🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৭
গ্রামের পশ্চিমের সরু পাকা রাস্তা ধরে কিছুদুর গেলেই বিশাল মাঠের দর্শন পাওয়া যায়। রাস্তা থেকে একটু নেমে জমির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয় মজুমদার বাড়ির বাগানে। বিশাল একটা পুকুর। এই মাথা থেকে ওই মাথা দেখতে বেশ কষ্ট হয়। সেই পুকুরের চারিদিকেই আম গাছ আর কিছু অংশ জুড়ে লিচু গাছ লাগান। বাগানের সাথেই একটা ছোট বেড়ার ঘর। সেখানেই বাগানের পাহারাদার থাকেন। পুকুরের এক পাশে ছোট জায়গায় শান বাঁধানো। সেখানে সম্ভবত বসার জন্য তৈরি করে রাখা হয়েছে। সেই পাশেই রাখা একটা ডিঙ্গি নৌকা। পুকুরের মাছ গুলোকে খাবার দেয়ার জন্য সেটা ব্যবহার করা হয়। গাছের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া আকা বাকা রাস্তা অনুসরণ করে হাঁটছে সাদেক, রাজ্জাক আর নাবিল। পিছনে স্নেহ আর সুহা। তার পিছনে গাছের ডাল ধরে ঝুলছে মুবিন। স্নেহর মুবিন কে দেখে মনের দশ্যি ইচ্ছা গুলো চাড়া দিয়ে উঠলেও বাবার ভয়ে আর ভদ্রতার খাতিরে দমিয়ে রাখছে। গাছে উঠার জন্য হাত পা কেমন উস খুস করে উঠছে। নিজেকে সংযত করা কঠিন হওয়ার আভাষ পেয়েই দ্রুত পায়ে পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটের উপরে বসে পড়ে। তার সেখানে বসা দেখে সুহাও মুবিন কে ইশারা করে নিজে দৌড় দেয়। মুবিনও তাকে অনুসরণ করে সেখানে গিয়ে বসে। সূর্যের আলোর ছটায় পুকুরের মাঝখানের কিছু পানি তাল মিলিয়ে সোনালি রঙ ধারন করেছে। পাড় থেকে দেখে মনে হচ্ছে তরল সোনা যেন ঝলমলিয়ে চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে। স্নেহর দৃষ্টি তাতেই আটকে যাচ্ছে বারবার। মন সেই তরল সোনার ফোটা চোখে মুখে ছোঁয়াতে চাইছে খুব করে। কিন্তু নৌকা চালিয়ে সেখানে যাওয়ার কথা বাবাকে বলবেই বা কি করে। অসহায় দৃষ্টি নৌকার উপরে ফেলে এক মনে ভাবছে। নাবিল একটু হেঁটে গিয়ে কিছু দূরত্ব বজায় রেখে তার পাশে বসলো। স্নেহর কোন ভাবান্তর হল না। নাবিল ঘাড় বেকিয়ে তার দিকে তাকাল। স্নেহকে এমন ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে বুঝতে চাইলো তার মনের ভাব। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে স্নেহ তার দিকে তাকাল। তার তাকানো দেখে নাবিল একটু অপ্রসতুত হয়ে গেলো। স্নেহ এক গাল হেসে বলল “নৌকায় চড়বেন?”
স্নেহর মুখে এমন কথা শুনে নাবিল একটু ভাবল। তারপর হেসে নিজের সম্মতি জানালো। স্নেহ আর দেরি না করে গলা তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল “বাবা নাবিল ভাই নৌকায় চড়তে চায়।”
সাদেক গম্ভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হেসে সম্মতি দিলো। স্নেহ বাবার সম্মতি পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। তার ঠোটের হাসি প্রশস্ত করে নাবিলের দিকে তাকাতেই থেমে গেলো। সে চোখ ছোট ছোট করে ভ্রু কুচকে কঠিন দৃষ্টি তার দিকে নিক্ষেপ করেছে। তার মিথ্যে বলার কারন সে বেশ বুঝতে পারছে। সেই দৃষ্টিও স্নেহর খুশির মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ালো না। সে বরং আরও ঠোঁট জোড়া চেপে হাসতে লাগলো। চোখ জোড়া নিচের দিকে নামিয়ে নিজের মনের আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো। তার সেই হাসি দেখে নাবিলও হেসে ফেললো। স্নেহ আড় চোখে নাবিলের দিকে দেখে নিয়ে এক দৌড়ে নৌকার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে হাত উঠিয়ে সবাইকে ইশারা করলো। মুবিন প্রথমে উঠলো। তারপর সুহা কে উঠালো। নাবিল উঠে পিছনে ফিরে স্নেহর দিকে তাকাল। নিজের হাত টা বাড়াতে যাবে তার আগেই স্নেহ লাফ দিয়ে তার পাশে দাঁড়ালো। নৌকাটা এক মুহূর্ত বেশ ভয়ংকর ভাবেই দুলিয়ে উঠলো। মুবিন সুহা বসে ছিল বলে তেমন ভয় না পেলেও নাবিল দাড়িয়ে থাকার কারনে বেশ ভয় পেলো এবং পিছনে হেলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই স্নেহ তার হাত টেনে ধরল। নাবিল নিজেকে সামলে নিয়ে ভ্রু কুচকে স্নেহর দিকে তাকিয়ে এক ধমক দিলো।
“এভাবে কেউ লাফ দেয়? ইডিয়েট!” উক্ত কথায় সবাই একটু ভয় পেয়ে যায়। নাবিল সবার দিকে একবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচে বসে পড়ে। স্নেহ নত দৃষ্টিতে দাড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল
“তোমাকে কেউ বসার জন্য ইনভাইট করবে না? বস!” পুনরায় ধমকে স্নেহ বসে পড়ে। মুবিন বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকার কিনারে বসে পড়ে। আনমনেে নৌকা চালাতে থাকে। সুহা নিজের দৃষ্টি এদিক সেদিক ফেরাতে লাগলো। স্নেহ তার কাঙ্ক্ষিত জায়গায় নিজের দৃষ্টি স্থির রেখেছে। নাবিল প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত। এলোমেলো হাওয়ায় পানির অস্বাভাবিক তোড়ে নৌকা হালকা ভাবে দুলেই চলেছে। নাবিল মাঝে মাঝে একটু ভয় পেয়ে নৌকার কিনারে জোরে চেপে ধরছে। মাঝে মাঝে হাওয়ার দুলুনি লাগতেই সে যেন নড়াচড়া করতেই ভুলে যাচ্ছে। একদম রোবটের মতো বসে পড়ছে। আবার একটু লজ্জাও কাজ করছে। সামনে দুইটা মেয়েকে অবিচল ভাবে বসে থাকতে দেখে সে নিজের এই ভয় টাকে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছেনা। মাঝে মাঝেই সেটা ভীষণ ভাবে চাড়া দিয়ে উঠছে। সেই সোনালি পানির কাছে পৌছাতেই স্নেহ আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। একটু ঝুকে সেই পানির ছিটা চোখে মুখে ছোঁয়াতেই নৌকা হেলে দুলে গেলো। আর নাবিল ভীষণ ভয় পেয়ে কেপে উঠলো। স্নেহ মুখ তুলে নাবিলের সেই ভয়ার্ত চেহারা চোখে পড়তেই। নাবিলের হাত শক্ত করে ফেললো।
“ভয় পাবেন না। কিছু হবে না।” আশস্তের সূরে বলল স্নেহ। কিন্তু নাবিলের সেই কথা কানের পর্দা ভেদ করতেই পারল না। সে তার হাতে রাখা স্নেহর হাতের উপরে দৃষ্টি স্থির করেছে। কিছু সময় সেখানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে উপরে চোখ তুলে তাকাতেই তার বুকের সেই দুরু দুরু কাপন কিছু সময়ের জন্য থমকে দাঁড়ালো। পুরো শরীর অনুভুতি শুন্য হয়ে গেলো। সোনালি রোদের আদুরে আলিঙ্গনে স্নেহর রুপ ঝলসে দিচ্ছে সব কিছু। তার সাথে সেই তরল সোনা নামক গলিত পদার্থ গুলো সারা মুখ ছুয়ে চিবুক বেয়ে ঝরে যাচ্ছে। কপালে কিছু চুলের গোছা এলোমেলো ভাবে লেপটে গেছে। ঘন পাপড়ির উপরে বিন্দু বিন্দু ভাবে জমে থেকে সেই তরল পদার্থ থেমে আছে ঝরে পড়ার অপেক্ষায়। প্রশস্ত করে রাখা গোলাপি ঠোঁট গুলো সোনালি বিন্দু গুলো নিজের আয়ত্তে নিয়ে যেন বিজয়ির বেশে হেসে উঠছে কেঁপে কেঁপে।
“তুমি নড়লা কেন আপা? এই জন্যই তো ভাইয়া ভয় পাইছে।” সুহার কথায় নাবিল নিজের সম্বিত ফিরে পেলো। নিজের চোখ বন্ধ করে ফেললো। চোখ খুলে দেখল স্নেহ ঠোঁট টিপে হাসছে। নাবিল ক্ষীণ হাসল। স্নেহ নাবিলের হাত ছেড়ে দিয়ে পাশ ফিরে তাকাল। নাবিল স্নেহকে দেখছে। তার মনের চঞ্চলতা ঠোটের মাঝে ফুটে উঠেছে এক অনাবিল হাসির মাধ্যমে। মেয়েটা বেশ উতফুল্য। নাবিল আসার পর থেকে তাকে কখনও মন খারাপ করে থাকতে দেখেনি। তপ্ত শ্বাস ছাড়তেই সাদেকের অস্পষ্ট সর কানে আসলো।
“ফিরে আসো ওই পাশটায় জাইতে হবে।” সাদেকের কথা শুনে মুবিন বৈঠা স্নেহর হাতে দিয়ে দিলো। কারন ফিরে যেতে হলে এখন উলটা পাশ থেকে বৈঠা চালাতে হবে। স্নেহ বৈঠা নিয়ে চালাতে লাগলো। নাবিল মুগ্ধ হয়ে দেখছে তাকে। এই মেয়ের কত রুপ। দুনিয়াতে কি কোন কাজ এমন আছে যা এই মেয়ে পারেনা। স্নেহ চোখ ফেরাতেই নাবিল কে অমন ভাবে দেখে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে নিলো। খানিক বাদেই অমন দৃষ্টির কারন উৎঘাটন করতে পেরে একটু হেসে বলল
“খুব সোজা! শিখায়ে দিলে আপনিও পারবেন।” স্নেহর কথায় নাবিল অদ্ভুত ভাবে হাসল। সেই হাসি স্নেহকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিলো। স্নেহর মুখের হাসি হাওয়ায় উড়ে গেলো। সে নিজের চোখ ফিরিয়ে নিলো। স্নেহর অবস্থা বুঝতে পেরে নাবিল নিজের হাসি আরও প্রশস্ত করে ফেললো।
অবশেষে নৌকা পাড়ে এসে দাঁড়ালো। সবাই এক এক করে নৌকা থেকে নেমে গেলো স্নেহ ছাড়া। স্নেহ নামতে যাবে তার আগে নাবিল নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো। স্নেহ একটু থমকে হাতের দিকে কিছুক্ষন দেখে নিয়ে চোখ তুলে নাবিলের দিকে তাকিয়ে বলল
“লাগবে না। আমি নামতে পারব।” নাবিল তার কথার গুরুত্ব না দিয়ে কঠিন ভাবে বলল “নিজে থেকেই ধরতে পার আর আমি বাড়ায়ে দিলেই অজুহাত!”
নাবিলের কথার মানে স্নেহ কত টুকু বুঝতে পারল কে জানে। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে হাত ধরে ফেললো। নাবিল হাসল। কিন্তু সেই হাসি স্নেহ বুঝতে পারল না। পায়ের তলায় শক্ত মাটির স্পর্শ পেতেই স্নেহ নিজের হাত টেনে নিতে চাইলো। কিন্তু নাবিল তার হাতের বাধন আলগা করার পরিবর্তে আরও শক্ত করে ধরল। স্নেহর এবার খুব অসস্তি হতে লাগলো। অস্থিরতা বিরাজ করছে। সহ্য করতে না পেরে কঠিন গলায় বলেই ফেললো
“ছাড়েন নাবিল ভাইয়া।” কোন কথা না বলে নাবিল হাতের বাধন আলগা করতেই স্নেহ তার হাত ছাড়িয়ে নিলো। নাবিল সামনে তাকিয়েই দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেলো।
কিছু সময়ের জন্য স্নেহ থেমে গেলো। আচমকাই এক অজানা অভিমান যে নাবিলের পুরো হৃদয় জুড়ে গ্রাস করেছে সেটা বুঝতে পেরেই স্নেহ থমকে গেলো। অভিমান টা বুঝলেও সেটার কারণটা স্পষ্ট হল না। কিন্তু এই অভিমান যে তীব্র ভয়ংকর কিছুর আভাষ জানিয়ে দিচ্ছে। সেই ভয়ংকর জিনিসটা হল অধিকার। তার উপরে নাবিলের কিসের এতো অধিকার যার ফলে এতো সহজেই সে তীব্র অভিমানের চাদর নিজের হৃদয়ে জড়িয়ে নিলো?
—————–
বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় বাড়ির পাশের পুকুরের পাড়ে নরম ঘাসের উপরে পা মেলে বসে আছে স্নেহ। ডাইরি লেখার অভ্যেস আছে তার। মাঝে মাঝে জীবনের কিছু মুল্যবান মুহূর্ত স্মরণীয় করে রাখতে এই ডাইরির সাদা পাতায় কলমের আঁচড়ে লিপিবদ্ধ করে নেয়। এখন মনোযোগ দিয়ে সেই কাজটিই করছে সে। কি এক বিশেষ মুহূর্ত তার মনে ধরেছে। সেটাই কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াশ চালাচ্ছে আনমনে। মাঝে মাঝে এদিক সেদিক তাকিয়ে চার পাশের পরিবেশ দেখে ভেবে নিচ্ছে কিছু একটা। খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে লিখে আবার একটু হেসে নিচ্ছে নিজের মনেই। লেখা শেষ করে ডাইরির ভিতরে কলমটা রেখে এক হাতে সেটা ধরে আর এক হাত থুত্নির নিচে আলতো করে রেখে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। টুপ করে একটা রঙ্গিন মাছ লাফ দিতেই আবার হেসে দিলো সে। সামনে একটু পা বাড়িয়ে মাথা ঝুকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো সেই মাছ। কিছু চোখে না পড়ায় আবার উঠে দাঁড়ালো। মাথাটা অনেক টা ঝুকিয়ে পানির দিকে তাকাল। বেশ খানিকটা ঝুকার কারনে পাশে গাছটা ধরতে নিতেই দৃষ্টি সামনে থাকায় সেই কাঙ্ক্ষিত গাছটা ধরতে পারল না। আর তখনি বাধল বিপত্তি।
চলবে……।