🧡 #এক_বসন্ত_প্রেম 🧡
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২
“তুই রান্না ঘরে গেইছিলি?” লতার কড়া কথায় সুহা না সুচক মাথা নাড়ায়। ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে। কারন তাকে আর বেশি ধমক দিলে ভয়ে মুখ ফস্কে বলে দিতে পারে যে স্নেহ রান্না ঘরে লবন আনতে গিয়েছিলো। তখনি মা কারন জিজ্ঞেস করবে আর সে সত্যি কথাটা বলে দিবে। লতা কিছুক্ষন চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো “কে গেছিলো জানিস?” সুহা একটা শুকনো ঢোক গিলে আবার না সুচক মাথা নাড়ে।
“কে যে রান্না ঘরের দরজা খুলে রাখছে আর বিড়াল ঢুকছিল। ব্যক্কেল কোথাকার!” লতার এমন ধমকে সুহা ভয়ে কেঁপে উঠে। লতা সুহার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে। অযথা মেয়েটা এমন ভয়ে কেঁপে উঠছে। নিজের রাগ সংযত করে বলল “ঘরে যা।” সুহা হাফ ছেড়ে বাচল। এক দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। ঘরে ঢুকে হাপাতে লাগলো।
——————
মাঘের শেষের দিকে হঠাৎ সকাল থেকেই রোদের তেজটা বেশ। আজ কুয়াশারা তেমন ভিড় করেনি। আকাশটাও বেশ স্বচ্ছ। শীতের রুক্ষতা শেষে প্রকৃতি কেমন ঝলমলিয়ে উঠছে। মিনা এক বালতি কাঁদা গুলে উঠোনে লেপটে দিচ্ছে। লতা দুই মেয়েকে নিয়ে পিঠা বানাতে ব্যস্ত। বিভিন্ন রকমের পিঠে হচ্ছে আজ। কারন আজ শহর থেকে স্নেহর ছোট ফুপু সুমি তার ছেলেকে নিয়ে আসছে। সুমি বিয়ের পর তার সামির সাথে ছেলেকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয়। ছেলের পড়ালেখা শেষ হয়েছে তাই সবাই মিলে দেশে ফিরে এসেছে। এত বছর পর বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসছে পরিবার নিয়ে। সবাই খুব খুশি। এক উৎসব মুখর পরিবেশ বাড়িতে। সারা বাড়ি পরিপাটি করে সাজাচ্ছে মিনা। আর লতা রান্না নিয়ে ব্যাস্ত। হরেক রকমের পদ রান্না হচ্ছে।
“চাচি মুবিন ভাইয়া কখন আসবে?” সুহার প্রশ্নে তার দিকে একবার দেখে আবার বালতির সেই কাদার মধ্যে হাত ডুবিয়ে ছোট্ট করে বলল “আসতেছে।”ফুপু আসার কথা শুনে মিনা তাড়াতাড়ি আসতে বলেছে। সেও রওনা দিয়েছে বাড়ির উদ্দেশ্যে। পৌঁছে গেলো বলে।
“মিনা রে কাজ শেষ হলে এই দিকে হাতি দে। ওরা এলো বলে।”লতার কথা শুনে মিনা স্নেহর দিকে তাকিয়ে বলল “স্নেহ তুই গোছলে যা। আমি হাত ধুয়ে আসতেছি।”স্নেহ চোখ তুলে চাচির দিকে একবার তাকাল। মিনা বালতির কাঁদা থেকে হাত তুলে ঝেড়ে নিয়ে দাড়িয়ে গেলো। স্নেহ হাতে রাখা শেষ পুলি পিঠাটা মুড়িয়ে রেখে নিঃশব্দে উঠে গেলো। বারান্দায় পা ফেলতেই মিনা আবার বললেন “সাদা জামাটা পরিস। ওটাতে তোরে খুব মানায়।”স্নেহ মাথা বাকিয়ে ছোট্ট করে “হুম।”বলেই চলে গেলো ঘরে।
মিনা হাত ধুয়ে এসে স্নেহর জায়গায় বসে সুহার দিকে একবার তাকাল। হাতে একটা পুলি পিঠা নিয়ে মোড়াতে মোড়াতে বলল “স্নেহর হলে তুই যাস। ওরা আসার আগেই রেডি হয়ে থাক।” সুহা মাথা নাড়াল।
বিরক্তি নিয়ে পুরাতন কাঠের আলমারি থেকে সাদা জামা বের করে নিলো স্নেহ। এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন সেই জামার দিকে চেয়ে থাকলো। মিনার কথাটাই মাথায় ঘুরছে। সাদার মতো একটা ফ্যাকাসে রঙ্গে কি এমন আছে যা একজন মানুষকে আরও বেশি সুন্দর করতে পারে। এই মুহূর্তে মাথায় ঢুকছে না। আর বৃথা চেষ্টাও করলো না। গোছল খানার দিকে চলে গেলো। টিউবওয়েল চেপে বালতিতে পানি ভরলো। কয়েক মগ পানি গায়ে ঢেলে নিজের ভেজা কাপড় গুলো বদলে সেই সাদা জামা পরে নিলো। ভেজা কাপড় নিয়ে বের হয়ে দেখল সুহা দাড়িয়ে আছে। সামনে হাটতে হাটতে ছোট্ট করে বলল “যা!” সুহাও আর অপেক্ষা না করে চলে গেলো গোছল খানায়।
উঠোনের মাঝখানে খুব সাবধানে পা ফেলে কাপড় মেলে দিলো স্নেহ। কারন লেপা উঠোনের কোন কোন জায়গা এখনো কাচা আছে। পায়ের ছাপ পড়লে বিষয়টা খারাপ দেখাবে। মাথার গামছাটা খুলে ফেলে চুল গুলো ঝেড়ে নিলো। হাত দিয়ে কয়েকবার কাল ঘন লম্বা চুল গুলো মেলে দিলো রোদে। গামছাটা দরিতে মেলে দিয়ে ভেজা চুলগুলো রোদে এলিয়ে দাড়িয়ে আছে। সুহাও খুব দ্রুত গোছল শেষ করে বের হয়ে এলো। সেও তার পাশে দাড়িয়ে কাপড় মেলে দিলো। এমন সময় সাদেকের চাপা সর কানে এলো “কই সবাই? দেখ কে আইছে?”
স্নেহ দ্রুত ভেজা চুল গুলো হাত খোপা করে নিলো। ওড়নাটা মাথায় টেনে দিয়ে সুহাকে উদ্দেশ্য করে বলল “চুল বাধ।” সুহাও তাড়াতাড়ি নিজের চুল বেধে মাথায় ওড়না টেনে দিলো। দরজা দিয়ে ঢুকল দুজন মানুষ তার ফুপা আর ফুপু। মিনা তাদেরকে ঘরে নিয়ে গেলেন।
সুহা স্নেহ দুই বোনই ঘরে ঢুকল। লতা ইশারা করে সালাম করতে বলছে। মাথার ওড়নাটা আরেকটু টেনে দিয়ে সামনে চোখ তুলে দেখে নিল। সামনে ফুপু আর ফুপা বসে আছে। এগিয়ে গিয়ে সবাইকে পা ছুয়ে সালাম করল। ফুপাকে সালাম করা শেষ হলে তিনি দুজনকে তার দুই পাশে বসিয়ে নেন। পরম আদরে মাথা ঝুকিয়ে মুখের দিকে দেখে নিয়ে বলেন “তোমার নাম কি?”
“স্নেহময়ী! স্নেহময়ী মজুদার।”চাপা সরে বলল স্নেহ।
“বাবা রাখছে। দুজনের নামই বাবা রাখছে।”সাদেক সহাস্যে কথাটা বলল। স্নেহর ফুপা রাজ্জাক সাহেব সুহার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন “তোমার নাম কি?”
“সুহাসিনী মজুমদার।”এমন ভাবে উচ্চারন করলো যেন এই নামটাই তার গরবের এক মাত্র কারন।
“বাহ! দুজনের নামই তো বেশ। স্নেহ আর সুহা।”বলেই তিনি সশব্দে হাসলেন। সারা ঘরে তার হাসির গুঞ্জন এক উতসব মুখর পরিবেশ সৃষ্টি করলো।
স্নেহকে পাশে বসিয়ে তিনি সাদেকের সাথে গল্পে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তিনি খুব একটা গ্রামে আসেন নি কারন বেশিরভাগ সময় বিদেশে থেকেছেন। তাই গ্রামের আত্মীয় সজনের সাথে তার খুব একটা সখ্যতা নেই। কিন্তু তিনি খুব ভালো মানুষ বলেই পরিচিত।
সবাই একসাথে খেতে বসেছে। মিনা আর লতা খাবার বেড়ে দিচ্ছে।স্নেহ আর সুহা পানি ঢেলে দিচ্ছে। রাজ্জাক দুই বোনের দিকে তাকিয়ে বলল “তোমরাও বসে পড়।”সুহা চোখ তুলে তাকালেও স্নেহ দৃষ্টি নতই রেখে দিলো। লতা দুই বোনের দিকে তাকালেন। মিনা লতার কানের কাছে এসে ফিস ফিসিয়ে বলল“দেখছ বুবু স্নেহর আচরণ। সুহার রুপ ধরেছে।”লতা মিনার কথা শুনে ভালভাবে খেয়াল করলো। সত্যিই তাই। সুহা নিজের আচরণ স্বাভাবিক রাখলেও স্নেহ আজ বেশ আড়ষ্ট। মেহমান আসার পর থেকে মেয়েটার সকল চঞ্চলতা যেন হারিয়ে গেছে। কেমন পরিপক্কতা একটা ভাব ফুটেছে চেহারায়।
“তোরাও বস। নে প্লেট নে।”মিনার কথায় লতা নিজের হাতে থাকা তরকারির বাটিটা একবার দেখে নিলো। সেটা বাড়িয়ে চামুচে তরকারি তুলে সুমির পাতে দিলো।
“আর না ভাবি অনেক খেয়েছি।“ সুমি হাত বাড়িয়ে বাধা দিয়ে বলল।
“কিছুই তো খেলেনা বুবু।”লতা একটু হেসে বলল।
“তোমার হাতের রান্না যা মজা। সেই কবে খেয়েছি বলত। কত বছর হয়ে গেলো।” একটু মন খারাপ করে বলল সুমি।
“বাবা এখনো আসলো না যে?” লতা সুমিকে প্রশ্ন করলো। সুমি প্লেটের দিকে তাকিয়েই বলল “ওর আস্তে একটু দেরি হবে ভাবী। কাজ আছে।”
লতা একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল “বাড়ি চিনবে তো? আসেনি তো আগে!” সুমি একটু হেসে বলল “চিন্তা করোনা চলে আসবে।”
“কি রে? এখন প্লেট হাতে নেস নি?” লতার জোরে কথায় একটু চমকে তার দিকে তাকিয়ে কমল কণ্ঠে স্নেহ বলল “নিচ্ছি মা।”বলেই একটা প্লেট সুহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আর একটা নিজে তুলে নিলো। ভাত সুহার প্লেটে বেড়ে দিয়ে নিজেও নিয়ে নিলো। যা যা খেতে ভালবাসে সবটা এক এক করে বাটি থেকে তুলে নিলো। নত দৃষ্টিতে খেতে শুরু করলো। সবাই খেতে খেতে গল্প করছে। কিন্তু স্নেহর কথা যেন হারিয়ে গেছে। সব কথা ভুলে গেছে সে। খাওয়ার মাঝেই লতা বলে উঠলো “ভাই সাহেবের কি চায়ের অভ্যাস আছে নাকি?”
লতার কথা শুনে তার দিকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে একটু ম্লান হেসে হ্যা সুচক মাথা নাড়াল রাজ্জাক। লতা স্নেহর দিকে তাকিয়ে বলল “খাওয়া শেষ করে চা বানাস। তোর ফুপাজি খাবে।”স্নেহ চোখ তুলে লতার দিকে একবার দেখে আবার প্লেটে চোখ নামিয়ে মাথা নাড়াল।
সুহা খাওয়া শেষ করে উঠে যেতে বলল “আপা আমি চায়ের পানি বসাইতেছি। তুমি খাওয়া শেষ করে আসো।”স্নেহ মাথা নাড়াল। নিসচুপে শেষ লোকমাটা মুখে ঢুকিয়ে প্লেট নিয়ে বের হয়ে গেলো। বারান্দার পাশেনিজের এঁটো প্লেট তা পরিস্কার করে নিয়ে হাত ধুয়ে পানি খেয়ে নিলো। তারপর প্লেট তা রেখে পা বাড়াল রান্না ঘরের দিকে। চায়ের পানি বসিয়ে ফুটতে দিয়েছে সুহা। “দেখি কতগুলা পানি দিলি?” বলেই পাতিলের উপরে চোখ চালিয়ে ভালো করে দেখে নিলো স্নেহ। সব ঠিক আছে। নিশ্চিন্ত হয়ে বসে পড়লো চুলার পাশে।
———————–
শীতের শেষ বেলায় তাড়াতাড়ি রোদ চলে যায়। তবুও আজকের রোদটা একটু তীব্রই। এখনো আছেই। বড় রাস্তার পাশে খেতে নানান রকম শীতের সবজি লাগান আছে। লতা সেখান থেকেই টাটকা সবজি আনতে পাঠিয়েছে তিন ভাই বোনকে। রাতে রান্না করবে খেতের টাটকা সবজি। মুবিন আর সুহা খেতের ভিতরে ঢুকে সবজি তুলছে। আর স্নেহ পাশেই দাড়িয়ে আছে। সাদা জামা পড়ে আছে জন্য আর ভিতরে ঢুকেনী। জামায় দাগ লেগে গেলে মুশকিল হয়ে যাবে। সাদা জামায় রোদ পড়ায় নিচের অংশটা বেশ চকচক করছে। সেটাই হাতে একটু তুলে নিয়ে দেখছে স্নেহ। সাদা রঙটার কোন সৌন্দর্য আছে কিনা আজও সেটা সে বুঝতে পারেনা। কিন্তু তাকে নাকি সাদা জামায় অনেক মানায়। মিনার কাছে অনেকবার এই কথা শুনেছে সে।
“আপা বড় মা কি কাঁচা মরিচ নিতে কইছে?” মুবিনের কথায় তার দিকে দৃষ্টি ফেরায় স্নেহ। রোদের তেজে ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা। কপালে হাত দিয়ে রোদ আটকাল। ভ্রু জোড়া সংকুচিত করে চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। “কয় নাই। তাও নে। সন্ধ্যায় চায়ের সাথে কাঁচা মরিচ পেয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখব।” একটু গলা তুলে বলল স্নেহ। মুবিন তার কথা শুনে বেশ কিছু কাঁচা মরিচ তুলে দুই হাতের তালু ভরে তার দিকে উঠিয়ে বলল “হইছে? না আরও?” স্নেহ একটু দেখে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল “হইছে।”
“এক্সকিউজ মি!” অপরিচিত ভারি গলার আওয়াজে সবাই রাস্তার দিকে ফিরে তাকাল। স্নেহ নিজের ভ্রু সংকুচিত করে ঘুরে দাঁড়ালো। একটা চকচকে কাল গাড়ির ভিতরে একজন সুদর্শন পুরুষ সান গ্লাস পরে বসে আছে। সামনে মনে হয় ড্রাইভার। পিছনের সিট থেকে সেই সান গ্লাস পরিহিত ব্যাক্তি নিজের মাথাটা একটু বের করলেন। সান গ্লাসটা খুলে ফেললেন। রোদের তেজে পিটপিট করে কয়েকবার নিজের দৃষ্টি ঠিক করে স্নেহর দিকে স্থির করে নিলেন। ভ্রু ভাঁজ করে স্নেহকে উদ্দেশ্য করে বললেন “আচ্ছা আপনি কি এই গ্রামে থাকেন? মানে আপনার বাড়ি কি আশে পাশে কোথাও?”
তার চোখের ঘন পাপড়ির আড়ালে পিটপিট করা বাদামি বর্ণের সেই মনি স্নেহর বুকের ভিতরে আলোড়ন তুলে দিলো। কি এক অদ্ভুত অনুভুতি। স্নেহ পলকহীন দৃষ্টি তার দিকে স্থির রেখেছে। মানুষটাকে এই প্রথম দেখল সে। কিন্তু এক অদ্ভুত টান অনুভব করছে তার প্রতি। কিন্তু কেন? কে এই পুরুষ যার চোখের চাহুনিতে স্নেহর ভিতরের সমস্ত লুকান আবেগ বেহায়া রুপে বের হয়ে আসতে চাইছে!
চলবে……..