এক পূর্ণিমা সন্ধ্যায় পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
1464

#এক_পূর্ণিমা_সন্ধ্যায়
#পর্ব_১১ (অন্তিম পর্ব)
#নিশাত_জাহান_নিশি

তড়িঘড়ি করে মিস্টার শিমুল হক বাড়ির ওয়াচ ম্যানকে শাসিয়ে বাড়ির মেইন গেইট খুলতে সমর্থ হলেন। অনল স্তব্ধ ভঙ্গিতে এখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এই পর্যায়ে এসে মিস্টার শিমুল হককে অনলের খুব রহস্যময় মনে হচ্ছে। এসব ভাবনা চিন্তার মধ্যেই মিস্টার শিমুল হক পুলিশ টিম নিয়ে মৃদুলের দু’তলা ফ্ল্যাটে উঠে গেলেন। মৃদুলের ফ্ল্যাটের দরজাটা সম্পূর্ণ খোলা! হনহনিয়ে সবাই ফ্ল্যাটের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখলেন মৃদুল ড্রিংকস করা অবস্থায় অচেতন হয়ে সোফার উপর হাত-পা ছিটিয়ে পড়ে আছে!

মিস্টার শিমুল হক এক প্রকার দৌঁড়ে গেলেন টালমাটাল হয়ে পড়ে থাকা মৃদুলের দিকে। মুখের কাছে কান ঠেকাতেই বুঝতে পারলেন মৃদুল নেশার ঘোরে দিশাহীন ভাবে আবোল তাবোল বকে চলছে। মূলত যে বকবকানির বিশেষ কোনো অর্থ নেই। সমস্তটাই নিরর্থক। কখনও উচ্চ শব্দে হেসে উঠছে তো কখনও ব্যথীত গলায় কেঁদে উঠছে৷ বদ্ধ উন্মাদের সুলভ আচরণ। অনল হিংস্রাত্নক হয়ে মৃদুলের দিকে তেড়েমেড়ে আসতেই মিস্টার শিমুল হক অনলকে থামিয়ে শান্ত গলায় বললেন,,

“বি কুল অনল। একে আর কি মারবে? এ তো আগে থেকেই মাতাল হয়ে আছে। মারধর করলেও এর উপর কোনো খারাপ ইফেক্ট পড়বে না। যা করার একে থানায় নিয়েই করতে হবে।”

অনল থেমে গেল। সীমাহীন ক্রুব্ধতাকে আয়ত্তে আনার চেষ্টায় অবিচল রইল। পরক্ষণে রাগে ফোঁস ফোঁস করে অনল মাতাল মৃদুলের দিকে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে মিস্টার শিমুল হককে বলল,,

“ভাই। আমার মনে হয়, মৃদুলের বেডরুমটা প্রথমে চেক করা উচিত। যেন তেন প্রকারেই হোক ভিডিও ফুটেজটি আগে উদ্ধার করা আমাদের সবার জন্য অতি জরুরি।”

মিস্টার শিমুল হক উনার সহকর্মীদের ইশারা করে বললেন পুরো ফ্ল্যাট চেক করে ভিডিও ফুটেজটি প্রথমে উদ্ধার করতে। অনলকেও দায়িত্ব দিয়ে বললেন হায়দার সাহেবের খোঁজ চালাতে। ফ্ল্যাটের কোথায় তিনি গাঁ ঢাকা দিয়ে বসে আছেন তার অনুসন্ধান চালাতে। শিমুল হকের নির্দেশকে সম্মতি জানিয়ে অনল পুরো ফ্ল্যাটে চিরুনি তল্লাশি চালিয়েও হায়দার সাহেবকে কোথাও খুঁজে পেল না! তবে মৃদুলের বেডরুম থেকে ধারণকৃত সেই দশ মিনিটের ভিডিও ফুটেজটি ক্যামেরাসহ উদ্ধার করা গেল! যে ক্যামেরাটিতে মুনার সঙ্গে হওয়া পাপাচার ভিডিও বন্ধী ছিল! পরিশেষে প্রমানসহ মৃদুলকে টেনে হেছড়ে ফ্ল্যাট থেকে বের করা হলো। ওয়াচ ম্যান থেকে জেরাপূর্বক জানা গেল হায়দার সাহেব সন্ধ্যার দিকে কোথাও একটা বের হয়েছিলেন। আজ আর বাড়িতে ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই৷ অবচেতন মৃদুলকে জীপে তুলতেই মিস্টার শিমুল হক জীপ ছেড়ে দিলেন। ঘন্টা খানিকের মধ্যেই জীপটি পুলিশ স্টেশান পৌঁছে গেল। মৃদুলকে আবারও টেনে হেছড়ে থানায় প্রবেশ করানো হলো। থানায় থাকা অন্যান্য গোয়েন্দা পুলিশরা এতক্ষনে মুনার থেকে এক এক করে সমস্ত স্টেটমেন্ট নথিবদ্ধ করে নিলো। যাকে বলে লিখিত অভিযোগ। মৃদুলকে লকাপে পুড়ে মিস্টার শিমুল হক হাঁফিয়ে উঠা গলায় অনল, ঐথি, মুনা, নিয়াজ, আহির এবং রুহাজের উদ্দেশ্যে বললেন,,

“তোমরা সবাই এখন আমার বাড়িতে চলো। সকালের দিকে আমার সাথে আবার থানায় আসবে। ততক্ষণে মৃদুলেরও নেশা কেটে যাবে।”

এর মধ্যেই মিস্টার শিমুল হকের ফোন বেজে উঠল। তড়িঘড়ি করে তিনি প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটি হাতে নিতেই বাঁকা হেসে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গেই কলটি কাট করে তিনি পুনরায় প্যান্টের পকেটে ফোনটি পুড়ে নিলেন। অনলের দিকে চেয়ে বিদ্রুপাত্নক হেসে বললেন,,

“উপর মহল থেকে কল! আই থিংক সাথে রাজন হাওলাদার এবং হায়দার সাহেবও আছেন!”

হাসতে হাসতে তিনি থানা থেকে বেরিয়ে গেলেন। উনার পিছু পিছু অনল, ঐথি এবং মুনারাও হাঁটা ধরল। এক এক করে সবাই জীপে উঠতেই মিস্টার শিমুল হক জীপ ছেড়ে দিলেন। থানা থেকে প্রায় পনেরো মিনিটের রাস্তা পরেই মিস্টার শিমুল হকের বাসা। বাসায় পৌঁছাতেই তিনি সবাইকে নিয়ে বসার ঘরে গোএ বৈঠকে বসলেন। তৎপর গলায় অনলকে বললেন,,

“মৃদুলকে শুধুমাত্র একটি কেইস দিয়ে আটকানো যাবে না অনল। তাকে আটকাতে হলে আরও বড় ধরনের কেইস লাগবে। তার বিপক্ষে সমস্ত প্রমাণ জড় করতে হবে। আর যা করার আমাদের এই দু’একদিনের মধ্যেই করতে হবে। আস্তে ধীরে উপর মহলের চাপ বাড়তে শুরু করল বলে।”

অনল বেশ উত্তিজত হয়ে অর্নগল বলতে আরম্ভ করল,,

“ভাই৷ মৃদুল শুধু মুনার সাথেই খারাপ কিছু করে নি। এমন অনেক অনেক মেয়ে আছে যার সাথে সে জোরজবরদস্তি করে তাদের মান-সম্মান লুটে নিয়েছে। আমরা চাইলে তাদের সাথে কথা বলে দেখতে পারি ভাই। তাদের বয়ানও নিতে পারি।”

“কিন্তু ঐ মেয়ে গুলো কি এত সহজে মুখ খুলতে চাইবে অনল? তারা তো চাইবেই সমাজে তাদের সম্মান নিয়ে দু’কথা না উঠুক। অন্তত সমাজে তারা একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পাক। খবরে, কাগজে, পত্রিকায় তাদের সম্মান হানির নিউজ না রটুক। বাকি সম্মানটুকু নিয়ে সারাজীবন কমপ্রোমাইজ করে বেঁচে থাকুক। সমাজের কটা মেয়ের মধ্যে এমন দুঃসাহস আছে অনল? নিজের সম্ভ্রম হারিয়ে সেই সম্ভ্রম হানির বিষয় নিয়ে আইনের আশ্রয় নেওয়ার?”

মুহূর্তের মধ্যেই ঐথি আগ পাছ না ভেবে নেত্র যুগল বুজে গলা জড়ানো কন্ঠে গড়গড় করে বলল,,

“আমি যদি মুখ খুলি? তাহলে হবে তো স্যার?”

উপস্থিত সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠতেই মিস্টার শিমুল হক ঐথির দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য গলায় শুধালেন,,

“মানে? তোমার সাথে কিছু ঘটেছিল ঐথি?”

অনলের ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি! বাকি সবার মত অনল একরত্তি ও উদ্বিগ্ন নয় ঐথির হৃদয়বিদারক কথার বিপরীতে! কোনো রকম ভাবান্তরই হলো না তার। মাথা নুঁইয়ে ঐথি বেদনাতুর গলায় বলল,,

“হুম ঘটেছিল৷ আমার সাথেও খারাপ কিছু ঘটেছিল স্যার! আর আমি আশাবাদী, যদি আমি এখন, এই মুহূর্তে, এই ব্যবিচারের বিরুদ্ধে মুখ খুলি তবেই আমার দেখাদেখি ঐসব মেয়েরাও মুখ খুলবে, যাদের সম্ভ্রম নিয়ে ঐ জালিম মৃদুল পৈশাচিক খেলায় মত্ত ছিল। আমি সেই অত্যাচারিত মেয়েদের হয়েই প্রতিনিধিত্ব করছি স্যার!”

“কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে?”

“আছে! আমার সাথে করা জোর জবরদস্তির সমস্ত প্রমাণ আমার কাছে আছে!”

“কি প্রমাণ?”

“অডিও ফুটেজ। সমস্ত প্রমাণ আমার ফোনে অডিও করা আছে!”

উপস্থিত সবাই আহত দৃষ্টিতে ঐথির দিকে চেয়ে আছে। কথা বলার সময় ঐথির গলাটা কেমন যেন খুব ধরে আসছিল! তাৎক্ষণিক অনল হাসি মিলিয়ে নিল! জোরপূর্বক ভাবে ঐথিকে সহানুভূতি দেখিয়ে বলল,,

“শান্ত হও ঐথি। কাঁদবে না একদম। তোমার সাথে যা যা অন্যায় করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে তুমি দাঁড়াবে, প্রমানসহ দাঁড়াবে। তোমার দেখাদেখি আট-পাঁচটা মেয়েও তাদের প্রতি করা অন্যায়ের দাবি নিয়ে দাঁড়াতে সাহস করবে। তবেই সমাজের প্রতিটা মেয়ে তাদের বিরুদ্ধে করা অন্যায়ের ন্যায় পাবে।”

ঐথির পূর্বে মুনাই হেচকি তুলে কেঁদে উঠল৷ ঐথি তাৎক্ষণিক মুনাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত গলায় বলল,,

“কেঁদো না মুনা। যে তোমার সম্মান হানি করেছে, এমনকি আমারও সম্মান হানি করার চেষ্টা করেছিল, এছাড়াও আরও অসংখ্য মেয়ের ইজ্জতের উপর হামলা চালিয়েছিল তাকে আমরা সবাই এক জট হয়ে তার অন্যায়ের শাস্তি দিব। যাবজ্জীবন তাকে জেলের ঘানি টানাব। তুমি একদম চিন্তা করবে না মুনা। আর চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও ফেলবে না প্লিজ।”

মিস্টার শিমুল হক কিঞ্চিৎ মুহূর্ত মৌণ রইলেন। মৌণতা কাটিয়ে তিনি সোফায় মাথা এলিয়ে আঁখি যুগল বুজে ক্লান্ত গলায় বললেন,,

“সকালে আমরা এই বিষয় নিয়ে কথা বলব। পাশের দুইটি রুমই ফাঁকা পড়ে আছে আমার। তোমার প্লিজ রুম দুইটি শেয়ার করে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে নাও।”

সবাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। নিয়াজ, আহির, রুহাজ এবং অনল এক রুমে এডজাস্ট করে নিলো। বাকি একটি রুমে ঐথি এবং মুনা বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিলো।

পরের দিন সকাল দশটা বাজতেই মিস্টার শিমুল হক, অনল এবং ঐথি মৃদুলের বিরুদ্ধে সেসব অত্যাচারিত মেয়েদের জড় করল যারা একটি সময় মান-সম্মানের ভয়ে মৃদুলের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে নারাজ ছিল। ঐথির এগিয়ে আসা দেখে তারাও পরোক্ষভাবে ঐথির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। অনলও তার করা ফেইক অডিওটি মিস্টার শিমুল হকের হাতে তুলে দিল! ভিডিওটি মূলত ৪/৫ মাস আগের করা। ঐথি এবং অনল দীর্ঘ এক বছর যাবত বিভিন্ন প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে মৃদুলকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছিল! কারণ তারা জানত, মৃদুলকে কোনোভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো গেলেই হায়দার সাহেব, রাজন হাওলাদার এবং প্রীতি হাওলাদারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হবে! ঐথি তার মায়ের সাথে অন্যায় ভাবে করা রেপ এবং সুইসাইডের প্রতিশোধও নিতে পারবে! দীর্ঘ ১৭ বছর পূর্বে ঐথির মাকে হায়দার সাহেব রেপ করেছিলেন! যে রেপকে প্রশয় দিয়েছিলের মিস্টার রাজন হাওলাদার। নিজের ইজ্জতের উপর হওয়া ব্যবিচারের আঘাত একরত্তি ও মেনে নিতে পারেন নি ঐথির মা। অতি লজ্জায়, তাড়নায়, যন্ত্রণায় তিনি বাধ্য হয়েছিলেন আত্মাহুতি দিতে। বিষয়টি পরে রাজন হাওলাদার আঁচ করতে পারলেও হায়দার সাহেবের বিরুদ্ধে তিনি মুখ খুলতে চান নি। ঐথির মায়ের হয়ে তিনি হায়দার সাহেবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান নি। মৃত্যুটিকে তিনি ক্ষমতার জোরে স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই আখ্যায়িত করেছিলেন। এবং ঐথির মায়ের মৃত্যুে কিছুদিন পরেই তিনি খুশি খুশি মনে প্রীতি হাওলাদারকে বিয়ে করে নিয়েছিলেন। তিনি যেন কোনো ভাবে এই সুযোগটির অপেক্ষাতেই ছিলেন। ভেতরে ভেতরে সংঘটিত হওয়া এত বড় ষড়যন্ত্র ঐথি এর আগে কখনও জানতে পারে নি বা বুঝতেও পারে নি৷ যখন ঐথি অনলের সাথে অভিমান করে তার বাবার কাছে কিছুদিনের জন্য থাকতে এসেছিল, তখনই ঐথি কোনো ভাবে গোটা ষড়যন্ত্রটি জানতে পারে। আর তখনই সে অভিমান ভুলে অনলকে সম্পূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত খুলে বলে। সম্পূর্ণ বিষয়টি জানার পর অনল ঐথিকে নিয়ে গোপন প্ল্যানিং শুরু করে। রাজন হাওলাদার এবং হায়দার সাহেবকে ফাঁসানের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ঐথি যখন মুনার থেকে জানতে পারে মৃদুল মুনার সাথে ব্যবিচার করে আসছে দীর্ঘ কয়েক মাস যাবত তখনই ঐথি এবং অনলের জন্য আরও সুবিধে হয় মৃদুলের পাশাপাশি হায়দার সাহেব এবং রাজন হাওলাদারকে ফাঁসানোর। মৃদুলের প্রতিটি কুকর্ম অনল ভিডিও করতে শুরু করে। প্রতিটি মেয়ের সাথে হওয়া নৃশংসতার প্রমাণ অনলের কাছে প্রমাণস্বরূপ আছে। এমনকি একদিন প্ল্যান মাফিক অনল মৃদুলকে একটি লজে ডেকে আনে। মৃদুলকে ওভার ড্রিংকস করিয়ে ঐথির সাথে কয়েকটি অপ্রীতিকর ছবি তুলে। ছবিটিতে ঐথির মুখ স্পষ্ট না হলেও শারীরিক ধরন দেখে বুঝায় যায় মেয়েটি ঐথি। একটি অডিও রেকর্ডিংও আছে। যে রেকর্ডিংটিতে শুধু মৃদুলের লজ্জাষ্কর কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। আর ঐথির কয়েকটা চিৎকারের আওয়াজ। কেউ যেন তাদের প্ল্যানিং বুঝতে না পারে তাই তারা নাটক করে আসছিল দীর্ঘ এক বছর ধরে। অনলের পরিবার গোটা বিষয়টি জানলেও ঐথির চাচা-চাচী এবং রাফিন এই বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। এমনকি নিয়াজ, আহির এবং রুহাজও এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটিতে জ্ঞাত ছিল না। অনল এবং ঐথি ইচ্ছে করেই তাদের কিছু জানাতে চায় নি। ষড়যন্ত্রটি গোপন রাখার সুবিধার্থে।

সমস্ত প্রমাণ এখন মৃদুলের বিপক্ষে! মৃদুলের সাথে রয়েছেন রাজন হাওলাদার এবং হায়দার সাহেবও। এত সব স্ট্রং প্রুফের বিরুদ্ধে যাওয়াটাও এখন উপর মহলের কাছে দায় হয়ে দাঁড়িযেছে। রাজন হাওলাদার এবং হায়দার সাহেবও তখন ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেদের বাঁচাতে পারেন নি। কেইসটি খুব দ্রুত কোর্টে উঠে যায়। প্রত্যেককে তিনদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়! পরিশেষে তারা বাধ্য হয় নিজেদের কুকীর্তি স্বীকার করতে। ঐথির মায়ের সুইসাইড কেইসের সাথে জড়িত রাজন হাওলাদার এবং প্রীতি হাওলাদারও তাদের দোষ স্বীকার করেছিল। গোপনে দুজনই পরকীয়ায় লিপ্ত ছিল। ঐথির মায়ের সুইসাডের পরেই তারা সমর্থ হয় পরকীয়ার সম্পর্কটিকে বিয়েতে রূপান্তরিত করতে। তাদের জবানবন্দি অনুযায়ী হায়দার সাহেবকে ঐথির মায়ের সুইসাইড কেইসের মূল হোতা হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ঘোষনা করা হয়। রাজন হাওলাদার এবং প্রীতি হাওলাদারকে দশ বছরের জেল এবং এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। মৃদুলকে দীর্ঘ বারো বছরের জেল এবং দু’লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়।

রাজন হাওলাদার নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন! ঐথির হাত ধরে ক্ষমা চেয়েছিলেন। শুধুমাত্র পায়ে ধরাই বাকি ছিল। যদিও ঐথি ক্ষমা করতে পারেন নি রাজন হাওলাদারকে। নির্দ্বিধায় মুখের উপর হাজারটা কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছিল। প্রীতি হাওলাদারকেও ঐথি ফিরিয়ে দিয়েছিল। ক্ষমা করতে পারে নি তার সৎ মাকেও। ঐথি আজ ভীষণ খুশি। কারণ তার মায়ের সাথে করা অন্যায় এবং নৃশংসতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সে তার মৃত মা কে ন্যায় দিতে পেরেছে। পাশাপাশি সমাজের শোষিত সবক’টা মেয়ের ইজ্জতের দোষরকে শাস্তি দিতে পেরেছে। মিস্টার শিমুল হক কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছিলেন অনল এবং ঐথির গোপন ষড়যন্ত্র। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে যদি ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা যায় তবে সেই মিথ্যের মধ্যে কোনো পাপ নেই। মিস্টার শিমুল হকের কাছে ঐথি, অনল এবং মুনা চির কৃতজ্ঞ হয়ে রইল৷ মূলত শিমুল হকের সাহায্য, সহযোগীতার জন্যই তারা পেরেছিল চার চারজন কার্লপ্রিটকে শাস্তি দিতে।

,
,

দীর্ঘ এক বছর কেটে গেল মাঝখানে! কানাডায় শীতের প্রকোপ বেড়ে নাজেহাল এক অবস্থা। কম্বলের উষ্ণতা ছেড়ে কিছুতেই যেন অলসতা কাটিয়ে উঠতে চাইছে না, ঐথি। কানাডার শীতার্থ আকাশে এতক্ষনে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অনলেরও অফিস থেকে ফেরার সময় ঘনিয়ে এসেছে। অনলের মা মিসেস জুবাইদা আফরোজ তেলের বোতল হাতে নিয়ে ভেজানো দরজাটি খুলে ঐথির বেড রুমে প্রবেশ করলেন। রুমের প্রতিটি থাই এখনও উন্মুক্ত। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস রুমে প্রবেশ করছে। যার কারনে শীতের মাত্রা অত্যধিক হারে বাড়ছে। পুরো রুমটিও কালো অন্ধকারে ঢেকে আছে। রুমের লাইটটি পর্যন্ত অন করে নি ঐথি। মুনাকে সাথে নিয়ে ট্যাবে মুভি দেখতে ব্যস্ত! দু বোনের অর্থহীন কার্যকলাপ দেখে জুবাইদা আফরোজ রাগে ফোঁস ফোঁস করে রুমের লাইট অন করলেন। অমনি ঐথি এবং মুনা থতমত খেয়ে ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জুবাইদা আফরোজের দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তাৎক্ষণিক শুকনো ঢোক গিলে ঐথি ফোনটা হাত থেকে বালিশের তলায় রাখতেই জুবাইদা আফরোজ রাগে গজগজ করে ঐথিকে বললেন,,

“কয়টা বাজছে শুনি? সন্ধ্যা যে হতে চলল সেই খেয়াল আছে দু’বোনের?”

জুবাইদা আফরোজের হাতে তেলের বোতলটি দেখা মাত্রই মুনা কপালের ভাঁজে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে কম্বলের উষ্ণতা ছেড়ে কোনো রকমে যেন জান নিয়ে রুম থেকে দৌঁড়ে পালাল! মুনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে জুবাইদা আফরোজ কিঞ্চিৎ মুহূর্ত মৌণ রইলেন। অতঃপর ঐথি এবং জুবাইদা আফরোজ হু হা শব্দে হেসে উঠলেন। চুলে তেল লাগানো মুনার একদমই পছন্দ নয়। আর প্রতিবারই জুবাইদা আফরোজ জোরপূর্বক মুনাকে তেল লাগিয়ে দেন চুলে৷ তাই আজ মুনা পূর্ব সতর্কিত হয়ে জুবাইদা আফরোজের হাত থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হলো। তবে ঐথি এবার বুঝতে পেরেছে, এবার ঐথির পালা! যেন তেন প্রকারেই হোক জুবাইদা আফরোজ এখন ঐথির চুলে তেল লাগাবেন তো লাগাবেনই। পৃথিবীর কোনো শক্তি উনাকে আজ আর আটকে রাখতে পারবে না। ঐথি কপাল কুঁচকে নাক সিটকে উঠতেই জুবাইদা আফরোজ হাসি মুখে এগিয়ে এলেন ঐথির দিকে। জোর পূর্বক ঐথির চুলে তেল লাগিয়ে দিলেন। ঐথি এই বিষয়টিতে যেমন বিরক্তবোধ হচ্ছিল তেমনি বৃহৎ আকারের খুশিও ছিল! জুবাইদা আফরোজের প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কেয়ারিং, ভালোবাসা, সবর্ক্ষন ঐথির পাশে থাকা, যেকোনো বিষয়ে ঐথিকে সাপোর্ট করা এই সবক’টা বিষয়ে ঐথি নিজের আপন মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়! তাইতো ঐথি বিনা দ্বিধায় নিজের মায়ের জায়গাটা তার শ্বাশুড়ী অর্থাৎ জুবাইদা আফরোজের নামে লিখে দিয়েছে! প্রায় নয় মাস হলো অনল এবং ঐথির বিয়ের৷ দুমাস আগেই তারা পরিবারবর্গ নিয়ে কানাডায় স্যাটেল্ড হয়ে গিয়েছে। ঐদিনের পর থেকে মুনা ঐথির সাথেই রয়ে গেছে। মুনার সমস্ত দায়িত্ব এখন ঐথি এবং অনলের! মাঝে মাঝেই মুনা যখন তার বাবা-মায়ের কথা মনে করে কান্না জুড়ে দেয় তখন ঐথি এবং অনল সন্তপর্ণে তাকে মানিয়ে নেয়। রাজন হাওলাদার এবং প্রীতি হাওলাদারের কুকীর্তি মনে করিয়ে দেয়! তখনই মুনা দমে যায়। বাস্তবতাকে মেনে নিতে বাধ্য হয় তখন। ঐদিকে, ইফা এবং রাফিনের মধ্যে থাকা সমস্ত ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে এখন তারাও বিয়ের মত পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে প্রায় তিন মাস হলো। তারা এখন বাংলাদেশেই আছে। সুখে শান্তিতে সংসার করছে। নিয়াজ, আহির এবং রুহাজও তাদের পরিবারের মতে বিয়ে করে বাংলাদেশে স্যাটেল্ড! মাঝে মাঝেই তারা একজোট হয়ে অনল এবং ঐথির সাথে ভিডিও কলে কথা বলে নিজেদের মধ্যকার বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে ঠিক আগের মতোই বাঁচিয়ে রেখেছে।

__________________________________

কানাডার আকাশে সন্ধ্যা রাত নেমে আসতেই থালার মতো পূর্ণিমা চাঁদটি আকাশে বিস্তর জায়গা নিয়ে নিজেকে তুলে ধরল। কুয়াশার ধুম্রজাল ভেদ করে চাঁদের আলো হাঁটু গলিয়ে ধরণীতে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘড়িতে সন্ধ্যে ৭ টা ৩০ মিনিট বেজে উঠতেই অনলের আগমন ঘটল বেডরুমে! ঐথি এখনও কম্বল পেঁচিয়ে ফোনে মুখ গুজে ব্যস্ত মুভি দেখতে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে অনল অফিসের ব্যাগটি বিছানায় ছুড়ে মারতেই ঐথি ফোন থেকে মুখ তুলে অনলের ক্লান্ত মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। জিজ্ঞাসু গলায় বলল,,

“আজ এত দেরি? রিপোর্টিংয়ের বাড়তি কাজ ছিল?”

শার্টের প্রথম দুটে বাটন খুলে অনল নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে ঐথির দিকে তাকাল। ঠোঁটের কোণে আচমকা ক্রুর হাসি ফুটিয়ে অনল রোমাঞ্চকর ভঙ্গিতে বিছানায় ঐথির দিকে এগিয়ে এলো! ঐথি কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই অনল ঐথিকে নিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানায় শায়িত হয়ে পড়ল। ঐথিকে বুকের মধ্যিখানে পুড়িয়ে অনল প্রেমমাখানো মন্থর গলায় বলল,,

“দিন শেষে সমস্ত ক্লান্তি যেন আমার, তোমার ঐ স্নিগ্ধ মুখপানে চাইলেই শান্ত হয়ে উঠে। উতলা মন সারাক্ষণ আকুপাকু করে ক্ষণিকের জন্য হলেও তোমার একটুখানি সান্নিধ্য পেতে। দেখ না? আজ আকাশে কেমন পূর্ণিমা চাঁদ উঠেছে! ঠিক এরকম এক পূর্ণিমা সন্ধ্যাতেই প্রথমবার আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। তারপর? তারপর, সারাটা দুনিয়া এক করে আমি তোমাকে চেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ্ দীর্ঘ একটি সময় পর, দীর্ঘ এক যুদ্ধের পর আমি তোমাকে পেয়েছি। নতুন ভাবে, নতুন পরিস্থিতিতে, নতুন একটি দেশে! সব অপূর্ণ স্বপ্ন আমরা একটু একটু করে পূরণের জোগাড়ে বেশ ব্যস্ত এখন। আমাদের ভালোবাসার এখানেই ইতি ঘটবে না ঐথি! আমরা আবারও ফিরে আসব, নতুন কোনো গল্পে, নতুন কোনো চরিত্রে আবারও একে অপরের পরিপূরক হয়ে!”

ঐথি স্মিত হাসল। অনলকে শক্ত ডোরে আবদ্ধ করে অনলের কানে প্রেমময়ী গুঞ্জন তুলে বলল,,

“তুমি ঠিক বলেছ অনল, আমরা আবারও ফিরে আসব! কোনো এক পূর্ণিমা সন্ধ্যায় প্রেমের শতরূপ নিয়ে ভালোবাসার সাত রঙে নিজেদের পুনরায় রাঙাতে আমরা আবারও ফিরে আসব! জীবনের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত পাশে থাকার চিরস্থায়ী অঙ্গিকার নিয়ে আবারও আমাদের মিলন ঘটবে অনল! পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো পক্ষের আর সাহস হবে না তখন, আমাকে তোমার জীবনের নাইকা হওয়া থেকে আটকে রাখা!”

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে