এক সমুদ্র প্রেম পর্ব-১২+১৩

0
1581

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১২)

ইকবাল, গাড়ির দরজা খুলে রেখেছে আগেই। ধূসর,পিউকে কোলে নিয়ে এসে বসাল সিটে। পা দুটো ঝুলিয়ে রাখল বাইরের দিক। র*ক্ত পরা তখনও থামেনি। অথচ পিউ কা*ন্নাকা*টি করছেনা। সে ফ্যালফ্যাল করে এখনও তাকিয়ে। ধূসর পিউকে বসিয়ে নিজেও ফের হাটুভে*ঙে ওর সামনে বসে। ইকবালের বাড়িয়ে দেয়া ফার্স্ট এইডের বাক্স থেকে তুলো নিয়ে স্যাভলনে ভেজায়৷ পরপর পিউয়ের পায়ে চে*পে ধরতেই সম্বিৎ ফিরল তার। ব্যা*থায় কঁ*কিয়ে উঠেই ধূসরের কাঁধের শার্ট খাম*ছে ধরল। ধূসর চোখ তুলে তাকায়। পিউ নেত্র খিঁ*চে ঠোঁট কাম*ড়ে ধরেছে। ধূসর মায়া মায়া কণ্ঠে শুধাল,
” কষ্ট হচ্ছে?”
পিউ চট করে চোখ খোলে। তার ভালোবাসার ধূসর ভাইয়ের সাথে চোখাচোখি হয়। নিমিষে য*ন্ত্রনা ভুলে মাথা নেড়ে উত্তর দেয়,
” উহু।”
ইকবাল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মাথা নামিয়ে ঠোঁট চে*পে হাসল। পুষ্পর চোখে ঠিক ধরা পরল তা। দাঁড়িয়ে ছিল ওর পাশেই। তার বোন ব্যা*থায় কা*তরাচ্ছে,আর এই লোক হাসছে? পুষ্প নাক ফুলিয়ে দুম করে কনুই দিয়ে গুঁ*তো দিল ইকবালের পেটে৷ মু*চড়ে, দুলে উঠল সে। সহায়হীন ভঙিতে তাকাল পুষ্পর পানে। মেয়েটা চোখ রা*ঙিয়ে নিশব্দে হাসতে মানা করছে। ওতো আর জানেনা,হাসার কারন কী! জানলে নিজেও হেসে গড়াগড়ি খেত কনফার্ম।

পিউ যে মিথ্যে বলেছে ধূসরের বুঝতে বাকী নেই। এতটা গাঢ় কাট*লে ব্যা*থা হয়না? অথচ বলল না কিছু। ঝুঁকে ফু দিল ক্ষতস্থানে। পিউ আবেশে পল্লব বুজে নেয়৷ ধূসর ভাইয়ের এতটা যত্ন তার পাওনা ছিল বুঝি? এরকম জানলে পিউ স্বেচ্ছায় লক্ষবার হাত পা কে*টে কে*টে সামনে যেত তার। সেই ছুঁতোয় একটু ভালোবাসা পেত,কাছাকাছি হতো।

সব শেষে পায়ে ব্যান্ডেজ বাধল ধূসর। বুড়ো আঙুল বাদে বাকী চারটা আঙুলই কে*টেছে। উঠে দাঁড়িয়ে পিউয়ের পা আস্তেধীরে গাড়ির ভেতরে ঢোকাল। ইকবাল কে বলল
” তুই ড্রাইভ কর।”
ইকবাল বিনাবাক্যে মাথা দোলায়। পিউ বোঝেনি কথাটার অর্থ। ভেবেছে ইকবালকে গাড়ি চালাতে বলার কারন হয়ত এতটা পথ চালিয়ে ধূসর ভাইয়ের ইচ্ছে করছেনা আর। ধূসর পুষ্পকে বলল,
” সামনে বোস।”
পুষ্প ঘাড় কাত করে। পিউয়ের কপালে ভাঁজ পরল। তক্ষুনি ধূসর ঘুরে এসে বসে গেল ওর পাশের জায়গায়। শুধু বসেইনি, তার দুটো পা-ই তুলে নিয়েছে উরুর ওপর। পরপর ঘটনায় অত্যাশ্চর্য হয়ে গেল পিউ। অপ্রত্যাশিত বিষয় গুলো মস্তিষ্ক তৎক্ষনাৎ গ্রহন করতে পারল না। বাক্য খুইয়ে বসে রইল।

ধূসরের গায়ে এভাবে পা দিয়ে বসায় পিউয়ের অস্বস্তি তরতর করে বাড়ল। খা*রাপ লাগছিল। একটু নড়েচড়ে নীচু কণ্ঠে বলল,
” ধূসর ভাই,পা নিচে রাখলে সমস্যা হবেনা।”
ধূসর জলদগম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দেয়,
” চুপচাপ বসে থাক।”
পিউ ঠোঁট উলটে বসে থাকে। ইকবাল গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবে হঠাৎই চেঁচি*য়ে বলল
” ভাইয়া আমার আইসক্রিম?”
তিন জোড়া অদ্ভূত দৃষ্টি আছ*ড়ে পরল তার ওপর। পিউ অপ্রতিভ হয়ে বলল,
” এভাবে তাকাচ্ছো কেন ?”
পুষ্প ভ্রুঁ কপালে তুলে বলল,
” তুই এত কিছুর মধ্যেও আইসক্রিমের কথা ভুললি না? তোর না পায়ে ব্যা*থা?”

পিউ মিনমিন করে বলল,
” ব্যাথা তো পা*য়ে। আইসক্রিম তো মুখ দিয়ে খাব,পায়ের সাথে সম্পর্ক কী?”
পুষ্প কপাল চাপ*ড়ে বলল,
” দেখলেন ধূসর ভাই, দেখলেন! কেঁ*দেকে*টে নদী বওয়ানো মেয়ে খাওয়ার কথা ঠিক মনে রেখেছে। ও জাতে মাতাল তালে ঠিক। শুধুশুধু তোর জন্যে আমিও চোখের জল ওয়েস্ট করলাম।”

ইকবাল টান ধরে বলল ” এভাবে বলছো কেন? বেচারির আইসক্রিমটা ছুটতে গিয়ে আমিই রাস্তায় ফেলে দিয়েছি। তুমি বসো পিউ, আমি আরেকটা এনে দিচ্ছি।”

পিউ খুশি হয়ে মাথা নাড়ল। ইকবাল বের হতে ধরলে ধূসর বাঁ*ধা দিয়ে বলল,
” দরকার নেই। গাড়ি স্টার্ট কর।”
” পিউপিউ-য়ের আইসক্রিম?”
” পরে দেখা যাবে।
” কিন্তু…”
” উই আর ল্যেট ইকবাল,সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে হবে। গাড়ি ছাড়।”
ইকবাল দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগল। কী করবে, কী করা উচিত! একটু সাহারা পেতে পুষ্পর দিক তাকাল। পুষ্প নিরুত্তাপ বসে। ধূসরের মুখের ওপর কথা বলা সম্ভব না। এখানে তার করার কিছু নেই।
ইকবাল পেছন ফিরে পিউয়ের দিক তাকায়। তার চেহারার সর্বত্র কৃষ্ণবর্ন কাদম্বিনী ছুটছে। আ*হত চোখে ধূসরের নি*রেট চিবুকের পানে চেয়ে সে। ধূসর ভ্রুক্ষেপহীন। একবার দেখল অবধি না। এর মধ্যেই তাড়া দিল,
” শুনিসনি কী বললাম?”
” হ্যাঁ যাচ্ছি।”
ইকবাল হতা*শ শ্বাস ফেলে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে। পিউ মূর্তির ন্যায় বসে রয়। অভিমানে তার বুক ভা*রি হয়ে আসছে। একটা আইসক্রিম খেতে চাইল,আর ধূসর ভাই এমন করলেন? জীবনে আর আইসক্রিম ছোঁবেনা বলে পণ করল পিউ। এইভাবে মুখের ওপর প্রত্যা*খান?

_______

ইকবালের গাড়ি তাদের বাড়ির আঙিনায় ভিড়ল। বৃদ্ধ দারোয়ান উঠে গেট খুললেন। ধূসর নেমে এসে পিউয়ের পাশের দরজা টেনে খুলল। ওমনি দৃশ্যমান হলো তার পায়ের সাদা ব্যান্ডেজখানা। চোখ বেরিয়ে আসে দারোয়ানের। হা*হাকার করে বলে ওঠেন,
” এ কী সর্বনা*শ! পিউ মায়ের কী হলো?”
ইকবাল ছোট করে জবাব দিল,
” এক্সিডে*ন্ট….. ”
বাকীটুকু শোনার মত ধৈর্য হলোনা তার। মাথায় হাত দিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটলেন সদর দরজার দিকে। পুষ্প ঢোক গি*লে বলল,
” আজ আমি বঁ*কা খাব শিওর।”
” কেন? ”
” এই যে, পিউয়ের পা কা*টল,আম্মু আমাকেই বঁক*বেন। বলবেন তুই কোথায় ছিলিস দেখে রাখতে পারিসনি ওকে? বড় হওয়ার অনেক ঝামে*লা ইকবাল ভাই। ও আপনি বুঝবেন না।”

ইকবাল ফোস করে শ্বাস ফেলে বিজ্ঞের মত মাথা দোলায়। বুঝেছে সে। পিউ গাঁট হয়ে বসে। ধূসর ঝুঁকে কোলে নিতে গেলেই আরো শ*ক্ত হয়ে গেল। ধূসর কপাল কোঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছে?”
পিউ রা*গে ভেতর ভেতর ফুঁ*সে থাকলেও ঠান্ডাস্বরে বলল,
” আমি একাই যেতে পারব।”
ধূসর ভ্রঁ বাঁকাল,
” শিওর?”
” হ্যাঁ।”
পুষ্প বলল,
” কীভাবে পারবি? হাঁটবি কী করে?”
পিউ মুখ গোমড়া করে জানাল,
” বললাম তো পারব। আমার কারোর সাহায্যের প্রয়োজন নেই।”

ধূসরের কিছু এলো গেলনা। সে কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
” ওকে।”
পরপর সরে গেল দরজা থেকে। পিউয়ের মুখটা আরো থমথমে হয়ে আসে। ক*ষ্টে কোটর ভরে। সে তো তখনকার রা*গটা ঝাড়ার জন্যে এরকম বলল। তাই বলে ধূসর ভাই ও মেনে নিলেন? এই তার যত্ন-আত্তি? পিউয়ের ঠোঁট ভে*ঙে আসে। নাক লাল হয়। তবু দৃ*ঢ় করল নিজেকে। দরকার নেই কারো সাহায্যের। কী হবে একা হাঁটলে, একটু ব্যা*থা লাগবে? লাগুক। পাষ*ন্ড ধূসর ভাইয়ের দ্বারস্ত হবেনা তাও।
পিউ এক আকাশ অভিমান নিয়ে পা দুটো মাটিতে ছোঁয়াতে গেল,ওমনি কোলে তুলে নিল ধূসর। পিউ চমকে গেল। ফিক করে হেসে উঠল পুষ্প। তাল মিলিয়ে ইকবাল ও হাসে। ধূসর হাঁটা ধরল বাড়ির দিকে। পিউয়ের ভেতরটা আনন্দে নেচে-কুঁদে উঠলেও ওপর ওপর রা*গ দেখিয়ে বলল,
” কেন নিলেন,আমি একাই পারতাম”

” তোর দৌড় আমার জানা আছে।”
সোজাসাপটা জবাবটায় পিউয়ের চো*টপাট অস্তগত। তক্ষনি ওদিক থেকে ছুটতে ছুটতে বের হলেন বাড়ির গৃহীনিরা। সাথে দারোয়ান। মিনা বেগম কেঁ*দে ফেলেছেন এর মধ্যেই। ধূসরের কোলে পিউকে দেখে তার কা*ন্না আরো জোড়াল হলো। নাকে কেঁ*দে কিছু বলার আগেই ধূসর সতর্ক করল,
” এখানে নয় বড় মা,ভেতরেই যাচ্ছি। এসো।”

***
” ভেতরে যাবেনা?”
ইকবাল একটু ভেবে বলল ” যাওয়া কি ঠিক হবে?”
” আব্বু তো নেই, অফিসে। ফিরবে সেই রাতে,তাহলে সমস্যা কোথায়?।”
” গেলে খুশি হবে? ”
পুষ্প মিষ্টি হেসে বলল, ” নিঃসন্দেহে! তোমাকে চোখের সামনে আরো দু দন্ড দেখব এতে খুশি না হয়ে উপায় আছে?”

ইকবাল বুকে হাত দিয়ে বলল, ” হায়! কোথায় রাখব এত ভালোবাসা? ”
পুষ্প এক পাশে মুখ বাঁকাল।
” ঢং থেকে আর বাঁচিনা।”
ইকবাল ফের হাসে। বলে,
” না, আসলে হয়েছে কী,সন্ধ্যের পর সমাবেশ আছে। এন্ড আমার ওখানে থাকাটা জরুরি। দেখবে ধূসরও একটু পর বেরিয়ে যাবে।”

পুষ্প ঠোঁট গোল করে বলল,
” ও আচ্ছা। তবুও একটু বসে যেতে…”
ইকবাল চারপাশে একবার চোখ বোলাল। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
” আমি যে একেবারে জামাই হয়ে ঢুকতে চাইছি ম্যাডাম। সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে হলে এখন কী ঢোকা উচিত হবে? ”

পুষ্প লজ্জ্বা পায়। মাথা নুইইয়ে লাজুক হাসে। ইকবাল ফিসফিস করে বলে,
” আসছি।”
পুষ্পও পালটা ফিসফিসিয়ে জবাব দিল,
” বাই। ”
ইকবাল যেতে যেতে ফিরে তাকাল। ফের একবার বাড়ির চারদিক দেখে নিল। কেউ নেই বুঝেই, হাত দিয়ে পুষ্পর দিকে ফ্লায়িং কিস ছু*ড়ে দিল। গাল দুটো র*ক্তাভ হয়ে এলো পুষ্পর। ভীষণ রকম কুন্ঠায় তলিয়ে গেল। ইকবাল গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর গুটিগুটি পায়ে ঢুকল বাড়িতে।

*****
মিনা বেগম একটু পর পর নাক টানছেন। রুবায়দা বেগম এই শীতেও বাতাস করছেন পিউকে। কখনও হাত বোলাচ্ছেন মাথায়। হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জবা বেগম। সুমনা বেগম বাড়িতে নেই। রিক্ত আর রাদিফকে নিয়ে রোজ পাশের স্কুল মাঠে যান তিনি। আশেপাশের ছেলেরা এই সময় খেলতে আসে ওখানে। ছেলে দুটোকে একটু খেলাধুলা শেখান। আজও গিয়েছেন। বাকী সবাই ঘিরে বসে পিউকে।

পুষ্প হাজির হতে না হতেই মিনা বেগমের কা*ন্না থেমে গেল। চোখ পাঁকি*য়ে রে*গেমেগে বললেন,
” মেয়েটা এভাবে গাড়ির ত*লায় পরল, তুই কোথায় ছিলি তখন?”
পুষ্পর ভ*গ্নহৃদয় নিঙরে শ্বাস বের হয়। আগেই জানত,দোষ তারই হবে। পিউ আস্তে করে বলল,
” আপুর কোনও দোষ নেই মা। আমিই..”
” তুই চুপ থাক। ইশ কতখানি কে*টেছে,কত ব্যা*থাই না পাচ্ছে আমার মেয়েটা! ”

জবা বেগম শুধালেন, ” ও পিউ তোকে একটু নুডুলস রেধে দেব? শরবত তো খেলিনা। ”
” খাবেনা মানে? ওকে জোর করে খাওয়া তে হবে। কত র*ক্ত পরেছে! বেদানার রস খেলে গায়ে র*ক্ত হয়। দে আমার কাছে গ্লাসটা দে। ”
পিউ অতীষ্ঠ হয়ে বলল
” মা আমি খাব না।”
মিনা বেগম চোখ গর*ম করলেন ” চুপপ!”

অনীহা সমেত চুমুক বসাল পিউ। গ্লাস ধরে রেখেছেন মিনা বেগম। পিউকে খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন,
” যত জ্বা*লা হয়েছে আমার! এত বড় মেয়ে ছোট বোনটাকে অবধি দেখে রাখতে পারেনা। বলি আমি ম*রে গেলে কী করবি তোরা? তোর ভরসায় যে একটু মেয়েটাকে রেখে যাব তাও তো হবেনা।”
পুষ্প কাঁ*দোকাঁ*দো হয়ে বলল,
” মা আমি কী করলাম?”
মিনা বেগম হা করলেন উত্তর দেবেন বলে, এর আগেই ধূসর দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
” বড় মা,পুষ্পকে অকারনে ব*কাঝকা করছো। এখানে সব দোষ তোমার ছোট মেয়ের৷ কুকুর দেখে ছুটলে কুকর ও পেছনে ছুটবে স্বাভাবিক। বহুবার এনিয়ে সাবধান করার পরেও শোনেনা কেন?”

পিউকে একেবারে ওর কামড়ায় দিয়ে ধূসর রুমে গেছিল। হাজির হলো এই এখনি। পিউয়ের চেহারা চোর ধরা পরার মতন হলো।
পুষ্প দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
” বলে লাভ নেই ভাইয়া। বিচার যা হোক তালগাছটা আমার। আম্মুর বেলাতেও তাই, ঘটনা যাই ঘটুক অপরা*ধী আমি।”

” হয়েছে হয়েছে,এত কথা বলার কিছু হয়নি। এখন যাও,হাত মুখ ধুয়ে এসে আমায় উদ্ধার করো।”
রুবায়দা বেগম ও বললেন,
” যা মা যা। অনেকটা ধ*কল গেছে তাইনা? জামাকাপড় ছেড়ে হাতমুখ ধোঁ গিয়ে। আমি নাস্তা দিচ্ছি….”
পুষ্প আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
” এই বাড়িতে তুমিই আমায় ভালোবাসো মেজ মা। আর কেউ বাসেনা৷ তুমি যে কেন আমার মা হলেনা আল্লাহ। ভাইয়া কত ভাগ্যবান তোমাকে মা হিসেবে পেয়ে । এই ভাগ্য আমার হলে কী হতো!”
আফসোস করে করে পুষ্প বেরিয়ে গেল।
মেয়ের অভিযোগে চোখ ছলছল করে উঠল মিনা বেগমের । একটু আগের মতই কেঁ*দে বললেন,
” দেখলি মেজো, দেখলি? কী একটু বলেছি সেজন্যে এভাবে বলে গেল!’
রুবায়দা বেগম অসহায় চোখে তাকালেন। বললেন,
” থাক আপা,তুমি মনে কিছু নিওনা। বাচ্চা মেয়ে।”
মিনা বেগম শুনলেন না। আঁচলে নাক চা*পলেন। জবা বেগম পাশে বসে বললেন,
” আপা,বাচ্চামানুষ কী বলতে কী বলেছে,ওসব ধরে কাঁদছো?”

পিউ অনুরক্তিহীন শ্বাস ফেলল। তার মা একটু বেশিই সেন্টিমেন্টাল। কথায় কথায় চোখ থেকে পানি ঝরে । এ দেখতে দেখতে অভ্যেস হয়ে গেছে। সে চোখ ফিরিয়ে দরজার দিক তাকাল,যেখানে ধূসর দাঁড়িয়ে। সে তাকাতেই চটপট আরেকদিক তাকাল ধূসর। পিউয়ের দৃষ্টি সতর্ক হয়। প্রতিবারের মত এবারেও মনে হলো ধূসর এতক্ষন তাকেই দেখছিল।

” তোমাদের কা*ন্নাকা*টি থামলে একটা কথা বলতাম।”
ধূসরের ভারী স্বরে মিনা বেগম সহ বাকীরা তাকালেন।
ধূসর ঘোষণা করল,
” আমি বের হচ্ছি,ফিরতে রাত হবে। কেউ অপেক্ষা কোরোনা।”
” কোথায় যাচ্ছিস বাবা?”
” কাজ আছে মা । শেষ করে একেবারে ফিরব।”
” কিছু খাবিনা?”
” না।”
ধূসর যেতে ধরবে আচমকা পিউ উদ্বেগ নিয়ে বলল,
” ধূসর ভাই,ধূসর ভাই,একটা কথা….”
ধূসর থেমে যায়। প্রশ্ন করে,
” কী?”
পিউ রয়েসয়ে বলল,
” মারিয়া পে__ ইয়ে মারিয়া ম্যাম কে আসতে মানা করে দিন না আজ। আমার তো পায়ে ব্যা*থা পড়তে পারব না।”
ধূসর চোখা চোখে চেয়ে বলল,
” কেন? গাড়িতে না বলেছিলি,খাবি মুখ দিয়ে পায়ের সাথে সম্পর্ক নেই। এখনও নিশ্চয়ই পা দিয়ে পড়বিনা!”.
নিজের কথার জালে পিউ নিজেই ফেঁ*সে গেল। কথা খুঁজল। দুঃ*খী মুখ করে বলল,
” এরকম বলছেন কেন? পথে আসতে আসতে পা ব্যা*থাটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পরেছে। এখন ব্রেইনেও আ*ঘাত করছে। এ অবস্থায় কী পড়া যায়? ও মেজো মা,তুমিই বলো না, যায়?’
রুবায়দা বেগম বললেন,
” সেইতো সেইতো। ও ধূসর আজ বরং থাক। তুই মারিয়াকে ফোন করে বলে দে না বাবা।”

ধূসর ক*ঠিন কণ্ঠে বলল ” না। এ মাসের শেষে ওর টেস্ট পরীক্ষা মা। এভাবে পড়াশুনায় গ্যাপ পরলে রেজাল্ট দেখতে হবেনা!”
পিউ ঠোঁট উলটে বলল,
” একটা দিনইতো! প্লিজ।

ধূসর শ*ক্ত চাউনীতে মুখের দিকে তাকাল। পিউ গায়ের কম্বলটা উচু করে নাক পর্যন্ত ঢেকে ফেলল তাতে। পাছে ধরা না পরে ! ধূসর কিছু একটা ভেবে বলল ” ঠিক আছে।”
পিউয়ের ওষ্ঠ ছড়িয়ে আসে। ধূসর যেতে যেতে আরেকবার তার পানে দৃষ্টি আনে। পিউ তাকাতেই শ্বাস ফেলল সে। যেন ধাতস্থ করল নিজেকে। লম্বা পায়ে ঘর ছাড়ল এরপর। পিউ মনে মনে ভাবল,
” আজকে পেত্নীটার পড়তে আসা থামিয়েছি। ঠিক এইভাবে একদিন ওটাকেও ভা*গিয়ে দেব হুহ।”
____

রাত প্রায় দুটো বাজে। পিউ ঘুমে তলিয়ে। টানটান করে পা রাখা বিছানায়। পাশে পুষ্প ঘুমিয়েছে আজ। মেয়েটা হাটতে পারেনা, কিছু দরকার পরলে? সেই চিন্তায়। পিউয়ের ঘুম গভীর। অথচ মনে হলো তাদের চা*পানো দরজাটা ঠেলে কেউ মাত্রই ঢুকেছে । পিউ জেগে যায়। চোখ না খুলে ঘাপটি মেরে শুয়ে রয়। আগন্তুক নিঃশব্দে ঢুকছে। হাঁটাতেও আওয়াজ নেই। পিউয়ের ভ*য় হয়। কে ঢুকলো ঘরে? কথা বলতে চাইলে কণ্ঠরোধ হয়, বাক্য ফোঁটে না। আগত আগন্তুক তার দিকে ঝুঁকে যায় হঠাৎ। উষ্ণ শ্বাস ঠিকরে পরে চেহারায়৷ পিউয়ের শরীর থরথরিয়ে কাঁ*পুনি ছাড়ে। নিভু নিভু করে চোখ খোলে। ভ*য়ে বিব*শ হতে হতেও থমকায়। লম্বা শ্বাস টে*নে অনিশ্চিত কণ্ঠে বলে,” ধূসর ভাই?”
ধূসরের ভ্রুঁ বেঁকে এলো। অবাক কণ্ঠে বলল,
” কী করে বুঝলি?”
পিউয়ের সব সন্দেহ বিশ্বাসে পরিনতি পেলো এবার। এতরাতে ধূসর তার কামড়ায় ভাবতেই দৃঢ়ীভূত হলো। ” আপনি সত্যিই এসেছেন?”
ধূসর উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল,
” কীভাবে চিনেছিস?”
পিউয়ের সরল স্বীকারোক্তি,
” চিনব না? আপনার গায়ের গন্ধ যে আমার ভীষণ পরিচিত। ”

অন্ধকারে ধূসরের অভিব্যক্তি বোঝা গেলনা। পিউ আলগোছে একবার ঘুমন্ত পুষ্পকে দেখে নেয়। তারপর মিহি কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
” এতরাতে আপনি এখানে?”
“বলছি,ওঠ।”
পিউ বিনাশর্তে মেনে নিল আদেশ। আস্তেধীরে উঠে বসল।
ধূসর ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালায়। বালিশের গা ঘেঁষে রাখে। যাতে পুষ্পর কাছে আলো না পৌঁছায়। পিউ কৌতুহল সমেত দেখছে সব। তখনও খেয়াল করেনি ধূসরের পিঠের সঙ্গে লুকোনো হাতটাকে। ধূসর সোজা হয়ে দাঁড়াল। পিউ চোখ পিটপিট করল। ফ্ল্যাশলাইট এমন ভাবে সেট করেছে ধূসর,কারোর মুখই স্পষ্ট নয়। আচমকা পেছনের হাতটা এনে সামনে ধরল সে। পিউ সেদিকে তাকাতেই হো*চট খেল। হাত ভর্তি আইসক্রিম দেখে বিস্ময়াবহ হয়ে বলল ” এসব কী?”
” ফেরার পথে এনেছি। এত রাতে মাত্র একটা দোকান খোলা ছিল। আনতে আনতে গলে গেছে। ধর।”
পিউ অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল ‘ এগুলো আমার জন্যে?”
” হু। অসুস্থ মানুষের ইচ্ছে অপূর্ন রাখতে নেই। বাচ্চাদের তো আরোই না।”
পিউ বাকরহিত। খুশিতে কথা বলতে ভুলে গেল। ধুসর এসে পাশে বসলো তার। কোণ আইসক্রিমের প্যাকেট খুলে মুখের সামনে ধরে বলল,
” নে। ”
পিউ তাতে মুখ ডোবায় ওর দিকে চেয়ে চেয়ে। ঠোঁটের কোনায় অল্প একটু লেগে যায়। ধূসর বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মুছে দেয় তা৷ পিউ কা*তর কণ্ঠে শুধায়,
” আপনি আমার জন্যে আইসক্রিম কেন এনেছেন ধূসর ভাই? সত্যি করে বলুন না।”
ধূসর চমৎকার হাসল। ঝুঁকে এসে সুস্থির কন্ঠে বলল,
” কারন,
পিউ উদগ্রীব হয়ে বলল ” কারন?”
” কারন…. আমি তোকে…
” আপনি.. আমাকে… বলুন না ধূসর ভাই আপনি আমাকে…?
” আমি তোকে ভা…..”

” পিউ তুই উঠবি? না কী পানি ঢালব গায়ে?”
ক*র্কশ আওয়াজে পিউয়ের ঘুম ছুটে গেল। ধড়ফড় করে চোখ মেলল। হকচকিয়ে কক্ষের চারপাশ দেখল। তার মানে এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিল? ভাবতেই পিউয়ের মুখ কালো হয়ে আসে। এত সুন্দর একটা দৃশ্য,এতটা জীবন্ত,স্বপ্ন ছিল সব? ধূসর ভাই আসেনইনি রুমে। আইসক্রিম আনা তো দূরের কথা। সে ধোঁ*কা খেয়েছে? পিউ বিছানা থেকে নামল। পা ব্যা*থা কমেছে । রাতে আমজাদ সিকদার বাড়ি ফিরেই ফার্স্টক্লাস ডাক্তার ডেকেছেন। এমন ওষুধ দিয়েছেন সে ব্যা*থা গায়েব এক রাতে। কিন্তু পিউয়ের বুকের ব্যা*থা ওসবের কাছে কিচ্ছু না। দেখল তো দেখল এমন একখানা স্বপ্ন, যা জীবনে সত্যি হওয়ার সুযোগ নেই। ধূসর ভাইয়ের মত লোক কী না রাত বিরেতে আইসক্রিম আনবেন? তাও ওর জন্যে ?

পিউ ব্যা*থিত মন নিয়ে ওয়াসরুমে যেতে নেয়৷ এর মধ্যেই হাতে খুন্তি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন মিনা বেগম। মেয়েকে উঠতে দেখে বললেন,
” যাক! বেঁচে গেলি!”
পিউ দুদিকে মাথা নেড়ে বাথরুমে ঢোকে। ব্রাশ করতে কর‍তে আয়নায় তাকায়। কিছু একটা ভেবেই, হঠাৎ সচকিত হয়। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়? সিনেমায় শুনেছিল তো। তাহলে কী এটাও সত্যি হবে?

______

পিউ কলেজে গেল। এ মাসের শেষে পরীক্ষা বলে পড়াশুনায় টালবাহানা চলবেনা। মন দিয়ে ক্লাস করল। আজ আর ধূসরের নাম লিখে খাতা ভরেনি। ছুটি শেষে বের হলো কেবল। বাড়ি থেকে গাড়ি আসেনি এখনও। তার পাশ ঘেঁষে কলেজের কতক মেয়েরা ছুটে ছুটে যাচ্ছে। ভিড় করছে ফুচকা,চটপটি আইসক্রিমের ভ্যানের সামনে। আইসক্রিম দেখেই পিউয়ের গতকালের কথা মনে পড়ল। তার মান ইজ্জ্বত রফাদফা হলো এটার জন্যে। মুখের ওপর ধূসর বলে দিল আইসক্রিম না দিতে। পিউ মুখ ফিরিয়ে নেয়। শপথ যখন নিয়েছে খাবেনা, তখন চেয়েও দেখবেনা ওদিকে।

