এক বসন্ত প্রেম পর্ব-০৬

0
1537

🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৬

মজুমদার বাড়ির পিছনে অনেকটা জায়গা দখল করে আছে এক বিরাট তেতুল গাছ আর তার কিছু সাথী। এই তেতুল গাছটা অনেক পুরাতন। স্বয়ং নুরুল মজুমদার নিজেও এর কোন হদিশ দিতে পারেন নি। ঠিক কোন সময়ে এর জন্ম সেটা এখন জীবিত কেউ জানেনা। গাছের তেতুল যেমন বিস্বাদ সেটাকে নিয়ে প্রচলিত কাহিনি গুলাও ঠিক তেমনই। কথিত আছে যে ওই গাছের নিচে নাকি কোন এক বৃদ্ধের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায় বীভৎস অবস্থায়। তাই সবার ধারণা ওখানে কোন অশরীরীর বসবাস। আর তার সেখানে কোন রকম মানুষের অস্তিত্ব অসহ্য। কেউ অবশ্য চোখে দেখেনি। তবুও এসব কথা গ্রামে বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সেখানে এখন কেউ যায়না। তাছাড়াও ওখানে এখন সাপের আঁকড়া। ওই জায়গাটা মুলত এক সময় মজুমদার বাড়ির অংশ ছিল। কিন্তু এমন কথা প্রচলিত থাকার কারনে সেটার সামনে মস্ত এক দেয়াল দিয়ে সেটাকে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। সেই দিকটায় এখন ঝপে ঝাড়ে ছোট খাটো জঙ্গলে পরিনত হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের গাছ চোখে পড়ে। কোন কোনটা আবার সেই দেয়াল ভেদ করে বাড়ির ভিতরেও উকি ঝুকি দিচ্ছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল দো তলার সিঁড়ির ঘরের জানালা দিয়ে সেই তেতুল গাছের ছড়ানো ডালপালার অনেক টাই হাতের মুঠোয় চলে আসে। তেতুল বড় হওয়ার পর গাছের দিকে তাকালে মনে হয় পাতার চেয়ে তেতুলের সংখ্যাই বেশি। স্নেহ কিন্তু এই কারনে খুব খুশি। কারন সে দো তলা থেকেই হাত বাড়িয়ে সেই টক তেতুল পেড়ে লবন মাখিয়ে খেয়ে ফেলে। গাছে উঠারও কোন ঝামেলা থাকে না। আর তাছাড়াও ওই জঙ্গলে গিয়ে গাছে উঠার মতো কোন সাহস করা মানেই চরম বোকামি। এভাবেই ঢের সুবিধা কেউ জানতেও পারেনা। দেয়ালের এই পাশ থেকেই মাথা উচু করে সেই তেতুল গাছের দিকে তাকিয়ে সুমি নাবিল কে সেই ভয়ংকর ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে যা সে তার ছোট বেলায় শুনেছিলো। নাবিলও নিজের মাথা উচু রেখে তেতুল গাছের উপরে বসে থাকা এক পাখির দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে মায়ের সব কয়টা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নিচ্ছে। নিজের দৃষ্টি ওই জায়গাতে স্থির রেখেই নাবিল জিজ্ঞেস করলো “এতক্ষন যা বললা দেখছ কখনও?”

সুমি হতাশা নিয়ে মাথা নাড়ায়। যেন তার দেখার সুযোগ না হওয়াটা একটা চরম দুর্ভাগ্য। নাবিল আবার বলল “কেউ আদৌ দেখছে?”

নাবিলের এমন প্রশ্ন করা দেখে সুমি খুব বিরক্ত হল। চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে বলল “আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছেনা?”

নাবিল মায়ের দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই দেখে তার মা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে যে তার কাছ থেকে কোন না সুচক শব্দ মোটেই আশা করছে না সেটা তার দৃষ্টি ভঙ্গি স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে। আর এই মুহূর্তে এরকম কোন ভাব প্রকাশ করা নাবিলের জন্য বড়ই বোকামি হয়ে যাবে। কারন সুমি যে এতো সময় ধরে অনেক বাক্য ব্যয় করে একটা গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করতে চাইলো, সেটা কোন ভাবেই নাবিলের উপরে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি সেটা জানা মাত্রই তার রাগের মাত্রাটা ঠিক কোথায় পৌঁছাবে সেটা আন্দাজ করেই নাবিল বিপদ বাড়াতে চাইছেনা। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল “না, আসলে কেউ দেখে থাকলে তার কাছ থেকে আরও ভালো ভাবে শুনতাম। আমার আবার এগুলা শুনতে খুব ভালো লাগে।”

নাবিলের কথায় সুমির ঠোঁট প্রসারিত হয়ে গেলো। তার বিদেশে বড় হওয়া ছেলে যে এতো সহজে তার এসব কথা বিশ্বাস করবে সেটা ভেবেই নিজের মনের আনন্দ তার ঠোটের সেই হাসির মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। হাস্যজ্জল চেহারা নিয়ে বলল “এক বয়স্ক লোক আছে। এই গাছ সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। মুবিন কে বললেই নিয়ে যাবে।”

নাবিল আর কিছু বলল না। আবার আগের জায়গায় দৃষ্টি ফিরে পাখি দেখায় ব্যস্ত হয়ে গেলো। সুমি এখনো নাবিলের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেছে। হাজারো হোক মা তো! ছেলের মিথ্যেটা ধরার এই অস্বাভাবিক ক্ষমতা তারা অলৌকিক ভাবেই পেয়ে থাকে। তারপরও সুমি নিজের মনের কথার চেয়ে ছেলের মুখের কথাকেই প্রাধান্য বেশি দিচ্ছে। একটু সময় নাবিলের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বলল “বলব মুবিন কে?”

নাবিল দৃষ্টি ফিরে মায়ের দিকে দেখে নিজের ঠোঁট প্রশস্ত করে একটা হাসি দিলো। সেই হাসির মানে সুমি হ্যা ধরে নিয়ে খুশি মনে চলে গেলো মুবিন কে খুঁজতে। নাবিল আবার সেই একি জায়গায় একি ভাবে নিজের দৃষ্টি স্থির করলো। কিন্তু খানিক বাদেই নিজের পায়ের উপরে শীতল কোন স্পর্শ অনুভব করতেই তার মস্তিষ্ক সাপের আভাষ জানিয়ে দিলো। কারন সে পড়েছে সাপের স্পর্শ অনেক শীতল হয়। আর তার মা কিছুক্ষন আগেই বলেছে সেই তেতুল গাছের ওখানে নাকি অনেক সাপ থাকে। সেই সাপ এই দেয়াল ভেদ করে আসাটা কোন ভাবেই অসম্ভব না। তাই ভয় পেয়ে চমকে উঠে চিৎকার করলো “সাপ! সাপ!”

পরক্ষনেই কোন মেয়েলি কণ্ঠের খিল খিল হাসির শব্দে পিছনে ফিরে তাকায়। স্নেহ মুখে ওড়না চেপে হাসি আটকাতে চেষ্টা করেও পারছে না। তার হাসির শব্দ আরও যেন বেড়েই চলেছে। সুরময়ী সেই হাসি চারিদিকে যেন এক মাদকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে যাতে যে কেউ সহজেই আসক্ত হয়ে পড়বে।

“কি হইছে বাবা?” মিনার এমন বিচলিত কণ্ঠে নাবিলের মনে পড়ে গেল যে তার পায়ে সাপ উঠেছিলো। সে আবার চোখে মুখে ভয়ের রেশ নিয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল “সাপ! মামি।”

বেশ কিছুক্ষন পরও যখন কারও কোন আওয়াজ পেলো না তখন চোখ তুলে তাকাল সামনে। ইতিমধ্যে পুরো মজুমদার পরিবার সেখানে উপস্থিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু কারও তেমন কোন হেলদোল না দেখে নাবিল বেশ অবাক হল। উলটা তারা আরও তার দিকে প্রশ্নবিধ্য দৃষ্টি ছুড়ে দিয়েছে যেন সাপ নামক প্রাণীটি তাদের কাছে বড়ই অপরিচিত। সে এবার ভাল করে ভাবতে লাগলো। উত্তেজিত হয়ে সাপের জায়গায় আবার অন্য কিছু উচ্চারন করে ফেললো না তো? নাহ! ঠিকই তো আছে। তাহলে সবার আচরণ এমন অস্বাভাবিক কেন?

“সাপটা কি শহর থেকে সাথে আনছেন?” স্নেহর এমন ঠাট্টার সূরে বলা কথার মানে খুঁজতে নাবিল তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়। স্নেহ নাবিলের অমন দৃষ্টি দেখে আবারো মুখে ওড়না চেপে হাসতে থাকে। কিছুক্ষন হেসে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলে “শীতের সময় কোথায় সাপ পাওয়া যায়? পাইলে আমারেও একটু দেখায়েন!”

স্নেহর এমন ঠাট্টা করায় নাবিল বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকায়। সবাই নাবিলের সেই দৃষ্টি বুঝতে পেরে ঠোঁট চেপে হাসে। তাদের হাসি দেখে নাবিল বিরক্তির রেশ নিয়ে তাকায়। তার সেই দৃষ্টির মানে বুঝতে পেরে যে যার মতো কাজে চলে যায়। নাবিল বিরক্তি নিয়ে বলে“সাপ কি ঋতু বুঝে কামরায় নাকি?”
স্নেহ আবারো হাসে। ঠোটের কোণে হাসি রেখেই সামনে তাকিয়ে বলে “শীতের সময় সাপ বাইর হয়না।”
“সাপ কি তোমাকে বলে বাইর হয় নাকি? সাপ নাহলে ওটা তাহলে কি ছিল?” আবারো বিরক্তি নিয়ে বলল নাবিল।
“শুধু আমারে না। এই সময় যে সে বের হবেনা তা সবাইরে জানায়ে দেয়। আর ওটা সাপ না…।”
সামনে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে বলে “ওই হাসের বাচ্চাটা আপনার পায়ের উপর দিয়ে গেছে। গায়ে পানি ছিল তাই ঠাণ্ডা লাগছে।”
স্নেহর আঙ্গুলের দিকে তাক করে তাকিয়ে নাবিল বুঝতে পারল তার কথার যুক্তি আছে। কিন্তু সেটা স্নেহকে বুঝতে না দিয়ে সে তাকে হালকা অপমান করার উদ্দেশ্যে কণ্ঠে অবাকের সুর টেনে বলে “আচ্ছা! তোমাদের গ্রামে এমনও হয় বুঝি? সাপ কবে বের হবে তা জানিয়ে দেয়!”
“শুধু আমাদের গ্রামে না আপনাদের শহরেও হয়। শীতের সময় সাপ শীতনিদ্রায় যায়। বইতেই তো লেখা আছে।”
স্নেহর কথা মাথায় ঢুকতেই নাবিল একটু লজ্জা পেলো। আসলেই তো! সাপ যে শীত নিদ্রায় যায় সেটা সে পড়েছে কিন্তু মাথাতেই নেই। তাকে অপমান করার উদ্দেশ্যে বলা কথাটা তার উপরেই ভারি পড়ে গেলো। অযথা একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির স্বীকার হল। একটু ভালো করে ভাবলেই এমন টা হতোনা। নিজের বোকামির কথা ভেবেই নাবিল নত দৃষ্টিতে নিঃশব্দে হাসল। স্নেহ আড় চোখে তার হাসি দেখে নিয়ে নিজের ঠোঁট আরও প্রসারিত করে আবার সামনে দৃষ্টি স্থির করে বলল “ আপনার মতো বিচক্ষণ ব্যক্তির এমন ভুল মানা যায়না।”

স্নেহর কথা শুনে নাবিল বেশ অবাক হল। নিজের দৃষ্টি তার দিকে ফিরিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো তার কথার মানে। স্নেহ নিজের ঠোঁট টিপে হাসছে। তার দৃষ্টি সামনে কোথাও একটা স্থির।

“আমি যে বিচক্ষণ তুমি কিভাবে জানলে?” স্নেহর দিকে তাকিয়ে ভ্রু জোড়া সংকুচিত করে প্রশ্ন করলো নাবিল। আড় চোখে একবার দেখে নিয়ে একটু হেসে আবার সামনে তাকিয়ে বলল “ফুপুরে যেভাবে বোকা বানাইতেছিলেন তা দেখেই আন্দাজ করা যায়।”

স্নেহর কথা শুনে নাবিলের ঠোটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ঠোঁট জোড়া আর একটু প্রসারিত করে স্নেহর দিকে তাকাল। তার ঠোঁটেও অমায়িক হাসি। অদ্ভুত এক মায়া সেই হাসিতে। মাথায় দেয়া ওড়নার নিচে দিয়ে বের হওয়া ছোট ছোট চুল গুলো বাতাসে অবাধ্যের মতো উড়েই চলেছে। এক আঙ্গুল দিয়ে অনবরত সেগুলোকে চোখের উপরে পড়া থেকে আটকাতে চেষ্টায় ব্যস্ত সে। নাবিল নিজের ঠোটে হাসি রেখেই কণ্ঠে দুষ্টুমির রেশ টেনে বলল “তাহলে দূর থেকে আমাকেই দেখছিলা?”

নাবিলের দুষ্টুমি ভরা কণ্ঠের বাক্য কানে আসতেই স্নেহর হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। ভ্রু জোড়া আপনা আপনি সংকুচিত হয়ে গেলো। কণ্ঠে গম্ভীর ভাব এনে বলল “কাউরে ওভাবে দেখতে হয়না। তার কথা শুনলেই বোঝা যায় কি বলতে চায়।”

নাবিল ঠোঁট চেপে হেসে সামনে তাকিয়ে আবার একি সরে বলল “তাহলে চুপ করে আমার কথা শুনছিলে? আমি কি এতোটাই মহনীয় কথা বলি যে চুপ করে হলেও শুনতে হবে?”

স্নেহ এবার এরকম কথায় বেশ বিরক্ত হয়। মেজাজ টাও নিমেষেই বিগড়ে যায়। বয়সে বড় জন্যই কিছু বলতে পারলো না। ছোট হলে এমন হেয়ালি কথা বলার কারনে এতক্ষনে থাপড়ায়ে গাল ফাটায়ে দিত। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে ফেলে। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল “শুনতে চাইনি। পাশেই দাড়ায়ে ছিলাম তাই কানে আসছিল। আপনি যত জোরে বলতেছিলেন।”
স্নেহর এমন নির্লিপ্ত উত্তরে নাবিল নিজের হাসি আটকে কোমল সরে বলল “আম্মু পাশে দাড়িয়ে যেটা বুঝতে পারল না তুমি দূর থেকেই সেটা বুঝলা? বেশ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তো!”

নাবিলের এমন কথা স্নেহর বিরক্তি আরও বাড়িয়ে দিলো। সে কোন বেয়াদবি করতে চায়না তাই নিজেকে সংযত রাখতেই তার কথার পাল্টা উত্তর করলো না। স্নেহর দিকে ঘুরে তার মুখের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেশ গম্ভীর গলায় নাবিল আবার বলে উঠলো “তো এই পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা কি সবার জন্যই নাকি শুধুই আমার জন্য!”

স্নেহ এবার রেগে নিজেকে সংযত না করতে পেরে তার দিকে দৃষ্টি ফেরাতেই তার সেই সম্মোহনী দৃষ্টির জালে আটকে গেলো। মুখ দিয়ে আর কোন কথাই বের হচ্ছে না। সেই প্রথম দিনের মতো আজও তার সমস্ত আবেগ নিজের মতো ছুটে বেরোতে চাইছে। নিজের অবাধ্য দৃষ্টি চাইলেও কিছুতেই নিজের আয়ত্তে আনতে পারছে না স্নেহ। নাবিলের সেই সম্মোহনী দৃষ্টির মাঝেই নিজের সম্মোহিত হওয়া বেহায়া চোখ জোড়া নিবদ্ধ হয়ে আছে।

“আপা! তোমারে ডাকে।”সুহার চাপা সরেও চমকে গেলো সে। বেহায়া চোখ জোড়া সংযত করে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেলো। নাবিল মাথা বাকিয়ে তার দিকে একবার দেখে সামনে তাকাল। তার দুই ঠোটের মাঝে এক বিশ্ব জয়ী হাসি জায়গা করে নিলো।

চলবে………।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে