এক শহর ভালোবাসা পর্ব-৩২

0
3109

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_৩২
#প্রোপোজ_স্পেশাল_২
#সুরাইয়া_নাজিফা

“এই সত্যি করে বলুন তো কোথায় যাচ্ছেন এতো রাতে? ”
“লং ড্রাইভে যাচ্ছি ।”
উনার কথা শুনে আমি হেসে বললাম,
“মজা করছেন কেন? ”
উনি রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে বললো,
“আমার কথা শুনে মজা করছি মনে হলো তোমার ?তোমাকে বলেছিলাম না আমি যদি স্মৃতিদের হেল্প করি তাহলে তোমাকে আমার সাথে লং ড্রইভে যেতে হবে ভুলে গেছো সেটা? ”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
“সেটা আগে বলতে পারেননি আমি একটু পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখতাম। ”
শান ভ্রু কুচকে বললো,
“এখানে পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়ার কি আছে রেডি তো আছোই। ”

আমি বিরবির করে বললাম,
“উফ ভেবেছিলাম আজকে আপনাকে আমার ভালোবাসার কথাটা বলবো কত সুন্দর একটা সুযোগ ছিল একটা পূর্বপ্রস্তুতির দরকার তো ছিলই। ”

শান আমার হাতের উপর হাত রেখে বললো,
“কি বিরবির করছো বলোতো শরীর ঠিক আছে তো? ”
আমি মাথা নাড়িয়ে কাচুমাচু মুখ করে বললাম,
“হুম ঠিক আছে। ”

তারপর আমরা দুজনেই চুপ করে রইলাম কিছুক্ষন। হঠাৎ শান বলে উঠলো,
“তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই তাই না? ”
উনার কথা শুনে আমি অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”
“মনে হলো তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”
আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম,
“আছে তো। ”

কথাটা শুনেই উনি গাড়িটা থামিয়ে দিলেন। আমি উনার দিকে সোজা ফিরে বললাম,
“কি হলো গাড়ি থামালেন কেন?”
উনি রাগি চোখে তাকিয়ে বললেন,
“মিথ্যা বলছো কেন। আমি জানি তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই। ”
আমি এইবার কোমড়ে হাত দিয়ে রাগি চোখে তাকিয়ে বললাম,
“জানেনই যখন তাহলে জিজ্ঞেস করলেন কেন?”
শান হাফ ছেড়ে বললো,
“শিউর হয়ে নিলাম। ”
“তাতে আপনার লাভ? ”
“অনেক আছে পরে বলবো। বাট আমার একটা কথাই মাথায় আসছে না যদি তোমার বয়ফ্রেন্ড না থাকে তাহলে তুমি ফুলসজ্জার রাতে মিথ্যা কথা বললে কেন যে তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে? ”
আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,
“আপনিও তো বলেছিলেন আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে তো আমি কেন ছোট হবো আপনার কাছে তাই আমি বলেছি আমার বয়ফ্রেন্ড আছে দ্যাট’স ইট। ”

আমার কথা শুনে শান খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো তারপর আবার গাড়ি স্টার্ট দিলো,
“তুমি না কখনো শুদ্রাবেনা। ”

আমি একদৃষ্টিতে উনার হাসির দিকে তাকিয়ে ছিলাম কি সুন্দর করে উনি হাসে। উনার এই হাসির প্রেমেই আমি বারবার পড়ি। ছেলেদের হাসি এতো সুন্দর হওয়া উচিত নয়। আমি চোখ সরিয়ে উনাকে মুখ ভেঙিয়ে বললাম,
“হুম জানি আমি। ”

উনি আবারও হাসলেন। আমি চুপচাপ বসে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। অনেকরাত হয়ে গেছে সেটা বাহিরের দিকে তাকালেই বুঝা যায়। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি হনহনিয়ে পাশ কেঁটে হাইওয়ে ধরে চলে যাচ্ছে। সোডিয়াম আলোয় রাতের রাস্তাটা কোনো কাল্পনিক শহর বলে মনে হচ্ছে।গাড়ি চলছে আর আমি একদৃষ্টিতে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ করে শানকে প্রশ্ন করলাম,
“আচ্ছা আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?”