সে গেট পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। গাড়ি এসে এখানেই থামবে। আচমকা একটা বাইক এসে দাঁড়াল তার পায়ের কাছে। ঘটনাচক্রে ভ*ড়কে গেল পিউ। ভ*য় পেয়েছে। সবে সবেই একটা দূর্ঘ*টনার স্বীকার হয়েছে বলেই। আরোহিকে রে*গে কিছু বলতে গেলেই চোখ পরল বাইকের দিকে। পরিচিত লাগছে। এরকম একটা বাইক ধূসর ভাইয়ের আছেনা? পরপর উদ্বেগ নিয়ে চালকের মুখের দিকে তাকাল পিউ। ধূসর হেলমেট খুলল তখনি। পিউ বিস্মিত হলো ওকে এখানে দেখে। হা করার আগেই ধূসর ব্যাক সিট ইশারা করে বলল,
” ওঠ।”
পিউ শুনেও, শুনতে পায়নি এমন ভাবে তাকাল। ধূসর ভাই ওনার বাইকে উঠতে বলছেন? ওনার গাড়ি,বাইকে এসবে তো কারো স্পর্শ ও নিষিদ্ধ। সে অনিশ্চিত হয়ে তাকিয়ে থাকল। ধূসর ভ্ররু কুঁচকে বলল,
” কান খাটো? শুনিসনি কী বললাম?”
” আসলেই শুনিনি। আপনি কী বাইকে উঠতে বললেন ধূসর ভাই?”
ধূসর চোখ ছোট করতেই পিউ ঢোক গিলে বলল,
” না মানে আপনি তো কাউকে….”
পথিমধ্যেই ধূসর গুরুভার কণ্ঠে বলল,
” মুখ বন্ধ৷ ওঠ।”
এবারে পিউয়ের মাথায় ঢুকল। বুঝল,যা শুনেছে ঠিক শুনেছে। ধূসর সত্যিই বসতে বলল তাকে। ধূসর ব্যাক সিট থেকে হেলমেট নিয়ে এগিয়ে দেয়। পিউয়ের আনন্দে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কত ইচ্ছে ছিল ধূসরের সঙ্গে এক গাড়িতে চড়বে,বা রিক্সায়,অথবা কিছু একটায়। এই এতদিনে সৃষ্টিকর্তা মুখ তুলে চাইলেন। পিউ সহস্র শুকরিয়া আদায় করল মনে মনে। তাড়াহুড়ো করে হেলমেট মাথায় বে*ধে, ব্যাগ কোলে নিয়ে উঠে বসল ধূসরের পেছনে। ধূসর ঘাড় বাঁকা করে শুধাল,
” বসেছিস?”
পিউ কথা বলতে গিয়ে টের পায় শব্দ আসছেনা বাইরে। স্বপ্নটার মতন। অতি ক*ষ্টে জবাব দেয়,
” হু।”
ধূসর টান বসাল। ওমনি পিউ হু*মড়ি খেয়ে পরল ওর পিঠে। বাইক চলছে। কানেমুখে সব জায়গায় হাওয়া লাগছে। পিউ একবার ধূসরের কাধে হাত রাখতে গিয়েও সরিয়ে আনছে। ধরবে না কী ধরবেনা ভুগছে মনঃদ্বিধায়৷ যদি কিছু বলে! তখনি ধূসর বলল,
” ধরে বোস,নাহলে পরে যাবি।”
পিউ আকাশের চাঁদ হাতে পেল যেন। শক্ত করে কাঁধ চে*পে ধরল ধূসরের। আরেকটু এগিয়ে বসল সাথে ।মুক্ত শ্বাস টানল পরপর। ধূসর ভাই কোথায় নিচ্ছেন, কেন নিচ্ছেন কিচ্ছু জানার প্রয়োজন বোধ করল না। ধূসর ভাই সাথে থাকলে সে মাটির নিচে যেতেও রাজি। বাইক থামল হঠাৎ। পিউ চোখ তুলে পাশ ফিরল। আইসক্রিম পার্লারের সাইনবোর্ড দেখে অবাক হলো। ধূসর বলল,
” নাম.”
এককথায় নেমে গেল সে। ধূসর নেমে বাইক স্যান্ড দিয়ে দাঁড় করে। কালকের মতোই তার হাত ধরে বলে,
” আয়।”

ভেতরে এসে চেয়ার টেনে দিয়ে বলে ” বোস।”
পিউ বসল। ধূসর বসল তার সম্মুখে। পিউ আশপাশ দেখে বলল,
” এখানে কেন এসেছি ধূসর ভাই?”
ধূসর উত্তর করল না। বরং উঠে গেল। আরেকবার অপমানিত হয়ে মুখ ছোট করল পিউ। মিনিট খানেকের মাথায় ধূসর ফিরে আসে,চেয়ারে বসে। পিউ আর প্রশ্ন করল না। চুপচাপ থাকল। কথা খরচ করে লাভ নেই। ধূসরভাই তাকে দুই আনা দাম ও দেয়না যেখানে।
কিন্তু অধৈর্য পিউ টিকে থাকতে পারছেনা। ধূসর এখানে এনেছে ভালো কথা। তার সাথে একটা কথাও না বলে ফোন টি*পছে কেন? কোন ধরনের ভদ্রতা এটা? পিউ হাজারবার চেষ্টা করল কথাটা বলতে। পারল না বিধায় গি*লে ফেলে বসে থাকল। কিছুক্ষন পর তার সামনে একটা বড় কাচের বাটি ভর্তি আইসক্রিম দিয়ে যায় একজন ওয়েটার। তাও চকলেট ফ্লেভার। পিউ তাজ্জব হয়ে ধূসরের দিকে তাকায়। ধূসর তাকেই দেখছিল। সে তাকাতেই ভ্রঁ উঁচিয়ে বলল
” কী? আজ কত আইসস্ক্রিম খেতে পারিস দেখব। প্রয়োজনে গোটা পার্লারের আইসক্রিম তোর।”

পিউ স্তব্ধ। আস্তে আস্তে হাত দুটো টেবিলের নিচে নামিয়ে একটা দিয়ে আরেকটার পিঠে স্বজোরে চিমটি কা*টল। ব্যা*থা পেলেও টু শব্দ করল না। ধূসরের সামনে থাকায় হজম করল। ধূসর চোখ ইশারা করে বলল,
” খা।”
” আপনি কী করে জানলেন আমার চকলেট ফ্লেভার পছন্দ?”
ধূসর কপাল গোঁটায়,
” পছন্দ না কি? আমি কী করে জানব? আমিতো এমনি দিতে বলেছি।”

পিউ মাথা নুইইয়ে মুচকি হাসে। আজ আর রা*গ হয়না, উলটে আদুরে ভালোলাগায় বক্ষ শীতল হয়। তার স্বপ্ন সত্যিই ফলল ভেবে লাল হয় গালদুটো। ধূসরের ফোন এলো। সে খেতে বলে বাইরে গেল কথা বলতে। পিউ ভুলে গেল শপথের কথা। চামচে আইসক্রিম তুলে মুখে পুরলো। পরপর চুমু খেল সেটার গায়ে। লাজুক হেসে বলল,
” এই চুমুটা আপনাকে দিলাম ধূসর ভাই।”
____

বাড়ির গাড়ি আইসক্রিম পার্লারের সামনে ডেকেছে ধূসর। পিউয়ের সাথে আর আসেনি। গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েই চলে গেছে বাইক সমেত । পিউ এতেই খুশি। এতটুকুও যে হবে আদৌ ভেবেছিল কখনও? সে স্ফূর্ত মন নিয়ে বাড়ি আসে। ফ্রেশ হয়ে খাবার খায়। এরপর ক্লান্ত পিউ বিছানায় শোয়। ঘোষনা করে আজকের দিন তার জীবনের সব থেকে শ্রেষ্ঠ দিন । ধূসর না চাইতেও যতটুকু দিয়েছে এতটুকু নিয়েই আরো তিন বছর অপেক্ষা করা যাবে ওর জন্যে।
পিউ চোখ বুজল।
আপাতত দুঘন্টার জন্যে জব্বর একটা ঘুম দেবে। নাহলে রাতে পড়তে পারবেনা। টেবিলে বসলেই ঢলে পরবে ঘুমে।

বেলকোনি ঘেঁষে যাওয়া রাস্তায় একটা সি-এন-জি গ্যারেজ আছে । কিছুক্ষন পরপর শব্দ করে করে একেকটা সি- এন -জি আসছে,আর থামছে। অন্যদিন এত আওয়াজ হয়না। পিউ চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারল না। তারপর বি*কট শব্দে একটা বাস যখন হর্ন বাজাল কলিজা উড়ে গেল তার৷ লা*ফিয়ে উঠে বসল। জানলা বন্ধ,তাও শব্দ আসছে।
পিউ বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয়।
জবা বেগম বারান্দা থেকে শুকনো কাপড় এনে ভাঁজ করছিলেন। পিউ রুমে ঢুকেই বলল,
” ও সেজো মা, তোমার ঘরে একটু ঘুমাই?”
জবা বেগম অবাক চোখে তাকালেন। পিউ মনস্তাপ নিয়ে বলল,
” আমার রুম থেকে গাড়ির এত শব্দ আসছে! ঘুমোনোই যাচ্ছেনা। একমাত্র তোমার রুমটাই রাস্তার পাশে নয়। নিরিবিলি।”

” ওমা,ঘুমাবি তো ঘুমা না। এভাবে সাফাই দেয়ার কী আছে বোঁকা মেয়ে!
দাঁড়া বিছানাটা ঝেড়ে দেই। রাদিফ এত এলোমেলো করে না।”

পিউ হাই তুলে বলল ” ওসব লাগবেনা৷ আমার ঘুমে চোখ ভে*ঙে আসছে৷”
বলতে বলতে এসেই শুয়ে পরল সে। জবা বেগম একে একে সব কাপড় ভাজ করে আলমারিতে ঢোকালেন৷ এরপর আলো নিভিয়ে দরজা চা*পিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

পিউ যখন সুগভীর নিদ্রায় টেবিলের ওপর থেকে জবা বেগমের ফোন বাজল। রিংটোনের শব্দে ঘুম ছুটল তার। উঠে বসল। ঘড়ি দেখল৷ আটটা বাজে। আর ঘুমোবেনা, চা খেয়ে পড়তে বসবে। ওদিকে ফোন বাজছে। পিউ স্ক্রিনে উঁকি দিলো। সাদিফের বাবার ফোন দেখে চট করে দরজা অবধি গিয়ে হাঁক ছুড়ল,
” সেজো মা, সেজো চাচ্চু কল করেছেন।”

জবা বেগম মিনিটের মাথায় ছুটে এলেন। আজমল ইদানীং কাজে ভীষণ ব্যস্ত। দিনে কথা বলার ফুরসত পাননা বলে কথাও হয়না। যা হয় এই সময়টায়। বাসায় ফিরতে ফিরতে গাড়িতে বসেই স্ত্রীকে ফোন করেন। পথে যেতে যেতে খোশগল্প জমান। জবা বেগমের এতেই চলছে। তিনি ব্যস্ত পায়ে রুমে ঢুকলেন। বিছানা খালি দেখে বুঝলেন পিউ চলে গেছে। ফোন তখনও বাজছে। যতক্ষন না ধরবেন আজমল সাহেব করতেই থাকবেন। ক্লান্ত হবেন না। জবা বেগম ঝটপট ফোন তুললেন কানে। ঘন শ্বাস টেনে বললেন
” হ্যালো!”
” হাঁ*পাচ্ছো কেন? নীচে ছিলে?”
” হ্যাঁ, তুমি ফোন করলে বলে দৌড়ে এলাম।”
ওপাশ থেকে আজমল হেসে উঠলেন।
” বাবাহ! বিয়ের এত বছর হলো,অথচ আমার বউয়ের এখনও কী টান আমার প্রতি।”
জবা বেগম হাসলেন।
সোজাসুজি শুধালেন,
” কবে ফিরবে,কিছু ঠিক করেছো?”
” এইতো,ঈদের এক সপ্তাহ আগে।”
” একটু তাড়াতাড়ি আসা যায়না এবার?”
আজমল ভ্রুঁ গোঁটান
” কেন? কিছু হয়েছে?”
” একটা কথা বলতে চাইছিলাম গতকাল থেকে। তুমি এত ব্যস্ত বিধায়…”
” এখন তো ফ্রি আছি। বলে ফেলো….”

জবা বেগম বললেন,
” একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সাদিফের ব্যাপারে। ”
” তাই? কী সিদ্ধান্ত? ”
জবা বেগম সময় নিয়ে বললেন,
” তুমি রা*গ করবে না তো?”
আজমল সাহেব অনতিবিলম্বে জবাব দিলেন,
” কী যে বলোনা! চাকরি করি আজ বিশ বছরের ওপরে। বাড়িতে থেকেছিই বা কতক্ষন। আমার অবর্তমানে সব একা হাতে সামলেছ। সব থেকে বড় কথা তুমি আমার স্ত্রী,সাদিফ তোমারও সন্তান। ওর ব্যাপারে যে কোনও সিদ্ধান্ত তুমি নিতেই পারো। আমি রা*গ করব কেন?”
স্বামীর কথায় জবা বেগমের বুক জুড়িয়ে আসে। তৃপ্ততায় চোখ ভরে ওঠে আনন্দে। নিভু কণ্ঠে বলেন,
” না আসলে…”
আজমল অভয় দিলেন,
” তুমি নির্দ্বিধায় বলো জবা! ”
জবা বেগম সময় নিয়ে বললেন,
” আমার না সাদিফের জন্যে পুষ্পটাকে ভারী পছন্দ হয়েছে। ওদের মধ্যে মিলও খুব। চার হাত এক করে দিলে কেমন হয়? পুষ্প আমাদের ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকল,আর সাদিফটারও একটা সুযোগ্য স্ত্রী হলো।”

আজমল সাহেব চুপ করে রইলেন। জবা বেগম ঘাব*ড়ে গেলেন। ভ*য়ে ভ*য়ে বললেন,
” রা*গ করেছ তাইনা?”
হঠাৎই হো হো করে হেসে ওঠেন আজমল। পরপর প্রফুল্ল চিত্তে বললেন,
” এতো আনন্দের সংবাদ গিন্নী! তুমিতো সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছ। আমার ভাইজানের মেয়ে আমার পূত্রবধূ হবে এর থেকে ভালো আর কিছু হতে পারে?”

” তুমি খুশি হয়েছো?”
” নিশ্চয়ই। খুশি হওয়ার মতোই তো খবর তাইনা?”
জবা বেগম বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির শ্বাস নিলেন। পরপর আনন্দিত হয়ে বললেন,
” তাহলে তুমি বাড়ি ফেরো। তারপর ভাইজানের সাথে কথা তুলব এ নিয়ে। কেমন? ”
” ঠিক আছে,ঠিক আছে।”

কথাবার্তা শেষ করে জবা বেগম বেরিয়ে গেলেন। তৎক্ষনাৎ ওয়াশরুমের দরজা খুলল পিউ। উচ্ছ্বল পায়ে ঘর ছাড়ল। তার বুক কাঁ*পছে খুশিতে। এতক্ষন জবা বেগমের সব কথা শুনেছে। সাদিফ ভাইয়ের সাথে আপুর বিয়ে হবে,কথাখানা ভাবতেই তার নাঁচতে মন চাইছে। ইচ্ছে করছে এই সুন্দর সিদ্ধান্তের জন্যে সেজো মাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিতে। পিউ লা*ফাতে লা*ফাতে ঘর থেকে বের হতেই
সামনে পরল সাদিফ। অফিস থেকে ফিরেছে কেবল। পিউকে দেখেই বলল,
” কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিলি? ডাকছিলাম না… পানি নিয়ে আয়।”
পিউ মিটিমিটি হাসল। সাদিফ,পুষ্পর বর হওয়া মানে সে তার দুলাভাই। এটা ভেবেই হাসি পাচ্ছে। অহেতুক হাসতে দেখে সাদিফের চেহারা বেঁকে আসে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই পিউ গান ধরল,
” সুন্দরী বউ আর সুন্দরী শালি,
খুশিতে দুলাভাই মা*রো হাতে তালি।”
ভড়কে গেল সে। দু লাইন গেয়েই পিউ ছটফ*টে পায়ে সিড়ি বেয়ে নেমে গেল। আর মাথামুণ্ডু না বুঝে ব্যাক্কল বনে দাঁড়িয়ে রইল সাদিফ।

চলবে,

রিচেইক করিনি কিন্তু, ভুল হলে আমি দ্বায়ী নই🙂

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১৩)

ব্যাগ থেকে খুচরো টাকা বের করে বাদামওয়ালাকে দিলো পুষ্প। পুরনো নিউজপেপারে মোড়ানো বাদাম গুলো হাতে বয়ে বেঞ্চে বসল। কাধব্যাগটা রেখে দিলো পাশে। একটা একটা করে বাদাম ছিলে ছু*ড়ে ছু*ড়ে মুখে ভরল। ছোট খাটো পার্কের এই জায়গাটা সবচেয়ে নিরিবিলি। মানুষ জন কম আসে। ইকবালের সাথে দেখা করার জন্যে পুষ্পর কাছে এটাই শ্রেষ্ঠ স্থান ৷ পাক্কা আড়াই বছর চুটিয়ে প্রেম করল,অথচ ধূসরের কানে পৌঁছাল না। এটাও তারই একটা কারন। ইকবাল আর সে যথেষ্ট সচেতন। কারো সন্দেহ হোক,এমন কাজ এখন পর্যন্ত করেনি। এমনকি বাড়ির মানুষ কারো সামনে পুষ্প, ইকবালের দিক তাকায় অবধি না। পাছে কেউ ধরে ফেলে! তবে সেদিন দূর্ঘটনা বশত ইকবাল কে দেখতে গিয়ে পিউটা দেখে ফেলেছে। ভাগ্যিশ ওটা একটা হাঁদারাম। নাহলে বুঝে ফেলত নির্ঘাত। কী হতো তাহলে?
ভাবতেই পুষ্পর হেচকি উঠে যায় । ব্যাগে পানিও আনেনি। পুষ্প হেচকি তুলতে তুলতে আশেপাশে তাকাল। এতক্ষন চোখের সামনে ঘুরঘুর করা পানিওয়ালা একটাও নেই এখন। ঠিক সেই সময় মুখের সামনে টলটলে জল ভর্তি পানির বোতল ধরে কেউ একজন। চট করে আগন্তুকের দিকে ফিরল সে। ইকবাল মুচকি হাসল, সাথে বলল,
” নাও?”
পুষ্প হেসে পানির বোতল হাতে নেয়। ছিপি আগেভাগেই ঢিলে করে রেখেছে ইকবাল। পানি খাওয়ার সময়টায় সে ঘুরে এসে পাশে বসল। বলল,
” অনেকক্ষন বসিয়ে রেখেছি তাইনা?”
পুষ্প ঠোঁটের চারপাশে লেগে থাকা জল মুছে তাকাল। মিষ্টি হেসে বলল,
” সমস্যা নেই।”
ইকবাল ভ্রু কোঁচকায়,
” তোমার কি আমার ওপর কখনওই রা*গ হয়না মাই লাভ ? ”
পুষ্প অবাক হয়ে বলল,
” ওমা, রাগ কেন হবে?”
” হবেনা কেন? এই যে প্রতিটা দিন আমি তোমায় বসিয়ে রাখি,অপেক্ষা করাই,সময়মতো আসতে পারিনা… ”

পুষ্প দুদিকে মাথা নেড়ে স্ফূর্ত কণ্ঠে জানাল,
” একদমই নয়। আপনি যে সাংঘাতিক ব্যস্ততার মধ্যেও আমায় রোজ সময় দিচ্ছেন,এটাই অনেক। তাছাড়া,তোমার জন্যে অপেক্ষা করতে আমার দারুন লাগে। কখন তুমি আসবে সেই আশায় পথ চেয়ে থাকার মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি আছে ইকবাল। ও তুমি বুঝবেনা।”

ইকবাল মুগ্ধতায় এবারেও হাসল। উৎফুল্ল চিত্তের ছেলেটির ঠোঁটে হাসি লেগে থাকে সবসময়। আরেকটু কাছে এগিয়ে বলল,
” নিশ্চয়ই কোনও ভালো কাজ করেছিলাম। তাই জন্যে তোমাকে পেয়েছি আমার জীবনে। ”
পুষ্পর কোমল হাতের আঙুলে হাত বোলাল ইকবাল। ওমনি সে মুখ বেঁকিয়ে বলে,
” নাটওওক! কতদিন পেছনে ঘুরানোর পর পাত্তা দিয়েছো হ্যাঁ? মনে নেই সেসব?”

ইকবাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দেয়,
” কী করব বলো জানেমন! ভ*য় পাচ্ছিলাম,পাছে ধূসরের সাথে বন্ধুত্বটা যদি ন*ষ্ট হয়? ও যদি খা*রাপ ভাবে আমায়? ওরই ছোট বেলার বন্ধু হয়ে ওর বোনকে পটয়েছি,ফুসলাচ্ছি এসব ভাবে? তাইজন্যেইতো তোমার ভালোবাসা দেখেও না দেখার ভান করতে হয়েছিল। মনে মনে আমি কী তোমায় ভালোবাসিনি? সেই প্রথম তোমায় দেখেই প্রেমে পড়েছিলাম। অথচ মনকে সংযত ও বা রাখতে পারলাম কই? তোমার এক সমুদ্র প্রেম আমাকেও ভাসিয়ে নিলো যে!”

পুষ্প ভ্রুঁ উচায়,
” তাই? তা এখন যখন ভাইয়া জানবেন,তখন কী করবে শুনি? একদিন না একদিন কী আমরা পরিবারকে জানাব না?”
ইকবাল চি*ন্তিত কণ্ঠে বলল,
” সেটা ভাবলেই তো হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তবে তুমি ভেবনা মাই লাভ, ধূসরকে আমি চিনি। ও যদি বুঝতে পারে আমি তোমাকে মন থেকে চাই,ও নিশ্চয়ই না করবেনা।”

পুষ্প থেমে থেমে বলল
” কিন্তু ইকবাল…., বাবা? সেত তোমাকে সহ্যই করতে পারেনা।”
ইকবাল মাছি তাড়ানোর মত হাত নেড়ে বলল,
” আরে ওসব নিয়ে চিন্তা নেই। একবার ধূসর জানুক,বাকী সবাইকে দেখবে ওই মানাবে,রাজি করাবে। আমার জিগরি দোস্ত না? বাই দ্যা ওয়ে,তুমি এত ভাবছো কেন? তুমি না প্রথম দিকে ভীষণ সাহসী ছিলে? বলেছিলে বাবাকে আমি বোঝাব এই সেই,এখন কী হলো?”

ইকবাল দৃষ্টি চো*খা করে ভ্রুঁ নাঁচাল। পুষ্প ওষ্ঠ উলটে বলল,
” তখন তো তোমার প্রেমে পাগল হয়ে গেছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে দিন যত যাচ্ছে,ভ*য় লাগছে। কী হবে, কী করব কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা।”

” কী আবার করব? মন প্রান দিয়ে প্রেম করব,সারাদিন ঘুরব,পরেরটা পরে দেখা যাবে৷ আচ্ছা,এখন বলো মাই লাভ ,কোথায় কোথায় যাবে আজ?”

পুষ্প একটু ভেবে বলল, ” চলো রিক্সায় ঘুরি। অবশ্যই এমন কোনও এরিয়ায় ঘুরব,যেখানে ধূসর ভাইয়ের নেটওয়ার্ক কম। বুঝলে?”
ইকবাল মাথা দোলায়,
” বুঝলাম। তাহলে চলুন মহারানী!”
পুষ্প এদিক ওদিক দেখে বলল,
” কিন্তু আমার পালকি কোথায়? আপনি কী আমায় হাঁটিয়ে নেবেন মহারাজ?”
ইকবাল জ্বিভ কে*টে বলল,
” মাথা খারাপ? আপনাকে হাঁটিয়ে নেয়ার মত সাহস আমার আছে? এই যে,মহারাজের পিঠটাই আপনার পালকি রানি,আপনি এতে চড়ে যাবেন। ”
ইকবাল পিঠ পেতে দিলো। ওমনি দুম করে কি*ল বসাল পুষ্প। ইকবাল পিঠ চে*পে ব্য*থায় দুলে ওঠে। সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দুঃখী কন্ঠে বলে,
” এত জোরে মা*রলে?”
পুষ্প খিলঝিল করে হেসে উঠল ওর মুখভঙ্গি দেখে। ইকবাল সব ভুলে চেয়ে থাকে। নিষ্পলক প্রনিধানে পরোখ করে মনকে জানায়,
” এই হাসির জন্যে সে জান লু* টিয়ে দিতেও প্রস্তুত।”
_______

পিউয়ের কান্ডকারখানা দেখে দেখে হয়*রান হয়ে পরছে সাদিফ। গত পরশু থেকে মেয়েটা ওকে দেখলেই মিটিমিটি হাসছে, আর গাইছে উদ্ভট সব গান। এরকম গান বাপের জন্মে শোনেনি সে। এইত একটু আগেও শুনিয়ে গেল। আর সেই থেকে সাদিফ চেহারা গুঁটিয়ে দরজার দিক চেয়ে আছে। পিউয়ের মাথায় হঠাৎ কীসের ভূত চা*পলো কে জানে! তার ভাবনার মধ্যেই ঘরে ঢুকলেন জবা বেগম। হাতে দুধ ভর্তি লম্বা কাঁচের গ্লাস। ছেলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
” নে বাবা,গ*রম গর*ম খেয়ে ফেল দেখি।”
সাদিফ তাকাল। দ্বিরুক্তি না করে গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিল। তার মায়ের কাছে সে এখনও ছোট্ট বাচ্চা বিধায় রোজ রাতে এক গ্লাস দুধ দেবেন। নাহলে না কী গায়ে শক্তি হয়না। সাদিফ হাজার মোচ*ড়া-মুচ*ড়ি করলেও লাভ নেই সেখানে। ইমোশোনাল ব্লাকমে*ইল করে হলেও জবা বেগম খাইয়াবেন,খাইয়েই ছাড়বেন। তাই আর সাদিফ আপত্তি করেনা। যেখানে লাভ নেই সেখানে কথা ন*ষ্ট করে এনার্জি খোয়া*নোর মত লোকসান সে করেনা।
জবা বেগম পাশে বসলেন। উজ্জ্বল মুখমণ্ডল। সাদিফ গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলল,
” কিছু বলবে?”
জবা বেগম মাথা নেড়ে বললেন,
” না। কী বলব!”
” ওহ।”
জবা বেগম মন দিয়ে ছেলের দিক চেয়ে রইলেন। তার গায়ের রং শ্যামলা বলে কত কথাই না শুনেছেন জীবনে। এ বাড়ির বাকী বউয়েরা যেখানে ফর্সা,সুন্দর সেখানে তিনি ছিলেন বড়ই বেনানান। যদিও আজমল বা এ বাড়ির কেউ বিন্দুমাত্র তাকে হেয় করে কথা বলেনি। উহু,কোনও দিন এরকম হয়েছে বলেও মনে পড়েনা। তবুও জবা বেগমের অবাক লাগে, তার মত কালো মানুষের কোল জুড়ে এমন সুন্দর একটা ছেলে এসেছে ভাবতেই। সাদিফের চেহারা,দৈহিক গঠন,সব কিছু নির্দ্বিধায় তাকে সুদর্শন পুরুষের আখ্যান দিতে প্রস্তুত। জবা বেগমের বুক ফুলে আসে গর্বে, নিজেকে এমন চমৎকার দর্শনের ছেলের জননী ভাবতেই। ওদিকে পুষ্প? ওটাও কম সুন্দর? যেমন রুপ,তেমন গুন। ভদ্র,শান্ত। জবা বেগম মনে মনে এঁকে ফেললেন ওদের পাশাপাশি বসা একটা ছবি। ইশ! কী দারুন মানিয়েছে দুটোকে! ভেবেই হেসে ফেললেন। সাদিফ ভ্রুঁ কোঁচকাল,
” কী ব্যাপার? একা একা হাসছো কেন?”
খানিক থতমত খেলেন তিনি।
” না মানে একটা কথা ভাবছিলাম।”
” কী কথা? ”
জবা বেগম সময় নিয়ে বললেন,
” তোর বিয়ে নিয়ে।”
সাদিফ চকিতে তাকাল। নিশ্চিত হতে শুধাল ” কী?”
” হ্যাঁ। বড় হয়েছিস,বয়স হচ্ছে,বিয়ে দেবনা? আমরাও বা কতদিন বাঁচব,নাতি নাতনীর মুখ দেখব তো না কি?”
সাদিফ ঠোঁট ফু*লিয়ে শ্বাস ফেলে দুদিকে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করল ” আনবিলিভ-এবল!”
আস্তে বললেও কানে গেল জবা বেগমের।
উদ্বেগ নিয়ে বললেন ‘ অবিশ্বাসের কী আছে এখানে? কথাটা গায়ে লাগালি না তাইনা?”

” মা! হঠাৎ কী হয়েছে বলোতো? আমার বিয়ে নিয়ে পরলে কেন? ভাইয়া আছে,সিরিয়ালে পুষ্প আছে এরপর আমি। অনেক দেরি এখনও। তাছাড়া সবে সবে চাকরি পেয়েছি এখনই বিয়ে-টিয়ে করলে কনসেনট্রেশন ঘুরে যাবে।”

” আরে এত দূর তোকে কে ভাবতে বলেছে? তুই মন দিয়ে কাজ করবি তো বাবা। কেউ বাঁ*ধা দেবেনা। আচ্ছা ঠিক আছে, আমাকে একটা কথা বলতে তো আপত্তি নেই, তোর কেমন মেয়ে পছন্দ এই বর্ননা টুকু শুধু দে, তাহলেই হবে।”
সাদিফ ল্যাপটপ বন্ধ করে তাকাল।
” কেন? ”
” জেনে রাখি। ছেলের পছন্দ জানতে পারিনা? আমি তো তোর বন্ধুর মতোই। তাহলে কী সমস্যা?”

সাদিফ ফোস করে নিঃশ্বাস ঝাড়ল। মুচকি হেসে বলল,
” আমার যেমন মেয়ে পছন্দ,সেরকম মেয়ে আমার আশেপাশেই থাকে,আমাদের সবার চোখের সামনে৷ তোমার ক*ষ্ট করে খোঁজার দরকার নেই,সময় হলে আমিই জানাব, ওকে?
এখন কাজ করতে দাও মা? কাল অফিসে আমার প্রেজেন্টেশন আছে।”
জবা বেগম আদুরে কন্ঠে বললেন, ” ঠিক আছে বাবা, কাজ কর তবে।”

ফাঁকা এটো গ্লাস হাতে তুলে হাটা ধরলেন তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির শ্বাস টানলেন। যাক বাবা! নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। সাদিফটার তাহলে পুষ্পকেই পছন্দ। অবশ্য না হয়ে উপায় আছে? তার ছেলে বলে কথা। পুষ্পর মতো লক্ষীমন্ত মেয়েকে কেউ অপছন্দ করতে পারে? এবার শুধু আজমল আসুক,ভাইজানের কাছে কথা তুলতে বিলক্ষন দেরি করবেন না তিনি।
_____

মিনা বেগমের একমাত্র ভাই রাশিদ মজুমদার। আগামী সপ্তাহে কন্যার বিয়ের তারিখ ধার্য্য করেছেন। ধুমধাম করে পাত্রপক্ষের হাতে তুলে দেবেন মেয়েকে। গতকাল রাতে ফোন করে সে খবর জানিয়েছেন বোনকে। আজ দুপুরে কার্ড পৌঁছে দিলেন বাড়ির দরজায়। যেখানে সিকদার বাড়ির প্রত্যেকের আগমন তার কাম্য। বহু বছর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। মিনা বেগম প্রস্তবাখানা রাখতেই সকলে হৈহৈ করে উঠল। পিউ একধাপ এগিয়ে চেঁ*চিয়ে জানাল,
” আমি যাব,আম্মু আমি যাব।”
পুষ্প ওর মাথায় চা*টি মেরে বলল,
” আমাদের কাজিনের বিয়ে,আমরা যাবনা? গর্দভ!”
পিউ মাথা ডলতে ডলতে বোনের দিকে তাকায়। পরপর মনস্তা*প নিয়ে বলে,
” কিন্তু কী পরে যাব? আমার তো কোনও ভালো জামা নেই আপু।”

কথাটুকু শেষ করা মাত্রই মিনা বেগম খেঁকিয়ে বললেন,
” তাহলে আলমারি ভর্তি জামাকাপড় গুলো নিয়ে আয়,আ*গুন লাগিয়ে পু*ড়িয়ে ফেলি। প্রতিমাসে দু বোন মিলে অনলাইন দেখে যে অর্ডার করিস? সেসব?
পিউ নিচু আওয়াজে বলল,
” সেসব পরে তো ছবি তুলে ফেলেছি আম্মু।”
তিনি মাথায় হাত দিলেন মেয়ের কথায়। এখন কী প্রতিটা ছবির জন্যে আলাদা আলাদা জামাকাপড় লাগবে এই মেয়ের? আফতাব সিকদার ওর হয়ে সাফায় গেয়ে বললেন,
” আরে ভাবি,এখনই তো ওদের বয়স,এসব করার। আপনিই বা এমন কেন করছেন বলুন দেখি। থাক পিউ মামুনি,এই বিয়ে উপলক্ষে তোমাকে একটা সুন্দর জামা কিনে দেব আমি। কেমন? ”

পিউ ঝলমলিয়ে ওঠে।
” আর আমি? আমাকে বুঝি দেবেনা?”
পুষ্পর বাচ্চামো কণ্ঠে আফতাব সিকদার হাসলেন। বললেন ” নিশ্চয়ই দেব৷ আমার মায়েদের না দিলে হবে না কী!”
দুবোন গিয়েই দুপাশ থেকে গলা জড়িয়ে ধরল আফতাবের।
পিউ তো ঝুলতে ঝুলতে বলল ” চাচ্চু তুমি কত্ত ভালো!”

” হয়েছে হয়েছে। এবার সর তো তোরা,আগে আলোচানা খানা শেষ করতে দে।”
মায়ের কথায় দুবোন সরে আসে। বসে পরে আগের জায়গায়। মিনিটের মাথায় ওপর থেকে নামল সাদিফ। বসে গেল পিউয়ের পাশ ঘেঁষে । টি-টেবিলের ওপর থেকে চানাচুরের বাটি হাতে তুলল। চিবোতে চিবোতে বলল
” কী চলছে রে এখানে?”
” বর্ষা আপুর বিয়ে। সেই আলোচনা।”
সাদিফ ঠোঁট গোল করে বলল ” ও।”
মিনা বেগম ওকে দেখতেই ব্যস্ত কণ্ঠে শুধালেন,
” হ্যাঁ রে সাদিফ,তুই যেতে পারবি তো বাবা?”

সাদিফ একবার পিউকে দেখে নেয় আড়চোখে। ক্ষনশ্বর ভেবে জবাব দেয়,
” হ্যাঁ। তিনদিনের মত ম্যানেজ করা যাবে। ”
” যাক! তাহলে তো ভালোই। এই হচ্ছে আমাদের ছেলে,কোনও বাহানা নেই কিচ্ছু না। ”
রুবায়দা বেগমের কথায় সাদিফ মুচকি হাসল। পুষ্প বলল,
” সবাই গেলে কত্ত ভালো হবে তাইনা ভাইয়া?”
সাদিফ মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝায়। হঠাৎ পিউয়ের দিক চোখ পড়তেই দেখল সে আবার মিটিমিটি হাসছে। সাদিফ ওমনি সতর্ক করল,
” খব*রদার উল্টাপাল্টা গান গাবিনা।”
পিউ ফিঁক করে হেসে বলল,
” না না, সবার সামনে কী এসব গান গাওয়া যায়? এগুলো আপনাকে আলাদা শোনাব।”

আলোচনা সভায় ধূসর ব্যাতীত বাকীরা উপস্থিত। আমজাদ সিকদার সিঙ্গেল সোফাটায় বসে এতক্ষন স্ত্রীর সব কথা শুনছিনেল। তিনি বিরতি নিতেই ঘোষণা দিলেন,
” বেশ তো,যাও তোমরা। বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে এসো।”
মিনা বেগম জ্ব*লন্ত শি*খার ন্যায় ফুলকে বললেন,
” তোমরা যাও মানে? আর আপনি, আপনি যাবেন না?”
আমজাদ সাহেব বললেন,
” আমার সময় হবেনা।”
আফতাব বললেন ” ভাইজান না গেলে আমিও যাবনা ভাবি।”
পাশ থেকে আনিস ও মিনমিনিয়ে জানিয়ে দিলেন একই কথা। ব্যাস! যা ভেবেছিল তাই হচ্ছে। মিনা বেগমের মাথা গ*রম হয়ে গেল। ক্ষে*পে বললেন,
” বাহ বাহ, কাউকে যেতে হবেনা। আমার বাপের বাড়ি যাওয়ার প্রসঙ্গ এলেই তোমাদের ভাইয়ের কাহীনি-সংলাপ শুরু হয়। নিজেও যাবেন না ইনিয়েবিনিয়ে আমাকেও যেতে দেবেন না। সব চালাকি বুঝি আমি। বয়স হলে কী হবে,শয়*তানি কী আর কমে?”

বলতে বলতে কেঁ*দে ফেললেন মিনা বেগম৷ পিউ -পুষ্প মাথায় হাত দিয়ে হাটুর ওপর ঝুঁকে গেল। বিয়েতে যাবে সব এক্সাইটমেন্টের দফারফা দেখে হতাশ তারা। আমজাদ সিকদার বললেন,
” আহা আমি তো তোমাকে যেতেই বললাম। তাও কাঁদ*ছো কেন? আমি কি একবারও বলেছি যে তুমি যেওনা? এই রুবি,জবা তোমরাই বলো বলেছি?”

তারা দুজন পরলেন মহা বি*পদে। কার পক্ষে কী বলবেন কেউই বুঝে উঠলেন না। শেষে সুমনা বেগম আস্তেধীরে বললেন,
” আপা কত বছর বাপের বাড়ি যাননি ভাইজান। আপনারা না গেলে উনি কী করে যাবেন? আমরাই বা কেমন করে যাই? পরিবারের সবাই মিলে যাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ,সে কী আর এভাবে ভাগ ভাগ হয়ে গেলে পাব বলুন?”
রুবায়দা বেগম ও তাল মেলালেন,
” হ্যাঁ, সেইত ভাইজান। ছোট তো ঠিক কথাই বলল। সবাই গেলে অন্যরকম আনন্দ তাইনা?”
” আমি সবই বুঝি। কিন্তু আমার কিচ্ছু করার আছে বলোতো? যাওয়ার ইচ্ছে আমার নিজেরও রয়েছে। কিন্তু, ধূসর টা সবে সবে ব্যাবসায় হাত দিলো। ছেলেমানুষ ও। এখনও কত কাজ ওকে বুঝিয়ে দেয়া বাকী। বিয়ে মানে একটা গোটা সপ্তাহের ব্যাপার। ওকে একা ফেলে যাই কী করে?”

পিউ চট করে মাথা তুলল। মিনা বেগম কপাল গুছিয়ে বললেন,
“তার মানে? ধূসর একা থাকবে কেন,ওতো যাবে আমাদের সাথে।”
আফতাব সিকদার দুটো ভ্রুঁই উচিয়ে বললেন,
” কী বললেন ভাবি? কে আপনাদের সাথে যাবে? ধূসর? এই আপনি ওকে চিনলেন? লিখে রাখুন সে নবাবসাহেব ঘটনা শোনা মাত্র বলবেন ” আমি যাব না বড় মা। তোমরা যাও। ”
আফতাব হুবহু ছেলেকে অনুকরন করে শেষটুক বলাতে জবা বেগম, সুমনা বেগম, পুষ্প ঠোঁট চে*পে হাসি আটকাল। মিনা বেগম তীব্র বিশ্বাস ঝুলিয়ে বললেন,
” কখনও না। আমি বললে ও ঠিক যাবে দেখো।”
” তাহলে তুমিই বলে দেখো। ও গেলে আমাদের ও সুবিধে। তবে মনে হয়না পারবে৷ কারন ছেলে যা ঘাড়ত্যারা হয়েছে,রাজি হলে হয়।”
” ঠিক আছে। আসতে দিন ওকে।”

পিউ চি*ন্তায় পরে গেল। তার উত্তেজনা, উদ্ভাসনা সব মাটি। ধূসর ভাই না গেলে ও কী গিয়ে করবে কী? যে মানুষটার জন্যে গত তিন বিছর যাবত বাড়ি ছেড়ে নড়েনি। একটা দিন অবধি নানাবাড়ি গিয়েও কা*টায়নি, সেখানে চারটে দিন ওখানে কীভাবে টিকবে? থাকবে কী করে? হাউ?

ভাগ্যবশত ধূসর তখনি ঢুকল বাড়িতে। বাইকের চাবি আঙুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চৌকাঠ পেরোলো কেবল। বসার ঘরে সবাইকে দেখে চাবি পকেটে ঢোকাল। এগিয়ে এল। রুবায়দা বেগম ছেলেকে দেখেই খাবার টেবিলের দিক গেলেন। পিউ ছুটে পেছন পেছন গেল। রুবায়দা বেগম গ্লাসে জল ভরে ফিরতে না ফিরতেই আবদার করল,
” আমি নিয়ে যাই মেজো মা?”
মানা করলেন না তিনি। বিনাবাক্যে গ্লাস ওর হাতে দিলেন। পিউ দ্রুত রওনা করল বসার ঘরের দিকে। ধূসর আসতেই পুষ্প উঠে জায়গা দিলো বসার। বসল সে। পিউ তক্ষুনি গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে মিহি কণ্ঠে বলল,
” নিন,আপনার জন্যে পানি এনেছি।”
ধূসর তাকায়। একি সময় চাইল সাদিফও। ধূসরের চাউনী সাবলিল হলেও তার চাউনি অদ্ভূত। পিউতো ওকে পানি দিতে গেলে গড়িমসি করে,ভাইয়ার বেলায় এত তৎপর?
ধূসর তার ভরাট কণ্ঠে জানাল ” লাগবে না।”
পিউয়ের মুখ কালো হলো পুনরায়। স্বাধ করে পানি আনল আর এইভাবে মানা করলেন? ফিরে যেতে গেলেই ধূসর ডেকে ওঠে। পিউ ঘুরে তাকালে দুই বাক্যে বলে,
” দিয়ে যা।”
পিউ খুশি হয়ে যায়। হাসি হাসি চেহারা ফেরত আসে। গ্লাস হাতে দেয় ধূসরের। সে এক চুমুকে পুরোটা শেষ করে টেবিলের ওপর রাখে। এতক্ষন বাকী সকল সদস্য নিরব রইলেও মিনা বেগম ক্রমশ চোখ ইশারা করছিলেন স্বামীকে। যার অর্থ, ‘ধূসরকে কথা টা বলো।’ আমজাদ সিকদার বির*ক্তির শ্বাস নিলেন। যেখানে বলে লাভ নেই তাহলে অযথা প্রসঙ্গ তোলার মানে কী? কিন্তু স্ত্রীর মন রক্ষার্থে, আর বাড়িতে তার শান্তির খাতিরে এটুকু করা উচিত। নাহলে এই মহিলা আবার কেঁ*দেকে*টে জলের পুকুর বসাবেন। ধূসরের জলপান শেষ হওয়া মাত্রই আমজাদ সিকদার গলা খাকাড়ি দিয়ে সবার মনোযোগ ঘোরালেন। সরাসরি ওকেই প্রশ্ন করলেন,
” বর্ষার কথা মনে আছে তোমার ধূসর?”
ধূসর ভাবতে গেলেই পিউ আগ বাড়িয়ে জবাব দেয়, ” আমার মামাতো বোন ধূসর ভাই। মনে নেই আপনার? শেষ যেবার এলো,নাঁচতে গিয়ে মেঝেতে আ*ছাড় খেয়ে পরে গেছিল?”

কথার মাঝে মেয়ের বাম হাত ঢোকানোয় বিদ্বিষ্ট হলেন আমজাদ। তবুও বললেন না কিছু। অথচ
মিনা বেগম সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাঁ*কিয়ে বললেন
” তুই বড়দের মধ্যে কথা বলছিস কেন? ”
পিউ চুপসে যায়। পুষ্প কানে কানে ফিসফিস করে বলে
” তুই যে কবে মানুষ হবি!”
পিউ দম ফেলে। আসলেই,সে কবে মানুষ হবে? কবে একটু বুদ্ধি হবে ওর?
ধূসর জানাল ” হ্যাঁ মনে আছে। হঠাৎ এই কথা? ”
মিনা বেগম ধৈর্যহীন কণ্ঠে বললেন,
” আমি বলছি। হয়েছে কী,আগামী শুক্রবার ওর বিয়ে। পুষ্পর মামা আমাদের পুরো পরিবার সমেত দাওয়াত দিয়েছেন। বারবার করে বলেছেন আমরা যেন সবাই যাই।”
” ভালো খবর। যাও তোমরা,ঘুরে এসো।”
মিনা বেগম হতভম্ব হয়ে আফতাবের দিক তাকালেন। তার ঠোঁটে বিজয়ের হাসি। একদম কথাখানা কাটায় কাটায় ফলে গেল যে!
রুবায়দা বেগম বললেন ” তুই যাবি না?”

ধূসর এক বাক্যে বলে দিল ” না।”
ব্যাস! সবার সমস্ত আয়োজন ফুস করে উড়ে গেল। পিউয়ের আনন্দ নেতিয়ে পরল লতার ন্যায়। মিনা বেগম বড় আহ্লাদী স্বরে শুধালেন,
” কেন রে ধূসর? কেন যাবিনা বাবা? না যাওয়ার কারন টা কী? ”
” তুমিতো জানো বড় মা,আমার এসব,প্রোগ্রামে ইরিটেশন হয়। ”
মিনা বেগম কেঁ*দে ফেললেন আবারও।
” তাতো হবেই। আমি তো কেউ নই,আমার বেলায় সবার কত শত ঝা*মেলা হবে। কাউকে যেতে হবেনা। কোনও বিয়ে বাড়ি যাবনা। ঘরে খিল দিয়ে বসব আমি,খবরদার কেউ আমার দরজায় টোকাও ফেলবেনা বলে দিলাম।”

সবাই উদ্যত হলেন তাকে বোঝাতে। তিনি চাইলেন না শুনতে। নাকে আঁচল ধরে সিড়ির দিকে এগোবেন তখনি ধূসর প্রশ্ন করে,
” তুমি চাও আমি বিয়েতে যাই?”
মিনা বেগম দাঁড়ালেন। ভেজা গলায় বললেন ” হ্যাঁ, চাইতো।”
ধূসর ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল ” বেশ,যাব।”
প্রত্যেকের মুখে হাসি ফুঁটলেও পিউয়ের চেহারা জ্বলে ওঠে। অত্যুজ্জল তারার ন্যায় আলো ছড়ায়। মিনা বেগম চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন। খুশি খুশি কণ্ঠে বললেন ” সত্যি তুই যাবি? আমি জানতাম আমার ধূসর আমার কথা ফেলবেনা। কী মেজো ভাই দেখলে তো?”
আফতাব সিকদার একটু চুপ থেকে বললেন,” হ্যাঁ তাইতো দেখছি। ”

মিনা বেগম অতি আনন্দে লতিয়ে পরবেন,ঠিক তখনি ধূসর জানাল,
” কিন্তু,আমি তোমাদের সাথে যাব না। একেবারে বিয়ের দিন গিয়ে বিয়ে এ্যাটেন্ড করে চলে আসব।”

পিউয়ের আনন্দিত মুখমণ্ডল ঠুস করে ফেঁ*টে যায়। হাসিটাও শেষ। মিনা বেগম তব্দা খেয়ে বললেন,
” এ্যা?”
ধূসর উঠে দাড়াল, বলল ” হ্যাঁ। তুমি কাঁ*দছিলে তাই যাব,এর বেশি আমাকে দিয়ে সম্ভব নয়। ”
বলে দিয়েই সে রুমের দিক হাঁটা ধরে। আফতাব সিকদার তার প্রস্থান দেখে দেখে বিরক্তি নিয়ে মাথা নাড়লেন। পুরোনো প্রশ্নটা রয়েই গেল ‘ এই ছেলে কার? ‘

ধূসর যখন বলেছে যাবে না,তখন সে যাবেওনা। পিউ হাঁসফাঁ*শ করছে। ধূসরকে রেখে ওখানে চার চারটে দিন তার কাছে চারশ বছরের সমান। কী করে থাকবে? পিউ ঘরময় পায়চারি করেও উপায় পেলোনা ধূসর কে রাজি করানোর। যেখানে তার মায়ের কা*ন্নাকা*টি দেখেও পাষ*ন্ডটার মন গলেনি সেখানে সেতো দুধভাত।
পিউ হাত কঁচলে কঁচলে হাটছে। মাথার মধ্যে উদ্ভভ হচ্ছেনা কোনও বুদ্ধি। শেষ মেষ ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

ওদিকে পুষ্পর অবস্থাও বেগ*তিক। ইকবাল যখন থেকে জেনেছে সে তার মামা বাড়ি যাবে, সেই মুহুর্তে শুরু হয় তার হাজারখানেক নিষেধা*জ্ঞা। বিয়ে বাড়িয়ে কত ছেলেপেলে থাকবে, এই করবেনা, সেই করবেনা, বেশি সাজবেনা। শুনতে শুনতে পুষ্পর মেজাজ বিগ*ড়ে গেল। প্রত্যেকবার কোথাও যাওয়ার কথা উঠলেই ইকবাল এমন করবে৷ পুষ্প রে*গেমেগে বলল,
” আমার যা মন চায় তাই করব। রাখোতো ফোন।”
সংসারে আ*গুন লাগিয়ে পুষ্প লাইন কা*টল। পরপর সেটাকে ছু*ড়ে ফেলল বিছানার ওপর। নিজেও ধপ করে বসে পরল পাশে। এই পুরুষজাতি মেয়েদের একটুও বিশ্বাস করেনা। আরে বাবা যেখানে তার হৃদয় জুড়ে মানুষটার বসবাস,সেখানে এসব শিখিয়ে দিতে হয়? সেতো এমনিতেও কোনও ছেলের সাথে কথা বলেনা। অসহ্য!

_____

পরেরদিন সকালবেলা ধূসর অফিসের জন্যে তৈরি হয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়। সিড়ির গোড়ায় আসতেই দেখে পিউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ফোনে। ধূসর ভ্রুঁ বাঁকাল। এই সাত সকালে কার সঙ্গে কথা বলছে ও?
ধূসর পাশ কা*টিয়ে চলে যাবে ভাবল। হঠাৎ পিউয়ের কিছু কথা কানে যেতেই থমকে দাঁড়াল। পিউ দেয়াল খুঁটছে হাত দিয়ে। অন্য হাতে ফোন। ওপাশের কাউকে হেসে হেসে বলছে,
” আরে তুইতো জানিস না,বর্ষা আপুর খালাতো ভাই আছে একটা, ‘রোহান’ নাম। যা সুন্দর দেখতে! এত্ত হ্যান্ডসাম,ড্যাশিং উফ! দেখলেই মনে হয় চেয়ে থাকি। সেই কবে দেখেছিলাম! এবার আপুর বিয়ে উপলক্ষে উনিও আসবেনা শুনলাম। আমার তো সেটা ভেবেই খুব আনন্দ লাগছে৷ এই কয়টা দিন চুটিয়ে এঞ্জয় করব।”

মুহুর্তমধ্যে ধূসরের চিবুক শ*ক্ত হয়। পিউ বলতে বলতে পেছন ঘুরল। একদম সম্মুখে ধূসরকে দেখেই চমকে গেল। ধূসরের দাঁত ফুটছে কট*মট করে। শ*ক্ত চাউনী তার দিকেই নিবদ্ধ৷ পিউ ভ*য় পায়। আতঙ্ক নিয়ে চেয়ে থাকে।
ঠিক তখনি ধূসর ধমকে ওঠে,
” সর সামনে থেকে,বেয়া*দব।”

পিউ হতবুদ্ধি হয়ে গেল। চটজলদি সরে দাঁড়াল। ধূসর গটগট করে সিড়ি ভে*ঙে নেমে যায়। পিউ চেয়ে থাকে। ধূসর সোজা নিচে এসেই উঁচু কণ্ঠে ডাকল,
” বড় মা!”
মিনা বেগম রান্নাঘরে ছিলেন। ডাক শুনে ব্যস্ত পায়ে সামনে এলেন ওর।
” হ্যাঁ রে,কিছু লাগবে বাবা?”
পিছু পছু রুবায়দা বেগমও এসেছেন। ধূসর তাদের দুজনকে একবার দেখে বলল,
” তোমরা কবে যাচ্ছো?”
” কোথায়? আমাদের বাড়িতে?”
” হ্যাঁ। ”
” এইত, কাল।”
” আমিও যাব।”

দুজন অবাক হয়ে একে অপরকে দেখলেন। রুবায়দা বেগম কৌতুহল নিয়ে বললেন,
” কাল যে বললি…”
” এখন বলছি,আমিও যাব। সমস্যা আছে তোমাদের?”

মিনা বেগম ত্রস্ত দুপাশে মাথা নাড়েন।
” না না কোনও সমস্যা নেই। আমিতো চাইছিলামই, তুই যাস।

ধূসর আরেকবার ওপরের দিক তাকায়। গুঁটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে পিউ। এদিকেই দেখছে। চোখ ফিরিয়ে পল্লব বুজে শ্বাস ফেলল সে। পরপর
হনহনে কদমে বাড়ি ছাড়ল। রুবায়দা বেগম বিড়বিড় করে বললেন ” এই ছেলেটার কখন যে কী হয়!”
ধূসর অদৃশ্য হতেই পিউ হেসে ওঠে। একা একা হাসিতে কু*টিকু*টি হয়। হাত মুঠো করে ওপর -নিচ ঝাঁকিয়ে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে ‘ ইয়েস!”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে