এটা গল্প হলেও পারতো পর্ব-১৭+১৮

0
1029

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১৭+১৮
ইতিমধ্যে কেটে গিয়েছে প্রায় মাস দেড়েক, সেদিন রাতের পর থেকে আর নতুন করে কিছু এগোয় নি, তার কারণ একটাই ওদের পরীক্ষা চলছিলো, ইচ্ছে করেই পরীক্ষা চলাকালীন অর্ক ওদের বিরক্ত করতে চায় নি। একজন শিক্ষক হিসেবে ওদের পরীক্ষাটা অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ওর কাছে। গতকাল বিকেলে পরীক্ষা শেষের পর তিয়াসা ফোন করেছিলো ওকে,

স্যার, এক্সাম শেষ হয়েছে আজ, এবার বলুন কি করতে চান?

ওর এত বেশি উৎসাহের কারণ বোঝে অর্ক, ও রিয়াকে মনে মনে একটুও পছন্দ করে না আসলে। তাই এই সুযোগে কিছুটা হলেও জব্দ করতে চায়, তবে বন্ধুত্ব নষ্ট হবার ভয়ে নিজে থেকে কিছু করতে চায় না, পুরোটাই অর্কর ঘাড় দিয়ে হয়ে গেলেই ওর সুবিধা!!

সেদিক থেকে কৌশিক ছেলেটি যথেষ্টই ভালো, রিয়া ওকে সব কিছু মিথ্যে বলেছে জানার পরেও ও রিয়া কে বাঁচানোর চেষ্টাই করে গেছে সব সময়।

ও আমাকে এক্সকারশনে গিয়ে একটা কথা বলেছিলো স্যার, আমি এখন বুঝতে পারছি ও কেনো এতো ডিপ্রেসড থাকে সব সময়!!

কৌশিকের কথায় একটু চমকে ছিলো অর্ক,

ডিপ্রেসড থাকে? বেশ হাসিখুশিই তো! বুঝিনি তো কখনো!

বুঝবেন না স্যার, ও কখনো কারোর সঙ্গে শেয়ার করে না এসব! ও বলেছিলো ও যাদেরকে ভালোবাসে, তাদেরকে কেউ ওর থেকে আলাদা করে দেয়! ওর মা নাকি ওকে ঠাকুমা, পিসিদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে! এখন বুঝছি শুধু ঠাকুমা, পিসি নয় বাবার কাছ থেকেও ওকে আলাদা করে দিয়েছে ওর মা!! আর সত্যি বলতে ওর দোষ তো একটাই, ও কিছু কথা নিজের মতো করে বানিয়ে বলেছে হয়ত, কিন্তু তাতে কার কি ক্ষতি হয়েছে ?

কৌশিকের গলার সহানুভূতির সুর সবাইকেই অবাক করেছিলো, অর্ক মনে মনেই একটু চিন্তায় পড়েছিলো, সত্যিই তো! মেয়েটার দোষ টা ঠিক কি? হয়ত কিছু মিথ্যে কথা বলেছে ও, তার জন্যে তিয়াসা যদি মুখ খুলতে রাজিও হয়, তাহলেও ও হয়তো রিয়াকে কিছু বকাবকি করতে পারে, এর বেশি কিছু না! কিন্তু সেটা বাদে আর কি করতে পারে ও। শুধু কিছু মিথ্যে কথা বলার জন্যে তো আর পুলিশে কমপ্লেইন ও করতে পারবে না!!তিয়াসা একটু বিরক্ত গলায় বলেছিলো,

মানে? কারোর ক্ষতি হয়নি বলে যা খুশি বানিয়ে বানিয়ে নিজের মতো করে বলবে? আমার সব সময় মনে হতো ও মিথ্যে বলে স্যার, ও যতটা বলে ততোটা বড়লোক ও নয়! জানেন তো, যখনই কোথাও ওর গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা উঠতো ও কোনোভাবে সেটা কে এড়িয়ে যেতো, এই শান্তিনিকেতন যাওয়ার সময়েও এই নিয়ে আমাদের কতো মিথ্যে বলেছিলো! ও গাড়ি নিয়ে গেলে ওর বাবা নাকি জেনে যাবে! এখন তো শুনছি বাবাই নাই, তার আবার রাগ!

তাতে কি? ট্রেনে গিয়ে কিছু কম আনন্দ হয়েছিলো নাকি? সবটাই তো আমিই অ্যারেঞ্জ করেছিলাম, শুধু কন্ট্রিবিউট করা ছাড়া আর কিই বা করেছিস তুই?

কৌশিক রাগের গলায় বলছিলো, অনির্বাণ তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলো,

আরে ছাড় না! কি লাভ ওসব পুরনো কথা তুলে, নিজেদের মধ্যে গন্ডগোল করিস না! আর ঘোরা তো হয়ে গেছে কবেই!

কৌশিক থামে নি, রীতিমত উত্তেজিত গলায় বলেছিলো,

কথাটা লাভ, লোকসানের নয়, কথাটা অন্য জায়গায়, কি হয়েছে যদি ট্রেনেই গিয়েছি? গাড়ি তো তোরও ছিলো, তোর বাবা তো সত্যিই বড়লোক, তো তুই তোর গাড়ি নিয়ে যাসনি কেনো তখন? তিয়াসা বারণ করেছিলো, তাই তো?

এবার তিয়াসা উত্তেজিত হয়েছিলো, অর্কর উপস্থিতি সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে বলেছিলো,

তুই হটাৎ করে এর সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ফেলছিস কেনো?আমি যা বলি অনির্বাণ তাই করে নাকি? আর তুই তাহলে কি করিস? রিয়াকে যাতে গাড়ি নিয়ে যেতে না বলি আমরা তাই তো তুই নিজে আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব নিয়ে নিলি সেদিন! কিছু বুঝি না ভাবিস নাকি! আজ পর্যন্ত তো কখনো কোনো দায়িত্ব নিতে দেখিনি তোকে!

দুজন কে তর্কে জড়িয়ে পড়তে দেখে শেষ পর্যন্ত অর্ক ইন্টারফেয়ার করেছিলো, কৌশিক কে নরম গলায় বলেছিলো,

এতো উত্তেজিত হয়ে পড়ছ কেনো? এগুলো খুব সাধারণ কথা, হয়ত তুমি ঠিকই বলেছো ওর মিথ্যে কথাতে কারো কোনো ক্ষতি হয় নি। কিন্তু ভেবে দেখো, এই হ্যাবিট টা তো ভালো নয়, আজ ক্ষতি হয়নি বলেই যে কাল হবে না, এরকম কোনো কথা আছে নাকি! মিথ্যে বলার অভ্যাসটাই খারাপ, আর তুমি একটা শিক্ষিত ছেলে হয়ে এটা কে সাপোর্ট করছো!

না, স্যার সাপোর্ট করছি না, আসলে তিয়াসা ওই ভাবে বললো তো তাই বলে ফেলেছি। কথা হচ্ছিলো রিয়া কে নিয়ে, ও সেখানে আমাকে জড়িয়ে ফেললো। আমি যে ট্রেনের টিকিট কেটেছি রিয়ার গাড়ি নিয়ে যাওয়া আটকাতে এটা কি ও প্রমাণ করতে পারবে? অহেতুক বিতর্ক তৈরি করার কোনো প্রয়োজন আছে ওর? আর যদি তাই হতো, তাহলে অনির্বাণের গাড়ি নিয়েও তো যেতে পারতাম আমরা, ও ও তো ট্রেনে যেতেই চেয়েছিলো তখন!

একটু অভিযোগের সুরে বলেছিলো কৌশিক, এবার অনির্বাণ কথা বলেছিলো,

ভুল ভাবছিস ভাই, কেউ তোকে জড়িয়ে ফেলেনি! তুই নিজের মতো করে ভাবছিস এগুলো! আমার গাড়ি নিয়েই তো যাই আমরা বেশিরভাগ সময়, আগেও গিয়েছি, এখনো যাই, আমি কখনো কিছু বলেছি তাই নিয়ে?

তুই বলিসনি, তিয়াসাই তো তোর হয়ে বলে দিলো সবটা,

বিদ্রুপের গলায় বলেছিলো কৌশিক, অনির্বাণ হাত তুলেছিলো,

প্লিজ, সবটা না জেনে কমেন্ট করিস না, আগে বলতে দে আমাকে! যেদিন আমাদের শান্তিনিকেতন যাওয়ার কথা হলো, তার মাস খানেক আগে একদিন তোরা আমার বাড়িতে এসেছিলি মনে আছে? সেদিন ওখানে আমাদের দোকান থেকে কেউ কোনো একজন ভদ্রমহিলা কে ফোন করে কিছু আজেবাজে কথা বলেছিলো। ভদ্রমহিলা পরে বাবা কে ফোন করে পুলিশে কমপ্লেইন করবেন বলেছিলেন, বাবা খুব রেগে গিয়েছিলো, বোন করেছে ভেবে ওকে বকাবকিও করেছিলো। পরে বোন বলেছিলো ও নাকি মেয়েদের সবাইকেই নিচে নামতে দেখেছিলো। এবার বল, এই ঘটনা জানার পরে আর বাবা আমাকে গাড়ি নিয়ে যেতে দিতো শান্তিনিকেতন? কোন লজ্জায় গাড়ির চাবি চাইতাম?

রাত বেশ খানিকটা হয়েছিলো, রুমা টেবিলে খাবার সাজাতে শুরু করেছিলেন দেখে অদিতি বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো তাঁকে সাহায্য করতে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখতে রাখতে ঘর থেকে আসা কথোপকথন সবটাই কানে আসছিলো ওদের, সমরেশ সোফায় বসেছিলেন, শুনতে পাচ্ছিলেন তিনিও, হটাৎ করেই অনির্বাণের কথায় চমকে উঠলো ওরা। দিতি হাতের থালা নামিয়ে রেখে প্রায় ছুটে ঘরে ঢুকে গিয়েছিলো, পেছন পেছন সমরেশ আর রুমাও।

তুমি কি বলছিলে? তোমাদের দোকান থেকে কেউ কোনো মহিলা কে ফোন করেছে?

ঘরে ঢুকে আসা অদিতির গলায় অনির্বাণ উঠে দাঁড়িয়েছিলো,

হ্যাঁ, ম্যাম! কিন্তু এটা অনেকদিন আগের কথা! আজকের নয়!

কতোদিন আগের কথা অনির্বাণ?

দিতি আর কিছু বলার আগেই উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করেছিলো অর্ক, অনির্বাণ ভ্রু কুঁচকে ভেবে বলেছিলো

শান্তিনিকেতনে যাওয়ারও মাস খানেক আগের কথা স্যার! কেনো বলুন তো?

তোমাদের দোকানের নম্বরটা কি?

জানতে চেয়েছিলেন সমরেশ, অদিতি আফসোস করছিলো,

ইস! একটুও যদি বুঝতে পারতাম এরকম হবে, তাহলে নম্বরটা সেভ করতাম! কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে নি তখন!

আমি সেভ করেছিলাম, সাথী করতে বলেছিলো তখন, নম্বরটা বলো তো অনির্বাণ,

পকেট থেকে মোবাইলটা বার করতে করতে বলেছিলো অর্ক, অনির্বাণের বলা নম্বরের সঙ্গে মিলে গিয়েছিলো সেভ করা নম্বর। তিয়াসা, কৌশিক আর অনির্বাণ তিনজনেই কিছু বুঝতে না পেরে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো, তৎক্ষণাৎ অর্ক ভেবে নিয়েছিলো কৌশিকের সামনে কিছু বলবে না ও! মেয়েটা কে কোনো খবর পেয়ে সতর্ক হতে দেবেনা কিছুতেই! কৌশিক জানলেই ও সবটাই জেনে যাবে! ভেতরের উত্তেজনা দমিয়ে রেখে বলেছিলো,

না, কিছুনা! চলো খেয়ে নেবে! পরশু থেকে পরীক্ষা, এখন আর এসব সাধারণ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।

ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরেই সমরেশ উঠে এসেছিলেন,

সাথীর তারমানে কিছুটা হলেও সন্দেহ হয়েছিলো, তাই না? সেই জন্যেই বোধ হয় নম্বরটা সেভ করতে বলেছিলো তোমাকে,

অর্ক লজ্জিত হয়েছিলো, অদিতির দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলেছিলো,

খুব খারাপ লাগছে! ভাবতেও পারিনি, মেয়েটা এরকম কোনো কাজ করতে পারে! কোনোদিনও সেই ভাবে কড়া হয়ে মেলামেশা করিনি স্টুডেন্টদের সঙ্গে, বরাবর বন্ধুর মতোই মিশতে চেয়েছি! তার প্রতিদান যে এই ভাবে পাবো,কল্পনাও করিনি!

অর্কর মুখ দেখে খারাপ লেগেছিলো অদিতির নিজেরও, সেই সঙ্গে অভিমানও হয়েছিলো খুব, ওকে তখন একটুও বিশ্বাস করে নি অর্ক! ও কতো কষ্ট পেয়েছিলো তখন! রুমা এগিয়ে এসেছিলেন, ছেলের পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন,

দোষ তোর নয়! দোষ তো তাদের, যারা তোর বন্ধুর মতো মেশা কে অন্য ভাবে নিয়ে এই সুযোগে অসভ্যতা করার চেষ্টা করছে। মন থেকে বার করে দে এসব, চল খেতে চল।

ওই জন্যেই তো নিজেদের মধ্যে স্বচ্ছতা রাখাটা জরুরি! তুমি সেটা কখনো বোঝনি। যদি তুমি নিজের দিকটা ঠিক রাখতে, এতো ক্যাজুয়াল না হতে, ফোন বন্ধ বা সাইলেন্ট করে রাখার মতো কাজগুলো দীর্ঘদিন ধরে না করতে, তাহলে কোনো বাইরের ফোন অদিতির বিশ্বাসে চিড় ধরাতে পারতো না। এই ছোটো ছোটো ব্যাপারগুলো কে ছোটো মনে হলেও এগুলোই কোনো কোনো সময় বড়ো বড়ো ব্যাপার হয়ে পড়ে। ভবিষ্যতে আশা করি তুমি সচেতন হবে এসব বিষয়ে,

পাশ থেকে বলেছিলেন সমরেশ, অর্ক মাথা নিচু করেছিলো।

বুঝতে পারছি সেটা এখন! সচেতন হবার কথা বলছো তুমি! আমার তো বিশ্বাস জিনিসটাই চলে গেলো, এরপরে তো শুধু তোমরা তিনজন ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতেও পারবো না কখনো! তুমি জানোনা বাবা, আমি কাউকে বোঝাতে পারছি না, আমার ঠিক কি রকম লাগছে!

অর্ক র মুখে দুঃখের ছাপ সবাইকেই কষ্ট দিয়েছিলো, সমরেশ উঠে পড়েছিলেন,

মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ! একজনের জন্যে তুমি সবাই কে অবিশ্বাস করতে পারোনা! চলো খেতে চলো!

সেদিন ওই প্রসঙ্গ চাপা পড়েছিলো এরপর, কিন্তু তিয়াসা যে যথেষ্টই বুদ্ধিমতি সেটা অর্ক বুঝেছিলো, যখন ও বাড়িতে ফিরে গিয়েই রাতে অর্ক কে ফোন করেছিলো। তখনই অর্ক বলেছিলো পরীক্ষা শেষ হলে সবটা আলোচনা করবে, সেই মতো কালকের কথার পর আজ ওদের জগু বাজারে দাঁড়াতে বলেছিলো কিন্তু কৌশিক কে না জানিয়ে!

জগু বাজারের ঠিক মুখে দাঁড়িয়ে অর্কর জন্যে অপেক্ষা করছিলো তিয়াসা আর অনির্বাণ, মেট্রো থেকে নেমে রাস্তাটা পেরিয়ে গিয়েই ওদের কে দেখতে পেলো ও আর অরিন্দম। ওদের দেখেই অনির্বাণ হাত তুললো,

স্যার, এদিকে!

গলির মধ্যে ঢুকে অরিন্দম হাত তুললো,

ওই হলুদ বাড়িটা,

কিই!

একসাথে বিস্ময় ছিটকে বেরোলো অনির্বাণ আর তিয়াসার গলায়। অর্ক কোনো কথা না বলেই বেলে হাত রাখলো, বেল বাজানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলে বেরিয়ে এসেই চমকে গেলো রিয়া, কিন্তু সোজা চোখে কোনো প্রশ্ন না করে তাকিয়ে থাকলো ওদের দিকে। অর্ক অবাক হচ্ছিলো, মেয়েটার কি কোনো ভয় নেই!

কে এসেছে? খুলেছিস দরজা?

বলতে বলতে ততোক্ষনে বেরিয়ে এসেছেন সেদিনের ভদ্রমহিলা, অর্ক আর অরিন্দম দেখেই অবাক গলায় বললেন,

ওমা! আপনারা! কি ব্যাপার? আসুন আসুন, ভেতরে আসুন স্যার,

রিয়া তখনও দরজা আটকে দাঁড়িয়েছিলো, মহিলা বিরক্ত হলেন, চাপা গলায় বললেন,

এটা কি ধরনের অসভ্যতা! দরজা থেকে সরে যাও, ওনাদের ভেতরে আসতে দাও!

একটাও কথা না বলে দরজা থেকে রিয়া কে সরে যেতে দেখে অরিন্দম একটু নিচু গলায় বললো,

ব্যাপার কি বলতো! মেয়েটা কি সব জেনে গেছে নাকি! কিরকম নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে দ্যাখ!

ওরা ভেতরে এসে বসলো, অতো লোকের বসার জায়গা না থাকায় অনির্বাণ দাঁড়িয়ে রইলো, একটু দূরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো রিয়াও। ভদ্রমহিলা বিনীত গলায় বললেন,

কি হয়েছে স্যার? আমার মেয়ে কি কিছু করেছে?

অরিন্দম মাথা নাড়লো,

হ্যাঁ, ম্যাডাম, খুব খারাপ লাগছে বলতে তাও সরাসরিই বলছি, আপনার মেয়ে সম্পর্কে আমাদের কিছু অভিযোগ আছে। ও আমার বন্ধুর স্ত্রী কে কিছু এমন কথা বলেছে যেগুলো ওদের সম্পর্কে জটিলতা তৈরি করেছে। এরকম বেশ কিছুদিন ধরেই ঘটছিলো কিন্তু এর কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে না থাকায় আমরা এটা নিয়ে এগোতে পারিনি। কিন্তু একটা ঘটনার প্রমাণ আমরা জোগাড় করতে পেরেছি বলেই আজ আপনার সামনে এসেছি। ও এই ছেলেটির দোকানের নম্বর থেকে ফোন করে আমার বন্ধুর স্ত্রী কে বেশ কিছু কথা বলেছে, যেগুলো আমরা পরে আপনাকে আলাদা করে বলবো,

অনির্বাণের দিকে আঙুল দেখিয়ে রিয়ার মা কে বললো অর্ক, ভদ্রমহিলা বিস্ফারিত চোখে তাকালেও, রিয়ার মুখের ভাবে কোনো পরিবর্তন এলো না। সে অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে খুব ঠাণ্ডা গলায় কেটে কেটে বললো,

আমি তোর বাড়ি থেকে ম্যাম কে ফোন করেছি? তুই দেখেছিস?

অনির্বাণ একটু চুপ করে থেকে বললো,

আমার বোন দেখেছে!

কি দেখেছে তোর বোন? আমি ফোন করেছি?

অনির্বাণ মাথা নাড়লো,

হ্যাঁ,ও দেখেছে তোকে,

অর্ক মনে মনেই শঙ্কিত হচ্ছিলো, অনির্বাণ যে এটা বানিয়ে বলেছে সেটা রিয়া জানে নিশ্চয়ই! কারণ ও ফোন করার সময় যথেষ্ট সতর্ক থেকেই করেছে সবটা। মেয়েটা বেশ শক্ত মনের, একে ভাঙা মুশকিল!

আর কতো শত্রুতা করবি? তিয়াসার কথায় ওঠাবসা বন্ধ কর এবার! তোদের কোনো ক্ষতি করেছি আজ পর্যন্ত, যে অহেতুক আমাকে ফাঁসাতে চাইছিস! নিজের চরকায় তেল দে না,

অনির্বাণের দিকে সোজা তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বললো রিয়া, অরিন্দম শেষ চেষ্টা করলো,

তুমি কি মিথ্যে বলো না রিয়া? কলেজে সবাই জানে তুমি তিনতলা বাড়িতে থাকো, তোমার বাড়িতে সিসিটিভি লাগানো আছে?

রিয়া মাথা নাড়লো,

না বলি না! এটা আমার বাড়ি না! এটা মায়ের বাড়ি! আমার বাড়িতে সি সি টি ভি লাগানো আছে, মা কে জিজ্ঞেস করুন না হয়!

অর্ক চমকে তাকালো, ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন,

আমরা এখানে ভাড়া থাকি, আমার শ্বশুরবাড়ি সত্যি তিনতলা, সি সি টি ভি ও আছে!

#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১৮
আমি এমনিতেই খুব অশান্তি তে থাকি স্যার, ও যদি আপনার সংসারে কোনো সমস্যা তৈরি করে থাকে তাহলে ওর হয়ে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, প্লিজ আমার মেয়েকে মাফ করে দিন,

ভদ্রমহিলা প্রায় হাতজোড় করলেন অর্কর সামনে, অর্কর খারাপ লাগছিলো। তিয়াসার দিকে তাকিয়ে বললো ও,

তোমরা বাইরে অপেক্ষা করো, আমরা কথা বলে আসছি একটু,

ওরা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রিয়া মুখ খুললো, মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

কেনো ক্ষমা চাইছো? কি করেছি আমি?

অরিন্দম অর্কর দিকে তাকালো ওর চোখে অসহায়তা ফুটে উঠলো, অর্কর মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ, মেয়েটা এতো সাংঘাতিক! ও রিয়ার দিকে তাকালো,

তুমি মনে করো তুমি কোনো অন্যায় করো নি রিয়া? তুমি কতোবার গিয়েছ আমার বাড়ি যে ম্যাম কে বলেছো তুমি অনেকবার কফি করেছো? তুমি এই কথাগুলো অস্বীকার করতে পারবে না, কারণ তিয়াসা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তখন। ও যদিও তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চায়নি বলে আমাকে কিছু বলছিলো না প্রথমে, কিন্তু এখন বাধ্য হয়েই স্বীকার করেছে। তিয়াসা কে বাঁচানোর জন্যে কথাগুলো কে একটু ঘুরিয়ে বললো ও।

আমি ওইভাবে কিছু বলিনি স্যার, আমি কফির কৌটো তাক থেকে নিচ্ছিলাম দেখে ম্যাম আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমি কোথায় কফি থাকে কিভাবে জানলাম। আমি তার উত্তরে বলেছিলাম আমি আগে করেছি এখানে, অনেকবার করেছি বলিনি, ম্যাম ভুল বুঝেছেন!

অরিন্দম অবাক চোখে অর্কর দিকে তাকালো, মেয়েটার কথা ঘোরানোর ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলো অর্ক নিজেও। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো,

কিন্তু তিয়াসা সাক্ষী আছে, তুমি এগুলো বলেছো। এমনকি তুমি বোলপুর স্টেশনেও অদিতি কে কিছু কথা বলেছিলে, সেগুলো দিতি আমাকে ট্রেনেই বলেছিলো।

রিয়া চুপ করে থাকলো এই প্রথম, সম্ভবত তিয়াসার কথা শুনেই, ভদ্রমহিলা ভয় পেলেন, মেয়ের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন,

যাও, ভেতরে যাও! আর কোনো কথা শুনতে চাই না তোমার মুখ থেকে!

রিয়া ভেতরে চলে গেলো, ভদ্রমমহিলা অর্কর দিকে ফিরে বললেন,

স্যার, অনেক ভুল করেছে বুঝতে পারছি আমার মেয়ে! আসলে ও খুব উদ্ধত, কথা শোনে না একদম, আমি নিজেই ওকে নিয়ে খুব চিন্তায় থাকি স্যার। আগে এরকম ছিলো না ও, যত বড়ো হচ্ছে ততো এরকম হয়ে যাচ্ছে, ইদানিং আমার সঙ্গেও খুব খারাপ ব্যবহার করছে। তবে আমার শ্বশুরবাড়ি সত্যিই বড়লোক, যদিও আমার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই! কিন্তু আমার মেয়ে সেখানে যাতায়াত করে লুকিয়ে আমি জানি।

আপনার হাজব্যান্ড এখানে থাকেন না বোধহয়?

অরিন্দম জিজ্ঞেস করলো, উত্তর দেবার আগেই ব্যাগ কাঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রিয়া, মহিলা অবাক হলেন,

কোথায় যাচ্ছিস!

তোমাকে সব কিছু বলতে হবে নাকি!!

বলেই বেরিয়ে গেলো রিয়া, ভদ্রমহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,

দেখুন! কি আর বলবো ওকে বলুন! আমার হাসব্যান্ড নিজের বাড়িতে থাকেন। আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই! উনি অন্য মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে আছেন, আমি সেটা মেনে নিতে পারিনি তাই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলাম। আইনত আমাদের ডিভোর্স হয়নি কখনো, আমার শাশুড়ি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলের স্বেচ্ছাচারিতা মেনে নিয়ে আমি ওখানেই থেকে যাই, কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমার মেয়ের ব্রেন ওনারা ওয়াশ করে ফেলেছেন, ও ওর বাড়ি ছাড়ার জন্যে, বাবার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবার জন্যে আমাকেই দায়ী করে। আমার শাশুড়ি, ননদ, স্বামী ওর সঙ্গে লুকিয়ে স্কুলে দেখা করতো, দামী দামী গিফ্ট দিতো,আর আমার বিরুদ্ধে ওর মনকে বিষিয়ে দিতো, এই করে ওর আমার সঙ্গে সম্পর্ক আর ভালো নেই।

অর্ক মনে মনে অবাক হচ্ছিলো, কতো রকমের লোক আছে পৃথিবীতে! ছেলের অবৈধ সম্পর্ক কে মেনে নেওয়ার জন্যে বউ কে চাপ দেয়! ওর খুব খারাপ লাগছিলো ভদ্রমহিলার জন্যে, আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,

আপনার চলে কি করে? চাকরি করেন আপনি? হাজব্যান্ডের কাছ থেকে সাহায্য পান?

ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন,

আমি একটা স্কুলে প্রাইমারি সেকশনে পড়াই, স্কুলের পরে দু একটা প্রাইভেট টিউশন করি। হাজব্যান্ডের কাছ থেকে নিই না কিছু তবে লুকিয়ে মেয়ের হাতে টাকা পয়সা দেয় ওর বাবা সেটা বুঝি। অনেকবার বারণ করেছি মেয়েকে, ও শোনে না, ও আমাকে ওর সবচেয়ে বড় শত্রু ভাবে। ওর মাথায় এটা ঢোকানো হয়েছে যে ইচ্ছা করেই আমি ওখান থেকে চলে এসেছি। অথচ আমার হাসব্যান্ড কিন্তু কখনো মেয়ের দায়িত্ব নিতে চায় নি।

উনি কি আবার বিয়ে করেছেন?

মহিলা ম্লান হাসলেন,

নাহ! ওর একটা ফ্ল্যাট আছে আলিপুরে সেখানে থাকে ওই মহিলা! মহিলা বিবাহিতা, একটা মেয়ে আছে। মেয়ের তো সেই জন্যেই রাগ, বাবা যখন বিয়ে করেনি তখন আমি চলে এলাম কেনো!

অর্ক উঠে দাঁড়ালো, দেখাদেখি অরিন্দমও, দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় বললো,

মেয়েকে বুঝিয়ে বলবেন একটু, মিথ্যে বলা ওর ভবিষ্যতের জন্যেও খারাপ। আসি!

বাড়িতে ঢুকতেই সবার মুখোমুখি হলো অর্ক, রিয়া কে দিয়ে স্বীকার করানো যায় নি শুনে দিতি হতাশ হয়ে পড়লো।

বিরাট ভুল হয়ে গেছে আমার! কল টা রেকর্ড করা উচিত ছিলো!

হা হুতাশ করতে লাগলো দিতি, সমরেশ হাত তুললেন,

ছেড়ে দাও! যা হয়ে গেছে তা তো আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে বা! মিছিমিছি ভেবে লাভ কি! আমার শুধু একটাই খারাপ লাগছে ভেবে যে সব কিছু জেনেও আমাদের শুধু মাত্র প্রমাণের অভাবে চুপ করে থাকতে হচ্ছে। এই রকম মানসিকতার মেয়ে কে কোনো শাস্তি ছাড়াই ছেড়ে দিতে হবে এটা ভাবলেই বিরক্ত লাগছে।

দুপুরের খাওয়া দাওয়া মিটে যাওয়ার পরে সমরেশ ঘরে ঢুকে গেলেন, রুমা টি ভি খুলে ড্রইং রুমের সোফায় বসে পড়লেন। এ তার প্রতিদিনের নেশা, সারা দুপুর বসে বসে টিভি দেখেন উনি। অদিতি ছেলে কে ঘুম পাড়াতে ঘরে ঢুকে গিয়েছিলো, কিছুক্ষন পরে অর্কও ঢুকে এলো। ছেলে ততোক্ষনে ঘুমিয়ে পড়েছিল, অর্ক কে ঢুকতে দেখে অদিতি উঠে বসলো।

মনটা খুব অস্থির লাগছে দিতি! এতো ঘটনার একটাও প্রমাণ করতে পারলাম না! কি সুন্দর একটার পর একটা মিথ্যে বলে গেলো! একবারের জন্যেও ভাবিনি জীবনে এরকম কোনো ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে। খুব সাধারণ জীবনই তো কাটাই আমরা, কোনো রকম জটিলতা তো হয় নি কখনো! তাহলে আজ কেনো এতবড় একটা ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটলো বলতো!! যদি ও সত্যিই আমাদের সম্পর্কটা ভেঙে দিতো তাহলে?

তুমি তখন আমার একটা কথাও বিশ্বাস করো নি! কতো বার তোমাকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করেছি!

দিতি র গলায় অভিমানের সুর, অর্কর কানেও বাজলো, দিতির হাত ধরে নরম গলায় বললো,

সরি দিতি, বিশ্বাস করো, নিজেকে ছোটো লাগছে খুব! ভুল আমারই, আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারিনি। ছোটো ছোটো ভুল বোঝাবুঝি ছিলো আমাদের মধ্যে, কিন্তু সেটা এতো বড় আকার নেয় নি কখনো আগে। আজ বুঝতে পারছি ফোন সাইলেন্ট রাখা, না ধরা, না বলে কোথাও চলে যাওয়াগুলো কে নিয়ে তোমার সাথে অশান্তি হয়েছে অনেকবার আগে, আমি আসলে সেগুলো কে খুব সাধারণ ব্যাপার ভেবেছি তখন। ভেবেছি তুমি অহেতুক অশান্তি করো, এখন মনে হয় যদি আমার ওই হ্যাবিটগুলো না থাকতো তাহলে হয়ত আমি ফোন হারিয়ে ফেলেছিলাম সত্যিই, এই কথাটা তোমাকে সহজেই বিশ্বাস করাতে পারতাম সেদিন। এখন বুঝি তোমার আস্থা আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজের দোষেই, কিন্তু এবার আমি প্রমিজ করছি, আমাকে আর একটা সুযোগ দিয়ে দ্যাখো, এই ভুলগুলো কোনোদিনও রিপিট হবে না আর! কিন্তু প্লিজ চলে যাবার কথা আর ভেবো না কখনো, সেদিন আমার ওইভাবে তোমাকে চলে যাওয়ার কথা বলা উচিত হয়নি, সেটা বাবা, মায়ের সামনেও বলেছি, আজও বললাম, ক্ষমা করে দাও প্লিজ।

অদিতি চুপ করে রইলো, কে জানে ওর কোনোদিনও বদল হবে কিনা! নাকি শুধুমাত্র মুখের কথা হয়েই থেকে যাবে এগুলো! কিন্তু বললো তো তবু, এই ক্ষমা চাওয়া টুকুই তো চাওয়া ছিলো ওর, অন্তত ওকে বুঝুক অর্ক, এটাই তো ও চেয়েছে মনে মনে এতদিন! কেনো যে এই ছেলেটাকেই এতো ভালোবাসে ও, শুধু মুখেই রাগ দেখায়, ছেড়ে যেতে পারে কই!

কিন্তু মেয়েটা এরকম করলো কেনো? আমি তো ওর কোনো ক্ষতি করিনি!

সেটাই তো! আমি নিজেও সারাক্ষন এটাই ভেবে যাচ্ছি, কোনো মোটিভ থাকবে না? কেউ কোনো কারণ ছাড়াই অহেতুক মিথ্যে কথা বলবে? তাও আবার তারই স্যার সম্বন্ধে! গত তিন বছরে তো এমন কোনো ইঙ্গিত আমি পাই নি যে ওর সম্বন্ধে এরকম কোনো ধারণা করবো! আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় আড়াই বছর হতে চললো, তারও প্রায় মাস ছয়েক আগে থেকে ওকে আমি চিনি, তখন তো আমার বিয়েও হয় নি। এরকম কিছু করার থাকলে তো ও সেই সময়েই করতে পারতো, তখন তো কিছু করে নি। আর এখন তো কলেজ শেষ হয়ে গেলো ওদের!

দিতি বাধা দিলো,

তুমি ভুল করছো! ঘটনা টা কিন্তু এখন কার নয়, এটা প্রায় একবছর আগের ঘটনা হতে চললো, যদি আমরা ফোনের সময় থেকে হিসাব করি! আচ্ছা! ও কি তোমাকে পছন্দ করতো মনে মনে? না হলে বিয়ের পরেই এরকম করলো কেনো?

অর্ক চমকে উঠলো,

পছন্দ করতো! তাই আবার হয় নাকি! হ্যাঁ, আমি তো সবার সঙ্গেই কথা বলি, ওর সঙ্গেও বলেছি! বার কয়েক মেট্রো স্টেশনে দেখা হয়েছে, এমনকি একটা নোটস এর জন্যে ফোন নম্বরও নিয়েছিলো আমার। নোটস নিয়ে যাবার জন্যে ফোনে রিমাইন্ডার ও দিয়েছে। কিন্তু এরকম তো বুঝিনি কিছু কখনো! এমনকি নোটস নিয়ে যেতে যখন ভুলে গিয়েছিলাম তখনও কিন্তু ও কিছু বলেনি আমাকে, তিয়াসাই বলেছিলো। তবে ও আমার সম্বন্ধে খোঁজ খবর রাখতো জানো তো! সেটা আমি এখন বুঝতে পারছি, যেদিন ওরা এখানে নোটস নিতে এলো, সেদিন রিয়া কফি করেছিলো। আমি চা খাবে কি না জিজ্ঞেস করায় আমাকে বলেছিলো, তুমি যেহেতু নেই তাই ওই করে নিচ্ছে। আমি তখন স্টাডিতে নোটস খুঁজতে ঢুকে গিয়েছিলাম। আমার একটু অবাকই লেগেছিলো তখন, যে ও কি করে জানলো তুমি এখানে নেই!

তুমি বলেছিলে না তোমার মোবাইল ওভেনের তলায় রাখা ছিলো? ওই কফি করতে গিয়ে রেখে আসেনি তো?

জানি না! এখন তো সবই সম্ভব মনে হচ্ছে! আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি মোবাইলটা সোফায় রেখে উঠে গিয়েছিলাম, কিন্তু কি করে যে ওখানে গেলো! এটাও তো প্রমাণ করতে পারবো না কিছুতেই! রিয়া যেমন কফি করতে গিয়েছিলো তেমনি তিয়াসা আর শ্রেয়া বলে আর একটা মেয়েও কিন্তু রান্না ঘরে ঢুকেছিলো সেদিন! খুব হতাশ লাগছে, এতগুলো ঘটনা চোখের সামনে দেখেও কিছুই করতে পারলাম না!

আর কিছু না, একটাই কথা মনে হচ্ছে যে এতো কিছু করার পরেও যদি ও পার পেয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে ওর সাহস আরো বেড়ে যাবে। আজ আমাদের সঙ্গে করলো, কাল আবার অন্য কারোর সঙ্গে করবে। দেখো, তুমি তো কিছুতেই বিশ্বাস করো নি আমার কথা, আমাকে চলে যেতেও বলেছিলে একদিন। আজ যদি আমিও চলেই যেতাম, আর যদি বলছি কেনো চলেই তো যাচ্ছিলাম, যদি না বাবা, মা হটাৎ চলে আসতেন, তাহলে আমাদের সম্পর্কটাই তো শেষ হয়ে যেতো ওর জন্যে! পৃথিবীতে কতো অদ্ভুত মানুষ আছে তাই না! যারা না নিজেরা ভালো থাকতে জানে, না অন্য দের ভালো থাকতে দেয়! কি লাভ হয় বলতো এতে! ও ও কি খুব ভালো আছে, এসব করে, কে জানে!

দীর্ঘশ্বাস ফেললো অদিতি, দুজনেই মনে মনে ছটফট করছিলো, কিন্তু কিছুই করার নেই। আস্তে আস্তে সন্ধ্যে হয়ে আসছে দেখে অদিতি উঠে পড়লো, ওর এখন অনেক কাজ আছে। অর্ক খাটে শুয়ে পরপর ঘটনাগুলো কে ভাবতে গিয়ে নিজেই অবাক হচ্ছিলো, এতদিন যে কেনো একটুও তলিয়ে ভাবে নি ও! মেয়েটা কি ইচ্ছে করেই দিতি র মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছে সব সময়! অতো জায়গা থাকতে ওর পাশে বসেই এমন ভাবে কথা বলছিলো যে মনে হবে, ও ফোনে নয় সামনে বসে অর্কর সঙ্গেই কথা বলছে!

