#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৬
সাদ বেশ বাড়াবাড়ি করতে লাগলো। সবকিছু যেন কতোই সহজ। নিজের যখন যা মনে চাইবে তখন ঠিক সেটাই পেতে হবে এমন একটা ভাব।
সালমা বেগম আর রমজান সাহেব মেয়ের কষ্ট আর নিতে পারলেন না। সালমা বেগম বরাবরই সরল-সোজা, নরম প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু এবার তিনিও আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। সাদকে ওনি এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখেছে। এর আগে শোভার কলেজের একটা ফাংশানে দেখেছিলেন। ওনাকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো সাদ। মনে মনে ছেলের আদব-কায়দা দেখে সেদিন ওনি খুব পুলকিত হয়েছিলেন। মনে মনে নিজের মেয়ের জন্য এমন সুন্দর-সুদর্শন, ভদ্র, সরকারি চাকুরীওয়ালা ছেলেই চাইছিলেন। কতশত বিয়ের প্রস্তাব আসতো শোভার জন্য। প্রবাসী, ব্যবসায়ী এমন অনেক প্রস্তাব আসতো। সালমা বেগম আর রমজান সাহেব চাইছিলেন না প্রবাসী বা ব্যবসায়ীদের কাছে মেয়ের বিয়ে দিতে। কারণ এই দুটো পেশায় অনেক রিস্ক, যেকোনো সময় লস হতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে ওনার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিলো সাদ। কারণ মানুষের বাইরের চেহারাটা আসল নয়, সৌন্দর্য ক্ষণিকের। ভেতরের মানুষটা কেমন সেটাই দেখার বিষয়। যাইহোক, সালমা বেগম এসে সাদের গালে চড় বসিয়ে দিলেন।বললেন,
‘ তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন তোমাকে আমার খুবই ভালো লেগেছিলো। তবে আমি ভুল ছিলাম। তোমার এসব কান্ডকীর্তি দেখার পর মেয়ের মতো আমারও পুরুষ মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। জানো, তোমাদের মতো কিছু পুরুষ আর টিনার মতো কিছু নারীর জন্য এদেশে ভালো নারী-পুরুষেরও কদর নেই। যদিও টিনাকে আমি দেখিনি। কিন্তু এবার এসব বন্ধ করো আর আমার মেয়ের জীবন থেকে চিরতরে চলে যাও আর আমাদের নাতি-নাতনির কাছ থেকেও!’
সাদ বলল,
‘ দেখুন, আপনি আমার মায়ের মতো। আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন না শুভিকে!’
‘ স্টপ মিস্টার সাদ চৌধুরী। আমার নাম আপনার মুখে শুনতে চাইনা, আমি আপনার শুভি নই। আপনার শুভি সেদিন মরে গিয়েছিলো যেদিন ওর সুসাইড এ্যাটেম্প করার নিউজ পাবার পরেও আপনি আসেননি!’
শোভার কথা শুনে সাদ বলল,
‘ আমি আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি।’
‘ পারবেন কীভাবে! আপনি তখন বর সেজে বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন যে।’
‘ শোভা প্লিজ।’
‘ আমার মেয়েকে আর বিরক্ত করো না।’
‘ আন্টি আপনি একবার বললেই শোভা শুনবে।’
‘ কী শুনবে?’
‘ আমি শোভাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।’
সবাই বেশ অবাক হলো। মিলি বলল,
‘ আপনি কোথা থেকে নাটকের রিহার্সাল শিখেছেন? আপনার অভিনয় পাকাপোক্ত নয়, আগে ওটা ভালো করে শিখে আসুন।’
‘ আমি কোনো অভিনয় করছিনা।’
সাইফ শক্ত গলায় বলল,
‘ অবশ্যই এখানে আপনি নাটক করছেন। বিকজ আপনি যদি সত্যিই শোভাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসে থাকতেন তাহলে রাফুবাবাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চাইতেন না।’
‘ আপনি চুপ করুন ডাক্তার। আপনার কথা কেউ শুনতে চায়নি। আপনার কোনো রাইট নেই আমাদের ব্যাপারে কথা বলার।’
শোভা হুংকার দিয়ে বলল,
‘ অবশ্যই ওনার হান্ড্রেড পার্সেন্ট রাইট আছে আমার, আমার ফ্যামিলি নিয়ে কথা বলার।’
সাদ রেগে বলল,
‘ কে হয় ওই লোকটা তোমার?’
‘ ওনি আমার ভাই হোন। আপনজন, প্রতিবেশী, প্রিয় মানুষগুলো আমার জন্য যা করেনি, ওনি আমাদের পাশে থেকে এতোদিন আমাদের জন্য অনেককিছুই করেছেন। হাজারবার জন্মগ্রহণ করলেও আপনি মিলি আর ওনার মতো হতে পারবেন না কখনোই!’
‘ তোমার তো আবার ভাই পাতানোর স্বভাব রয়েছে, তাইনা? কীভাবে পটালে তোমরা দুই বান্ধবী ওই ডাক্তারটাকে?’
‘ ইউ বাস্টার্ড! আই উইল কিল ইউ..!’
বলেই সাইফ সাদকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। এমন সময় সাইফের মা-বাবা এসে দেখলো একটা ছেলেকে সাইফ মারছে। ঘটনাটা মিলির মুখ থেকে শুনে ওনি সাদের উদ্দেশ্য বললেন,
‘ দুর্ভাগ্য তোমার মায়ের, যিনি তোমার মতো কুলাঙ্গার জন্ম দিয়েছেন। না জানি সেই বেচারি কত কষ্ট পেয়েছেন জীবনে। সাইফ বাবা ওকে ছেড়ে দাও।’
‘ কিন্তু আম্মু..!’
‘ মারামারি করে কোনো সমাধানে আসা যায়না!’
সাদ কিছু বললো না। যতোই চাচ্ছে মাথা ঠান্ডা রাখতে ততোই গরম হয়ে উঠছে। এই সাইফটাকে ও একদম সহ্য করতে পারেনা। শোভাদের সাথে সাইফের ভালো সম্পর্ককে ওর অনুর্বর মস্তিষ্ক বারবার খারাপ চিন্তার জন্ম দেয়। যদিও সাদ মনেপ্রাণে এগুলো অবিশ্বাস করতে চায়। আসলে যার নিজের ভেতরটাই অপরিষ্কার, তার চিন্তাভাবনা পরিষ্কার হবেই বা কী করে! সে তো আশেপাশের সবাইকে নিজের মতোই ভাববে।
সাদ সাইফের মাকে ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ আন্টি, আপনি বুঝদার ব্যক্তি। আপনি একটু বোঝান শোভাকে, আমি ওর সাথে কিছু বিষয় আলোচনা করতে চাই। একা কথা বলা প্রয়োজন আমাদের।’
শোভা চিল্লিয়ে বলল,
‘ আমি কোনো আলোচনা করতে চাইনা।’
সাইফের মা এগিয়ে এসে শোভাকে বললেন,
‘ যাও!’
‘ আন্টি!’
‘ এভাবে সিনক্রিয়েট না করে দুজনের মাঝে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে ফেলো।’
শোভা অবাক হয়ে বলল,
‘ আন্টি আপনি কী আমাকে ওনার সাথে সমঝোতা করতে বলছেন?’
সাইফের মা মুচকি হেসে বললো,
‘ না মা। এখানে দেখছোনা বাচ্চার সামনে কী বিশ্রি একটা পরিবেশ তৈরি হচ্ছে? তার চেয়ে তুমি ঠান্ডা মাথায় সাদের সাথে কথা বলো, দেখো ও কীজন্য এসেছে। তারপর তুমি যা ডিসিশন নেবে সেটাই ফাইনাল।’
শোভা বুঝতে পেরে বললো,
‘ ঠিক আছে। কিন্তু ওনার কোনো অন্যায় আবদার আমি মানবোনা।’
‘ তুমি যা চাও তাই হবে, আমরা আছি তোমার পাশে।’
মায়ের কথায় সাইফ আর মিলিও একমত হলো। রমজান সাহেব শোভাকে বললেন,
‘ ওনি ঠিকই বলেছেন মা, তুমি যাও।’
সাদ মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কোনোমতে বুঝিয়েটুঝিয়ে যদি ওদের সম্পর্ক ঠিক করা যায় তাহলে ভালোই। একা কথা বলার আরেকটা কারণ হলো, শোভা বড্ড বেশী আবেগী। এরকম আবেগী মেয়েরা সবসময় কারো মনে আশ্রয় আর একটু ভালোবাসা পেলেই খুশি।
তখন বৃষ্টি কমে গিয়েছে। বাসায় যেহেতু মেহমান আছে, যদিও ওরা এসব ঘটনা জানতে পারেনি কারণ সবাই ঘুমে মগ্ন। তাই শোভা ছাদে চলে এলো। সাদও এলো। রাফুও মায়ের সাথে এলো, মায়ের কোল থেকে নামছেনা, এতোক্ষণে বুঝে গিয়েছে যেই লোকটা ওকে ধরে নিতে এসেছে সেই-ই ওর আর তুতুলের আব্বু। কিন্তু ওদের আব্বু এরকম চুরি করে ওদের নিয়ে যেতে এসেছে ভেবেই বাবার প্রতি রাফুর একটা বিদ্বেষ তৈরি হলো। তাছাড়া এতোক্ষণ যা যা ঘটছিলো সব ওর সামনে ঘটায় ওর মনে প্রচুর আঘাত পেয়েছে। কারণ ভেবেছিলো ওদের বাবা বুঝি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা, কিন্তু না। শ্রেষ্ঠ বাবারা কখনো এরকম জঘন্য কাজ করতে পারেনা। তাই রাফু ঠিক করেছে আর কখনো বাবার কাছে যাবেনা, যেতে চাইবেওনা। তুতুলকেও যেতে দিবেনা এরকম খারাপ একটা মিথ্যুক লোকের সাথে।
ছাদে বিভিন্ন ফুলের গাছ লাগানো। বৃষ্টিতে ধুয়ে সেগুলো এখন সতেজ হয়ে বাতাসে দুলছে। যেন একটা নতুন জীবন লাভ করেছে। হাসনাহেনার সুবাসে ভুরভুর করছে পুরো ছাদ। অনেকদূর অবধি এই ঘ্রাণ পৌঁছাচ্ছে। রাতজাগা নিশাচর পাখিরা ডানা ঝাপটে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে৷ যতদূর দেখা যায়, ততদূর পর্যন্ত চেয়ে রইলো শোভা। রাতের চট্টগ্রাম খুবই মোহনীয় আর আকর্ষণীয় লাগছে। এতো সুন্দর হওয়ার ছিলো রাতটা? তাও আবার আজই? জীবন এলোমেলো হওয়ার দিনগুলো নাকি বড্ড ঘোলাটে আর বিশ্রি হয়? তাহলে শোভার বেলায় প্রকৃতি এতো সাজে কেন?
কোথায় যেনো পড়েছিলো, ‘তোমরা যেটা নিজের জন্য চাও, সেটা সবসময় তোমাদের জন্য কল্যাণকর না-ও হতে পারে। কিন্তু তোমার জন্য যেটা কল্যাণকর সেটা আল্লাহ তায়ালা তোমাকে ঠিক সেটাই দেন।’
তাই হয়তো! শোভার জন্য যেটা কল্যাণকর সেটাই তো আল্লাহ তায়ালা করছেন। সাদের সাথে যে সারাজীবন থাকতে হয়নি এর চাইতে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? যে চলে যেতে চায়, তাকে যেতে দেওয়া উচিৎ। কারণ সৃষ্টিকর্তা তোমার জন্য আরো ভালো কিছু রেখেছেন। তাহলে শোভা কেন মনমরা হয়ে থাকবে? যেখানে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাঁর ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন! আর আল্লাহ তায়ালা যা নিয়ন্ত্রণ করেন সেটা কখনো অকল্যাণকর হতে পারেনা।
‘ কী বলবেন বলুন। এভাবে চুপ করে থাকার মানেটা
কী?’
‘ কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিনা।’
‘ হাস্যকর! আপনাকে আমার কাছে অসহ্য লাগছে।’
সাদ আচমকা শোভার হাত ধরে বলে উঠলো,
‘ শোভা আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
শোভার রাগ হলেও সেটা চেপে বললো,
‘ তারপর?’
‘ আমি তোমাকে চাই। আমাদের বাচ্চাদেরও চাই।’
‘ আর কিছু?’
‘ হুম। আমি তোমার সাথে সংসার করতে চাই।’
‘ এতোদিনে?’
‘ জানি অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এতোটাও দেরি হয়নি। চলো না, আমরা আবার এক হয়ে যাই। বাচ্চাদেরও তো বাবা প্রয়োজন।’
‘ তারপর?’
‘ আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে।’
‘ কেন? আপনার ফ্যামিলির কী হবে?’
‘ আব্বু তো নেই। আম্মু আছেন, তোমার যদি তাতে কোনো আপত্তি থাকে তাহলে আমি মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেবো।’
শোভার গা রি রি করতে লাগলো। ঘৃণায় শরীর গুলিয়ে উঠলো। মানুষ কতোটা স্বার্থপর হতে পারে তা সাদকে না দেখলে বুঝতে পারতোনা। মাকে পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে চায়।
সাদ বলল,
‘ শোভা আমি দুঃখিত। তোমাকে এভাবে অপমান করা আর কষ্ট দেওয়া আমার ইনটেশন ছিলোনা। কিন্তু তখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিলো। আমাকে ক্ষমা করে দাও।’
শোভা চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। রাফু মায়ের কোলে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাবা নামক মানুষটাকে দেখছে আর অবাক হচ্ছে। তুতুলের সাথে এই লোকটার কতো মিল। রাফু মায়ের কোল থেকে নেমে গেলো। বললো,
‘ আসছি আম্মু, ওয়ান মিনিট!’
‘ কী করছো?’
‘ একটা জিনিস দেখাবো!’
‘ কাকে?’
জবাব পাওয়া গেলোনা। রাফু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। রাত প্রায় একটা বেজে বিশ। তুতুল ঘুমাচ্ছিলো। মেয়েটা বড্ড ঘুমাতে ভালোবাসে। রাফু বোনকে ডেকে তুললো। রাফুকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কী?’
‘ আমাদের বাবা এসেছে। তুই চল।’
তুতুল টাস্কি খেলো। নিমিষেই চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে গেলো। বলল,
‘ কোথায়? এতো রাতে এসেছে? সত্যিই?’
‘ হুম, চল!’
রাফু বোনকে একপ্রকার টেনে নিয়ে গেলো। ছাদে এলো তুতুল। মাকে একটা লোকের পাশে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে তুতুল রাফুকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ ওনি?’
‘ হুম। জানিস, আমাদের বাবা ভালো না! আমাকে মায়ের কাছ থেকে দূরে করে দেওয়ার জন্য চুরি করতে এসেছিলো। আমাকে মিথ্যা কথাও বলেছে। আম্মু ঠিকই বলতো। এই বাবাটার সাথে কিছুতেই থাকা উচিৎ নয়।’
সাদের চোখ যখন তুতুলের নিষ্পাপ মুখের ওপর পড়লো তখন বড্ড অবাক হয়ে গেলো। হুবহু তার চেহারা। শোভাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কে এই বাচ্চাটা?’
শোভা রাফুর সামনে মিথ্যে বলতে পারলোনা। বললো,
‘ আমার মেয়ে।’
সাদ চমকে বলল,
‘ মানে আমাদের? ওয়েট..টু ইন বেবি! মানে ও আমার মেয়ে! ওহ মাই গড!’
তুতুলকে কোলে তুলে নিয়ে অনেকগুলো চুমু খেলো সাদ। রাফুকেও কাছে টেনে নিলো। শোভার রাগ হলো প্রচন্ড। আদিক্ষেতা সব। আচ্ছা, এটা কী সত্যি হতেব পারতোনা? পারতো কিন্তু সাদ চায়নি। নিজের হাতে সবটা ধ্বংস করেছে ও। যার কোনো ক্ষমা হয়না।
নিজের বাচ্চাদের উপর সাদের আলাদা একটা মায়া এসে ভর করলো। বিশেষ করে তুতুলকে দেখে। নিজের অবয়ব যেনো আরেকটা। একে কোনোমতে ছাড়া যাবেনা। সাদ শোভাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কী ঠিক করলে? আমার কাছে প্লিজ ফিরে এসো।’
‘ আপনি জানেন আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।’
‘ শোভা প্লিজ, তুমি আমার জীবনে ফিরে এসো। আমি তোমার খুব খেয়াল রাখবো!’
সাদের এসব শোভার কাছে বড্ড অসহ্য লাগছে। তাই বলল,
‘ আমি ভেবেচিন্তে জানাবো। কাল সকালে। এখন আপনি আসুন!’
সাদ বলল,
‘ আচ্ছা। তবে আমি চাই উত্তরটা যেনো পজিটিভ হয়। আমি জানি তুমিও সেটাই চাও, কারণ একটা মেয়ে সারাজীবন দুটো বাচ্চা নিয়ে, তাও হাজব্যান্ড ছাড়া চলতে পারেনা!’
শোভা তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিলো শুধু। ভাবটা এমন যেনো ও শোভাকে দয়া করছে। ডিজগাস্টিং! সাদ রাফু-তুতুলকে খুব করে আদর করলো। দেখে মনে হচ্ছে ও-ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। শোভা জানে, এগুলো সাদের ভন্ডামি মাত্র। যখন যেটা দরকার সেটা হাতিয়ে নিতে চায়। যখন দেখলো ওর পাশে আর কেউ নেই, তখনোই সুড়সুড় করে শোভার কাছে চলে এলো। এখন আবার শোভা আর রাফু-তুতুলকে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করছে। বোকা, নিজেকে অতি চালাক ভাবাটাই মানুষের সবচেয়ে বড় বোকামি।
সাদ নিজের সাথে ঘটা সবকিছু খুলে বললো। নিজের কষ্টগুলো একটু বাড়িয়ে বাড়িয়েই বললো সাদ, যদি শোভা ওর প্রতি একটু নরম হয় আরকি! সাদের পরিণতি এমন হওয়ারই ছিলো। তারপর বিদায় নিয়ে কাল সকালে আসবে বলে চলে গেলো। শোভার ভিতরে ভিতরে কষ্ট হলেও নিজেকে সামলে নিলো। কারণ আজ যদি সাদের পাশে টিনা নামক মেয়েটা থাকতো তাহলে সাদ কখনোই শোভার কাছে আসতোনা। আর এই দুমুখো রুপ যে সাদ নিতে পারে, সেটাও শোভার জানা হতোনা। যখন যার প্রয়োজন তখনই তাকে ব্যবহার করে টিস্যুর মতো ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়াটাই সাদের কাজ। যেরকম শোভার সাথে করেছে, টিনার সাথেও করেছে। কিন্তু সেখানে টিনার নিজের দোষও ছিলো যা শোভার ছিলোনা।
বাবার ভালোবাসা প্রতিটি সন্তানের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা বলে এমন নয় যে, বাবা ছাড়া কেউ বাঁচেনা। বাঁচে, বাঁচতে হয়। কিছু কিছু প্রিয় জিনিস কখনো পাওয়ার জন্য হয়না। কষ্ট ভোগ করা ভালো কিন্তু আত্মসম্মান কখনোই বিসর্জন দেওয়া উচিৎ নয়। ছোটবেলা থেকে রাফু-তুতুল বাবা ছাড়া কী বড় হচ্ছেনা? ঘাটতি যেটা আছে সেটা থাকুক, ওদেরও তো জীবনের সাথে লড়তে হবে। ছোট থেকেই অত্যন্ত দুর্লভ কিছু জিনিস হারাতে শিখুক, ভবিষ্যতে তাহলে বেশি কষ্ট অনুভব করতে হবেনা। কারণ কষ্ট অনুভব করতে করতে একসময় বড় বড় কষ্ট অনুভব করার ক্ষমতা অনেকগুণ বেড়ে যায়। তখন জীবনটাই পালটে যায়। জীবনে প্রিয় জিনিস হারাতে আর যুদ্ধে হারতে শিখতে হয়। তাহলেই জেতার মজা টের পাওয়া যায়, অনুভব করা যায়। যেটা বেঁচে থাকার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ!
শোভা দুই সন্তানকে এমনভাবেই তৈরি করবে যেন কোনোদিন মেয়েদের দুর্বল বা ভোগ করার বস্তু না ভাবতে পারে। এমনভাবে বড় করবে যাতে মা জাতির প্রতি আজীবন ওদের মনোভাব পজেটিভ থাকে, তবে অবশ্যই টিনার মতো খারাপ মহিলাদেরও যাতে চিনতে পারে সেই শিক্ষাও দেবে। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতেও শিখাবে। সর্বোপরি একটা সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশে রেখে সন্তানদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। সেটা শোভা নিজে করবে, না মিলির সাহায্যও নেবেনা। কারণ সাদকে বারবার বিশ্বাস করে শোভা যে ভুল করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত এটা।
বাসার কেউ শোভাকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না। মিলি কিছুক্ষণ গাইগুই করলো। কিন্তু মিলির আজ বাসর রাত হওয়ায় শোভা ওকে ধমকে ঘরে পাঠালো। নিজেও ফ্রেশ হয়ে রাফুর হাতে ব্যান্ডেজ করে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে দুই ছেলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো। রাত প্রায় দুটোর দিকে সবাই যার যার ঘরে ঘুমুতে গেলো। অনেকের মতে, মেয়েরা তরল পদার্থের মতো, যেই পাত্রে রাখবে সেই পাত্রের আকার ধারণ করবে। কিন্তু তারা এটা জানেনা, মেয়েরা তরল পদার্থ নয় বরং কঠিন থেকে কঠিনতর পদার্থ! মেয়েরা একবার কঠিন হলে তাঁকে আর তরলে রুপান্তর করা যাবেনা, কোনোমতেই না।
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়!
চলবে…ইনশাআল্লাহ!