#এবং_স্ত্রী
#পর্ব_৩১
#Jannatul_Ferdos
হাসপাতালের এদিকে ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে মানুষজন।কেউ কেউ হয়তো স্বজন হারানোর কান্নায় ভেঙ্গে পেড়েছেন কেউবা স্বজনকে খুঁজে পাচ্ছেন না বলে আহাজারিতে জর্জরিত হয়ে আছেন।বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় ছেড়ে যাওয়া একটা বিমান উপরে উঠার কিচ্ছুক্ষণ পরই বিধ্বস্ত হয়।ভয়ংকর এক দুর্ঘটনা ঘটে সকাল ১০ টা নাগাদ। সেই বিমানে যাত্রীর আত্মীয় স্বজনেরা এখন তাদের আপনজনদের খুঁজতে ব্যস্ত।সেই দলের মধ্যে এসে যোগ দেয় নিরুপমা ও উৎসের পরিবার।বিমান দূর্ঘটনার শিকার হয়েছেন মিসেস ডালিয়া।তার খোঁজ করতেই তাদের আগমন।মিসেস ডালিয়া তার এতোদিনের করা অন্যায়গুলো বুঝতে পেরে খুব অনুতপ্ত বোধ করেন।কিন্তু এদেশে থাকলে তার এই অনুতপ্ত বোধের যে যন্ত্রণা তা যেন আরো ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতর হবে।তাই মিসেস ডালিয়া নিরুপমা ও উৎসের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখে তা তার বাসার কেয়ার টেকারের কাছে দেয়। এরপর ফ্লাইট ছাড়া আগ মূহুর্তে উৎসকে ফোন দিয়ে জানায় সে আজীবনের জন্য আমেরিকা চলে যাচ্ছেন তার ছেলের কাছে।কেয়ার টেকার এর থেকে চিঠিটি নিয়ে আসতে বলেন।এইখানে থেকে নিজের অপরাধবোধে দগ্ধ হয়ে পুড়ে যাবেন।তখন কথায় কথায় তিনি উৎসকে বলেছিলেন ১০ নাগাদ তার ফ্লাইট। এরপর উৎস যখন নিউজ দেখেন কন্টিনিউসলি মিসেস ডালিয়াকে ফোন দেন ফোন বন্ধ পায় এরপর উৎস আর দেরি না করে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।এয়ারপোর্টে গিয়ে বিধ্বস্ত বিমানে আরোহন করা যাত্রীদের নাম চেক করে সে শিওর হয় দুর্ঘটনার শিকার মিসেস ডালিয়া ও হয়েছেন।উৎস তখন ধুপ করে মাটিতে বসে পরে।নিজেকে সামলে নিরুপমাকে জানায়।বিমানের বেশির ভাগ মানুষই মৃত্যুবরন করেছেন আর যদি কেউ বেঁচে থাকে তাদের দেখার মতো না কারোর হয়তো হাত অথবা পা নেই শরীর পুড়ে জর্জরিত কেউ বা লড়াই করছে মৃত্যুর সাথে।নয়ন রহমান হাসপাতালের এক কোনায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।তার বোন যতোই খারাপ হোক না কেন তিনি খুব বেশি ভালোবাসতেন।তার বোন জীবিত আছে না মৃত তা ও তিনি জানেন না। বোনকে হারানোর এক অজানা তীব্র ভয় তার মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।হাসপাতালে জীবিত আছে যে মানুষ গুলো উৎস আর নিরুপমা মিলে সবগুলো রুম চেক করে কিন্তু নাহ তাদের মধ্যে মিসেস ডালিয়াকে তারা পায় না।এরপর বাধ্য হয়ে তারা লাশ যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে যায়।নিরুপমার শরীর কাঁপছে।হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে।মিসেস ডালিয়া তার অপকর্মের শাস্তি পাক নিরুপমা চেয়েছিল কিন্তু সেই শাস্তি যে এভাবে সে ভোগ করুক এটা নিরুপমা কখনো চায় নি।এতো লাশ দেখে নিরুপমা উৎসের শার্ট খামছে ধোরে।লাশ গুলোকে চেনা যাচ্ছে না হাত পা মুখে পুড়ে উফফ কি বিচ্ছিরি অবস্থা। নিরুপমা সাহস করে কারোর মুখের উপরে থাকা কাপড় তুলতে পারছে না।চার পাঁচটা লাশের পর একটা লাশের দিকে নিরুপমার চোখ যায়।ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সে।লাশটি একটি মহিলার। হাতে দামী একটা সোনার ভ্যাস্লেট।নিরুপমা চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না ভ্যাস্লেটটি মিসেস ডালিয়ার।শরীরের ভিতত অজানা ভয় শিহরণ দিয়ে উঠতেছে তার।উৎস অন্যদিকে খুঁজতেছে।নিরুপমা এক পা দুই পা করে এগিয়ে যায় লাশটির দিকে।এরপর লাশের হাতটি ধোরে ভ্যাস্লেটটা ভালোভাবে দেখে।হ্যা এটা মিসেস ডালিয়ার হাত।তার ভ্যাস্লেটে উপরে ছোট ছোট করে লিখা ছিল ডালিয়া।নিরুপমা এবার চিৎকার করে কেঁদে উঠে।তার কান্নার আওয়াজে উৎস ছুটে আসে…
“নিরুপমা কি হয়েছে?কাঁদছো কেন?
” উৎস ফু ফু ফুফি।এইযে ফুফি উৎস। ফুফি আর নেই ফুফি চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।
নিরুপমাকে উৎসকে জড়িয়ে ধোরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।উৎসের চোখের নোনা পানিতে উৎসের গাল ভিজে যায়।
মিসেস ডালিয়ার লাশ তার চিহ্নিত করার পর সব ডিটেইলস মিলিয়ে তার লাশ ছেড়ে দেওয়া হয়।উৎস তাদের বাড়িতে নিয়ে আসে।যেহেতু মিসেস ডালিয়ার স্বামী বেঁচে নেই আর একটা ছেলে সে ও আমেরিকাতে তাই উৎস তাদের বাড়িতে আনে।আপনজন বলতে একমাত্র তারাই আছে।নয়ন রহমান বিলাপ করছেন আর কাঁদছেন।
“আমি চেয়েছিলাম আপা তার শাস্তি ভোগ করুক কিন্তু আমি তো কখনোই চাই নি আপা আমাকে এভাবে ছেড়ে চলে যাক।আজকে যে নিজেকে খুব দোষী মনে হচ্ছে।
নিরুপমা তার বাবাকে জড়িয়ে ধোরে কাঁদে।উৎস তাকে বুঝিয়ে জানাজার নামাযে নিয়ে যায় আর তারপর স্থানীয় কবর স্থানে কবর দেয়।
নিরুপমা বেলকনির গ্রিলের সাথে মাথা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মিসেস ডালিয়া মারা গেছেন ১ মাসের মতো হবে।সব কিছু আগের মতো চললে ও নিরুপমা কেন জানি নিজেকে এখনো আগের মতো করতে পারছে না।যে মানুষটাকে সে ছোট থেকে এতো ঘৃনা করতো সেই মানুষটার মৃত্যুতে সে এতোটা ভেঙ্গে পড়েছে।আসলেই নিরুপমা নরম হৃদয়ের অধিকারী।হঠাৎ করেই নিরুপমার মিসেস ডালিয়ার রেখে যাওয়া চিঠির কথা মনে পড়ে।উৎস রুমে কাজ করছিল।সে ড্রয়ার থেকে চিঠিটা বের করে উৎসের পাশে বসে।অপর পাশে মুসকান ঘুমোচ্ছিল।
” চিঠির কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম উৎস..
“আমি ও।আচ্ছা চিঠি খুলো দেখি কি লিখেছেন
নিরুপমা চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলো…
প্রিয় নিরুপমা ও উৎস…
চিঠিটি তোমাদের দুজনকে লিখলে ও উৎসকে জানানো দরকার এমন কিছু কথা আছে চিঠিতে।জীবনে আমি অনেক পাপ করেছি কিন্তু কখনো সেগুলোর জন্য অনুতপ্ত হই নি।আজ কেন জানি অনুতপ্তবোধটা মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে।এই অনুতপ্তবোধের যে দহন তা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।নিরুপমার একটি সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যত আমি নষ্ট করেছি।৪ বছরের একটা বাচ্চাকে মাহারা করেছি।এগুলার জন্য আমি এতোবেশি অনুতপ্ত যে আমার কাছে এই কষ্টে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করছে।কিন্তু জীবনে অনেক পাপ করেছি এই মহাপাপ করার সাহস আমার হলো না।
উৎস অরিত্রা তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করলে ও আমি অরিত্রাকে তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছিলাম শুধু মাত্র তোমার প্রোপার্টি দেখে।টাকা আর প্রতিপত্তির প্রতি আমার এতো নেশা হয়ে গিয়েছিল যে আমি আমার বিবেকবুদ্ধি সব হারিয়েছিলাম।অরিত্রার হরমোনের প্রব্লেম থাকায় ডাক্তার বলেছিল যে ওর বেবি কন্সিভ করতে সমস্যা হতে পারে।তখন আমার মাথায় চিন্তা আসলো যদি ও কখনো মা হতে না পারে তাহলে তুমি বা তোমার ফ্যামিলি যদি তখন আর ওকে রাখতে না চাও।হায় আমি এতো বেশি নির্বোধ ছিলাম যে তোমার মতো খাঁটি ছেলে আর এতো ভালো পরিবারকে নিয়ে এমন নিচু চিন্তাভাবনা করেছিলাম।অরিত্রাকে এরপর আমি বার বার বোঝাইতে থাকি বিভিন্ন ভাবে তোমাকে হারানোর ভয় দেই। এরপর অরিত্রা তোমাকে চেপে বসে বাচ্চা নেওয়ার জন্য।অরিত্রার প্রেগ্ন্যাসির যখন ২ মাস তখন ডাক্তার বলেছিল এই বাচ্চা রাখা রিস্ক হয়ে যাবে বাচ্চা না রাখাই ভালো তবে অরিত্রা আর কন্সিভ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান তারা।আমি অরিত্রাকে বলি বাচ্চা রাখতে।আমি তখন ও জানতাম না আমি আমার মেয়েকে হারিয়ে ফেলব চিরতরে। অরিত্রা মারা যাওয়ার পরে ও এই অনুতপ্ত বোধ গুলো আমার ভিতরে জাগলো না।আমি তো আছিই আমার বিলাসিতার জীবনে।আমি সত্যিই কখনো অরিত্রার মা হতে পারি নি।ছোট থেকে আর মারা আগে পর্যন্ত আমি কখনো তাকে সময় দেই নি, বুকে টেনে নেই নি, বুকে জড়িয়ে চুমু খাই নি।আমি অনুতপ্ত উৎস।আমাকে তুমি আর নিরুপমা মাফ করে দিও।এতো গুলো করা অন্যায় নিয়ে আমি এই দেশে থাকতে পারব না।বার বার এগুলা আমাকে তাড়া করে বেড়াবে।আর সর্বশেষ একটা কথাই বলবো উৎস তোমাকে নিরুপমার মতো একটা মেয়ে হয় না আমি অরিত্রা ও এতো ভালো ছিল না।একসময় আমি তোমাকে বলেছিলাম সৎ মা কখনো মা হতে পারে না।কিন্তু নিরুপমা পেরেছে।নিরুপমা একজন সৎ মা থেকে মুসকানের আদর্শ মা হয়েছে যা এই যুগে এই দুনিয়াই খুবই দুর্লভ। একজন সৎ মা যদি নিরুপমার মতো করে তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলায় তাহলে হয়তো কোনো ছেলে মেয়ে সৎ মায়ের নির্মম অত্যাচারের শিকার হতো না।আমি শুধু প্রতিহিংসা ও লোভে বশিভূত হয়েই নিরুপমাকে সবসময় তোমার থেকে দূরে রেখেছি। অরিত্রা যেমন আমার মেয়ে ছিল নিরুপমা ও আমার মেয়ে।এর আগে তোমার হাতে এক মেয়েকে তুলে দিয়েছিলাম আর আজ আমার আরেক মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। তুমি তার প্রাপ্য সম্মান দিও।আর আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও।আমি চলে যাচ্ছি ভালো থেকো আর মুসকানের যত্ন নিও তাকে কখনো বলো না যে তার এই নানু এতো খারাপ ছিল।মুসকানের চোখে অন্তত আমার জন্য ঘৃনা দেখতে চাই না।আল্লাহ হাফেজ।
চিঠিটা পড়ে উৎস নির্বাক হয়ে বসে রইলো।এই মূহুর্তে তার ঠিক কি করা উচিত?মিসেস ডালিয়ার উপরে কি খুব রাগ করা উচিত?নাকি সব ভুলে যাওয়া উচিত।যদি রাগ ও করে তাতে লাভ কোথায়?মানুষটা তো আর বেঁচে নেই।আজ সেই ও নিরুপমার মতো করে মিসেস ডালিয়াকে ক্ষমা করে দিল।
চলবে!