একটু পরেই অদিতি চা নিয়ে এলো, সমরেশ ঘর থেকে উঠে এলেন, সোফায় বসে চা খেতে খেতে আলোচনা চলছিলো, বিষয়বস্তু একটাই, রিয়া! সবারই আফসোস কিছু করা গেলো না! এই করতে করতে রাত দশটা বেজে গেলো, এর মধ্যে রান্নার দিদি এসে রান্না করে দিয়ে গেছে। রুমা থাকলে এসব বিষয়ে অদিতি খুব একটা মাথা ঘামায় না, তিনিই এদিকটা দেখাশোনা করেন। সাড়ে দশটা নাগাদ ছেলে কে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসে ওরা একসঙ্গে খেতে বসলো, খাওয়া যখন প্রায় মাঝপথে এমন সময় অর্কর ফোন বাজলো, ফোন ধরতেই কৌশিকের উত্তেজিত গলা শোনা গেলো,

স্যার, রিয়া হাতের শিরা কেটে ফেলেছে, ওকে হসপিটালে ভর্তি করেছি স্যার!

কথাগুলো এতটাই জোরে ছিলো যে সবাই শুনতে পাচ্ছিলো, অর্ক এঁটো হাতেই উঠে দাঁড়ালো,

কেমন আছে এখন?

স্যার, এমার্জেন্সি তে ঢুকিয়েছি, এখনো কিছু জানায় নি ভেতর থেকে, আণ্টি আপনাকে ফোন করতে বললেন, আপনি কি আসবেন স্যার?

বলতে বলতেই পাশ থেকে রিয়ার মা ফোন টেনে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন,

স্যার, আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি, পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই! আমি কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না!

অর্কর খুব খারাপ লাগতে লাগলো, ওর সকালে কথা গুলো বলার জন্যেই কি মেয়েটা আত্মহত্যার চেষ্টা করলো! মেয়েটার কিছু হয়ে যাক, এরকম তো চায়নি ও কখনো! তাড়াতাড়ি বললো,

আপনি চিন্তা করবেন না, আসছি আমি।

টেবিলের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে, সবার মুখেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট! ও তাড়াতাড়ি অরিন্দম কে ফোন করলো,

শোন রিয়া সুইসাইডের চেষ্টা করেছিলো, কৌশিক এই মাত্র ফোন করলো আমাকে! একটু যাবি আমার সঙ্গে?

কোনো রকমে খাওয়া শেষ করে উবের বুক করলো অর্ক, যাওয়ার পথে অরিন্দম কে তুলে নিয়ে যখন হসপিটালে পৌঁছলো তখন রিয়া কে বেড়ে দিয়েছে। কৌশিক জানালো ডাক্তার বলেছেন ও বিপন্মুক্ত এখন। রিয়ার মা এক পাশে শুকনো মুখে বসেছিলেন, অর্ক আর অরিন্দম ওনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, ওদের দেখেই মুখ তুললেন ভদ্রমহিলা,

আজ শুধু কৌশিকের জন্যে আমার মেয়েটা বেঁচে গেলো স্যার! ও না এলে আমি জানতেও পারতাম না আমার মেয়ে এরকম করেছে! আমি টিউশন পড়াতে চলে গিয়েছিলাম, ওর কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকে, কখন ও বাড়ি থেকে ফিরেছে আমি জানিই না!

অর্ক কৌশিকের দিকে তাকালো, কৌশিক মাথা নাড়লো, হাতের মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

দেখুন স্যার!

একটা হোয়াটসঅ্যাপে করা মেসেজ, ” বলেছিলাম না তোকে, আমাকে কেউ ভালোবাসে না! বাবাও আজ ফিরিয়ে দিলো! ওই মহিলা বাবা কে কেড়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে, আর মা ওকে সেই সুযোগটা করে দিয়েছে! ওরা কেউ আমার কথা ভাবে না, একমাত্র তুই কিছুটা হলেও বুঝিস আমাকে, তাই এগুলো তোকেই জানালাম। ভালো থাকিস, আর কোনোদিনও তোর সঙ্গে দেখা হবে না!”

অর্ক স্তম্ভিত হয়ে গেলো, অরিন্দম অবাক গলায় বললো,

তুমি এই মেসেজ দেখে এলে নাকি?

কৌশিক ঘাড় নাড়লো,

হ্যাঁ, স্যার আমি সন্ধ্যে বেলায় টিউশন করি, তাই মেসেজটা দেখিনি তখন! বাড়ি ফিরে দেখেই ওকে ফোন করেছিলাম, ধরলো না দেখে কেমন সন্দেহ হলো! তাই সরাসরি বাড়ি চলে গিয়েছিলাম এবার অনির্বাণের কাছ থেকে অ্যাড্রেস নিয়ে, ও বোধহয় সকালে আপনাদের সঙ্গে গিয়েছিলো ওর বাড়ি। আণ্টি ছিলেন না তখন, বেল বাজাতে কেউ খুললো না, তখন ওপরের বাড়িওলার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে আন্টিকে ফোন করেছিলাম। তারপর আণ্টি আসতে দরজা খুলে দেখি এই কান্ড! খুব জোর বেঁচে গিয়েছে স্যার, ডক্টর বললেন আর দেরি হলে বিপদ হতে পারতো!

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে