এক মুঠো ভালোবাসা পর্ব-০১

0
4050

#এক_মুঠো_ভালোবাসা 💝
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::০১

বিয়ের লাল টুকটুকে বেনারসি আর গহনাঘাটি পড়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে মেহের। নিঃশব্দে চোখের অশ্রুপাত করছে।। ভেতরের আর্ত চিৎকার গুলো গলায় দলা পাকিয়ে আটকে আছে।মাঝে মাঝে শরীরটা মৃদু কেঁপে কেঁপে উঠছে।জানান দিচ্ছে মেহের কাঁদছে। চোখের দৃষ্টি সামনের দিকে যেতেই কান্নার পরিমান ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে।তার থেকে কিছুটা দূরে পড়ে আছে প্রান প্রিয় চাচার প্রানহীন দেহটা।তিনি শুধু মেহেরের চাচাই নয় প্রান ভোমরা।

মেহের চাচার প্রানহীন দেহটার দিকে দুকদম এগিয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা হাতে স্পর্শ করার আগেই চাচি এসে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে বর পক্ষের সামনে ছুড়ে ফেললো।হাতের কনুই পায়ের হাঁটুতে বেশ ব্যাথা পেল মেহের। কিন্তু কোনো বাক্য উচ্চারণ করলো না সে।ব্যাথার্থ হাতটা হাঁটুর উপর রেখে অশ্রুসিক্ত নয়নে চাচির মুখের দিকে তাকালো।যে দৃষ্টিতে মিশে আছে এক রাশ আকুতি মিনতি। কিন্তু তার এই দৃষ্টির মানে বুঝতে ব্যর্থ হলেন তিনি। দাঁতে দাঁত চেপে চেঁচিয়ে বললেন…

— “জন্মের সময় নিজের মাকে খেয়েছিস। তারপর বাবাকে।যে তোর সুখের জন্য নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়েছে।যে চাচা তোকে বুকে আগলে বড় করেছে, আজ তোর সেই চাচাকে খেয়ে ফেললি। তুই যার ঘরে যাবি, তার জীবনটা শেষ করে ফেলবি।ফের যদি তোর একটা পা এই ঘরে পড়ে, আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। দূর হ অপয়া মেয়ে।।
আপনারা এই অলক্ষনে, অপয়া, রাক্ষসী মেয়েটাকে নিজেদের ছেলের বউ করবেন”??

যে চাচি আজ সকাল অবধি আদর ভালবাসায় ভরিয়ে রেখেছে।সেই চাচির কাছ থেকে এমন ব্যবহার আশা করি নি মেহের।তবে তার কথা তিল পরিমাণ মিথ্যা নয়।মেহেরের জন্মের সময় তার মা মারা যায়। মেহেরের কষ্ট হবে বলে তার বাবা আর দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। খুব কষ্ট করে তাকে বড় করার চেষ্টা করছে।প্রায় বছর দশেক আগে কার এক্সিডেন্টে মেহেরের বাবা মারা যান। তখন থেকে অঢেড় ভালোবাসায় লালন পালন করে চাচা চাচি। কোনো কিছুতে কমতি রাখে নি।
আজ ছিলো মেহেরের বিয়ে। ধুমধাম করে বিয়ের‌ আয়োজন করা হয়। বরপক্ষ যৌতুক হিসেবে বিশ লক্ষ টাকা দাবী করেন। মৃত্যুর আগে মেয়ের নামে অনেক সম্পত্তি রেখে গেছেন মেহেরের বাবা । চাচাজান বিয়ের টাকা তুলতে শহরে গিয়েছিলেন।টাকা নিয়ে ফেরার পথে ডাকাতরা টাকা নেওয়ার চেষ্টা করে।যখন তিনি টাকা দিতে নাকোচ করে, তখন ছুড়ি দিয়ে..!

শরীরের শক্তি অবশ হয়ে আসছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু সেই ক্ষমতা টুকু তার নেই। শোনা গেল আরেকটি কর্কট কন্ঠস্বর..

— “না .!! না..!! এই অপয়া মেয়েটাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমরা বিপদে পড়বো নাকি। জলিল সাহেব আমাদের কাছ থেকে এই বিষয়গুলো লুকিয়ে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেজন্য আজ তার এই অবস্থা।তাই তো বিশ লক্ষ টাকা যৌতুক চাওয়ার সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেছিলো।যদি আগে জানতাম এই মেয়ে রাক্ষুসী।তাহলে বিশ লক্ষ কেন বিশ হাজার কোটিতেও ঘরে তুলতাম না। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া বিয়ের আগে মেয়েটার আসল রুপ চিনিয়ে দিয়েছেন।এই অপয়া মেয়েটার দৃষ্টিতেও অন্যর ধ্বংস লুকিয়ে আছে।নিজেদের জীবন বাঁচাতে চাইলে এখান থেকে চলে আসো সবাই”।।

কথাগুলো বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলেন তিনি।যেন বেরিয়ে গেলে জীবনের মতো বেঁচে যাবে তিনি। মুহুর্তের মধ্যে বিয়ের আমেজ ভরা বাড়িটা কান্নার রোলে ছেয়ে গেল।মেহের কোনোরকম হামাগুড়ি দিয়ে চাচির পা বুকে জরিয়ে ধরলো।।

— “চাচি তুমি তো জানো , এই পৃথিবীতে তোমরা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তাড়িয়ে দিলে কোথায় যাবো আমি”।

— “জানি না কোথায় যাবি তুই।তবে এই বাড়িতে তোর কোনো জায়গা নেই।যেখানে পারিস চলে যা।। প্রয়োজনে মরে যা”।

মেহেরের কথায় গললো না তার পাষাণ হৃদয়।পা ছাড়িয়ে চলে গেলেন তিনি। ক্লান্ত চোখে চাচির যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালো মেহের।

_________________
উজ্জল আকাশের কোণে কালো মেঘেরা ভর করেছে। দুপুরের সময় ছিলো সূর্যের আলোর খেলা আর সন্ধ্যার আগেই তা স্তরীভূত মেঘে রুপান্তরিত হয়েছে। আকাশে বিদ্যমান কালো মেঘগুলো সামান্য উঁচু ঢিবির উপর দাঁড়ালে ছোঁয়া সম্ভব।কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে বৃষ্টিতে পরিনত হলো সেগুলো। একটু সময়ের ব্যবধানে গ্ৰামীন রাস্তা ঘাট পিচ্ছিল হয়ে গেছে।ছোট ছোট গর্ত গুলো পানিতে ভরে ছোট ছোট খাদের রুপ ধারণ করেছে। বৃষ্টির পানির প্রভাবে মেহেরের শাড়ি কাঁদার সাথে লেপ্টে আছে।সেই কখন থেকে বাবা মায়ের কবরের মাঝে শুয়ে আছে। দুই কবরের মাঝে স্বল্প ফাঁকা জায়গায় আরো একটি কবর তৈরি করে সেখানে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে তার।তাহলে আর কেউ বিন্দু পরিমাণ বাজে কথা বলতে পারবে না।

মাগরিবের আযান কান পর্যন্ত পৌঁছালে চোখ মেলে তাকালো মেহের। চারদিকে অন্ধকার বিরাজ করছে। এতোক্ষণে খেয়াল করলো, বৃষ্টির পানিতে ভিজে আছে । বৃষ্টিতে একটু ভিজলেই ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ধাত আছে তার। হেঁটে আম গাছের নীচে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে স্লীপ করে ধপাস শব্দে নীচে পড়ে গেল মেহের। আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো সে..

— “বাবা ..!!মা.. তোমরা এতো নিষ্ঠুর কেন?? কেন এই স্বার্থপর পৃথিবীতে আমাকে একা রেখে গেলে? কেন যাওয়ার সময় আমাকে সাথে করে নিয়ে গেলে না।? কেন আমাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিলে।আমি সত্যিই অপয়া, সবকিছু ধ্বংস করে দেই। ভেবেছিলাম আকাশের মেঘগুলো আমার কষ্টের সঙ্গি হতে এসেছে। কিন্তু না এরা আমাকে তোমাদের কাছ থেকে আলাদা করতে এসেছে।এরা পারবে না আমাকে তোমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে। তোমাদের কাছে চিরতরে চলে আসছি আমি। আসছি…

দুহাতে শাড়িটাকে ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিজের গন্তব্যে ছুটে চলেছে মেহের।একটু পরপর গাল থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু গুলো ক্লান্ত হাতে মুছে নিচ্ছে। ইচ্ছে এই অসহায় জীবনটার সমাপ্তি টানা।বেঁচে থাকলে হয়তো অন্যর জীবনের ধ্বংসের কারন হয়ে দাঁড়াবে সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছালো নদীর পাড়ে।।

নদীর তীরে আঁচড়ে পড়া ঢেউ গুলো মন দিয়ে দেখছে সে। বিশাল বিশাল ঢেউগুলো এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে দিতে সক্ষম। চারদিকে ঢেউ গুলো আঁচড়ে পড়ার তীব্র আওয়াজ। এখান থেকে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।হাত দুটো শূন্যতায় মেলে চিৎকার করে উঠলো সে…

— “হে শীতলক্ষ্যা নদী,, তুমি তো আমার শৈশবের একমাত্র সাক্ষী । বাবা মাকে হারিয়ে প্রতিদিন তোমার কাছে এসে নিজের দুঃখগুলো ভাগ করে নিতাম।আজ আমি শৈশবের চেয়েও বড় অপরাধী।আরো একবার আমার কষ্টগুলো তুমি ভাগ করে নাও।আমাকে পৌঁছে দাও আমার প্রিয়জনদের কাছে।যেখানে গেলে কেউ আমাকে অপয়া, অলক্ষী, রাক্ষুসী বলে কষ্ট দিবে না”।

মেহেরের কথাগুলো ঢেউয়ের গর্জনের সাথে ধাক্কা খেয়ে কয়েকবার প্রতিধ্বনি আওয়াজ তৈরি করল।। কিছুক্ষণ পর আবার মিলিয়ে গেল বাক্য ধ্বনি গুলো।

মেহের চোখ মুছে নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে কেউ একজন তার বাহু চেপে ধরে থামিয়ে দিল। বারবার তার লক্ষ্য বাঁধা আসায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল সে।তখন গভীর ভাবে নিজের পাশে অন্য একজনের উপস্থিতি অনুভব করল ।ঘাড় বাঁকিয়ে একবার তাকালো অচেনা মানুষটার মুখের দিকে । অন্ধকারের মাঝে ব্যর্থ হলো মানুষটিকে চিনতে । মানুষটির থেকে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে সে।মুখ থেকে ক্রমাগত তিনটি শব্দ বের হচ্ছে,,” ছাড়ুন আমাকে, ছাড়ুন”।।
পরক্ষণেই নিজের গালে চড়ের আঘাত অনুভব করলো মেহের। সাথে সাথে থেমে গেল তার ছোটাছুটি।গালটা প্রচন্ড জ্বলে যাচ্ছে।
সকালে অনেক কষ্টে দুই লোকমা খাবার খেয়েছে। শরীরটা ক্রমশ দূর্বল হয়ে আসছে।ক্লান্ত শরীর নিয়ে চোখ খুলে রাখার মতো ক্ষমতা নেই মেহেরের।নয়নজোড়া ঢেকে গেল গভীর অন্ধকারে। ভয়ংকর নিঃস্তব্ধতা এসে গ্ৰাস করলো মেহেরের মন মস্তিষ্ককে।। আস্তে আস্তে হেলে পড়লো সে। কানের কাছে তখন অস্পষ্ট স্বরে বলছে ,, “এই যে মিস: শুনছেন”??

চলবে…🎀🎀
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন,, ধন্যবাদ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে