🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১০
গত রাতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হওয়ায় ঠাণ্ডাটা আজ জেঁকে বসেছে। সোয়েটারের সাথে চাদরেও মানছে না। বাড়ির সবাই খুব ব্যস্ত। সবাই এদিক সেদিক দৌড়া দৌড়া করছে। লতা অনেক সকালে উঠে রান্না বসিয়েছে। আজ স্নেহর বড় ফুপু আসছে। সব কিছু ঠিক থাকলে কয়েকদিনের মধ্যেই স্নেহর বাগদান। স্নেহও সকাল সকাল উঠে পড়তে বসেছে। হালকা রোদের ছটা দেখতে পেয়েই গায়ে ভালো করে চাদর জড়িয়ে পুকুর পাড়ে গেলো রোদের মাঝে বসে পড়বে। সকাল সকাল এতো চেচামেচিতে নাবিলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে উঠে আড়মোড়া ভেঙ্গে বাইরে বের হয়। একটু হেঁটে সামনে গিয়ে এক পাশে দাড়িয়ে পকেটে হাত গুঁজে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে।
“নাবিল ভাইয়া!” কোমল মেয়েলি কণ্ঠের ডাক কানে আসতেই নাবিল কণ্ঠের মালিক কে টা বুঝে গেলো। এই কয়দিনে কয়েকটা কণ্ঠ তার কাছে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। তার মধ্যে এটা একটা। পিছন ফিরে স্নেহর দিকে তাকাল। স্নেহ মুখে হাসি টেনে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ফেরা দেখে দ্রুত পায়ে একটু কাছে আসলো। একটু হেসে জিজ্ঞেস করলো “কি করছেন?”
“কিছুনা। শীতের সকাল উপভোগ করছিলাম।” নাবিল কথা শেষ করে তার দিকে ঘুরে তাকায়। স্নেহ একটু হেসে নিজের ডান হাত পিছন থেকে বের করে সামনে এনে ডাইরিটা ধরল। এক গাল হেসে বলল “এই মুল্যবান উপহারটা সারাজীবন নিজের কাছে যত্নে রাখবো।”
নাবিল কিছুক্ষন ডাইরিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। একটু বাকা হেসে স্নেহর ঘন কাল মনিতে নিজের বাদামি কঠিন মনিটা স্থির করে বলল
“বিয়ের পর অচেনা মানুষের সাথে কাটানো বিশেষ মুহূর্ত গুলো্র সমন্বয় করে আমার মুল্যবান জিনিসটার উপরে আচর কাটতে পারবে তো? ভেবে দেখ ঠিক ঠাক! তোমার চালান সেই আঁচড় আমাকে আঘাত করবে। যদি বলি আমার সেই মুল্যবান জিনিসটা আমি ফেরত চাই দিতে পারবে? মানুষের জীবনের সব থেকে কঠিন মুহূর্ত তখনি আসে যখন সে বুঝতেই পারেনা যে সে আসলে কি চায়। এখন ঠিক সেই অবস্থাতে তুমি আছো। আমি জোর করবো না। জদি বুঝতে পার কখনও তোমার কোনটা দরকার তাহলে নির্দ্বিধায় চাইবে আমি তোমাকে ফেরাব না। ”
নাবিলের কথা স্নেহর মাথার উপর দিয়ে গেলেও কিশোরী মনে যে ঠিক ঠাক আঁচড় কেটেছে সেটা কিন্তু নিশ্চিত। স্নেহর মুখের ভাঁজটাই এখন আলাদা হয়ে গেছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তার মন সেই কথার অর্থ উদ্ধার করতে নিজের ব্রেনের সাথে রীতিমত যুদ্ধ করে বিধস্ত হচ্ছে। কিন্তু তবুও সেটার অরথদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না।
————
দোতলার সেই জানালার পাশে বসে বই খুলে এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে স্নেহ। বই খুলেও কেন পড়তে পারছে না। এমন টা তো আগে হয়নি? পাশে পড়ে থাকা কাল ডাইরিটা হাতে নিয়ে এদিক সেদিক নাড়াচাড়া করছে বারবার।নাবিলের সেই শেষ কথাটার অর্থ স্পষ্ট নয়। বারবার সেই একটা শব্দ কানে বাজছে খুব করে ‘আঁচড়!’। সেই শব্দটা যে স্নেহর কোমল মনেও আঁচড় কেটেছে সেটা মোটামুটি স্পষ্ট। জীবনের বিশেষ মুহূর্ত গুলো লিপিবদ্ধ করার অভ্যাস থেকেই ডাইরিটা হাতে তুলে নিলো। সাথে পাশে পড়ে থাকা লাল কালির একটা কলমও। আজ সেই বিশেষ কথাটা রঙ্গিন কালির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতে ইচ্ছা হচ্ছে খুব করে। ডাইরিটা খুলে সাদা পাতার উপরে লাল কালির কলমটা খুব কাছাকাছি ছোঁয়াতেই আঁতকে উঠলো সে। কি লিখবে? সমস্ত অক্ষর হারিয়ে ফেলেছে সে। এই সচ্ছ কোমল জায়গায় লাল কালির আঁচড় কাঁটা যে তার সাধ্যের বাইরে। তার মন কিছুতেই এটার সায় দিতে পারেনা। তাহলে সেই বিশেষ মুহূর্তটা কি কখনও লিপিবদ্ধ করা হবে না? ভাবতেই এক রাশ মন খারাপ হানা দিলো।
তার ভাবনার মাঝেই নিচ থেকে সোরগোল কানে আসতেই জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখার চেষ্টা করলো। মিনা রান্না ঘর থেকে দ্রুত পায়ে ঘরের ভিতরে যাচ্ছে। কি মনে করে উপরে তাকাতেই স্নেহর মাথা দেখতে পেয়ে এক গাল হেসে বলল
“নিচে আয়। ফুপু আইছে।“
স্নেহ দ্রুত পায়ে নিচে দৌড় দিলো। সোফার ঘরে বড় ফুপু শেফা তার ছেলে সোহান আর মেয়ে ছায়া বসে আছে। স্নেহ ভিতরে ঢুকে সালাম দিতেই শেফা তাকে হাতের ইশারায় নিজের কাছে ডাকল। সে ফুপুর পাশে গিয়ে বসলো। শেফা তার মাথায় হাত দিয়ে হেসে বলল “মাশআল্লাহ! আরও সুন্দর হয়েছিস।”
“খালামনি কখন আসলে?” নাবিলের কথায় সবাই ঘুরে তাকায় তার দিকে। শেফা নাবিল কেও কাছে ডাকে। এক পাশে নাবিল আর এক পাশে স্নেহকে বসিয়ে তিনি তদের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
“বুবু অনেক দূর থেকে আইছেন। গোছল সারে খাবেন।” লতার কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে তিনি উঠে জান। ছায়া নাবিলের দিকে একটু তাকিয়ে বলে “ভাইয়া তুমি কবে এসেছ? আমাদেরকে জানাওনি কেন?” নাবিল মাথা নামিয়ে ফোনে দেখতে দেখতে বলল “হুট করে চলে এসেছি তাই জানাতে পারিনি।”
সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল “কি রে কেমন আছিস?” সোহান হেসে বলল “বেশ ভালো। স্নেহর বিয়ে উপলক্ষে হলেও এতদিন পর গ্রামে আসা হল।” সোহানের কথাটার প্রতিবাদ স্বরূপ নাবিল বলল “এখনো বিয়ে হয়নি। আংটি পরাবে। আর আংটি পরালেই বিয়ে হয়না।” সোহান নাবিলের কথার মানে বুঝতে না পেরে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো বুঝতে।
—————
দুপুরে খাওয়া শেষ করে সবাই আড্ডা দিচ্ছিল। সুমি নিজের ব্যাগ থেকে একটা আংটি বের করে বলল “এটা আমার শাশুড়ি আমাকে দিয়েছিলেন। তার ইচ্ছা নাবিলের বউকে এটা দিয়েই বরন করবে।” শেফা আংটিটা হাতে নিয়েই বলল “বাহ! খুব সুন্দর তো।” এমন সময় সোহান আর নাবিল ঘরে ঢুকল। ছায়া তাদেরকে দেখে বলল “ভাইয়া দেখ তোমার বউয়ের আংটি।”
নাবিল আংটিটা হাতে নিয়ে সেটার দিকে মনোযোগ দেখছে। এদিক সেদিক নাড়িয়ে ভালো করে দেখে নিলো। সুমির বাইরে থেকে ডাক আসতেই সে বাইরে চলে গেলো। নাবিল এতক্ষন আংটিটার দিকেই দেখছিল। শেফা নাবিলের দিকে তাকিয়ে বলল “আছে নাকি আংটির মালিক?” নাবিল শেফার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে পিছনের ঘুরে স্নেহর দিকে তাকিয়ে বলল “দেখ খালামনি আংটির সাইজটা একদম স্নেহর হাতের জন্য পারফেক্ট তাই না?” নাবিলের প্রশ্ন শুনে সবাই তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। স্নেহ মাথা তুলে একবার নাবিল আর আংটির দিকে চোখ ফিরিয়ে আবার নামিয়ে নিলো।
“কি বলছিস তুই?” সোহানের কথা কানে যেতেই নাবিল ঘুরে তাকায়। সোহান কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নাবিল ভ্রু কুচকে বলল “বিশ্বাস না হলে প্রমান করে দেখাচ্ছি।” বলেই স্নেহর সামনে গিয়ে তার হাত টেনে আঙ্গুলে পরিয়ে দিলো। সবাইকে অবাক দৃষ্টি তার উপর স্থির রেখেছে। স্নেহ আংটির দিকে তাকিয়ে আছে।
“আপা তোমারে মা ডাকে।” সুহার কথা শুনে স্নেহ যাওয়ার জন্য উঠে দাড়িয়ে আংটিটার দিকে তাকিয়ে সেটা খুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু আংটিটা আঙ্গুল থেকে বের করতে পারেনা। নাবিল একটু হেসে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সবাই স্নেহর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সুহা এগিয়ে এসে স্নেহর হাত উঠিয়ে আংটির দিকে তাকিয়ে বলে “এটা কই পাইলা আপা?”
“তুই যা সুহা স্নেহ আসছে।“ শেফার কথা শুনে সুহা তার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বের হতে যাবে তখনি পিছন থেকে আওয়াজ শুনে আবার থেমে গেলো।
“আংটির কথা বাইরে কাউকে বলিস না।” শেফা খুব শান্ত ভাবে সুহাকে নিষেধ করে দিলো। সুহাও বুঝে গেলো কিছু একটা হয়েছে যা বাইরে বলা যাবেনা। তাই একটু হেসে মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে গেলো। নাবিল স্নেহকে দেখছে। আর স্নেহ নিজের দৃষ্টি নত রেখেছে।
“স্নেহ।” শেফার গম্ভীর গলার আওয়াজে স্নেহ তার দিকে তাকায়। হাত দিয়ে তার কাছে যেতে ইশারা করে। স্নেহ নত দৃষ্টিতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শেফা তার হাত টেনে কোন রকমে টেনে টুনে আংটিটা খুলে নেয়।
স্নেহর দিকে তাকিয়ে বলে “কাজ সেরে আয়।” স্নেহ নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। শেফা নাবিলের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলে “আমার নাবিলের সাথে কথা আছে। একা।” মায়ের কথা শুনে সবাই বাইরে চলে যায়।
শেফাকে এই বিষয়ে এতো রিয়াক্ট করতে দেখে নাবিল খুব অবাক হয়।
“খালামনি আমি…।” নাবিল কথাটা শেষ করতে পারেনা তার আগেই বাইরে থেকে চিৎকারের আওয়াজ আসে। শেফা নাবিল দুজনি সেদিকে তাকায়। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বাইরে যায়। বাইরে এসে দেখে সাদেক মাটিতে পড়ে আছে আর সবাই তাকে ঘিরে কান্না কাটি করছে। শেফা দৌড়ে গিয়ে সাদেকের মুখের দিকে তাকিয়ে ভিত গলায় জিজ্ঞেস করে “কি হইছে?”
চলবে……।