#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_১৭
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ
সময় গড়াল আরো একমাস। মেহু হোস্টেল ছেড়ে বাসায় ফিরে গিয়েছেও একমাস হলো।আর এই একমাসে তার শারিরীক, মানসিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটল। চোখের নিচে কালি বসেছে৷ এমনকি খাওয়া-দাওয়া না করার ফলে আগের থেকে শুকনোও দেখাল মুখ। জ্যোতি অবশ্য এই একমাসে অনেকবারই এই বাসায় এসেছে, মেহুর সাথে দেখা করে গিয়েছে। অবশ্য এর মাঝে মেহেরাজের সাথেও সাক্ষাৎ হয়েছে অসংখ্যবার। সব মিলিয়ে মেহেরাজের প্রতি সে অল্প দুর্বলতাটা এখন দৃঢ় হলো যেন। মানুষটার কথা, কথা বলার ভঙ্গি, আচার আচরণ, চলাফেরা সবতেই যেন একরাশ মুগ্ধতা কেবল। মানুষটাকে দেখলেই বোধহয় আজকাল হৃদয়ের ভেতর প্রেমানুভূতি অনুভূতি হয়। কেমন কেমন যেন করে উঠে ভেতরটা। কিন্তু সেসবের কিছুই প্রকাশ পায় না বাহিরে। কেবল প্রকাশ পেল বিয়ের প্রস্তাবে সে রাজি এইটুকুই। তিনদিন আগেই দাদী যখন ফের জিজ্ঞেস করেছিল বিষয়টা নিয়েই তখনই রাজি হওয়ার এই মতামতটা জানিয়েছিল সে। আর তারপর থেকেই মেহেরাজদের বাসাতে একবারও পা ফেলেনি। এমনকি মেহুর সাথে আলাপ করতেও আসেনি। কোথাও যেন সমুদ্রসমান অস্থিরতা আর লজ্জ্বারা জড়ো হয়েছে খুব করে। কিন্তু অবশেষে আজ আসতেই হলো মেহুর কল পেয়েই। এসেই মেহুর মুখচোখের এই বেহাল দশা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনেক বুঝিয়ে দুপুরের খাবারটা খাইয়ে চলে যাবে ঠিক সেসময়ই দেখা মিলল মেহেরাজের। জ্যোতি আড়চোখে একবার তাকিয়েই দৃষ্টি সরাল দ্রুত। যেন হৃৎস্পন্দন খুব দ্রুতভাবে বাড়ল। হৃদয়ের ভেতর যেন কেমন একটা অনুভূতি হলো তার। আর সে অনুভূতিকে লুকায়িত রাখার জন্যই কিছু না বলে বের হতে চাইলে মেহেরাজ বলে উঠল,
“কি আশ্চর্য। তুই আমায় দেখে এমনভাবে নজর সরালি কেন? আবার লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়েও যাচ্ছিস? কি ব্যাপার? প্রেমে ট্রেমে পড়ে গেছিস নাকি আমার? ”
জ্যোতি শ্বাস ফেলল কেবল।সে কথা না বললেও যে মেহেরাজ আগ বাড়িয়ে কিছু না কিছু বলবেই তা যেন সে জানতই।অন্তত এই এক মাসের অভিজ্ঞতায় সে ভালো করেই জানত। কিন্তু এমন কিছু যে শুনতে হবে সেটা ভাবেনি সে। হতাশ হলো যেন। পিছু ঘরে মেহেরাজের দিকে একবার তাকিয়েই শুধাল,
“আমার কি আপনার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে উচিত মেহেরাজ ভাই?”
মেহেরাজ ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,
“ ছিঃ!একটা ছেলের দিকে তুই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে যাবি কেন তুই?”
“তাহলে নিশ্চয় নজর সরিয়ে নেওয়া উচিত। তাই না? ”
মেহেরাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বুকে হাত গুঁজে জ্যোতির দিকে তাকিয়েই বাঁকা হেসে বলল,
“কিন্তু তোর নজর সরানো তো লাজুকভঙ্গিতে ছিল। সমস্যা তো ওখানেই।”
জ্যোতি যেন ধরা পড়া গেল। অস্বস্তি হলো ভীষণ করে। তবুও অস্বস্তি চেপে রেখে জিজ্ঞেস করল,
“ মানে?”
মেহেরাজ ফের বাঁকা হাসল। জ্যোতির দিকে কিছুটা ঝুকে ফিসফিস করে শুধাল,
“মানে অবশ্য বেশি কিছু নয়। শুধু তোর চোখের দৃষ্টিতে প্রেমপ্রেম ভাব দেখা যাচ্ছে এইটুকুই। ”
জ্যোতি ভ্যাবচ্যাঁকা খেয়ে গেল। সত্যিই চোখের দৃষ্টিতে প্রেমপ্রেম ভাব ফুটে উঠছে? সত্যি সত্যিই কি তার হৃদয়ের ভেতরের ধড়পড় করা অনুভূতিটা চোখের দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয় উঠছে?তাহলে যে এরচেয়ে লজ্জ্বার আর কিছু হয় না। মুহুর্তেই দৃষ্টি সরাল অন্যত্র।জিজ্ঞেস করল,
“ হ্হু? স্ সত্যি? ”
“মিথ্যে কেন বলব আমি? ”
জ্যোতি পালাতে চাইলে এবারে। দ্রুত চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে বলে উঠল,
“ আমি আসছি। ”
চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেও যেতে পারল না জ্যোতি। তার আগেই হাত চেপে ধরল মেহেরাজ। বলল,
“উহ!তুই প্রেমপ্রেম দৃষ্টিতে তাকাতেই পারিস। নো নিষেধাজ্ঞা!শত হোক তোরই তো উডবি! তাই না? ”
জ্যোতির জবাব এল না অবশ্য। সে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকল কেবল। মেহেরাজ দু পা বাড়িয়ে জ্যোতির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
“তবে আমি ভেবেছিলাম তুই আমার প্রেমে পিছলে পড়তে পড়তে যুগ কাটিয় দিবি। কিংবা আমি বুড়ো হয়ে যাব তোকে বউরূপে পেতে পেতে।কিন্তু এদিক থেকে তুই কিন্তু খুব কম সময়ই নিয়েছিস জ্যোতি। আমাকে আর ভালোবাসাহীনতায় বুড়োও হতে হলো না বল? ”
কথাটুকু বলেই জ্যোতির হাত ছাড়তেই জ্যোতি দ্রুত পা বাড়াল। যেন পালিয়ে বাঁচল সে৷ মেহেরাজ সেদিক পানে তাকিয়ে হাসল শুধু। পা বাড়িয়ে মেহুর রুমের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ কানে মেহুর কান্নার স্বর। সাথে কিছু কথা,
“ কেন এমনটা করলের সাঈদ ভাইয়া?আমায় ভালোবাসলে কিইবা ক্ষতি হতো বলুন? কি এমন ক্ষতি হতো? এইটুকু ভালোবাসা কি দেওয়া যেত না আমায়? আমি বাঁচতে পারছি না এই ভালোবাসাহীন জীবন নিয়ে। বেঁচে থাকতে পারছি না। আপনাকে চাইলেও আমি ভুলতে পারছি না। কেন পারছি না? এতোটা ভালো আপনাকেই কেন বাসলাম আমি? আমার জীবনটা বিচ্ছিরি হয়ে গেছে!বিচ্ছিরি হয়ে গেছে!শুধু আপনাকে ভালোবেসে। ”
মেহেরাজ সবটাই শুনল দরজার বাইরে তাকিয়ে। মুহুর্তেই যেন সবটাই স্পষ্ট হয়ে উঠল তার কাছে। মেহুর এমন গুটিয়ে যাওয়া, কান্না, গুমড়ে মরা, অসুস্থ হওয়া, জীবনের অনিয়ম সবকিছুর কারণই যেন একমুহুর্তেই স্পষ্ট হয়ে উঠল। মুহুর্তেই তপ্তশ্বাস ফেলল সে৷ তারই একমাত্র বোন কষ্টে গুমড়ে মরছে অথচ সে এই কারণটা টেরই পেল না। একবারও বুঝে উঠল না তার এই ছোট বোনটি তারই কাছের বন্ধুটিকে ভালোবেসে এতোটা কষ্ট পাচ্ছে?মেহেরাজ আগ বাড়িয়ে মেহুর কাছে গেল না আর। সিদ্ধান্ত নিল সাঈদের বাবার সাথে কথা বলবে।সে অনুযায়ী পরদিন সাঈদের বাবার সাথে সাক্ষাৎ ও করল সে৷ আর সে সাক্ষাৎয়ে সাঈদের বাবার থেকে যে তথ্যটি পেয়ে সে চমকাল তা হলো সাঈদও মেহুকে ভালোবাসে। ছোটবেলা থেকেই বাবা-ছেলে বন্ধুস্বরূপ থাকার ফলে সাঈদ সবকিছুই শেয়ার করত বাবার সাথে। সেভাবে এই বিষয়টাও শেয়ার করেছিল বাবার সাথে। কিন্তু বিষয়টা যে এই পর্যায়ে এসে ঠেকেছে তা তিনি বুঝতেই পারেননি। সে সাথে অবাক হলেন মেহুর এই বেগতিক অবস্থার কথা শুনেও। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলের বিয়েটা খুব শীঘ্রই সারবেন। তাও মেহুর সাথেই!
.
সাঈদ তখন বিছানায় বসা।এক হাতে একটা ড্রিংকের গ্লাস অন্য হাতে মেহুর হাস্যোজ্জ্বল একটা ছবি। ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসার পরও ফিরিয়ে দেওয়াটা বোধহয় আরো বেশি যন্ত্রনার। ঠিক সে যন্ত্রনায় বুকের ভেতর জ্বলন অনুভব করল সাঈদ। একনজরে মেহুর হাস্যোজ্জ্বল ছবিটার দিকে চেয়েই তপ্তশ্বাস ফেলল।ঠিক সেসময়ই ঘরে ডুকলেন সাঈদের বাবা রায়হান সাহেব৷ ছেলের এহেন দশা দেখে ভ্রু জোড়া খানিকটা কুঁচকেই চাইলেন৷ পর মুহুর্তে সে দৃষ্টি শীতল করে নিয়ে পাশে বসলেন। গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
“ সবাই তোমার মা হয় না সাঈদ! আর সব প্রেমিকই তোমার বাবার মতো কষ্ট পায় না।মেয়েটাকে তুমি ভালোবাসো, সেও তোমায় ভালোবাসে৷ তবে কিসে এত বাঁধা? ”
সাঈদের মাঝে ভাবাবেগ দেখা গেল না যেন। আগের মতোই তাকিয়ে রইল মেহুর সে হাস্যোজ্জ্বল ছবিটায়। রায়হান সাহেব তা দেখে মৃদু হাসলেন। ফের বললেন,
“আমি সবার আগে এটা মান্য করি যে ভালোবাসা মানেই বিশ্বাস সাঈদ। যাকে ভালোবাসো তাকে বিশ্বাস করো না এটা বলবে না নিশ্চয়?”
সাঈদ এবারে তাকাল বাবার দিকে। বলল,
“বিশ্বাস যদি ভেঙ্গে যায় আব্বু?যদি তোমার মতোই পরিণতি আমারও…”
কথাটা বলা শেষ করতে পারল না সাঈদ। তার আগেই তার বাবা বলে উঠল,
“আমি এইটুকু নিশ্চিত যে মেয়েটা তোমার বিশ্বাস ভাঙ্গবে না কোনদিন। এতোটা ভালোবাসার পর কেউ বিশ্বাস ভাঙ্গতে পারে না সাঈদ। আর তুমি যদি তোমার মায়ের কারণেই এমনটা ভেবে থাকো তাহলে বলব যে তোমার মা আমাকে কখনো ভালো বাসেইনি। শুধু বেটার অপশন ভেবে আমাকে বিয়ে করেছিল সে। পরমুহুর্তে যখন নিজের মনকে কিংবা অনুভূতিকে গুরুত্ব দিল তখন খুব বেশি দেরি হয়ে গেল।দেরি হলেও অবশ্য সে মনের ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দিয়েছিল শেষমেষ। মাঝখান থেকে আমি আর তুমি তার জীবনের একটা খুচরো অংশ হয়ে গিয়েছিলাম আরকি। তবে সে যদি আমায় ঠকিয়ে, লুকিয়ে নিজের মনের ইচ্ছে পূরণ না করে আমায় একবারও জানাত? আমি কিন্তু কখনোই তাকে নিষেধ করতাম না সাঈদ। ”
“ তুমি কখনো দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা ভাবলে না কেন আব্বু? যে তোমায় ঠকিয়েছে তার বিরহে সারাজীবন নষ্ট করার কি মানে হয় বলো?”
তার বাবা মৃদু হাসল। উত্তরে বলল,
“তুমি যাকে ভালোবাসবে তাকে তুমি কখনো ছোট ভাবতেই পারবে না সাঈদ। সে হাজারটা দোষ করলেও তোমার কাছে তখন সে দোষগুলো জঘন্য বলে অনুভব হবে না। তুমি তাকে চাইলে ও খারাপ ভাবতে পারবে না। এটাই সত্য!আর এই কারণেই তার সাথে বিচ্ছেদের এত বছর পরও আমি তাকে অন্য কারো সামনে অপমানিত হতে দেখতে পারি না, খারাপ বলতে পারি না, অসম্মান করতে পারি না।হয়তো তার দিক থেকে সে ঠিকই ছিল সাঈদ।সেসব বাদ দাও বরং, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শুধু তোমাকে জানানোর অপেক্ষায় ছিলাম। ”
সাঈদ ভ্রু কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,
“কি সিদ্ধান্ত?”
জবাব এল,
“তোমার বিয়ের সিদ্ধান্ত।বয়স হলো তো আমার বলো?এই বাসায় যা তোমার সাথে রাতে কিংবা সকালে ব্রেকফাস্টের সময় দু চারটে কথা বলা। দিনশেষে কেমন ফাঁকা ফাঁকা না এই বাসাটা বলো?তাই ভাবলাম তোমার বিয়েই উত্তম সিদ্ধান্ত!”
সাঈদ হাসল। কৌতুক স্বরে বলে উঠল,
“ধুরর!মজা করছো আব্বু?আমি যে বিয়ের বিরুদ্ধে তুমি জানো না তা?”
গম্ভীর স্বরে বলল তার বাবা,
“মজা না সাঈদ। এটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। আশা রাখি তুমি তোমার আব্বুর সিদ্ধান্তে অমত করবে না? ”
সাঈদ মিনমিনে চাহনিতে চাইল। ছোটবেলায় মা চলে যাওয়ার পর থেকে বাবাই তার সব। বলা চলে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের লোকটি তার বাবা। যাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, সবচেয়ে বেশি সমীহ করে চলে সে হলো তার বাবা। তার বাবা তার বাবার আগেও তার বন্ধু। আর তাই তো এই বাবাকে মায়ের কারণেই এতোটা কষ্ট পেতে দেখেছে বলেই সে তার মাকে এতোটা ঘৃণা করে! কিন্তু এই এতো ভালোবাসার, এত সমীহ করে চলা মানুষটির কোন সিদ্ধান্তকেই সে এই পর্যন্ত না করেনি। তাইতো সরাসরি না বলতে পারল না। ক্লান্ত স্বরে শুধাল,
“ বিয়ের এত তাড়া কেন আব্বু?সময় তো আছেই বিয়ের জন্য। তাই না? ”
“ কারণ তোমার বিরহে আমার পূত্রবধুর জীবনটা কষ্টময় হয়ে উঠেছে দিনের পর দিন। আমি চাই না সে তোমার বিরহে আর কষ্ট পাক। ”
সাঈদ ভ্রু উচাল। জিজ্ঞেস করল,
“ আবার মজা করছো?বিয়ে না করতে চাইলে কি জোর করে দিবে তুমি?”
“ একদমই নয়।যদি মনে করো তোমার জোর করে বিয়ে দিচ্ছি তো জোর করেই বিয়ে দিচ্ছি ধরে নিতে পারো।তবে বিয়েটা খুব শীঘ্রই হচ্ছে সাঈদ। আমি খুব শীঘ্রই বাসাটা পরিপূর্ণ দেখতে চাই।”
সাঈদ ভ্রু কুঁচকাল। কপাল কুঁচকে বলে উঠল,
“এসবের মানে কি আব্বু? আমি তো আর ছোট নেই যে জোর করে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিবে আমার উপর। ”
“তুমি খুব ভালো করেই জানো এটা চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত নয়৷ চোখ বুঝে মনকে একবার জিজ্ঞেস করো বরং। উত্তরটা আশা রাখি তুমি পেয়ে যাবে সাঈদ। ”
এটুকু বলেই তার বাবা বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আর একটাও কথা না বলে দ্রুত রুম ছেড়ে বের হলো সে।অপরদিকে সাঈদ চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল কেবল। হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন? হঠাৎ এসবই বা কেন বলে গেল তার বাবা?
.
পার হলো আরো দিন পনেরো। আশ্চর্যজনকভাবে এই পনেরো দিনে জ্যোতি যতবারই মেহেরাজদের বাসায় এসেছে বা মেহেরাজের সাথে দেখা হয়েছে ততবারই মেহেরাজ তাকে এড়িয়ে গিয়েছেে।আগে যেমন নিজ থেকে কথা বলত এই পনেরো দিনে ছেলেটি একবারও তার সাথে কথা বলেনি নিজ থেকে।বরং জ্যোতি বলতে চাইলেও এড়িয়ে গেছেই কেবল। জ্যোতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।মেহেরাজকে সামনে পাওয়া মাত্রই স্পষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠল,
“ বিয়েতে হ্যাঁ বলার পরই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন কেন মেহেরাজ ভাই?এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন আমাকে?”
মেহেরাজ অন্যদিকে তাকাল। গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল,
“ বলতে ইচ্ছুক নই আমি। ”
জ্যোতি চাপা শ্বাস ফেলে মেহেরাজের দিকে তাকাল। তার কেন জানি মনে হচ্ছে মেহেরাজ বিয়ের প্রস্তাবটা ভুলবশতই দিয়েছিল হয়তো। আর এখন সে বিয়ের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলে দেওয়াতে সে ভুলটা হয়তো বুঝতে পেরেছে। আর তাই হয়তো মনে মনে পস্তাচ্ছে বিয়র প্রস্তাবটা দিয়েছে বলে। কিন্তু তাই বলে এড়িয়ে যাওয়ার কি আছে? সরাসরি বলে দিলেই তো হতো যে সে জ্যোতিকে বিয়ে করতে চায় না। জ্যোতি কি জোর করবে তাকে? এসব ভেবেই জ্যোতি জিজ্ঞেস করল,
“আমায় বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার এই সিদ্ধান্তটা নিয়ে আপনাকে কি এখন পস্তাতে হচ্ছে মেহেরাজ ভাই? আপনি কি কোনভাবে ফিরিয়ে নিতে চাইছেন প্রস্তাবটা? সমস্যা নেই। আপনি বললেই আমি দাদীকে নাহয় ব… ”
মেহেরাজের চোয়াল শক্ত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ কি সমস্যা তোর?”
“ হ্ হু?আমার মনে হচ্ছিল আপনি বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার এই সিদ্ধান্তটা নিয়ে সাফার করছেন। তাই জিজ্ঞেস করে নেওয়াটা ভালো নয়?কনফিউশন দূর করা উচিত নয়?
মেহেরাজ বুকে হাত গুঁজে দাড়াল। ভ্রু উঁচিয়ে বলে উঠল,
“ কনফিউশনের মতো কিছু তো আমি দেখছি না। বিয়ে তোকেই করছি আমি। আর কিছু? ”
“ আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি ঝোকের বশে প্রস্তাবটা দিয়ে এখন সাফার করছেন।”
মেহেরাজ বিরক্ত হলো যেন। রাশভারী কন্ঠে কপাল কুঁচকে বলল,
“একই কথাই বলছিস বারবার৷ আশ্চর্য! ”
জ্যোতি আকস্মিক প্রশ্ন ছুড়ল,
“আপনি কি রেগে আছেন মেহেরাজ ভাই?”
“রেগে থাকার মতো কিছু করেছিস কি তুই?”
জ্যোতি বিরক্তিস্বরে কথা শুনে মুখ কালো করে। নিঃশ্বাস ফেলে নিষ্প্রই কন্ঠে বলল,
“আপনি বোধহয় আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয় মেহেরাজ ভাই। এতক্ষন ধরে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আসছি!”
কথাটা বলেই পিঁছু ঘুরল চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ঠিক তখনই মেহেরাজ গম্ভীর গলায় বলল,
“দাঁড়া!”
ঘাড় বাকিয়ে তাকাল জ্যোতি৷ অস্ফুট স্বরে বলল,
“হ্ হু?”
মেহেরাজ লম্বা শ্বাস ফেলল৷ কিয়ৎক্ষ চুপ থেকে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
“তোর উচিত ছিল না আমায় সাঈদ আর মেহুর বিষয়ে সবটা বলা? উচিত ছিল কিনা বল? ”
জ্যোতি বুঝতে পারল যেন সবটা। বলল,
“ হয়তো উচিত ছিল। ”
“হয়তো না, অবশ্যই উচিত ছিল এটা।আমি বারবার জিজ্ঞেস করার পরও বলিসনি তুই। ”
জ্যোতি নিশ্চুপ থাকল। কিয়ৎক্ষন পর উত্তর দিল,
“ একজন আপনার বোন, অপর জন বন্ধু।আপনার সাথে সাঈদ ভাইয়ের সম্পর্ক নষ্ট হবে… ”
“ সম্পর্ক নষ্ট হবে ভেবে জানাসনি। এটাই তো?অথচ যদি আমি এসব না জেনেই মেহু আর মেঘের বিয়েটা দিয়ে বসতাম? মেহু সারাজীবন ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়ার আপসোস করত। আর আমি ওর কাছে সারাজীবনের জন্য অপরাধী হয়ে যেতাম। ”
জ্যোতি মিনমিনে চাহনিতে চেয়ে শুধাল,
“আমি ভুল করেছি বুঝলাম।আমার কি এখন ক্ষমা চাওয়া উচিত আপনার কাছে মেহেরাজ ভাই? নাকি শাস্তি দিবেন?”
মেহেরাজ ফের চোয়াল শক্ত করল। মুখ টান টান করে উত্তর দিল,
“ মেহেরাজ নিজস্ব পন্থায় শাস্তি আদায় করে ফেলে। তোকে সেসব ভাবতে হবে, তোর এখন আপাতত একটা কাজ। মেহুকে সাঈদের সাথে বিয়েতে রাজি করাবি।”
জ্যোতি নিষ্প্রভ স্বরে উত্তর দিল,
“মেহু আপু সাঈদ ভাইকে ভালোবাসে, সেক্ষেত্রে মেহু আপু তো রাজি হবেই। কিন্তু সাঈদ ভাই?”
“সেটা তোকে না ভাবলেও চলবে।তুই শুধু মেহুকে রাজি করাবি। ”
কথাটা বলেই মেহেরাজ চলে গেল।
.
তখন রাত একটা। অথচ মেহুর চোখে ঘুম নামল না। শুধ কিছু দীর্ঘশ্বাস আর দুঃখ তার সঙ্গী হলো। এই দীর্ঘশ্বাস আর দুঃখবিলাশের মাঝেই হঠাৎ ফোন বাঁজল। সাঈদের কল। সেদিনের পর প্রায় দেড়মাস হতে চলল সে একবারও কল দেয়নি সাঈদকেে।এতদিন পর হঠাৎ কল পেয়ে অবাক হলেও কল তুলল সে। শুনতে পেল ওপাশে সাঈদের গলা,
“ভালো আছো মেহু? ”
বাবার কাছেই মেহুর শারিরীক, মানসিক এরুপ অবস্থার কথা শুনেছিল সাঈদ। তবুও সাহস করে কল করা হয়ে উঠেনি। জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠেনি কেমন আছে এই মেয়েটা। অবশেষে নিজের অস্থিরতাকে দমিয়ে না রাখতে পেরেই কল করেই বসল৷ জিজ্ঞেস ও করল। বিনিময়ে উত্তর পেল,
“আমাকে তো কল করতে নিষেধ করেছিলেন সাঈদ ভাইয়া।তাহলে আপনি কেন কল দিয়েছেন এখন? কি প্রয়োজনে সাঈদ ভাইয়া?”
“কেমন আছো তা জানতেই কল দিলাম। ”
মেহু হাসল কিঞ্চিৎ। বলল,
“ কেমন আছি তা জেনেই বা কি করবেন আপনি? ”
সাঈদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর স্বরে শুধাল,
” জানার কোন প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না?”
মেহু আক্ষেপ নিয়ে বলল,
“ আপনি তো আমায় ভালোবাসেন না। তারপরও প্রয়োজন থাকাটা হাস্যকর নয় সাঈদ ভাইয়া?”
সাঈদ উত্তর দিল না। বিনিময়ে বলল,
“শুনলাম নিজের প্রতি খুব অযত্ন করছো?খাওয়াদাওয়া কেছো া ঠিকভাবে?নিজের শরীরকে কেন কষ্ট দিচ্ছো শুধুশুধু? নিজের যত্ন নাও মেহু। ক্ষতিটা তো তোমারই হচ্ছে। তাই না?”
মেহু কেঁদে ফেলল এবারে। সাঈদের প্রতি দুর্বলতাটা যেন তড়তড় করে বেড়ে উঠল। তাই তো সে দুর্বলতার সীমারেখা আঁকতে বলল,
“ আমি আপনার প্রতি দুর্বল সাঈদ ভাইয়া। এসব বলে আর আমার দুর্বলতা বাড়াবেন না। ভালোই যখন বাসবেন না তখন দুর্বলতা কেন বাড়াচ্ছেন?”
সাঈদ কথা বাড়াল না এবারে। চাপাস্বরে বলল,
“রাখলাম তাহলে?টেইক কেয়ার মেহু। ”
#চলবে…..