”কেমন আছেন আপনারা?”
শশুড় খুশি মনে বলেন,”এইতো আল্লাহ তায়ালা যেমন রেখেছেন।”
শাশুড়ি গম্ভির হয়ে বলে,”ভালো!তুমি?”
আমি বললাম,”জ্বী আলহামদুল্লিল্লাহ ভালো!”
ইতিমধ্যে আব্বু খবর পেয়ে নিচে আসলেন। গম্ভির মুখ নিয়ে তাদের সালাম দিলেন তারা সালামের উত্তর দিলেন। আব্বু বসে বললেন,”হঠাৎ আপনারা?”
তাহসীন সাহেব হেসে বললেন,”কেনো বেয়াইন হঠাৎ করে আসতে পারি না?”
উনি আগের ন্যায় গম্ভির মুখ করে বললেন,”তা না!”
তাহসীন সাহেব কথা ঘুরিয়ে বললেন,”এই বিষয় ছাড়ুন!আমরা স্পর্শীতাকে নিতে এসেছি সাথে করে!”
চমকালাম আমি!আমাকে নিতে এসেছে?তাদের ছেলে কি ফিরে এসেছে?হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মাথায় এক অজানা ভয় ঝেঁকে ধরেছে।
আব্বু বললেন,”মানে?একবার বলেছিলাম না আমি?আপনাদের ছেলে না ফিরলে স্পর্শীতাকে আপনার ছেলের হাতে তুলে দিবো না আমার মেয়েকে।”
উনি আমতা আমতা করে বললেন,”আসলে আমি একজনকে পাঠিয়ে ছিলাম জানেনই তো!উনি নিশ্চয়ই বলেছিলো বিভোর বিদেশ চলে গিয়েছে। কিছুদিন আগে ও দেশে ফিরেছে তাই আমি চাই স্পর্শীতাকে নিয়ে যেতে সেই হিসেবেই আপনাদের বাসায় আসা। দয়া করে না করবেন না!”
আব্বু কিছুক্ষন গম্ভির থেকে বলে,”আচ্ছা যাবে স্পর্শীতা আপনাদের সাথে।”
আব্বুর কথায় আমার শশুড়ের চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলেন। মনে হয় তিনি ভেবেছিলেন আব্বু দিবে না আমাকে উনাদের সাথে কিন্তু এতো দ্রুতই যে রাজী হয়ে যাবে উনার কল্পনার বাহিরে ছিলো তা।
অসহায় চোখে তাকালাম আব্বুর দিকে!আব্বু উঠে চলে যান।
আমার শাশুড়ি আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভির স্বরে বললেন,”যাও!ব্যাগ গুছিয়ে নিচে এসো!”
মাথায় নাড়িয়ে উঠলাম। রুমে এসে বিছানায় বসে রইলাম। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে এতো সহজেই আব্বু কিভাবে রাজী হলো?উনার তো আরো কঠিন কথা শোনানোর কথা ছিলো কিন্তু এক কথায় রাজী হয়ে গেলেন!
_____________
“তুমি পাগল?মেয়েকে ওদের সাথে কেনো পাঠাবে!”
মৃদু রেগে বললেন তাফিদা বেগম। আফতাব সাহেব নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,”কি করবো তাহলে?আচ্ছা তাফিদা!যদি আমি মানা করতাম তাহলে আমার বা তোমার কিছুই হতো না কিন্তু আমাদের মেয়ের হতো পাড়া প্রতিবেশি সমাজের কাছে কটু কথা শুনতে হতো তা কি সহ্য করতে পারতে তুমি?নাকি সারারাত কাঁদতে!”
চুপ করে রইলেন তাফিদা বেগম এর উত্তর উনার কাছে নেই!মেয়ের সুখেই উনি সুখি!তাচ্ছিল্য হেসে বললেন আফতাব সাহেব।
“যা হচ্ছে হতে দাও আশা রাখছি উনারা স্পর্শীতাকে কোনো কষ্ট পেতে দিবে না। সুখিই রাখবে।”
উত্তর দিলেন না চলে গেলেন।
আম্মুকে আমার রুমের সামনে এসে দরজা ধাক্কান। আমি দরজা খুলতেই উনি ভিতরে ঢুকে বলেন,”স্পর্শীতা!রেগে আছিস তোর বাবার উপর?”
আমি হেসে মাথা দুপাশে নাড়িয়ে বললাম,”উহু!রেগে থাকার কি?বিয়ে হয়েছে শশুড় বাড়ি যাবো এটাই স্বাভাবিক।তুমি এতো ব্যস্ত হয়ে কথা বলছো।”
আম্মু আমার গালে হাত রেখে বলেন,”অভিমান জমেছে তোর ভিতর!আমি মা বুঝতে পারছি বুঝেছিস!তোর বাবার দিক থেকে তিনি সঠিক!আচ্ছা স্পর্শীতা অভিমান জিনিসটা জানিস বড্ড খারাপ!যত বড় হবে সম্পর্কের দুরুত্ব তত বাড়বে!”
তাচ্ছিল্যের সহিত হাসলাম কোনো উত্তর দিলাম না। উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না আপাতত।
আম্মু আমাকে ব্যাগ গুছাতে সাহায্য করলেন। আমি বরাবরই চুপ করে রইলাম!টু শব্দ পর্যন্ত করলাম না। ব্যাগ গুছানো শেষ হতেই আম্মুকে বললাম,”আমি গেলে কষ্ট লাগবে না তোমার?স্পর্শের।”
“হু!অনেক কষ্ট লাগবে! ২১ বছর থেকেছিস আমাদের সাথে কষ্ট লাগাটাই স্বাভাবিক।”
মনে মনে হাসলাম। হুট করে স্পর্শ এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আমি এক হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ও বলল,”আপু প্লিজ যেয়ো না তোমাকে অনেক মিস করবো!”
আমি বললাম,”আমিও তোকে অনেক মিস করবো স্পর্শ। মাকে জ্বালাবি না কোনোরকম দুষ্টুমিও করবি না কিন্তু!”
এর মাঝেই নিচ থেকে ডাক পড়লো।
#চলবে