আমার কথা শুনে শান আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো হয়তো ভাবতেই পারেনি আমি এমন কিছু বলবো। আমিও নিজের প্রশ্নে নিজেই থতমত খেয়ে গেলাম একটু দম নিয়ে বললাম,
“আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবে না। ”

কথাটা বলেই আবার বাহিরের দিকে তাকালাম। হুট করে উনার বলা কথা কানে এলো,
“না নেই। ”

আমি উনার কথা শুনে অনেকটা খুশি হয়ে গেলাম। যদিও জানতাম উনি আমাকে ভালোবাসে তারপরও শিউর হতে তো ক্ষতি নেই।

আমি একটু মজা করেই বললাম,
“সত্যি?বিশ্বাস হয় না? ”
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“কেন?”
“কেন আবার দেখুন আমি সত্যিটা স্বীকার করতে ভয় পাই না ওকে এর অন্যকোনো মানে বের করবেন না। আপনি তো দেখতে শুনতে ভালোই মানে হ্যান্ডসাম, ড্যাশিং, কেয়ারিং, সুইট, কিউট আরো আছে যাইহোক মেয়েরা যেমন চায় তেমনই তাহলে আপনার গার্লফ্রেন্ড নাই এটা আমি কেন কেউই বিশ্বাস করবে না বললে।”

কথাটা আমি এক নিঃশ্বাসে বলে থামলাম।উফ বলাটা কি খুব জরুরি ছিল এখন কি ভাববে। উনি আমার দিকে পানির বোতল বাড়িয়ে দিলো।

“পানিটা খেয়ে নেও। প্রশংসা নিজের বরের করলে অথচ এমন ভাব করছো যেন অন্য কারো বরের প্রসংশা করেছো এখন সে জানলে তোমাকে শুলে চড়াবে অদ্ভুত মেয়ে তুমি। কখনো তো নিজের অধিকারটা নিজে আদায় করে নেও। ”

আমি উনার হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে নিলাম। বোতলের ছিপি খুলে কয়েক ডোক পানি খেয়ে নিলাম। আবার বাহিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। আজ হঠাৎ এতো খুশি খুশি লাগছে কেন জানি না। তবে উনি পাশে থাকলে প্রতিটা দিন আমার আনন্দময় কাঁটে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। আমি বাহিরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম,
“নিবো তো খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে নিজের করে নিবো শুধু কিছুক্ষনের অপেক্ষা।”


কিছুক্ষন পর গাড়িটা একটা শুনশান জায়গায় এসে থামল। গাড়িটা এখানে থামার আগেই উনি গাড়ির কাঁচটা তুলে দিয়েছিলেন আমি জিজ্ঞেস করতেই উনি বলেছিলেন বাহিরে খুব ঠান্ডা পড়ছে জানালা না খোলা রাখাই ভালো। উনার কথা শুনে খুব রাগ হলো তাই উনার সাথে কথা না বলে গোমড়া মুখে বসে ছিলাম। এজন্য আমি বুঝতে পারছি না জায়গাটা কোথায়।আমি উনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,
“এটা কোন জায়গা? ”
উনি নিজের সিট বেল্টটা খুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“একটু পর বুঝতে পারবে এইবার পিছন ঘুরোতো। ”

উনার কথায় আমি অবাক হয়ে বললাম,
“পিছন ঘুরবো কেন?”

উনি আর কথা না বলে নিজেই আমাকে ধরে পিছনে ফিরিয়ে দিলেন হঠাৎ আমার চোখ একটা কালো কাপড় দিয়ে উনি বেঁধে দিলেন। কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না।উনি গাড়ির দরজা খুলে আমার হাত ধরে বাহিরে বের করে নিয়ে আসলেন। তারপর উনি আমার একটা হাত ধরলেন আর উনার আরেকটা হাত দিয়ে আমার কাঁধে আকড়ে ধরে আমাকে নিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছে।উনি অনেক যত্নসহকারে আস্তে আস্তে আমাকে নিয়ে হাঁটছে যাতে আমি ব্যাথা না পাই। কিন্তু উনার এহেন কর্মকান্ড দেখে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে।

“কি করছেন এসব বলবেন কি? চোখ বাঁধলেন কেন? এখন আবার কই নিয়ে যাচ্ছেন? ”
“তুমি না বড্ড কথা বলো আমার উপর বিশ্বাস নেই নাকি দুই মিনিট চুপ করে থাকো না। ”

আমি বেশ বুঝতে পারলাম উনি আর এখন কিছু বলবে না তাই আমি চুপচাপ উনার সাথে তাল মিলাতে থাকলাম। কিছুক্ষন পর মনে হলো উনি আমাকে কোলে তুলে নিলেন।আমার এখন কেমন যেন একটু একটু ভয় করছে।মনের মধ্যে অজানা শিহরণে শিহরিত হচ্ছি। আমি উনাকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,

“কি হলো কোলে নিলেন কেন?”
“তোমার ওজন কত হয়েছে সেটাই মাপছি। ”
উনার কথা শুনে আমি চোখ মুখ কুচকে বললাম,
“এভাবে কারো ওজন মাপা যায় নাকি?”
“কে বললো যায় না এই যে আমি বেশ মাপতে পারছি। দিন দিন কোনো কাজ না করে বসে থাকতে থাকতে ছোট খাটো একটা হাতির বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো। ”

উনার কথা শুনে আমি রেগে উনার বুকে একটা কিল মারলাম,
“একদম বাজে কথা বলবেন না। আমার ওজন একদম পারফেক্ট আছে আমি অনুযায়ি। ”

আমার কথা শুনে উনি আরো জোরে হেসে উঠলো। শুনশান জায়গা হওয়ার উনার হাসির শব্দটা আরো বেশি জোরে এসে কানে লাগছে। উনার এই হাসিটা আমি নিতে পারছি না। আচ্ছা উনি কি আমাকে উপহাস করছে?ভাবতেই রাগ বেড়ে যাচ্ছে। উনি হাসি থামিয়ে বললেন,

“আচ্ছা তোমরা মেয়েরা এমন কেন বলোতো কেউ তোমাদের ওয়েট বেশী বললে তোমরা এতো রেগে যাও কেন? ”

আমি মুখ ঘুরিয়ে অভিমান নিয়ে বললাম,
“এমন অবান্তর কথা বললে মানুষ কি রাগবে না। যাই হোক আমাকে নামিয়ে দিন।হাতির বাচ্চা কোলে নিতে কষ্ট হচ্ছে আপনার। আমি কারো কষ্টের কারণ হতে চাই না । ”

“কেন তুমি বলার পর কোলে নিয়েছি নাকি যে নামিয়ে দিবো। নিজের ইচ্ছায় যখন নিয়েছি যখন ইচ্ছা হবে নামিয়ে দিবো এখন বকবক না করে চুপ থাকো।”

আমি উনাকে মুখ ভেঙিয়ে চুপ করে রইলাম। তবে দেখতে না পেলেও অনুভব শক্তি দিয়ে উনি যে হাসছে সেটা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারলাম।


কিছু সময় পর মনে হলো আমরা বোটে আছি। কারণ বোট চলার স্পষ্ট আওয়াজ কানে আসছে। চারদিক থেকে প্রচন্ড হাওয়া আসছে। যেটা আমার শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। এতো শীত লাগছে বলার বাহিরে।হাত, মুখ ঠান্ডা হয়ে গেছে। একটু ভালোভাবে চারপাশটা অনুভব করতে চেষ্টা করলাম চারপাশ থেকে নদীর পানির কলকল শব্দ আসছে। তাহলে কি আমরা নদীতে।মানে এটা কি করে সম্ভব।উনাকে কি প্রশ্ন করব না থাক উনি বলবে না তারচেয়ে বরং চুপই থাকি চোখ খুললে তো দেখতেই পাবো। উনি তখনও আমাকে কোলে নিয়ে ছিলেন। হঠাৎ করে বোট চলার শব্দটা মিলিয়ে গেল। বুঝলাম থেমে গেছে। উনি আবার চলতে লাগলো। এইবার আর নিজের কৌতুহল থামাতে পারলাম না,

“কোথায় এসেছি বলবেন কি?”

উনি এবার আর কোনো কথা বললেন না। হুট করে আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন। আমার বুকের মধ্যে ডিপডিপ শব্দ করছে। উনি আমার চোখের বাধনটাও খুলে দিলেন। এতোক্ষন চোখ বাঁধা থাকার পর এখন চোখ খুলতেই কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। সামনে মৃদু আলোর দিকেও তাকাতে পারছি না। চোখ একবার খুলে আবার বন্ধ করে নিলাম। কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে হাত দিয়ে একটু ম্যাসাজ করে সামনের দিকে তাকালাম আর তাকাতেই আমার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।

আমি মাঝ নদীতে দাঁড়িয়ে আছি একটা জাহাজের উপর। আমার মাথার উপর একফালি চাঁদ উঠে আছে যেটা চারদিকে আলো ছড়িয়ে আলোকিত করছে। নদীর পানি গুলো ঢেউ খেলে যাচ্ছে। চাঁদের আলো পানিতে পড়ে পানি চিকচিক করছে।মাঝরাতে কেমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সেটা হয়তো চোখে না দেখলে বুঝা সম্ভব নয়। খুশিতে আমি হাসতেও ভুলে গেছি। চোখ বড় বড় করে শুধু চারপাশে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষন পর চোখ ঘুড়িয়ে জাহাজের ভিতর তাকাতে আরো অবাক হলাম যদিও খুব একটা আলো নেই তবে মৃদু আলোতে যেটুকু দেখা যাচ্ছে চারপাশটা ছোট ছোট ফেরী লাইট আর নানান ধরণের ফুল দিয়ে ডেকোরেশন করা হয়েছে। আমার সামনে একটা গোল টেবিল রয়েছে।আর দুইপাশে দুটো চেয়ার। টেবিলের উপর আমার পছন্দের একগুচ্ছ অর্কিড ফুল দিয়ে সাজানো।আর মাঝে একটা রেড ভেলভেট কেক রাখা আছে।একদম সবটা আমার পছন্দ মতো সাজানো। চারদিকে ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না আমি এটা চোখের সামনে দেখছি। হঠাৎ আমি সামনের দিকে তাকিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শানকে ছুতে চাইছিলাম। কিন্তু পাশে হাত দিতেই উনাকে খুজে পেলাম না। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমার বুকে ধক করে উঠলো শান কোথায় গেল। আমি দ্রুত সামনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে পাশে তাকাতেই আরো বড়সর শক খেলাম। আটোমেটিক আমার মুখ ইংরেজি “ও” বর্ণের মতো হয়ে গেল আর হাত আপনাতেই গালের দুইপাশে চলে গেল।

শান আমার সামনে হাটু গেড়ে একটা রিং নিয়ে বসে আছে। আর কতো সারপ্রাইজড হবো বুঝতে পারছি না। শান আমার দিকে তাকিয়ে খানিকটা হাসলো তারপর বলতে শুরু করল,

“আমাদের প্রথম দেখাটা একটা ম্যাজিক্যাল সাক্ষাৎ ছিল আমার জন্য জানো তো। যেই আমি সবসময় ভাবতাম বিয়ের আগে কোনো মেয়ের জন্য মনে ফিলিংস আনবো না একবারে বিয়ের পর বউয়ের সাথে প্রেম করব কিন্তু সেই প্রথম আমি আরিয়ান আরেফিন শান নিজের কথা থেকে সরে গেলাম এক পলকে যেদিন তোমায় দেখেছিলাম। এক পলকে থমকে গেছিলাম তোমার ওই ডাগর ডাগর চোখ গুলো দেখে।তোমার ঐ বাচ্চা বাচ্চা স্নিগ্ধ মুখের মায়ায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম। যতোই নিজেকে তোমার থেকে সরিয়ে নিতে চাইলাম ততোই যেন তুমি আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলে তোমার দিকে। তোমার অবুঝের মতো কথা, তোমার পাগলামি গুলো, তোমার ইচ্ছাকৃত ঝগড়া গুলো, সব থেকে যেটা বেশী কাছে টানত তোমার চোখের চাহনী যেটা দেখলে আমি আর নিজেকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরাতেই পারতাম না। আস্তে আস্তে তোমাতে আশক্ত হয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম আমাকে প্রেমরোগে ধরেছে। আমি নিজেই নিজের কাছে অবাক হলাম যে শেষ পর্যন্ত এতো মেয়ে দেখে শেষে কিনা একটা বাচ্চার প্রেমে পড়লাম। ভাবতেই প্রচন্ড হাসি পেত। তোমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করতাম সবসময়। কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দেখলে সহ্য করতে পারতাম না। ভয় হতো এত ছোট্ট বয়সে কোনো ভুল না করে ফেলো। আমি তোমাকে হারালে বাঁচতে পারবো না। সবসময় শুধু ভাবতাম কবে বড় হবে আমার পরীটা যাতে তাকে একদম নিজের মনে খাঁচায় বন্ধ করতে পারি। সময়গুলো যেন কাঁটতেই চাইতো না। তোমাকে কাছে না পেয়ে দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম তোমার জন্য। তোমার জন্য এতোদিন যাবৎ বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা জমিয়েছি শুধু তোমাকে দিবো বলে। ভেবো না এটা কোনো মোহ বরং তোমার ঐদিনের বলা আত্মীক ভালোবাসা। যেটা আজ থেকে নয় অনেক বছর আগে থেকে শুধু কখনো বলা হয়নি। আজ বলছি তোমাকে ছাড়া একটা দিন থাকা আমার জন্য কষ্টকর, তুমিবিহীন নিজেকে কল্পনা করা মৃত্যুর সমান, তোমাতে হারাতে চাই হাজার বার যেখানে হারালে কোনো আক্ষেপ থাকবে না শুধু থাকবে ভালোবাসা। হুম আমি ভালোবাসি তোমাকে। শুনতে পাচ্ছো ভালোবাসি তোমাকে আমার বেখেয়ালি।

উনার কথাটা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ আমার পাশ থেকে কিছু একটা গিয়ে বাজির মতো আকাশে ফুটে উঠল আর সেখানে বড় বড় করে লেখা উঠল

“আই লাভ ইউ এন্ড ওয়ান্ট টু বি উইথ ইউ ফর দ্যা রেস্ট অব মাই লাইফ মাই লাভ।প্লিজ গিভ মি আ চান্স টু লাভ ইউ এন্ড কিপ সেইফ ইউ অল দ্যা টাইম। জাস্ট সে ওয়ান্স ইউ আর অনলি মাইন! ”

এতক্ষন জাহাজের মধ্যে কম আলো থাকলেও হঠাৎ সব আলো গুলো জ্বলে উঠলো। আলোয় ঝলমল করছে আমার চারপাশে। আমার কিছুটা দূরত্বেই ফুল আর ছোট ছোট মোমবাতি দিয়ে লাভ সাজানো আছে আর তার ভেতরেও লেখা,
“শান লাভস সোহা। ”

আমি ছলছল চোখে শানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আচ্ছা এতো সব কিছু বাস্তবেই ঘটছে। আমি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি না তো।আমি নিজের হাতে নিজেই একটা চিমটি কেঁটে দেখলাম যে আমি ঘুমিয়ে নেই তো। না এটা স্বপ্ন না সত্যি। হঠাৎই আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। না এটা কোনো কষ্টের পানি না এটা আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিনের সাক্ষী। আমার জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান একটা মানুষকে পাওয়ার প্রাপ্তি। আমার হৃদপিন্ডটা যেন চলছেই না। একদম স্থির হয়ে গেছি। কানের কাছে বারবার শানের বলা কথা গুলো বারি খাচ্ছে আর আমি শিহরিত হচ্ছি।আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। কি বলবো বুঝতেছি না।

শান আমার হাত ধরে বললো,
“কি হলো কিছু তো বলো?”
আমি তখনও চুপ করে ছিলাম। শান উঠে দাঁড়িয়ে অস্বস্থির হয়ে বললো,
“কি হয়েছে সোহা তুমি কাঁদছো কেন?তাহলে কি ধরে নেবো তুমি আমাকে ভালো….।”
উনি সম্পূর্ন কথা বলার পূর্বেই আমি উনার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম আর কান্না করতে করতে বললাম,
“আপনি জানেন আপনার মুখ থেকে এই একটা কথা শুনার জন্য আমি কতদিন অপেক্ষা করেছিলাম।ভিতর ভিতর শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম কেন বলেননি আপনি এই কথাটা এতোদিন কেন কষ্ট দিলেন এইভাবে আমাকে দূরে রেখে। ”

কথাটা গুলো বলেই আমি উনার বুকে কিল ঘুসি দিতে লাগলাম।
“আরে আরে কি করছ মেরে ফেলবে নাকি?”
আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
“হুম মেরেই ফেলব। ”
উনি আমার কোমরে হাত দিয়ে আমাকে আরেকটু উনার কাছে টেনে নিলেন আর স্লো ভয়েসে বললেন,
“আমি তো কবেই মরে গেছি তোমার প্রেমে সুইটহার্ট। একজন প্রেমিককে আর কিভাবে মারবে তুমি।”

উনার এমন কথা শুনে আমার হৃদপিন্ডের গতি বাড়তে লাগল। আমি লজ্জায় উনার বুকে মুখ লুকালাম। উনিও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। কিছুক্ষন পর উনি বলে উঠলেন,
“আচ্ছা এভার তো কেকটা কেঁটে আমাদের নতুন জীবনের সূচনা করি কি বলো। ”

আমি উনাকে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। উনি আমার হাত ধরে টেবিলের কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর আমাকে সামনে দাঁড় করিয়ে উনি আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমার হাতে ছুরিটা দিয়ে তার উপর উনার হাত রেখে কেঁকটা কাটলেন আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুধু উনাকেই দেখতে লাগলাম। যেনো দেখা শেষই হচ্ছে না।

“কি দেখছ ওভাবে? ”
আমি উনার দিকে ফিরে উনার গলা আমার দুইহাত দিয়ে জড়িয়ে বললাম,
“আমার বরটাকে।”
“তা কি দেখছো। ”
“দেখছি আমার বরটা এতো সুন্দর কেন মাঝে মাঝে খুব ভয় হয় কখনো হারিয়ে ফেলব না তো। ”
উনি আমার ঠোঁটে এক আঙ্গুল রেখে বললেন,
“হুশ একদম বাজে কথা বলবে না তোমার বর শুধু তোমারই থাকবে। শুধু তোমারই। ”

কথাটা বলে উনি এক টুকরা কেক তুলে আমার মুখের সামনে ধরলেন আমি একটু কেক মুখে দিলাম।কিন্তু শান ইচ্ছা করে বেশ খানিকটা ঠোঁটে লাগিয়ে দিল।আমি উনার গলা ছেড়ে গাল ফুলিয়ে বললাম,
“এটা কি হলো? কেকটা খাওয়ার জিনিস লিপস্টিক লাগানোর জিনিস না। ”

কথাটা বলেই মুছতে নিবো উনি আমার হাত ধরে নিলেন আর আমাকে আবারও উনার কাছে টেনে নিলেন,
“কি সুইটহার্ট শুধু নিজে খেলে হবে? আমাকে খাওয়াবে না। ”
“খাওয়াবো তো কিন্তু আপনি আমাকে এভাবে ধরে রাখলে কি করে খাওয়াবো ছাড়ুন আমি কেক নিচ্ছি। ”
উনি চোখে মুখে দুষ্টমির হাসি নিয়ে বললো,
“উহুম আমি তো ঐ কেক খাবো না। ”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
“তাহলে? ”

কথাটা বলতে না বলতেই উনি আমার ঠোঁটটা নিজের দখলে নিয়ে নিলেন। আচমকা এমন হওয়াতে আমি পুরো জমে গেলাম।প্রথম কোনো পুরুষের এতো গভীর স্পর্শে শিউরে উঠছিলাম আমি।আমার চোখ থেকে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলছি। আমি শক্ত করে উনার কলার খাঁমচে ধরলাম।কিছুক্ষন পর উনি আমাকে ছেড়ে দিলেন।উনার চোখের দিকে চোখ মেলানোই দায় হয়ে যাচ্ছে। উনি আমার থুতনিতে উনার এক আঙ্গুল দিয়ে আস্তে করে মুখটা উপরে তুললেন আর স্লো ভয়েসে বললেন,

“এভাবে লজ্জায় লাল হয়ে গেলে হবে সবে তো মাত্র শুরু এখন থেকে এসব তোমাকে রোজ রোজ সহ্য করতে হবে সুইটহার্ট তাই অভ্যাস করে নেও। আমাকে এতোদিন কষ্ট দেওয়াটা সুদে আসলে উসুল করে নেবো। ”

আমি লজ্জা পেয়ে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলাম,
“অসভ্য লোক একটা। ”
উনি আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে বললেন,
“হুম শুধু তোমার প্রেমে। ”


আমি আর শান জাহাজের এক কোনায় বসে পা দুটো পানিতে ঝুলিয়ে বসলাম। কি ঠান্ডা পানি তারপরও কেমন অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে। শান একহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে আর উনার বুকের মাঝে আমি মাথা দিয়ে নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে আছি। আমার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ আমি।

“শীত লাগছে বেশী? পা টা তুলে বসো ঠান্ডা লেগে যাবে। ”
শানের কথা শুনে আমি বললাম,
“কিছু হবে না ভালো লাগছে আমার। ”
“তাই? ”
“হুম।”

একটু চুপ থেকে আবার বলে উঠলাম,
“আচ্ছা এই কথা গুলো বলতে এতোটা সময় নিয়ে নিলেন কেন আপনি? ”
“তো কি করতাম কতবার তোমাকে আমার কাজের মাধ্যমে বুঝানোর চেষ্টা করলাম বাট তুমি বুঝতে কই। পরে ভাবলাম বাচ্চা মেয়েকে ভালোবাসলে এমনই হয় আর অপেক্ষা করা যাবে না এভার নাহয় সরাসরিই বলে দি। ব্যস বলে দিলাম। ”

উনির কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম।উনি বললেন,
“আচ্ছা এভার কি তুমি বলা যায় না? ”
“না আমি আপনাকে আপনিই বলবো কারণ আপনি ডাকটা অনেক রোমান্টিক হয় এর আড়ালে অনেক ভালোবাসা আর সম্মান লুকানো থাকে আর আমি আপনাকে অনেক সম্মান করি বুঝলেন। ”

উনি একটু অভিমানি গলায় বললেন,
“বাবা বউটা আবার রোমান্টিকতাও বুঝে তাহলে শুধু আমার বেলাই অবুঝ হয়ে যায়। ”
আমি একটু হেসে বললাম,
“একটু অবুঝ হলে ভালো তাহলে বরের বেশী বেশী ভালোবাসা পাওয়া যায়। ”

উনি আমাকে চোখের ইশারায় মুচকি হেসে বললেন,
“আচ্ছা তাহলে ভালোবাসা শুরু করি? ”

আমি উনার ইশারা বুঝতে পেরে একটু দূরে সরে বললাম,
“এখন একদম দুষ্টমি নয়। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।”

কথাটা বলেই আমি আবারও উনার বুকের উপর মাথা রাখলাম।শানও আমাকে দুই হাতে জড়িয়ে বললো,
“ওকে তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো। ”

আমি একটু চোখ বুঝলাম।হঠাৎ শান বলে উঠল,
“একটা কথা আছে এখন ঘুমিও না। ”

উনার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালাম উনার দিকে
“কি কথা? ”

“শুধু আমি একাই ভালোবাসি বললাম তুমি কিছু বললেন না।”

“এতো কিছুর পরেও বলতে হবে বুঝি?”

“মনটা যে ব্যাকুল হয়ে আছে শুনার জন্য। ”
আমি একটু মুচকি হেসে উনার বুকে মুখ লুকিয়ে বললাম,
“ভালোবাসি। ”

“এতো আস্তে বললে যে শুনতেই পেলাম না। ”

আমি উনার বুকের উপর থেকে মুখ তুলে উঠে বসে চিৎকার করে বললাম,
“আজকের এই মূহূর্তকে সাক্ষী রেখে বলছি আমি আপনাকে ভালোবাসি শান অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি।এভার চলবে? ”

শান হেসে আমাকে উনার কাছে টেনে নিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,
“চলবে না দৌঁড়াবে। ”

উনি আমাকে উনার কোলের উপর শোয়ালেন,
“এভার ঘুমাও। ”

আমি আবার চোখ বন্ধ করলাম হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই আমি আবার চোখ মেলে তাকালাম।

শান বললো,
“কি হয়েছে? ”

আমি ধীর কন্ঠে উনার হাত আমার হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে বললাম,
“একটা কথা দিবেন?”

শান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“কি কথা? ”

আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

“যখন শহরটা ঢেকে যাবে ভালোবাসায়
তোমায় প্রতিটা ছোঁয়ায় খুঁজে পাবো তোমায়
কোনো এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় নতুন করে আবারও প্রেমে পড়ব তোমার
ফাঁকা রাস্তায় সোডিয়াম আলোর হালকা আলোতে খালি পায়ে তোমার কাঁধে মাথা রেখে হারিয়ে যাবো তোমার সাথে
তখন শুধু তুমি তোমার ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে আমার অধর ছুয়ে দিয়ে মিষ্টি করে বলো “ভালোবাসি”
তোমার শত ব্যাস্ততায় আমাদের ভালেবাসা যেন কখনো না হারায়
তুমি সবটা সময় শুধু দিবে আমায়
পুরো শহর জুড়ে ছেঁয়ে যাবে জনমানবশূন্যতায়
থাকবে না কেউ পিছু ডাকার, থাকবে না কেউ দূরে রাখার, থাকবে না কেউ আমাদের মাঝে আসার
রয়ে যাবো শুধু তুমি আর আমি
সেই শহরে লেনাদেনা হবে তোমার আর আমার
এক শহর ভালোবাসার।”

আমার কথা শুনে উনি আমার দিকে কিছুক্ষন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আর আমি উনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমার উত্তরের আশায়। হঠাৎ উনি আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে উনার কপালের সাথে আমার কপাল ঠেঁকিয়ে বললো,
“কথা দিলাম। ”
.
.
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে