এক সমুদ্র প্রেম পর্ব-১৬+১৭

0
1520

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১৬)

ধূসরের অপেক্ষা ফুরোচ্ছেনা। আর কতক্ষন বসে থাকবে এভাবে? সে বেজায় বির*ক্ত। ফোন টি*পতে টি*পতে অসহ্য লাগছে এখন। তবুও উঠে রুমে গেল না। আগে ছেলেটাকে দেখবে তারপর যাবে। এমন কোন রাজপুত্র, যাকে পিউয়ের এত্ত পছন্দ! সে আরেকবার চকচকে সাদাটে হাতঘড়িটা দেখে নেয়। কমসে কম বিশ মিনিট ধরে বসে আছে এখানে। তার অপেক্ষার অবসান ঘটাতে রাশিদ মজুমদার ঢুকলেন। সাথে আনিসের বয়সী এক ভদ্রলোক। কথা বলতে বলতে আসছিলেন দুজন। পেছনে রয়েছে আরো কজন। ধূসর গলার আওয়াজ শুনে বিদ্যুৎ বেগে তাকাল। ভাবল এই বুঝি অনাকাঙ্ক্ষিত, প্রত্যাশিত মানুষটি এলো। ওকে বসা দেখেই রাশিদ মজুমদার থেমে গেলেন। বললেন,
” কী ব্যাপার বাবা,তুমি রুমে যাওনি?”
ধূসর উঠে দাঁড়াল।
” কিছু দরকার?”
” না,আসলে পরে যাব ভেবেছিলাম। ”
পেছন থেকে নারীটি শুধালেন,
” ছেলেটি কে দুলাভাই?”
” হু? মিনা আপার মেজো জায়ের ছেলে। ”
ধূসর ওনাকে সালাম দিলো। রাশিদ পরিচিত করালেন,
” উনি হলেন পিউয়ের মামীর ছোট বোন,রূম্পা। আর ও ওর স্বামী মুস্তাফিজ রহমান। ”
ধূসর হেসে লোকটির সাথে করমোর্দন সাড়ল। অথচ তার মন, চোখ দুটোই রইল সদর দরজায়। সে রোহানকে খুঁজছে। ছেলেটা কী আসেনি? রাশেদ ওনাদের কাছে ধূসরের প্রসংশা স্বরুপ নানান কথা বললেন। তাদের হয়েও কিছু কথা ওকেও শোনালেন। বিধিবাম! একটাও ধূসরের মস্তিষ্কে গেল না। সে উদগ্রীব হয়ে বাইরে দেখছে। অনেকক্ষন গেলেও দরজা দিয়ে কেউ ঢুকছেনা,আসছেনা। শেষমেষ অধৈর্য হয়ে পরল ধূসর।
অস্থি*রতায় ভেতরটা টইটম্বুর হলো। কৌতুহল চে*পে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসল,
” রোহান আসেনি আঙ্কেল?”
রাশেদ মজুমদার ভ্রুঁ গুঁটিয়ে বললেন,
” তুমি রোহান কে চেনো?”
ধূসর চটপট উত্তর দেয়,
” পিউয়ের কাছে শুনেছিলাম। আসেনি?”
” আমিইত রোহান। এই যে আমি, আমি।”
ছোট্ট বাচ্চা কণ্ঠ শুনে ধূসর চোখ নামায়। রূম্পা বেগমের আঙুল ধরে দাঁড়িয়ে সরল চেহারার স্বাস্থ্যবান ছেলেটা হাত উঁচিয়ে বলল ‘ হাই।’
সাথে ফোঁকলা চারটে দাঁত বের করে হাসল। মাথা দুলিয়ে বলল,
” তুমি আমাকে খুঁজছো, কেন? ক্রিকেট খেলবে?”

ধূসর আকাশ ভে*ঙে ধপ করে মাটিতে পড়ল। হতবাক হয়ে বলল,
” ওর নাম রোহান?”
প্রশ্নটাও বেজে বেজে এলো গলায়। রাশিদ বললেন,
” হ্যাঁ। কেন, তুমি কি ভেবেছো?”
ধূসরের ভাবনাচিন্তা হযবরল হয়ে আসে।
” আপনাদের পরিবারে আর কোনও রোহান নেই? বর্ষার খালাতো ভাই?”
রূম্পা বেগম বললেন,
” আমিইত বর্ষার একমাত্র খালা বাবা। আমার এই একটাই ছেলে। তুমি কি অন্য কাউকে খুঁজছিলে?”
ধূসর আহাম্মক বনে থাকল কিছুক্ষন। রাশিদ ওর কাধে হাত রেখে চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
” কিছু হয়েছে?”
তৎক্ষনাৎ ওপর থেকে খিলখিল হাসি ভেসে আসে। ধূসর চোখ তুলে তাকায়। পিউ হাসিতে নুইয়ে পরছে। পাশে অবোধের মতো দাঁড়িয়ে সুপ্তি। ধূসরের বুঝতে বাকী নেই,পিউ তাকে কী মারাত্মক লেভেলের বোঁকা বানিয়েছে। রাশিদ সহ উপস্থত বাকীদের পিউয়ের হাসিটা মাথার ওপর দিয়ে গেল। তিনি শুধালেন,
” হাসছো কেন মা?”
পিউ চটজলদি স্বাভাবিক হলো। হাসিটা ঠোঁট দিয়ে চে*পে দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝাল ‘কিছুনা’। তারপর দ্রুত চলে গেল ভেতরে। ধূসর দাঁত চে*পে চোখ বোজে। মনে মনে কষে একটা থা*প্পড় মারে নিজেকে। তার মত ছেলে কী না একটা হাঁটুর বয়সী মেয়ের থেকে ধোঁ*কা খেল? ছি!

***
পিউ হাসতে হাসতে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পরল। হাঁটু দুটো ভাঁজ হয়ে পেট অবধি উঠে এসেছে। একবার ডান কাত হচ্ছে একবার বামে। সুপ্তি নির্বোধের মত দেখল কিছুক্ষন। কৌতুহলে চোখ পিটপিট করে বলল,
” ও পিউপু,হাসছো কেন তুমি?”
পিউ হাসির চোটে কথা বলতে পারছেনা। পেট -পিঠ ব্যা*থায় আঁটশাঁট। চোখ চিকচিক করছে। সুপ্তি শেষ মেষ বিদ্বিষ্ট হলো। ছোট মানুষ হলেও মেজা*জ উঠল তুঙ্গে। পিউ আপুর এই এক রো*গ,হাসি উঠলে আর থামেনা।
ধ্যাত! বলে সে পা ছু*ড়ে ছু*ড়ে বেরিয়ে যায় বাইরে। পিউ তখনও গড়াগড়ি খেয়ে হাসছে। চেষ্টা করছে,চাইছে, স্বভাবিক হতে। অথচ ধূসরের চেহারাটা মনে পড়লেই পেট চি*রেখু*ড়ে হাসি বের হয়। এখানে তার কী দোষ?

****

গায়ে হলুদের প্যান্ডেল বড় করে সাজানো হয়েছে উঠোনে। গ্রামের বাড়ি যখন, আশেপাশে জায়গা জমির অভাব নেই। কাকভোর থেকেই তার তোরজোড় শুরু। মশলা বাটাবাটির আওয়াজে পিউয়ের ঘুম সুবিধের হলোনা। সবাই মিলে আড্ডা দিয়ে রাত করে ঘুমোলেও, উঠে পরেছে এখন। বর্ষার রুমে ঘুমিয়েছিল ওরা। পিউ,পুষ্প,বর্ষা এক ঘরে,এক বিছানায় । পিউ শোয়া থেকে উঠে বসে। দুহাত মেলা আড়মোড়া ভাঙে। হাই তুলতে তুলতে সামনে তাকাতেই দেখল বর্ষা পায়চারি করছে। হাতে ফোন। ব্যস্তভাবে মেসেজ করছে কাউকে। সে দুষ্টু হেসে বলল,
” সকাল অকাল প্রেমলীলা শুরু হু হু,? ”
বর্ষা কপাল কুঁচকে তাকায়। ভুল শুধরে দেয়ার ভঙিতে বলে,
” মোটেওনা। আমি আমার এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি।”
” আরে থাক বর্ষাপু,এসব বলে লাভ নেই। আমি কি ছোট আছি এখনো? আর তোমারই তো জামাই,নিয়ে যাব না আমরা। আমার চয়েস আবার অত বাজে না বুঝলে।”
” চ*ড় খাবি। আমি সত্যিই আমার বন্ধুর সাথে কথা বলছি।”
পিউ সন্দেহী কণ্ঠে বলল ” আসলেই? ছেলে না মেয়ে?
” মেয়ে।”
” এত সিরিয়াস মুড নিয়ে মেয়েরা, মেয়েদের সাথে কথা বলে?”
বর্ষা আনন কয়েক ধাপ কালো করে বলল,
” কী করব বল! ওর সাথে কথা হয়েছিল ও আমার বিয়ে, গায়ে হলুদ সবেতে থাকবে। অথচ এখন বলছে আসবে কাল। রা*গ হবেনা আমার?”

পিউ বিজ্ঞের ন্যায় মাথা দুলিয়ে বলল,
” অবশ্যই! কেন হবেনা? এইটুকু পথ, কাল আসবে কেন,আজ আসলে কী হয়?’
” এইটুকু পথ? ও ঢাকা থেকে আসবে পিউ।”
পিউ ভ্রঁরু উঁচিয়ে বলল,
” ওরে বাবাহ!তাহলে তো অনেক পথ।”

পুষ্প ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল ‘ সকাল সকাল তোদের ছেলে-মেয়ে বিয়ে দেয়া বন্ধ কর৷ ঘুমোতে দে আমাকে। এমনিতেই রাতে ঘুমোইনি। ”
বর্ষা বলল,
” সারা রাত চ্যাটিং করবি,আর রাতে ম*রার মত ঘুমাবি।”
ওমনি পিউ সচেতন কণ্ঠে শুধাল,
” সারা রাত কার সাথে চ্যাটিং করেছে আপু?”
পুষ্পর ঘুম ছুটে গেল। চোখ বড় বড় করে তাকাল। দুদিকে মাথা নেড়ে বর্ষাকে ইশারা করল মুখ না খুলতে। পিউ পেছনে চাওয়া মাত্রই স্বাভাবিক করে ফেলল নিজেকে। বেচারী কিছুই বুঝল না। আহ্লাদী স্বরে বলল,
” ও বর্ষাপু বলোনা।”
বর্ষা কী বলবে বুঝল না। জোর করে হাসার চেষ্টা করল। এর মধ্যেই পুষ্প ধম*ক দেয়,
” তোর জেনে কাজ কী?যা নিচে যা।”
পিউর চেহারায় মেঘ জমে। সচরাচর পুষ্প তার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেনা বলে অভিমান হলো। আস্তেধীরে ঘর ছাড়ল। ধম*ক দিয়ে পুষ্পর নিজেরই খা*রাপ লাগল। অনুতাপ করে বলল,
” আহারে! সকাল বেলাই বকলাম। থাক,পরে আদর করে দেব।”
পুষ্প আবার চোখ বন্ধ করে। ঘুমোবে সে। বর্ষা সব শেষে ফোনে মন দেয়। ওপাশের ব্যাক্তিটিকে মেসেজ পাঠায়।
” আমি অতশত জানিনা,বিকেলের মধ্যে তোকে বাড়িতে দেখতে চাই ব্যাস।”

***
পিউ ভাবছে। এক্কেবারে হাবুডু*বু খাচ্ছে ভাবনায়। পুষ্প ধ*মক দিয়ে ঘর থেকে বার করতে পারলেও মাথা থেকে প্রসঙ্গটা বার করতে পারল না। তার জানামতে পুষ্প সদা সিঙ্গেল। কখনও দেখেওনি কারো সাথে কথা বলতে৷ সাদিফ ভাইয়ের সাথে না ওর বিয়ে হবে? তাহলে কী ওনার সাথেই রাত জেগে কথা বলেছে? ওরা কী তাহলে জানে এ ব্যাপারে? তার জানামতে এটাতো কারো জানার কথা নয়। সে নিজেওত জানতোনা,যদি না ওইদিন সেজো মায়ের ওয়াশরুমে থাকতো। তবে কার সাথে কথা বলছিল আপু?

পিউ ঠোঁট কা*মড়ে ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল। অন্যমনস্কতায় সামনে যে পিলার পরেছে খেয়াল অবধি করেনি। যেই মাত্র মাথাটা ঠু*কে যেতে ধরবে ওমনি মাঝপথে হাত রাখল কেউ। পিউয়ের কপাল শুদ্ধ গিয়ে ঠেকল একটা ঠান্ডা হস্ত তালুতে। চমকাল সে। চকিতে তাকাল। ধূসরকে দেখতেই নুইয়ে যায়, দৃষ্টি নামায়। ধূসর হাত নামাল, রে*গে বলল,
” চোখ কই থাকে তোর? দেখে হাঁটতে পারিস না? মানুষ রাতকানা হয় শুনেছি, তুই কী দিনকানা?”

পিউ নীচু কণ্ঠে বলল,
” সবে ঘুম থেকে উঠেছি তো,তাই দেখতে পাইনি।”
বলতে বলতে চোখ তুলল । গলায় মাফলার পেঁ*চানো,গায়ে কালো জ্যাকেট পড়ুয়া ধূসরকে দেখে আটকে গেল দৃষ্টি। কয়েক পল চেয়েই রইল ওভাবে। ধূসর এদিক ওদিক তাকায়। কিছুতেই পিউয়ের সাথে দৃষ্টি মেলানো যাবেনা এমন। পিউ ধূসরের আপাদমস্তক দেখল। বরাবরের মতই ঘোষণা করল,
” ধূসর ভাই তার দেখা শ্রেষ্ঠ সুদর্শন পুরুষ! ”
কালো জ্যাকেটে কাউকে এত মারাত্মক লাগতে পারে? পারেইতো, এই যে ধূসর ভাইকে লাগছে।
পিউ অভিভূতের মতোন তাকিয়ে রয়। জ্বিভ খসে বেরিয়ে আসে,
” আপনি এত সুন্দর কেন ধূসর ভাই?”
ধূসর চট করে তাকাল। চোখ ছোট করে বলল ” কী?”
পিউ হুশে আসতেই ভ্যাবাচেকা খেল। পলক ঝাপ্টে বলল,
” না মানে হয়েছে কী….”
কথা খুঁজতে মাথা চুল্কাল। ক গোছা চুল এসে পরল চোখের পাশে। সবে ঘুম ভা*ঙা, এলোমেলো কেশ,ফোলা মুখচোখের পিউকে মনোযোগ দিয়ে দেখল ধূসর। শুকনো ঢোক গিল*ল। পরপর পিউয়ের চোখ ঢেকে দেয়া চুল সরিয়ে গুঁজে দিলো কানে। পিউ স্তব্ধ হয়ে তাকালো। চাউনিতে ধূসর অপ্রস্তুত হয়ে পরে। গলা ঝেড়ে বেরিয়ে যায় সদর দরজা থেকে।
**
” এই পিউ,তোকেই তো খুঁজছিলাম। কোথায় থাকিস?’
পিউ বিস্ময়াকুল হয়ে দেখছিল তার ধূসর ভাইয়ের প্রস্থান। সাদিফের হঠাৎ কথায় ধ্যান ভা*ঙে। সম্বিৎ ফেরে। সাদিফ কাছে এসে দাঁড়ায়।
” ফ্রেশ হয়েছিস তুই?”
পিউ দুদিকে মাথা নাড়ল।
” এই বাড়িতে সুন্দর একটা বাগান আছে শুনলাম। চল দেখে আসি।”
সাদিফের উদ্বোলিত ভঙি। চেহারাতেও হাসি লেপ্টে। গ্রামে এসে প্রচন্ড এঞ্জয় করছে। শীত শীত ব্যাপারটাও দারুন এখানে। যতই শীত হোক, ঢাকায় অতটা বোঝা যায়না।
পিউ বলতে গেল,
” কিন্তু আমিতো… ”
সাদিফ পথিমধ্যে বলল ” আরে কিন্তু টিন্তু বাদ। চলতো…”
পিউয়ের কথা পাত্তা পায়না। রীতিমতো হাত টে*নেটুনে নিয়ে চলল সাদিফ।

***
আমজাদ আর আফতাব সিকদার রাশিদের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছেন। আনিস আর তিনি গতকাল রাতেই পৌঁছেছেন এখানে। রাশিদ বয়সে অনেক ছোট তার। দুলাভাইকে একদম নিজের বড় ভাইয়ের মত শ্রদ্ধা করেন রাশেদ। যে কোনও ভালো মন্দ কাজের পরামর্শ নেন। এখনও নিচ্ছেন। কী মেন্যু করলে ভালো হবে,কোন দিকে গেট করবেন, সব বুঝে নিচ্ছেন ভালো করে। ধূসর এসে তাদের কাছে দাঁড়ালো। প্যান্ডেলের বাইরে বাবুর্চিখানা বসবে। বিশাল বিশাল হাড়ি পাতিল জমা হচ্ছে সেখানে। মুত্তালিব ওকে দেখতেই বললেন
‘ কী ব্যাপার ধূসর,এত সকালে উঠলে যে? বুঝেছি, আওয়াজে ঘুম ভে*ঙেছে তাইতো?”
ধূসর শুভ্র হেসে বলল ‘ না আঙ্কেল, আমি সকালেই উঠি।”
” বাহ! বেশ ভালো গুন। ”
এরপর ধূসরের কাঁধ আগলে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
” আমার তোমাকে দারুন লেগেছে বুঝলে। একটা ব্যাপার পেয়েছি তোমার মাঝে। ”
ধূসর এবারেও হাসল। তিনি বললেন,
” তা বাবা ফিউচার প্ল্যান কী তোমার? রাজনীতি করছো শুনলাম।”
” জি। ”
” আমার রাজনীতির প্রতি তরুন বয়স থেকেই আলাদা ঝোঁক ছিল বুঝেছ। করেছিলাম কিছুদিন।”
” তাই? তাহলে কন্টিনিউ করলেন না কেন?”
মুত্তালিব শ্বাস ফেলে বললেন,
” কী করে করব বলো দেখি,বিয়েত নিজেরা পছন্দ করে করেছিলাম। আমার শ্বশুর মশাই মেয়ে দেয়ার আগেই শর্ত ছু*ড়েছেন,কিছুতেই ওসবের কাছে ঘেঁষা যাবেনা। অগত্যা আমিও আর এগোইনি। ভালোবাসাটাকেই বেছে নিয়েছি। তবে তোমার ব্যাপারটা ম*ন্দ লাগছেনা। ব্যাবসা,রাজনীতি সব এই কাঁধে। হা হা হা।”
মুত্তালিব হাসলেন। অথচ ধূসরের মুখে পরতে পরতে অন্ধকার ছেঁয়ে এলো। ভবিষ্যতের কোনও এক ভাবনায় আকুল হয়ে ওঠে মস্তিষ্ক। তার রাজনীতি, শেষমেষ তারই প্রতিকূলে যাবে না তো?

‘ আচ্ছা ধূসর,বলোতো বাবা, কোন দিকে স্টেজটা করলে ভালো হবে? বামে করব,না কী ডানে? ডানে আবার সদর গেটটা সামনে পরে। কী করা যায়,একটু বুদ্ধি দাওতো।”
ধূসর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেকে ধাতস্থ করে। নিচের ঠোঁট কা*মড়ে আশপাশ দেখে। হুট করে নজর আটকায় সাদিফ আর পিউয়ের দিকে। হাত ধরাধরি করে হাঁটছে তারা। ধূসরের কপালে ভাঁজ পরল। আগ্রহভরে চেয়ে রইল।

পিউ সাদিফের দীর্ঘ কদমের সঙ্গে কূলোতে না পারলেও তাল মেলাচ্ছে। মূলত সাদিফটাই টেনে নিচ্ছে ওকে। তার মাথায় তখনও ঘুরছে ধূসরের কথা। ইদানীং ধূসর যা যা করছে তিন বছরে করতে দেখেনি। মানুষটা বিদেশ থেকে ফিরে মধু মিশিয়ে কথা বলতো। হুটহাট বদলে গেল। ধম*কাত,চোখ রাঙা*ত। তারপর এতদিন ধরে ভালো করে কথাও বলেনি, তাকানো তো দূর। অথচ এখন প্রায়ই চোখাচোখি হচ্ছে। বেখেয়ালে তাকালেও দেখছে ধূসর তার দিকে তাকিয়ে। যেন সব সময় ওকেই দেখছে। কী মানে এসবের?

বিভ্রান্ত পিউয়ের ভাবনার সুতোতে টান লাগে সাদিফের উচু কণ্ঠে। তড়িৎ বেগে ঘুরে তাকায় সে। সাদিফ হাত ছেড়ে দূরে গিয়েছে অথচ সে খেয়ালও করেনি। পিউ আহত শ্বাস নেয়। বিড়বিড় করে বলে,
” হায়রে ধূসর ভাই! আপনার জন্যে আমার ধ্যান জ্ঞান ডিভোর্স দিলো আমাকে। ”

উঠোনের পাচিল জুড়ে অসংখ্য মর্নিং গ্লোরিস ফুটেছে। শ্যাওলা পরা দেয়ালে নীল রঙ বেশ লাগছে দেখতে। এছাড়াও আশেপাশে গাঁদা,গোলাপ,ডালিয়া গাছের চারা লাগানো। কিছুতে ফুল ফুটলেও কিছুতে কলি এসেছে সবে। সাদিফ মর্নিং গ্লোরির কাছে এগিয়ে যায়। পকেট থেকে ফোন বের করে ফটাফট কিছু ছবি তোলে। মুগ্ধ হয়ে আওড়ায়,
” সুন্দর না ? ”

পিউ ছোট করে বলল ‘ হু।’
সাদিফ একটা ফুল ছিড়ে হাতে নেয়। এগিয়ে আসে। হুট করে পিউয়ের কানে গুঁজে দেয়। আচমকা ঘটনায় পিউ বিহ্বল হয়ে তাকায়। তৎক্ষনাৎ দূরে দাঁড়ানো ধূসরের হাত মুঠো হয়। সাদিফ বিমোহিত হেসে বলল,
” ফুল গাছে সুন্দর জানি, অথচ আমার মনে হচ্ছে ওকে তোর চুলে বেশি মানিয়েছে। ”
পিউ হেসে বলল,
” থ্যাংক ইউ।”
সাদিফ দোলনা দেখিয়ে বলল ‘ চল ওদিকে যাই।”
আবারও তার হাত ধরে সাদিফ। পিউ আনন্দ সমেত এগোয়। সাদিফ ওকে বসালো। সামনে এসে ফোন উঁচিয়ে বলল,
” তুই বোস,আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।”

পিউ তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। আপত্তি করে বলে,
” না না আমি চুলটাও আচড়াই নি। এভাবে ছবি তুলবেন না,ভাইয়া। বি*শ্রি আসবে।”
” কে বলল? সুন্দর লাগছে তো।”
পিউ দুদিকে মাথা নাড়ে,
” না। এক কাজ করি,আপনি অপেক্ষা করুন,আমি যাব আর আসব। ”
” কোথায় যাবি?”
” সেজেগুজে আসি?”
সাদিফ তব্দা খেয়ে বলল,
” এ্যা?”
” হ্যাঁ। আসছি দাঁড়ান।”
পিউ উঠতে নিলেই সাদিফ বাঁ*ধা দিলো,
” না। এভাবেই ভালো লাগছে। চুপচাপ বোস। ”
পিউ করুন কণ্ঠে বলল,
” অন্তত একটু লিপস্টিক দিয়ে আসি ভাইয়া?”
সাদিফ হাটুমুড়ে বসে ক্যামেরা অন করল। কথাটায় চোখ রা*ঙিয়ে বলল,
” তুই চুপ করে বোসবি?”
পিউ ঠোঁট উলটে বসে থাকে। সাদিফ ফোন চিৎ- কাত করতে করতে বলে,
” পোজ দে।”
পিউ দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসে বসে পোজ দেয়। মুত্তালিব নিষ্পৃহ ধূসরকে বললেন,
” কী ধূসর, বলো কিছু। ”
জবাব এলোনা। শুনেছে কী না সন্দেহ। তিনি এবার উঁচু স্বরে ডাকলেন,
” এই যে ধূসর বাবা! ”
ধূসর নড়ে ওঠে। ডাকটা পিউ অবধি পৌঁছে যায়। ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে সেদিকে তাকায়। ধূসর এদিকেই চেয়ে। শ*ক্ত চিবুক,হাড় হিম চাউনী।
‘ তুমি তো কিছু বলছোনা,কোন দিকে করতে বলব।”
ধূসর জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। হাসার চেষ্টা করে বলে,
” বামদিকে ভালো হবে। ”
মুত্তালিবের পছন্দ হলো।
” তাহলে এটাই পাঁকা কী বলো!”
” জি।”
মুত্তালিবের কাঁধে প্যান্ডেলের দায়িত্ব বর্তেছে। দ্বিধায় ভুগছিলেন কী করবেন সে নিয়ে। একটু আইডিয়া পেয়ে ধূসরকে রেখেই দ্রুত এগোলেন ভাইকে জানাতে। এরপর আরেকবার পিউয়ের দিক তাকাল ধূসর। দৃষ্টি অদ্ভূত,দূর্বোধ্য। লম্বা পায়ে ফের ঢুকে গেল বাড়িতে। পিউয়ের মাথা ভেদ করে গেলেও সে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ায়। কাজে ব্যা*ঘাত ঘটল সাদিফের। শুধাল,
‘ কী হলো?”
” আর তুলতে হবেনা ভাইয়া। থাক এখন।”
কোনও মতে বলেই সেও ঘরের দিক ছোটে। সাদিফ কিছুই বোঝেনি। ওদিকটায় কতক্ষন চেয়ে থেকে ফোনের স্ক্রিন সামনে ধরল। এতক্ষন ধরে তোলা পিউয়ের ছবিগুলো দেখতে দেখতে চশমাটা ঠেলে মুচকি হাসল।

***

পিউ প্রত্যেকটা ঘরে গিয়ে গিয়ে উঁকি মারছে৷ রাতে ধূসরকে কোন ঘরে থাকতে দিয়েছে সে জানেনা। গ্রামের বাড়ির হাড়কাঁপানো ঠানায় সেই যে খেয়ে রুমে গেল,লেপের তলায় ঢুকল, আর বেরই হয়নি। তাই এখন তিন তলার প্রত্যেকটি ঘর খুঁজে ম*রতে হচ্ছে। ধূসর ভাই তখন ওভাবে তাকালেন কেন? কেন ওরকম করলেন? তিনি কি রা*গ করেছেন?
জানতেই হবে। নাহলে আজ দুপুরে ভাত খেলেও হজম হবেনা। পিউ ক্লান্ত হলো। হার মানল। তবুও ধূসরকে পাওয়া গেল না। লোকটা তো বাড়ির ভেতরেই এসেছে দেখল,গেলটা কোথায় তাহলে?
ছাদে? হ্যাঁ, ওখানে থাকতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে পিউ ধুপধাপ পা ফেলে ছাদের দিকে ছুটল।

ধূসর রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। কুয়াশা কে*টে অল্প স্বল্প রোদের দেখা মিলেছে। সরাসরি পিঠে এসে লাগছে তার। হাত ভর্তি কাপড়ে নিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠল শান্তা৷ সব গুলো আধা-শুকনো। এখন রোদে দিলে বাকীটাও শুকিয়ে যাবে। ছাদে আসতেই ধূসরকে দেখে থমকাল সে। ধূসর পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শান্তা গুঁটিয়ে আসে। মাথায় ঘোমটা টানে। সুধীর পা ফেলে আস্তে আস্তে দড়িতে কাপড় মেলে দেয়। মাঝে মাঝে, আড়চোখে দেখে নেয় তাকে। ধূসর হঠাৎই ঘুরে তাকাল। ওমনি চোখাচোখি হলো দুজনের। চটপট আঁখি ফেরাল শান্তা। অপ্রতিভ হয়ে পরল। কী করবে, কোথায় তাকাবে! নার্ভাসনেসে মাথা নুইয়ে মেলে দেয়া কাপড়টা গোঁটাল,পরপর আবার মেলল। ধূসর দেখেও দেখলোনা ওসব। পকেট থেকে ফোন বের করে নিউজফিড অন করল। শান্তার কাজ শেষ অথচ যাচ্ছেনা। ক্ষনে ক্ষনে চোরা চোখে তাকাচ্ছে তার দিক। ধূসরের বুঝতে বাকী নেই। ফোন থেকে চোখ তুলল এবার। মেয়েটার খুশখুশ করা দেখে প্রশ্ন করল,
” কিছু বলবে?”
হঠাৎ প্রশ্নে শান্তা ভড়কে যায়। নিরব পরিবেশে ধূসরের গভীর স্বর তার লোম কাঁ*পায়। ঘনঘন দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝায় ‘ না। ‘

ধূসর সোজাসাপটা শুধাল,
” তাহলে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ”

শান্তার মুখস্রী থমথমে হলো। আস্তে করে বলল “যাচ্ছি। ”
নিচে নামতেই পথে বাঁধল পিউ। সে দুরন্ত পায়ে আসছিল৷ ওকে দেখেই দাঁড়িয়ে যায় সে। একবার ওপর দিক চেয়ে বলে,
” ছাদে যাচ্ছো পিউপু?”
পিউ ব্যস্ত কণ্ঠে বলল” হ্যাঁ, সর সর।”
শান্তা হাত দিয়ে রাস্তা আটকে বলল ” যেওনা। উনি নিষেধ করেছেন।”

চলবে,

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১৭)

‘ উনি? উনি কে?’
শান্তা নাজুক স্বরে জানাল ‘ ধূসর ভাই।’
হাবভাব দেখে পিউয়ের মাথা গরম হয়। নামটা বলার সময় এত লজ্জ্বা পাওয়ার কী আছে? কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,
‘ উনি কী? ভাইয়া বলতে পারিস না?’
শান্তা বিরক্ত হলো। ভ্রুঁয়ে ভাঁজ পরলেও উত্তর করল না। পিউ যেতে নিলে নিরবে আবার বাঁ*ধা দিলো। পিউ রে*গে তাকায়। পরপর চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে বলে,
‘ উনি কি তোকে পাহাড়াদার রেখেছেন?’
‘ না,কিন্তু এখন কাউকে যেতে মানা করলেন।’
পিউ দৃষ্টি সরু করে বলল,
” তোকে বলতে বলেছে?”
শান্তা মাথা দোলাল। পিউ ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলে বলল,
” বলেছিস,শুনেছি। এখন সর,যেতে দে।’
শান্তা শুনলনা। উলটে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
‘ গেলে উনি রা*গ করবেন।’
‘ আশ্চর্য! করলে আমার ওপর করবেন। তোর তাতে কী? ‘
‘ ভালোর জন্যে বলছি,শুনছোনা।’
‘ শুনবওনা। ধূসর ভাই যদি পুরো দুনিয়াটাকেও পাহাড়া বসান,ওনার কাছে যাওয়া থেকে আমাকে আটকাতে সফল হবেনা। ”

শান্তার রা*গ হলো। পিউ বয়সে বড় দেখে মুখের ওপর কিছু বলতে পারল না। বললেও কী সে তোয়াক্কা করবে? পিউ ওকে ঠেলেঠুলে ওপরে উঠতে নেয় । এর আগেই ওপাশ থেকে নেমে এলো ধূসর। থেমে গেল পিউ। ধূসর দুজনকে দেখেও এড়িয়ে গেল। পাশ কা*টিয়ে নেমে যেতেই পিউ পেছন পেছন ছুটল। শান্তা দাঁড়িয়ে থাকল সেখানে।

” আপনি কি আমার সাথে রা*গ করেছেন ধূসর ভাই?”
নামতে নামতে উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন ছুড়*ল পিউ। ধূসর থামল না। চলতে চলতে জবাব দিল,
” না।”
পিউ বুক ভরে শ্বাস নেয়। খুশি হয়ে আওড়ায়,
” তাহলে ঠিক আছে।
ধূসর থেমে দাঁড়ায় হঠাৎ। ঘাঁড় বাঁকা করে চেয়ে বলে,
‘ কিচ্ছু ঠিক নেই।সময় এলে তোকে বোঝাব।’

‘ কী বোঝাবেন?’
ধূসর অর্থটা আর ভে*ঙে বলেনা। শব্দ যুক্ত পায়ে নেমে যায়৷ পিউ বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথায় ঘুরছে ‘সময় এলে তোকে বোঝাব ‘ কথাটা। কবে আসবে সময়?

******
লীলাবালি লীলাবালি,
বড় যুবতি সইগো,
বড় যুবতি সইগো,
কী দিয়া সাজাইমু তরে…!

সাউন্ডসিস্টেমে পুরো দস্তুর চলছে গান। আওয়াজে একজন আরেকজনের গলাও শুনছেনা। কাল অবধি খোলামেলা বাড়িটাতে আজ পা রাখার জায়গা নেই। বিয়েতে দাওয়াত প্রাপ্ত সকল মেহমানে ঠে*সে গিয়েছে একদম। আত্মীয় স্বজনের উপচে পরা জমকাল ভীড়। ময়মুনা খাতুনের হাত জিরোচ্ছেনা। মেয়ের বিয়ের কাজে ছুটতে হচ্ছে এদিক সেদিক। কতরকম মেহমানদের আপ্যায়নের দায়িত্ব কাঁধে ! রাশিদ মজুমদার সামলাচ্ছেন বাইরেটা। তার সঙ্গে অবশ্য লোকের অভাব নেই। এখন তো সাদিফ ও আগ্রহভরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে । দুপুর থেকেই হৈচৈ বেঁধেছে। গিজগিজে কথাবার্তায় কান ঝালা পালা। বর্ষা গ্রামে বড় হলেও বেশ মর্ডান। বিয়ে উপলক্ষে তার হাজারখানেক আবদার। এই যেমন, বাড়ির গৃহীনিরা চেয়েছিলেন, বাড়ির পেছনের উঠোনে গোসল করাবেন ওকে। সেখানেই হলুদ সাড়বেন। মাটিতে পাটি বিছিয়ে বসাবেন। প্রস্তাবখানা শুনেই বর্ষা নাকচ করে দিলো। তার একটাই কথা, স্টেজ করে বসাতে হবে। নাহলে সে ঘর আটকে বসে থাকবে৷ দুদিন বাদেই পরের ঘরে চলে যাবে যে মেয়ে, তার আবদার ফেলার সাহস নেই মজুমদারের৷ বিনাশর্তে মেনে নিলেন তিনি। ছোট খাটো একটা স্টেজ সেখানেও গড়লেন। মুত্তালিব আবার নাঁচ -গানের জন্যে বাইরে থেকে লোক আনাবেন রাতে। ভদ্রলোক বুঝলেন না,বাড়ি ভর্তি ছেলেমেয়ে নাঁচলেই স্টেজে জায়গা হবেনা,সেখানে বাইরের লোক পা রাখবে কোথায়?

বর্ষাকে পড়ানো হয়েছে হলুদ রঙের কড়কড়ে তাঁতের শাড়ি আর ফুলের গয়না। সাথে টুকটাক মেক-আপের আস্তরন। সব মিলিয়ে শ্যামলা মেয়েটা পরীর মতো হয়ে উঠল। কচি-কাঁচা মেয়েরা সব পাল্লা দিয়ে সাজছে। হাঁটলে দু তিনটে আ*ছাড় খেয়ে পরা বাচ্চাটাও শাড়ির আঁচল ছড়িয়েছে পিঠে।

এদিকে পুষ্প পরেছে মহা ঝা*মেলায়। ইকবাল তাকে বারবার নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে কিছুতেই বেশি সাজগোজ করা যাবেনা। বিয়ে বাড়িতে কত ছেলে আছে,আসবেও পরে,ওর ভেতর যত কম সুন্দর লাগবে ততই ভালো। পুষ্পর শাড়ির’ শ’ ও উচ্চারন করা বারন । মেয়েটা চো*টপাট দেখিয়েও লাভ হলোনা। ইকবাল গললনা একটুও। শেষ মেষ মুখ ভাঁড় করে হলুদ থ্রি পিস পরেই বের হলো পুষ্প। একটু পরপরই ভিডিও কল দিচ্ছে ইকবাল। পরীক্ষা করছে আদৌতেই সে পরেছে কী! পুষ্প মাঝেমধ্যে বেজায় ক্ষু*ব্ধ হয় তার এসব স্বভাব দেখে। যার সাথে গোটা জীবন কাটাবে, তাকে বিশ্বাস নেই? আশ্চর্য পুরুষ মানুষ!

সবাই সেজেগুজে শেষ করে ফেললেও পিউ তৈরি হচ্ছেনা। সে অগোছালো রুপেই হাঁটাহাঁটি করছে। এর অবশ্য কারনও আছে। সে এখনও দেখেনি ধূসর কী রঙের জামা পরেছে। আগে ওকে দেখবে,সে মোতাবেক মিলিয়ে নিজেও পরবে। কারন অনুষ্ঠানে কাপলরা একে অন্যের সাথে ম্যাচিং করে জামাকাপড় পরে। সে আর ধূসর তো মনে মনে কাপল। ধূসর তার ইয়ে না….! ভেবেই পিউ লজ্জ্বায় গুঁটিয়ে যায় একহাত।

পিউ সদর দরজায় এসে দাঁড়িয়ে রইল। ধূসর বাড়ির কোথাও নেই। মুত্তালিব ওকে কাছ ছাড়াই করছেন না। অল্পতে দারুন জমেছে দুজনের। পিউ অপেক্ষা করছে ধূসরকে দেখার। প্যান্ডেলে এত ছেলেরা ঘুরছে ,মিনা বেগম কড়া করে বলে দিয়েছেন ওখানে না যেতে। গ্রামের ছেলেপেলে, কী বলতে কী বলবে! শেয়ানা- ডাঙর মেয়ে হলে চিন্তার শেষ নেই।
পিউয়ের প্রতীক্ষার মাঝেই ধূসর দৃশ্যমান হলো। পাশে সবুজ রঙের শার্ট পরিহিত সাদিফ,দুজন কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছে। ওর গায়ে নীল রঙের পাঞ্জাবিটা দেখতেই পিউ উজ্জ্বল পায়ে ঢুকে গেল বাড়িতে।

***
গ্রামের রীতি অনুসারে গোসলের আগে-পরে মেয়েকে হাঁটিয়ে নেয়া বারন। দুলাভাইয়েরা কোলে করে নিয়ে যান। কিন্তু জ্ঞাতীগোষ্ঠিতে বর্ষাই সবথেকে বড়। দুলাভাই আসবে কোত্থেকে?কোলে নেয়ার কথা উঠতেই মিনা বেগম হৈহৈ করে ধূসরের নাম জানালেন। সেই মোতাবেক রুবায়দা বেগমও ছুটে এলেন ছেলের কাছে। জ্বলজ্বলে চোখমুখে প্রস্তাব খানা রাখতেই ধূসর এককথায় বলে দেয় ,
” আমি পারব না।”
রুবায়দা বেগমের হাসি নিভে গেল। অবাক হয়ে বললেন,
” ওমা,কেন?”
ধূসর রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে জানাল,
” এমনি।’
” এটা কোনও কথা হলো?’
‘ হলো। মেয়েদের সাথে কথা বলিনা যেখানে,সেখানে কোলে নেয়া তো অনেককিছু। আনকম্ফোর্টেবল ফিল হয়,অন্য কাউকে বলো।’

‘ বর্ষা তো তোর বোনের মতো। কোলে নিলে কী হয়? পিউ যখন পায়ে ব্যা*থা পেল ওকে তো নিয়েছিলি।’
ধূসর মায়ের দিক অসহায় চোখে তাকায়। মনে মনে আওড়ায়,
” পিউ আর বাকী মেয়ে এক ?’
মুখে বলল,
” তখন ইচ্ছে করেছে,এখন করছেনা। সাদিফ কে বললে সমস্যা কী? ‘
রুবায়দা বেগম হার মেনে বললেন,
” আচ্ছা,ওকেই বলি বরং। ”

সাদিফ বাধ্য ছেলে। একবার বলাতেই রাজি। বর্ষার কামড়া ছিল দোতলায়। একদম সেখান থেকে কোলে তুলে পেছনের উঠোন অবধি নিয়ে এলো সে। তার সুঠাম গাত্র, সৌন্দর্য দেখে গলে গেল বিয়ে বাড়ির অনেক তরুনী । সব থেকে বেশি প্রভাব পরল মিনা বেগমের ছোট বোনের মেয়ে মৈত্রির ওপর। অনার্সে উঠেছে কেবল। সাদিফ কে দেখেই তার গা ছুঁলো খোলা বসন্তের হাওয়া।

***
পিউ নীল রঙের শাড়ি পরেছে। কোমড় অবধি খোলা চুল। সাথে অল্প স্বল্প সেজেছে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল লিপস্টিক দিতে গিয়ে। নীলের সাথে কোন রঙ মানাবে কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা। লাল পরবে না গোলাপি? নাকি মেরুন? তার দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যেই ঘরে ঢুকল পুষ্প। বোনকে দেখে প্রথম দফায় মুগ্ধ হলো। পিউ জীবনে প্রথম শাড়ি পরল আজ। দেখতে হুরের মত লাগছে। পরপর ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
‘ গায়ে হলুদের দিন তুই এই কালার পরেছিস কেন? হলুদ পরতে হয় জানিস না?’
পিউ ঘুরে তাকাল না। আয়নার দিক চেয়ে থেকে বলল,
” ইচ্ছে হয়েছে তাই।’
পুষ্প মৃদূ হাসল। দু পা ফেলে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে বোনের গলা জড়িয়ে বলল, ‘ রা*গ করেছিস?’

পিউ ভেঙচি কে*টে বলল
‘ রা*গ করব কেন? আমি কে? মানুষ ইচ্ছে করলেই আমাকে ব*কবে,মা*রবে,ধম*কাবে তাতে কী,আমিতো সরকারি। ‘
পুষ্প গাল টেনে বলল,
‘ ওলে আমাল বাবুতা! তুই তো আমার সবথেকে আদরের। তখন একটু ধ*মকেছি বলে এতদিনের ভালোবাসা ভুলে যাবি?’

পিউ এতক্ষনে ঘুরে তাকায়, আহ্লাদী স্বরে বলে,
‘ আর ব*কবি আমায়?’
‘ না না মাথা খা*রাপ। ‘
পিউ হাসল। ঝকঝকে দাঁত উন্মুক্ত হলো। পুষ্প অভিভূতের ন্যায় আওড়াল,
” তোকে যে কী সুন্দর লাগছে রে পিউ!”
‘ থ্যাংক ইউ। আচ্ছা আপু,কোন লিপস্টিক টা পরব?
‘ মেরুন পর, ভালো লাগবে।’
” আচ্ছা।”
পিউ ঘুরে আবার আয়নার পানে তাকায়। পুষ্প ঘর থেকে বের হতে হতে বলল
” তাড়াতাড়ি আসিস। ”
‘ আসছি, আসছি।’

পিউ একা একা শাড়ি পরেছে। অত গোছালো না হলেও হয়েছে কোনও রকম। কিন্তু কুঁচি উলটে যাচ্ছে বারবার। এই নিয়ে মুসিবতে পরেছে ভীষণ । সব ঠিকঠাক করতে করতে বাড়ি শূন্য। সে একবার জানলায় গিয়ে উঁকি দিলো। উঠোন ভর্তি মানুষ। গায়ে হলুদ শুরু হয়েছে। অত মানুষের মধ্যে ধূসরকে ঠিকই দেখতে পায়। ওইত উঠোনের এক কোনায় গোল টেবিল পাতানো। চার পাঁচজন ঘিরে বসে সেখানে। ধূসরও আছে। সে দ্রুত ঘর থেকে বের হলো।এমনিতেই কত কিছু মিস করে ফেলেছে। তবে হাতদুটো খালি খালি লাগছে। একটা ব্রেসলেট ও আনেনি পরবে বলে। কাঁধে মেলে রাখা আঁচল ঠিকঠাক করে উঠোন অবধি এলো।
ওমনি কানে গেল একটি পুরুষালি আওয়াজ।
কেউ চিন্তিত স্বরে বলছে, ‘ এই যা! ধূসর ভাই, আপনার ফোনের গ্লাস তো ভে*ঙে গেল।’

পিউ চট করে তাকায়। চোখাচোখি হয় ধূসরের সাথে। নিষ্পলক তার দৃষ্টি। গোটা চার পাঁচজন ছেলে নিয়ে দাঁড়িয়ে সে। ফোনটা পরে আছে মাটিতে। কানে গুঁজে কথা বলছিল। পিউকে দেখতেই হাত শিথিল হয়ে খসে পরল সেটা। ছেলেটা ফোনের ধূলো ঝেড়ে ধূসরের দিক বাড়িয়ে দিলো। সাথে পরামর্শ দিল,
” এই মোড়ে একটা সার্ভিসিংয়ের দোকান আছে,বিকেলে নিয়ে যাব আপনাকে। ”
ধূসরের জবাব নেই। থমকে আছে সে। কথা কানে ঢুকেছে কী না সন্দেহ! সে ব্যস্ত সামনের নীল জামদানি পরিহিতা মেয়েটিকে নিপুণ চোখে দেখতে।

পিউ ঘটনার আগামাথা জানেনা,বুঝলোওনা। সে ধূসরের চাউনী দেখেই গুঁটিয়ে গেছে। লজ্জ্বায় মাথা নামিয়েছে। মিনা বেগম কুলো নিয়ে পাশ থেকে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মেয়েকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলেন। পা থেকে মাথা অবধি দেখে আওড়ালেন,
” মাশ আল্লাহ! কে সাজালো তোকে?’
‘ আমি একাই সেজেছি।’
মিনা বেগম আপ্লুত হয়ে মেয়ের মাথায় চুমু খেলেন। সাথে কূলোর ওপর রাখা কূপের কালি নিয়ে লাগিয়ে দিলেন গলায়।

মায়ের যাওয়া থেকে দৃষ্টি এনে পিউ আবার ধূসরের দিক তাকায়। সে তখনও চেয়ে আছে৷ তার দিক তাকাতে তাকাতেই চেয়ারে বসল। কেমন হাঁ*সফাঁস করে উঠল,যেন শ্বাস নিতে পারছেনা। পরপর টেবিল থেকে বোতল নিয়ে ছিপি খুলে ঢকঢক করে পানি খেলো। পিউ দাঁড়িয়ে থাকে। খুব করে চায়,ধূসর একবার কাছে আসুক। এসে জানাক কেমন লাগছে! কিন্তু এলোনা সে। ভা*ঙা ফোনটা হাতে নিয়েই ব্যাস্ততা দেখাল। পিউয়ের আনন্দ মিইয়ে আসে। মুখ ভাঁড় হলো। সেই ফাঁকে ছুটে এল সাদিফ। গলায় ঝুলছে তার পার্সোনাল ক্যামেরা। পিউকে দেখেই বলল,
‘ মাই গুডনেস! তোকে তো পরীর মত লাগছে।”
পিউ আলগোছে ওপর ওপর হাসল । এত সুন্দর প্রসংসাও তার মন ভালো করতে পারেনি। মেয়েরা প্রিয় মানুষের মুখের একটু তারিফ শুনলে যে খুশি হয়,পুরো পৃথিবী সেখানে বিফল।

সাদিফ বলল ‘ চল ছবি তুলে দেই। না, আয় আগে সেলফি তুলি।’
পিউ মানা করল না। সাদিফ ফোনের ক্যামেরা উচু করে ধরল। পরপর ক্যাপচার হলো তাদের যূগল ছবি। ধূসর উঠে যাচ্ছিল, কোত্থেকে শান্তা এসে দাঁড়িয়ে গেল সামনে। অত গুলো ছেলেকে এড়িয়ে সরাসরি তাকে বলল,
‘ আপনি কি ভালো ছবি তুলতে পারেন ভাইয়া? আমাকে তুলে দেবেন?”

ধূসর সাদিফের দিক ইশারা করে বলল,
” ক্যামেরা ম্যান ওদিকে। যাও, তুলে দেবে।’

এরপর চলে গেল সে। শান্তা মনস্তাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পাশ থেকে এলাকার ছেলে রাকিব দাঁত কেলিয়ে প্রস্তাব করে,
” আমি তুলে দেই শান্তা?”
শান্তা জ্ব*লে উঠে বলল ‘ আপনাকে বলেছি? নিজের কাজ করুন”
_____

সাদিফ ছবি তুলতে ভালোবাসে। আর সেই ভালোবাসার চক্করে ফেঁসেছে পিউ। এদিক সেদিক টেনে নিচ্ছে ওকে। এখানে বোস,এভাবে তাকা, ওদিক ঘোর,এরকম হাজার খানেক ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে। পিউ মনোযোগ দিয়ে পোজ দিতে পারছে না। তার মাথায় একটা নতুন চিন্তা বাসা বেঁধেছে। চিন্তার নাম শান্তা। কাল থেকে লক্ষ্য করছে মেয়েটা একটু বেশিই ধূসরের ধারেকাছে ঘিঁষছে। মতলব কী ওর? কোনও ভাবে যদি উল্টোপাল্টা ভাবনাচিন্তা করেই থাকে,এক চ*ড়ে সিধে করে দেবে পিউ। টেনে সব চুল ছি*ড়ে ফেলবে। ধূসর ভাইকে নিয়ে নো কম্প্রোমাইজ!
” কী রে! দ্যাখ এদিকে…”
পিউ নড়েচড়ে লেন্সের দিক তাকায়। সাদিফ ক্লিক করে। এর মধ্যে পেছনে এসে দাঁড়াল মৈত্রি। আস্তে করে ডাকল,
” শুনছেন?”
সাদিফ ঘুরে তাকায়। বাঙালী মেয়েদের মত শাড়ি পরা,খোপা করা মেয়েটিকে চিনতে পেরে বলে,
” জি বলুন?”
” আমার ক’টা ছবি তুলে দেবেন?”
সাদিফ কিছু বলার আগেই সামনে থেকে পিউ চটপটে কণ্ঠে বলে দেয়,
” হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। কেন দেবেনা? আমার সাদিফ ভাইয়া দারুন ছবি তোলে।”

সাদিফের বলার কিছু রইল না। মৈত্রি হেসে বলল,
‘ থ্যাংক ইউ। আসলে বিয়ে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত। ফটোগ্রাফার বর্ষার ছবি তুলছে তো,তাই আমি আপনাকে বলছিলাম।’
এবারেও পিউ জবাব দেয়,
‘ আরে কোনও সমস্যা নেই। তাইনা ভাইয়া?’
সাদিফ চোখা চোখে চেয়ে ভ্রুঁ কুঁচকায়। পিউয়ের লাফালাফি টা অহেতুক ঠেকল। মেয়েটাকে দেখেছে আজ সকালে। পরিচিত ও হয়নি। এখন কী না ছবি তুলতে হবে? সে মুখের ওপর মানা করতে পারেনা। পিউ যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেদিকটা দেখিয়ে বলল,
‘ ওখানে গিয়ে দাঁড়ান,ছবি ওদিকটায় ভালো আসে।’

মৈত্রি উচ্ছ্বল পায়ে এগিয়ে যায়। পিউ সুযোগ পেয়ে সরে আসে। স্টেজের দিক না গিয়ে ধূসরকে খুঁজতে থাকে। চিরুনি তল্লাশি করেও পায়না। শেষে সুপ্তিকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
‘ ধূসর ভাইকে দেখেছিস?’
‘ হ্যাঁ, বাড়ির ভেতর গেল তো ‘
পিউ চিন্তায় পরে যায়৷ অনুষ্ঠান রেখে সে ভেতরে গেল কেন? শরীর টরির খারাপ না কী? উদ্ভট ভাবনা মনে নিয়ে শাড়ির কুঁচি আগলে ছুটল সে।

ধূসর আর সাদিফ কে একটা ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে। যেহেতু বিয়ে বাড়ি,সংখ্যাতীত মানুষজন,একেক জন কে একটা রুম দেয়া তো সম্ভব নয়। ওদের কামড়া পরেছে তিন তলায়। পিউ ত্রস্ত সিড়ি বেয়ে উঠল। বাড়িতে আপাতত কেউ নেই। সবাই ওখানে। পিউ একদম গিয়ে কামড়ার সামনে দাঁড়াল। দরজা ভেজানো। পিউ টোকা দিয়ে ডাকল,
” ধূসর ভাই, শুনছেন? ‘
সাড়া এলোনা। সে আবার ডাকল,
‘ শুনছেন? আপনি কি আছেন ভেতরে?’
জবাব এবারেও আসেনা। পিউ দরজা ঠেলে দেয়। ঘরটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার। জানলা বন্ধ,পর্দা ঝুলছে। পিউ দরজা আরেকটু ঠেলতেই একটা হাত শক্ত করে তার হাত ধরল। পিলে চমকে উঠল তার। রীতিমতো হাতটা জোর খাটিয়ে টে*নে তাকে ঢুকিয়ে নিলো ভেতরে। পরপর ঠে*সে ধরল দেয়ালে। দরজা লাগালো শব্দ করে। পিউয়ের গলা শুকিয়ে যায়। সে নিশ্চিত এটা অন্য কেউ। ধূসর জীবনেও এরকম আচরন করেনি,করবেওনা। সমস্ত শরীর ভ*য়ে থরথর করে কেঁ*পে ওঠে। কম্পিত কণ্ঠে শুধায়,
‘ ককে? ককে আপপনি?’

আগন্তুক নিরুত্তর। উলটে ঘেঁষে এলো কাছে। গা থেকে ছুটে এলো কড়া পারফিউমের গন্ধ। উষ্ণ শ্বাস তে*ড়ে এসে পরল মুখমন্ডলে। পিউ বিভ্রান্ত হয়ে পরল। অবয়ব ছাড়া কিচ্ছু বুঝতে না পেরে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলো। চেনা সুবাসে অপরিচিত আচরন ভ্রান্ত করল মস্তক। সে চটজলদি ফোনের সাইড বাটন চেপে আলো ধরতে গেলেই ওই হাতটাও আটকে দিল আগন্তুক। পিউ এবার নেতিয়ে গেল শ*ঙ্কায় । এ কিছুতেই ধূসর হবেনা। কোনও বখাটের পাল্লায় পরেছে নির্ঘাত। গলা ফাঁ*টিয়ে চিৎকার করবে ভাবল,এর আগেই সুইচ টেপার আওয়াজ হয়। কক্ষে জ্বলে ওঠে চকচকে আলো। সেই আলোয় স্পষ্ট হয় ধূসর। পিউ কিংকর্তব্যবিমুঢ়, হতবিহ্বল। ঠোঁট ফাঁকা করে বলে,
” আপনি?”
ধূসর নিশ্চুপ। সে চেয়ে আছে। ক্লান্তিহীন, অমত্ত চোখে।
হাত দুটো ছেড়ে দেয় পিউয়ের। পকেটে গোঁজে। সেকেন্ডের মাথায় কিছু একটা বেরিয়ে আসে। প্যাকেট ছি*ড়ে পিউয়ের চোখের সামনে উন্মুক্ত হয় দু মুঠো নীল কাচের চুড়ি। পিউ স্তব্ধ,বিস্মিত। ধূসর তার বিস্ময়ের তোয়াক্কা করল না। মুখ ফুঁটে একটা কথাও বলল না। চুপচাপ ওর হাত তুলে উঁচুতে ধরল। মুঠো ভর্তি চুড়ি পাঁচ আঙুলে ভরে কব্জিতে রাখল। তারপর একটা একটা করে কব্জি বেয়ে নামাল। পুরোটা সময় পিউ হতবাক চেয়ে। অথচ ধূসর ভ্রুঁক্ষেপহীন,নিরুপদ্রব৷
পিউয়ের ফর্সা খালি দুটো হাত, নিমিষেই চুড়িগুলো দখল করে। ধূসর তার হস্তদ্বয় মুঠোয় তুলে উল্টেপাল্টে বলল,
‘ এবার ঠিক আছে।’

‘ আপনি এগুলো আমার জন্যে কিনেছেন ধূসর ভাই?’
পিউয়ের অবিশ্বাস্য কণ্ঠ৷ ধূসর বলল,
” না। রাস্তায় পরে ছিল। ভাবলাম ফেলে দেব? তাই নিয়ে এসছি।’

পিউ চোখ নামিয়ে মুচকি হাসল। জানাল,
” আমার খুব পছন্দ হয়েছে!”
বলতে বলতে তাকাতেই দেখল ধূসর তার আপাদমস্তক দেখছে। দৃষ্টিতে মুগ্ধতা। শাড়ি পরা পিউকে প্রথম দেখল কী না! এক পর্যায়ে ভ্রুঁ কোঁচকায় সে। জিজ্ঞেস করে,
‘ কুঁচির এই হাল কেন?’
ধূসরের চোখ অনুসরন করে তাকাল পিউ। আগের মতোই কুঁচি সরে গেছে দুদিকে। ঠোঁট উলটে ভীষণ দুঃ*খ নিয়ে বলল,
‘ একা একা পরেছি না,তাই।’
ধূসর তাকায়। শ্বাস ঝাড়ে। হুট করে হাটুমুড়ে বসে যায়। আশ্চর্য হয় পিউ। পাথর বনে দাঁড়িয়ে রয়। ধূসর একটা একটা করে কুঁচি ধরে ঠিকঠাক করে দিচ্ছে। পিউ বাকরুদ্ধ। জ্বিভে শব্দ নেই,মুখে কথা নেই। কাজ শেষে ধূসর সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পিউ প্রবল বিস্ময়ে চেয়ে থাকে তার তামাটে চেহারায়। ধূসর তার মাথার একপাশের দেয়ালে হাত রাখে। কিছু বলতে চায়,এর আগেই বাইরে থেকে পুষ্পর গলার স্বর ভেসে এলো। উঁচু কণ্ঠে নাম ধরে ডাকছে সে। পিউ ভ*য় পেল। চোখ বড় করে বলল,
‘ আপু আসছে।’
‘ সমস্যা নেই।’
‘ আছে। এভাবে দেখলে কী না কী ভাববে!’
‘ কী ভাববে?’
পিউ চুপ করে যায়। কী ভাববে তা কি মুখ ফুটে বলা যায়? লজ্জ্বা লাগবে না?
পুষ্প ডেকে ডেকে হয়রান। পিউয়ের সাড়া নেই।
আচমকা ধূসরই চিল্লিয়ে জানাল,
” এদিকে পুষ্প।”
পিউয়ের মুখ আ*তঙ্কে ছোট হয়ে এলো। চকিতে চেয়ে বলল, ‘ ডাকলেন কেন?’
ধূসর জবাব দেয়না। ডাক শুনে পুষ্প ঘরে ঢুকে পরে। দেয়ালে লেপ্টে থাকা পিউ আর কাছাকাছি ধূসরকে দেখে থতমত খেয়ে চোখ ফেরাল। পিউ মুচড়ে উঠলেও ধূসর সরলোনা। একটু দূরত্ব অবধি বাড়াল না। সে নিরুদ্বেগ। পুষ্প ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
” তোকে আম্মু ডাকছেন, আয়। ”
বলে দিয়েই বেরিয়ে গেল। ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক। পিউয়ের কপালে ভাঁজ পরে। ধূসর এতক্ষনে সরে দাঁড়ায়৷ চোখ ইশারা করে বলে,
‘যা।’
পিউ হাঁটা ধরল। এক পা বাড়াতে গেলেই ধূসর পেছন থেকে শাড়ির আঁচল টেনে ধরল। চমকে, থমকে গেল সে। দুরুদুরু বুকে ঘাঁড় ঘুরে তাকাল। ধূসর উদ্বেগহীন,শান্ত কণ্ঠে বলল,
” শাড়ি পরেছিস ভালো কথা, সামলে রাখার দায়িত্বটাও তোর। আমি যেন না দেখি, শরীরের অযাচিত কোনও অংশ বেরিয়েছে। ”

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে