এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_২২

0
1966

এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_২২
লেখনিতে: চৈত্র রায়

৪১
,
,
সে রাতের ভালোবাসা নামক গভীর বিষয় আমাকে মনে প্রাণে দেহে এক ঝটকায় বড় করে দিলো…… এতো দিন নিজেকে গিন্নি ভাবলেও সেদিনের পর থেকে একেবারে নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে আবিষ্কার করলাম….. মানুষটার প্রতিটা ছোয়ায় নিজেকে খুব স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে হয়…….. অফিসে যাবার পর চাতকের মতো অপেক্ষা করি কখন ফিরবে…. কখন দেখতে পাবো….. ওনার সান্নিধ্যের লোভ আমার কাছে দুই মিনিট ও দুই বছরের মতোন দীর্ঘ…… আজকাল খুব করে চাই ওনার চোখে চোখে থাকতে।।।। ওনার পছন্দের রান্নাটা শিখে প্রশংসা পেতে….. ওনার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে…..আমার সব কিছু যেন ওনাকে দিয়ে শুরু হয় এমন ভাবনা এমন খেয়াল প্রতিমূহুর্তে আমার মনে আসে….. ভালোবাসার একেবারে ভরাডুবি হয়েছে আমার যাকে বলে…..
,
,
,
দফায় দফায় ভালোবাসাবাসি তে ওনার সাথে সখ্যতা আর সহজতাটা খুব ভালোভাবে হয়ে গেলো আমার….. মানুষ টাকে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসি নি….. হুট করে কিভাবে যেনো ওনার প্রতি ভালোবাসা টা পেয়ে বসলো আমায়….. ইজ ইট ম্যাজিক্যাল!!! জানি না….. আমি কিচ্ছু জানি না…..শুধু জানি এই মানুষটার সাথে আমার আরও অনেক গুলো সময় কাটানো দরকার……
,
,
,
সাদাফ নামক যমঠাকুর রূপি মানুষটা বিছানায় যেমন একজন ভালোবাসায় পরিপূর্ণ স্বামী তেমনি পড়ার টেবিলে উগ্রবাদী যমঠাকুর….. একটু এদিক ওদিক হলেই তুলোধুনো করে দেয়…… যদিও আজকাল খুব একটা সুযোগ পায় না…. তবে আমাকে ভাগে পাবার জন্য যেনো একেবারে মুখিয়ে থাকে……বকাবকির পরিমাণ বেশি করে ফেললে একদম ঘাপটি মেরে আম্মুর রুমে বসে থাকি….. সেরাতে আর রুমে ফেরা নাই……. পরদিন সকাল থেকে শুরু হবে একেবারে অফিসে যাবার আগপর্যন্ত অত্যাচার ……
.
,
,
——— তুলিইইই আমার ব্যাগ কই…
,
,
——— তুলিইইইইই আমার সেন্ডো গেঞ্জি টা পাচ্ছি না…..
,
,
——— ওয়ালেট টা খুজে দেবার জন্য আরেকটা বিয়ে করতে হবে…… আম্মু পাত্রী দেখা শুরু করো….. এইবার‍ যেটাকে বিয়ে করবো সেটা যেন আগের মতো না হয়…..
,
,
,
কথাগুলো বলছে আর আড় চোখে তাকাতে তাকাতে ঘড়ির বেল্ট বাধছেন….. আম্মু ও কেমন মিটিমিটি হাসেন ওনার এসব কথা শুনে……হাসবেন নাই বা কেন হাড়েমজ্জায় তো ওনার বাদড়ামি…… তারপর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে রোজকার রুটিন মোতাবেক শেষ অত্যাচার টা করেন…..
,
,
,
——— তুলিইইইইই এক গ্লাস পানি নিয়ে জলদি আসো আমার দেড়ি হয়ে যাচ্ছে….
,
,
,
আমি ইচ্ছা করে দাতে দাত চেপে ঢিলেমি করে পানি নিয়ে যাই….. ওনি দরজার নব ধরে বেশ আরামসে বিরক্তি ভাব নিয়ে পানিটা শেষ করেন….. তারপর গ্লাস ফেরত দেবার সময় কানের কাছে ফিসফিস করে ওনার বিখ্যাত হুমকি…..
,
,
,
——— আজ হচ্ছে তোমার…. শুধু ফেরার অপেক্ষামাত্র….
,
,
দুই একটা ঢুক মনে মনে গিলে ভেংচি কেটে চলে আসি….. তারপর সে রাত টা বর্ণণাতীত……পরের দিন আবার সেই ঢুলাঢুলি শুরু….. যেখানে বসি সেখানেই ঘুম…. উফফফ কি যে এক লজ্জাজনক ব্যাপার….. যদিও এই রীতি বেশি দিন চলে নি…… বকাবকি শেষে দেখা যেতো উল্টো থ্রেট দিয়ে যেতো…..
,
,
,
——— যদি আজ রাতে আম্মুর ঘরের দিকে তাকাও ও তাহলে তোমার কোন দিন আসবে না…. রাতের পর রাত শুধু রিপিট হবে…..
,
,
,
নয়তো কখনো আম্মুর রুমের পাশে ঘাপটি দিয়ে থাকতো….. সেখান থেকে জোর করে টেনেটুনে নিয়ে আসতো…… মাঝেমধ্যে তিরিং বিরিং করে বের হয়ে আম্মুর পাশে শুয়ে পড়লেও ঘুমের মধ্যে বাচ্চাদের মতন করে কাধে মাথা ফেলে বুকের সাথে মিশিয়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবে…….. এরপর আম্মুর কাছে রাগ করে যাওয়া টাও লজ্জায় পরিনত হয়েছে….. একদিন তো বলেই ফেললো ———
,
,
,
——— রাতে আমার পাশে ঘুমিয়ে তো সকাল দেখতে পারিস না….. কি লাভ বল এই রাগের….. মাঝখান থেকে ছেলেটার মাঝরাত্রিরে কসরত করতে হয়……
,
,
,
আম্মুর এই কথায় ওনি বেশ খুশিতে গদগদ করছিলেন….. আর সুযোগ পেলেই চোখ মারছেন…..
,
,
,
৪২
,
,
,
ওনার নতুন স্যালারি পাবার পর আমাকে নিয়ে বের হলেন বড়দের জন্য কেনাকাটা করবে বলে…..বলেছিলাম সাথে আম্মুকে নিয়ে নিই কিন্তু তাতে এক্কেবারেই রাজি হলেন না…. বললেন এটা নাকি সারপ্রাইজড….. যাই হোক আর কথা বাড়ালাম না….. সবুজ আর কালো মিশেলে একটা শাড়ি পড়লাম কালো ব্লাউজ দিয়ে….. বিয়ের পর একদিনে যে গায়ের রঙ বেশ ফুটেছে বুঝতে আর বাকি রইলো না….. কালো ব্লাউজ আর কালো পাড় টা যেনো আমার গায়ের উজ্জ্বল মেটে রংটাতে ফুটে উঠেছে ভারি….. কপালে ছোট্ট করে কালো টিপ আর খোলা বেণুণি….. চুল খোলে বাইরে যাওয়া টা যেমন আম্মু পছন্দ করেন না তেমনি ওনিও…. তাছাড়া চুল হচ্ছে পিঠ পর্যন্ত….. যার দরুন বেণি করার কারনে অনেকটা উপরে উঠে গেছে….ওনি গল্প বা সিনেমার কোন নায়কের মতো করে আমার সাথে মিলিয়ে কোন পোশাক পড়ে নি….. ব্লু জিন্সের সাথে ফুল হাতা এশ কালারের একটা ফতুয়া পড়েছেন….. বেশ লাগছে দেখতে….. আমার হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে করতেই হাত দিয়ে চুল গুলোকে উলটে আচড়ে ঘড়ি পড়ে নিলেন…… তারপর বের হবার সময় আম্মু আটকে দিলেন……..
,
,
,
——— টুকি ধরতো এখানে হাজার দুয়েক টাকা আছে….. কোন কিছু পছন্দ হলে কিনে নিবি….
,
,
——— আম্মু আমি তো সাথেই যাচ্ছি…..
,
,
——— তুই চুপ কর….. আর শোন রিক্সায় শাড়ির আঁচল কোলে নিয়ে বসবি মনে করে….. আর বাবু শোন সাবধানে যাস….. খেয়াল রাখিস ওর…..
,
,
,
আম্মুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে সোজা শপিংমলে ঢুকে পড়লাম…… গুনে গুনে যতো গুরুজন আছেন সবার জন্য কেনাকাটা শেষ করে বেরুণোর সময় শিমুল ভায়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো….. দেখা হলো বলতে ভুলই হলো….. শিমুল ভাই ই ডেকে দাড় করিয়েছেন….. পাশে ওনার বউ ও ছিলো….. অনেকটা মুটিয়ে গেছেন আগে থেকে……. পেট টাও বেশ ভরাট লাগছে….. যা ভাবছিলাম তাই….. পাঁচ মাসের গর্ভবতী তিনি….. শিমুল ভাইয়ের মুখ থেকে যেনো হাসির ঝিলিক সরছেই না….. তবে ভাবিকে দেখে খুব ক্লান্ত লাগছিলো…… ইন্টার্নি নাকি এখনো শেষ হয় নি….. তাই ভাইয়া রোজ অফিসের পর সাথে করে নিয়ে যায়….. খুব কথা হলো সেদিন….. ওনি আর শিমুল ভাই তো বেশ মাতিয়ে রেখেছিলেন আড্ডা টা….. ভাবিও বেশ মিশুক….. কি সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন….. এসবের মাঝে শিমুল ভায়ের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাতে আমার কোন ভুল হয় নি….. ওনার মুখের দিকে তাকাতেই কেন যেনো আগের সব ভাবনা গুলো দৃষ্টি ঝাপসা করে দিলো……. এই মানুষটাকে নিয়ে একদিন কতো জল্পনা কল্পনা না করে ছিলাম….. বিয়ে হবে…..প্রেম হবে…….. ছোট্ট একটা সংসার হবে….. তারপর আমার কোলজুড়ে একটা ছোট্ট বাচ্চা আসবে….. মা মা বলে ডাকবে….. অচিরেই একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে গেলাম…… বাস্তবতা টা বড়ই ভিন্ন হয়ে গেলো………
,
,
,
টেবিলের উপারে আমার কল্পনা তার ভালোবাসা আর অনাগত সন্তান নিয়ে বেশ সুখে আছে….. আর টেবিলের এপাড়ে আমি মানুষটা…. ভাবতেই নিজের অজান্তেই খাম খেয়ালে পাশে তাকিয়ে দেখি মানুষটা বড্ড সুন্দর করে হেসে হেসে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছে…..ওনার হাসিটায় নিজেও না চাইতেই হেসে দিলাম….. নাহ….. আমি খারাপ নেই…..মানুষটা আমাকে খারাপ থাকতে চাওয়া স্বত্তেও জোর করে ভালো রেখেছে এইযে নাচাওয়া হাসিটার মতোই…… ভালোবাসা মনে হয় এমনি….. কোন কারণ লাগে না….. অকারণেই হাসিতে হাসা যায় আবার অকারণেই কান্নাতে কান্না করা যায়……আমার তোমার বলে আলাদা কোন স্বত্তা নেই….. দুয়ে মিলে এক যাকে বলে….. আবারও বুক চিড়ে নাক ফোড়ে একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো….. তবে এইবারের দীর্ঘশ্বাস টা জানান দিয়ে গেলো আমি ভালো আছি…. এই যে আমার পাশে বসা মানুষ টা আমাকে ভালো থাকতে বাধ্য করেছে….. বাধ্য করেছে তাকে ভালোবাসতে….. বাধ্য করেছে তাকে নিয়ে আরো হাজার টা বছর বাঁচার আকাঙ্ক্ষা করতে….. আর যাই হোক এমন একটা মানুষের সাথে নিশ্চয় খুব করে চেয়েও খুব একটা খারাপ থাকা যায় না….. সেদিন শিমুল ভাইকে পেছন ফেলে আসতে আসতে আরো একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম আমার বুকটা ধ্বক করে উঠে নি ওনাকে দেখে….. সেই চিনচিন ব্যাথাটাও হচ্ছে না…..
,
,
,
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে