#এলিয়েন।
#তিতিশ্মা_মুসাররাত_কুহু।
#পর্ব_৬
আমার আর সহ্য হচ্ছেনা এসব।
তাই সহ্যের সীমা টা ছাড়িয়ে যেতেই আমি আমার মোবাইল টা দেয়ালে ছুড়ে মারলাম।
আর মোবাইল টা সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।
কিছুতেই আজ দু চোখ বুজতে পারছিনা আমি।ঘুমহীন চোখ।
সারা রাত ঘুমহীন কাটিয়ে দিলাম।
সকালে আম্মু ডেকে বললেন,
-আরফা,উঠেছিস?কখন যাবি তোর আন্টির বাসায়?
-যেতে ইচ্ছে করছেনা মা,তোমরাই বরং চলে যাও।
-কি বলিস?রাতেই না বললি যাওয়া উচিৎ আমাদের।আর এখন বলছিস যেতে ইচ্ছে করছেনা।
তুই না গেলে আমরাও যাবোনা।
-আচ্ছা আচ্ছা যাবো।
-কখন যাবি?সকালে গেলেই তো ভালো হয়।সারাদিন একটু বোনের বাসায় থাকা যাবে।গল্প করা যাবে।
বিকেল থেকেই তো আবারর বাড়ী ভর্তি মানুষের সমাগম হবে।
গেলে সকালেই চল।
-আচ্ছা,
-তাহলে আমি নাস্তা বানিয়ে নেই।খেয়ে দেয়ে রেডী হ তাহলে।
-ঠিক আছে।
আম্মুর নাস্তা বানানো হলে আমরা সবাই নাস্তা করে আন্টিদের বাসায় যাই।
আন্টিদের বাসায় পা রাখতেই কেমন যেন লাগছিলো।
আগে তো কখনো এমন হয়নি।
আন্টি আমাদের দেখে খুশিতে অনেক টা দৌড়ে আসেন,আর এসেই আমাকে আর আম্মুকে জড়িয়ে ধরেন।
আমাদের নিয়ে বসতে দেন।
-তোরা সকাল সকাল এসেছিস আমি কত খুশি হয়েছি।
বস আমি নাস্তা নিয়ে আসি তোদের জন্য।
-আমরা খাওয়া দাওয়া করেই এসেছি।তুই এত তাড়াহুড়ো করিস না তো।
বস আমাদের সাথে।
-কি ভাইজান,ভালো আছেন তো?
-আলহামদুলিল্লাহ্ ভাই।আপনি কেমন আছেন?
-জ্বী ভালো।
-আসেন তো না এখন বাসায়,
-আর ভাই ব্যস্ততায় সময় পাড় করছি।
আর যাবোই বা কোন মুখ নিয়ে ভাই,
ছেলেটা আমার যা করলো,
এরপর আর কিভাবে…
-কি যে বলেন না ভাই।
এসব আমরা কবেই ভুলে গেছি।
এসব মনে করে সংকোচ বোধ করবেন না একদম।
আব্বু আর আংকেলের কথা শুনে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।
কতই না কষ্ট পেয়েছেন তারা।
আবার হৃদকেও সবাই ভুল বুঝেছে।
অথচ দোষি তো আমি।
হৃদ নয়।
এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আমি,
কোথাও হৃদকে খুঁজে পাচ্ছিনা।
কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করারও সাহস পাচ্ছিনা যে হৃদ কই।
আন্টি আমাদের সবাইকে নাস্তা খেতে দিলেন।
আমরা হালকা নাস্তা করলাম।
তারপর আন্টি আমাকে নিয়ে তার রুমে গেলেন।
-আয় তোকে কিছু দেখাই আজ।না দেখালে হয়তো কোন দিন শান্তি পাবোনা আমি।
-কি দেখাবেন আন্টি?
-তুই বস এখানে।
আন্টি আমার ঘাড় ধরে আমাকে খাটে বসিয়ে দিলেন।
আমি বসলাম,আর আন্টি তার আলমারি খুললেন।
আমি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার আর হৃদের পরিবারের সবার এটাচ ছবি।
-আন্টি,এই ছবি গুলোতো আগে দেখিনি।
যেদিন তোর ইন্টারের রেজাল্ট দেয়,সেদিন এসে লাগিয়েছিলাম।
তুইতো এর পর আর আসিস নি।তাই দেখিসনি।
-ওহ।
আন্টি আলমারি খুলে অনেক গুলো শাড়ী বের করলেন,
আর অবাক করা বিষয় হচ্ছে,
যেই শাড়ীই বের করছে,সব শাড়ীর ই ডাবল পার্ট আছে।
মানে এক রকমেরই দুইটা করে শাড়ী।
সেটা হোক পুরাতন ডিজাইনের কিংবা নতুন ডিজাইনের।
আন্টি শাড়ী গুলো বের করে বললেন,এগুলো সব আমি কিনেছি।নিজ হাতে কিনেছি,
জানিস এখানে একই রকমের দুটো করে শাড়ী কেন?
-কেন আন্টি?
-কারণ সব শাড়ী আমি আমার আর তোর জন্য মিল করে কিনেছি।একটা তোর আর একটা আমার।
ভেবেছি তোকে যেদিন হৃদের বউ করে ঘরে তুলবো সেদিন তোকে সব গুলো শাড়ী দিবো।
আর আমরা দুজন মিলে এল সাথে এক রকমের শাড়ী পরবো।
কিন্তু দেখ,কি ভাগ্য আমার।
ছেলেটা আমার সব স্বপ্ন মাটির সাথে মিশিয়ে দিলো।
আমার এবার কলিজাটা যেন ছিড়ে যাচ্ছে।
একজন মায়ের মনে এতটা কষ্ট দিলাম আমি?
-আচ্ছা শোন,এই শাড়ী গুলো আমি না তোর বিয়েতে উপহার দিবো।
নিবি না?
বল না নিবি?
-আন্টি এগুলোর উপর হৃদের বউ এর হক আছে শুধু।
আমার না।
আপনি তাকেই দিয়েন শাড়ী গুলো।
কথাটা কতটা কষ্টে যে বলেছি আমি তা শুধু আমিই জানি।
আন্টি এবার কিছু গহনা বের করে দেখালেন,
দেখ এই গুলোও আমি তোর জন্য গড়ে রেখেছিলাম।
আন্টি আমাকে সব দেখাতে দেখাতে এক সময় আমার হাতে দুইটা চুড়ি পরিয়ে দিয়ে বললেন,
তুই তো কিছুই নিবিনা এসবের।
কিন্তু আমি চাই এই চুড়ি দুটো তুই নে।
-প্লিজ আন্টি,এত দামী জিনিষ আমি নিতে পারবোনা।
-একটা থাপ্পড় লাগাবো।
এই দুইটা আমি তোকে হৃদের মা হিসেবে না।
তোর মা হিসেবে দিলাম।
এই চুড়ি এখন খুললে তোর খবর আছে।
আমি আন্টিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলাম।
আন্টিও কাঁদছে।
-কাঁদিস না মা।
কাঁদিস না।
তুই খুব সুখী হবি,আমি দোয়া করি।
আমি মনে মনে বলি,
আমার সুখ যে তোমার বাড়ীতে আন্টি।
যা আমি এত দিনে বুঝেছি।
কিছু ক্ষণ পর আম্মু আসেন আন্টির রুমে,
কি রে কি করছিস তোরা?
আন্টি সব কিছু আলমারিতে রাখতে রাখতে বললেন,
-এইতো,আরফাকে জিজ্ঞেস করছিলাম কোন শাড়ীটা পরবো।
আসলে আন্টি চাচ্ছিলেন না আম্মুকে এসব দেখাতে।
কারণ আম্মু খুব কষ্ট পাবে এগুলো দেখে।
সেই জন্য।
আমার হাতে স্বর্ণের চুড়ি দেখে আম্মু জিজ্ঞেস করেন,
-কিরে আন্টির চুড়ি পরেছিস?
তোর গুলো পরতে বললাম তখন দেখি পরলিনা।
-আন্টির না,
ওরই এগুলো।
আমি ওকে দিয়েছি।
-এত দামী জিনিষ ওকে দিলি তুই?
-কেন আমার মেয়েটা কি কম দামী নাকি?
আম্মু আন্টিকে জড়িয়ে ধরলেন।
তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই আম্মু জিজ্ঞেস করলেন,
হৃদ কই রে?
হৃদকে যে দেখছিনা।
-আর বলিস না,ও আজ কাল কি করে না করে কোন খবরই পাইনা।
ছেলে আমার বড় হয়ে গেছে এ কয় দিনে।
-মানে?
-এখন আর সাদাসিধে হৃদ নেই আমার।
এখন কেমন হয়েছে দেখলেই বুঝবি।
দুপুর হয়ে গেলো হৃদের কোন খবর নেই।
হয়তো যুথীকে নিয়ে ঘুরছে।
বসে আছি আমি হৃদের রুমে,
কি সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে রুমটা হৃদ।আন্টি একবার বলেছিলেন,হৃদের রুম হৃদ যে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে।
একদম গোছালো আমার ছেলেটা।
হঠাৎ চোখ গেলো ওর ডায়েরীর দিকে।
হাতে নিয়েও খুলার সাহস পাচ্ছিনা,
কারো অনুমতি ছাড়া তার ডায়রী পড়া নাকি উচিৎ না।
কি করবো কি করবো ভাবতে ভাবতে খুলেই ফেললাম ডায়রীটা।
ডায়রীর শুরু থেকে,সব ওর জীবনে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ কাহিনী।
এক এক করে পড়তে লাগলাম আমি।
শেষমেস আমাকে নিয়ে লিখা ঘটনায় চোখ পড়লো আমার।
আরফা, আমার কাজিন হয়।মেয়েটা দেখতে খুবই সুন্দর।ওর মুখের দিকে তাকালে যে কেউ ওর মায়ায় আবদ্ধ হতে বাধ্য হবে।
ভাগ্যগুণে বাবা মা আমার এই মেয়েটার সাথেই নাকি বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন।
যদিও মা বাবা বলার আগে আমি কখনো ওকে সেই নজরে দেখিনি।
কিন্তু যেদিন জানলাম,সেদিন থেকে ওর জন্য অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করতে শুরু করলো।
ওর জন্য হৃদয়ের অন্তস্থঃতল থেকে ভালবাসার ফুল ফুটতে লাগলো।আমি সাদাটে এক মানব।তেমন গুছিয়ে লিখতে পারিনা।কবি বা লেখক হলে হয়তো আরো সুন্দর করে লিখতে পারতো।
জীবনের প্রথম ভালো লাগা আমার আরফা।
এখন ভালবাসাও বলা যায়।ওকে আমি ধীরেধীরে ভালবেসে ফেলেছি।আমার খুব ইচ্ছে আমরা দুজন মিলে নদীর ধারে ঘুরতে যাবো।
এ কথা শুনলে হয়তো আরফা আমাকে পাগল বলবে,
মানুষ তার ভালবাসার মানুষ টাকে নিয়ে নামী দামি জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে।আর আমি কিনা এই নদীর ধারে যাবার স্বপ্ন দেখি।
আরফা সেদিন ধবধবে সাদা একটা শাড়ী পরবে।আর সাথে থাকবে কালো রঙের ব্লাউজ।
যা আমি ওকে কিনে দিবো।
আর আমিও পরবো সাদা রঙের পাঞ্জাবী।কালো জিন্স প্যান্ট।
আরফা হয়তো বলবে,মানুষ লাল নীল হলুদ রঙ পরে ঘুরতে বের হয়।
আর আমরা কিনা সাদা কালো পরবো।
এ কেমন পছন্দ তোমার।
আর আমি তখন বলবো,আমি যে সবার থেকে আলাদা রে বউ।
এইটুকু পড়ার পর আমি লক্ষ্য করলাম আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে ডায়রীর পাতায় পড়লো।
দম নিতেও যেন আজ কষ্ট হচ্ছে আমার।
আমি জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলছি,
আমি এসব কিছুই বলতাম না রে হৃদ।
কারণ আমি জানি তুমি সবার থেকে আলাদা।আর তোমার পছন্দও সবার থেকে আলাদা।
তুমি যে আমার এলিয়েন।
আর তখনই হুট করে এসে কে যেন আমার হাত থেকে ডায়েরীটা নিয়ে নিলো।
আমি তাকিয়ে দেখি হৃদ।
-কি করছো তুমি এটা?
তুমি জানোনা,কারো অনুমতি ছাড়া তার ব্যক্তিগত ডায়েরী পড়া উচিৎ না।
-প্লিজ আমাকে শেষ করতে দিন।
আমি পড়বো ডায়েরী টা।
-না,
আমি চাইনা যুথীকে নিয়ে লিখা ফিলিংস গুলো কেউ পড়ে নিক।
-কথা দিলাম আমি শেষের দিকের কিছুই পড়বোনা।
শুধু আমার টপিক টুকু পড়েই আমি রেখে দিবো।
-সরি।আমার ব্যক্তিগত ডায়েরী আমি ছাড়া শুধু মাত্র যুথীর পড়ার অধিকার আছে।
আর কারো নয়।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি পড়বোনা আপনার ডায়েরী।কিন্তু আজ আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।
আজ না বলতে পারলে হয়তো আর কোন দিনও বলতে পারবোনা।
প্লিজ একটু শুনবেন?
-কি বলবে বলো?
-আমি ভণিতা করে কথা বলতে পারিনা,না পারি কাব্যিক ভাবে গুছিয়ে কথা বলতে।
কিন্তু এসব না পারলেও আমি সোজাসুজি ভাবে কথা বলতে পারি,
তাই সোজাসুজি ভাবেই আপনাকে কথা টা বলছি,
হৃদ,আমি আপনাকে..
হৃদ এই হৃদ কোথায় তুমি?
উফফ এসেই নিজের রুমে ঢুকে গেছো?আমাকে বাইরে একা বসিয়ে রেখে।
কথা টা সম্পূর্ণ হবার আগেই যুথী চলে আসে।
আমি যুথীর দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর আচমকা একটা ঝড় বয়ে গেলো।
যুথীর পরনে ধবধবে সাদা রঙের একটা শাড়ী,আর কালো রঙের একটা ব্লাউজ।
আমি দেখে তাকিয়ে রইলাম।
আর যুথী আমাকে দেখে হেসে দিয়ে বল্লো,
আমার ননদ টা তাহলে আমার আগেই এসে গেছে?
চলবে…