এবং স্ত্রী পর্ব-২৯

0
1518

#এবং_স্ত্রী
#পর্ব_২৯
#Jannatul_Ferdos

নয়ন রহমান নিজের কান্না আটকে রাখতে পারছেন না।হয়তো তার অতীত তাকে এতো তীব্র যন্ত্রণা দিচ্ছে।তিনি দুহাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বলতে শুরু করলেন…
“নিরুপমার মা দ্বিতীয় সন্তান সম্ভাবনা হয় ৮ মাস রানিং ছিল।আমরা সকলে খুব খুশি ছিলাম।কিন্তু আপা কখনোই নিরুপমার মাকে ভালো নজরে দেখতে পারত না।অনেক সময় অনেক কথা শুনিয়েছে কিন্তু সে কখনো আমাকে জানায় নি।এরপর একদিন আপা আমার উপরে প্রেসার দিতে থাকল সম্পত্তি নিয়ে।আমাকে ক্রমাগত হুমকি দিতে থাকে।বাবা তার প্রতি অবিচার করেছে।হ্যা এটা আমি ও মানি।আমি আপাকে সম্পত্তি দিতে রাজি ছিলাম কিন্তু আমি তাকে বলেছিলাম নিরুপমা এবং আমার অনাগত সন্তানের জন্য অর্ধেক আমি রেখে বাকি অর্ধেক দিয়ে দিব।সে তাতে রাজি হয় না।তার পুরো সম্পত্তিই লাগবে।এই নিয়ে আমাদের দুজনের খুব ঝামেলা শুরু হয়। নিরুপমার বয়স তখন ৪।ও খুব ভয় পেয়ে যায় এমন ঘটনায়।নিরুপমার মা তাকে অন্য রুমে রেখে আসে। আমাদের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আপা আমাকে মারতে আসলে নিরুপমার মা হাত ধোরে ফেলে এবং বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে।হায় আল্লাহ আমি যদি জানতাম এই সামান্য সম্পত্তির জন্য আমি আমার স্ত্রী, অনাগত সন্তানকে হারাবো কখনোই আমি কথা বাড়াতাম না।নির্দ্বিধায় সম্পত্তি দিয়ে দিতাম।নিরুপমার মা যখন আপাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে সে নিরুপমা মাকে জোরে ধাক্কা দেয়।সে গিয়ে সোজা টেবিলের সাথে পেট বরাবর গুতা খেয়ে মাটিয়ে লুটিয়ে পরে।আমার চোখের সামনে সে পেটে হাত দিয়ে বিষাদময় চিৎকার করে উঠে।
নয়ন রহমান এবার বাধ ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।নিরুপমাকে জড়িয়ে ধোরে কাঁদতে থাকেন।তারপর আবার বলা শুরু করেন….
“আমি দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। নিরুপমার মায়ের সেদিনের বাঁচতে চাওয়ার ইচ্ছা আমি পূরণ করতে পারি নাই।ডাক্তার তাকে অটিতে নিয়ে যায়।আমি নিরুপমাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদি।ডাক্তার এসে জানায় আমার স্ত্রীকে তারা বাঁচাতে পারে নি।চলে গেল নিরুপমার মা আমাকে ছেড়ে।এর কিছুদিনের মধ্যেই আপা আমাকে বলে সে অর্ধেক সম্পত্তি নিতেই রাজি।আমাকে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে সাইন করতে। ওই মূহুর্তে আমার মনে ছিল আমার স্ত্রী আর অনাগত সন্তান হারানোর বেদনা।আমি না পড়েই সাইন করে দেই।আর তারপর আমার বোন আমার আপন বোন আমার ৪ বছরের মেয়েসহ বাড়ি থেকে বের করে দেয়।কোথায় যাবো এই ছোট মেয়েটাকে নিয়ে ভেবে পাচ্ছিলাম না।তখন দেখা হয় আমার ঝুমুরের মামা মানে আলি ভাইয়ের সাথে।সে আমাকে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়, কাজের ব্যবস্থা করে দেয়।আমি নিরুপমাকে নিয়ে সেখানে থাকতে শুরু করি।এর মধ্যেই আলি ভাই একদিন আমাকে হাত ধোরে বলে পারুলকে বিয়ে করতে।তাহলে নিরুপমা ও একজন মা পাবে আর ঝুমুর ও একজন বাবা পাবে।আমি তাই ভেবে বিয়ে করি।নিরুপমা মায়ের সাথে ঝুমুরকে খেলার সাথী হিসাবে পাবে কিন্তু কথায় আছে একজন নারী চাইলে খুব সহজে কিছু গড়তে পারতে আবার একজন নারী চাইলে খুব সহজে তা ভাঙ্গতে পারে।তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ মিসেস ডালিয়া আর এই পারুল।
“এই এই কি কইলা তুমি?…পারুল বেগম তীব্র রাগ নিয়ে নয়ন রহমানকে বলে
” তুমি চুপ করে থাকো।আজ আমাকে বলতে দাও।
“আম্মু আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন।বাবাকে বলতে দেন।বাবা আপনি বলেন…..উৎস পারুল বেগমকে বললেন
“আমি বাবা হিসাবে অকর্ম।আমি মা মরা এই মেয়েটাকে ভালোবেসে বড় করতে পারি নাই।পারুল আমাকে যেভাবে বলেছে সেভাবে করেছি।সে বার বার আমাকে মনে করিয়ে দিত আমি তার ভাইয়ের দয়ায় বেঁচে আছি।পুরুষ হিসাবে নিজেকে কাপুরুষের মতো লাগত।কাজের সততায় আমি প্রোমোশন পাই চাইলে ও হয়তো আমি ভালো বেতনের একটা চাকরি পেতাম না।তাই নিজের আত্মসম্মানবোধ মাটিয়ে মিশিয়ে আলি ভাইয়ের দেওয়া চাকরিটা করি।কিন্তু আমি বাবা হিসাবে অক্ষম।আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস নিরু।আমি পারুলের কথা শুনে অনেক অন্যায় করেছি তোর সাথে।
নয়ন রহমান নিরুপমার দুহাত ধোরে কাঁদতে লাগলেন। নিরুপমার ও কাঁদে।তারপর নিরুপমা বলে…
“আপনারা হয়তো ভাবছেন যে মুসকান অরিত্রা আপুর মেয়ে এজন্য আমি মুসকানকে এতো বেশি ভালোবাসি।তাকে আপন করে নিয়েছি। কিন্তু না আমার যখন বিয়ে হয় আমি জানতাম না যে মুসকান অরিত্রা আপুর মেয়ে ইভেন আমি এটাও জানতাম না যে উৎসের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে।উৎস আর অরিত্রা আপুর কথা আমি জানতাম।কিন্তু বিয়ে হওয়ার আগে অব্দি আমি জানতাম না আমি আমার নিজের ফুফাতো বোনের সংসারে এসেছি।তার ফেলে রাখা সংসার পূন্য করতে।কিন্তু কখনো এটা মাথায় আসে নাই যে মুসকান আমার বোনের মেয়ে তাই তাকে ভালোবাসব।আমার মাথায় এটা ছিল আমি প্রথম মুসকানকে যেভাবে তার পরিচয় না জেনেই বুকে টেনে নিয়েছি সেভাবেই মুসকানকে আমার বুকে রাখব।সে মুসকান আমার বোনের মেয়ে হোক বা না হোক।ফুফি যখন জানতে পারে আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে তখন থেকে ফুফি আপনাকে এটা বুঝিয়ে আসে যে সৎ মা কখনো মা হতে পারে না।ওনাকে জিজ্ঞেস করেন তো সে কখনো অরিত্রা আপুর গর্ভধারিণী মা হয়ে ও মা হতে পেরেছিল কিনা?আজ তো তার নাম -জোস, খ্যাতি, টাকা- পয়সা, ব্যাংক-ব্যালেন্স সব আছে কিন্তু অরিত্রা আছেকি?আছে কি সেই মেয়েটা যে মায়ের একটু ভালোবাসা খুঁজত?মায়ের কোলের একটু ঘুমাতে চাইতো?
নয়ন রহমানের অতীতের কথা শুনে সকলের চোখে পানি এসে ভিড় করেছিল।কিন্তু মিসেস ডালিয়ার মধ্যে অনুতপ্ত দেখা না গেলে ও নিরুপমার শেষ কথায় তিনি মাথা নত করে ফেলেন।আসলেই তিনি কখনো অরিত্রার মা হয়ে উঠতে পারেননি।মা থাকতে ও অরিত্রা মা ছাড়া থেকেছে।মিসেস ডালিয়া তার বিলাসিতা নিয়ে ব্যস্ত ছিল।কখনো তো পার্লার কখনো শপিং কখনো ঘুরাঘুরি কখনো ডিস্কে।তার বিলাসিতার জন্য কখনোই অরিত্রাকে সময় দিতে পারে নি।দিতে পারে নি বললে ভুল দেয় নি।তবু ও অরিত্রা মিসেস ডালিয়াকে অনেক বেশি ভালোবাসত।তার কথা মতো চলত।আজ তার ভিতরে মাতৃত্ব জেগে উঠেছে।মেয়েকে হারানোর পরে ও এই আফসোস তার ভিতরে ছিল না কিন্তু নিরুপমার একটা ছোট্ট কথায় তার হৃদয়ের ভিতরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।অনেক বছর আগে করা পাপের ফল অরিত্রার মৃত্যুর মাধ্যমে আল্লাহ তাকে দিয়েছে।কিন্তু সে বুঝতে দেরি করেছে।অনেক সময় আছে মানুষকে হাজারটা কথা বললে ও তার ভিতরে অনুশোচনা বোধ কাজ করে না কিন্তু ছোট্ট একটা কথা তীরের ফলার মতো কাজ করে।মিসেস ডালিয়া নয়ন রহমানের পা জড়িয়ে ধোরে হাউমাউ করে কেঁদে দেন।
“আমাকে তুই মাফ করে দে ভাই।আমি জীবনে অনেক বড় পাপ করেছি ভুল করেছি।আমি তোর জীবনটাকে নরক করে ফেলেছিলাম ভাই।আমাকে মাফ করে দে।
” আপা পা ছাড়।আমি তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি আগেই।বড় বোন হয়ে পা ধরিস না।
“নিরু মা আমাকে মাফ করে দে।আমি তোর সাথে সবচেয়ে বড় অন্যায় করেছি।৪ বছর বয়সে তোকে মা হারা করেছি। আমাকে মাফ করে দে।তোরা সবাই আমাকে মাফ করে দে…নিরুপমার হাত জড়িয়ে ধোরে কান্নারত অবস্থায় বলে মিসেস ডালিয়া
” ফুফি কথায় আছে “সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়”।তুমি কি মনে করেছো তুমি ক্ষমা চাইলেই কি ক্ষমা করা আদৌ সম্ভব?সম্ভব না।কিন্তু আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব কেন জানো?কারন আল্লাহ ক্ষমাশীলদের পছন্দ করেন।তোমাকে ক্ষমা করে দিব আর ওই উপরের আল্লাহর কাছে বিচার দিব।আল্লাহ যেন তোমার বিচার করেন।আর প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে তো একটা কথা আছে তাই না?তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম ফুফি কিন্তু তোমার করুণ দশার জন্য তুমি প্রস্তুত থেকো।আল্লাহ তোমার বিচার করবেন।আমার প্রতি তুমি যতো অন্যায় করেছো তার প্রতিটার বিচার আল্লাহর কাছে দিলাম।সময়ের কথা সময়ে বুঝলে না ফুফি..।

চলবে!!!!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে