#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৫
কিছুক্ষণ আগে।
শোভার হাতে থাকা মোমবাতিটা বাতাসে নিভে যায়। রাফুকে টুলের ওপর বসিয়ে দেয়। ও রাফুকে ছেড়ে দেশলাই খুঁজতে থাকে। তারপর আবার মোমবাতিটা জ্বালিয়ে রান্নাঘরের এঁটোবাসন গুলো ধুতে থাকে। কফির জন্য পানি বসায়। ওর প্রতিদিনের অভ্যাস, রাতে চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি খায়। তাছাড়া সাদ আছে বাসায়, ভাবতেই ওর প্রচন্ড মনখারাপ হলো। এই যা, বৃষ্টিটা আরেকটু কমলেই ওকে বের করে দেবে বাসা থেকে। ভাবনায় মগ্ন থাকার এই ফাঁকে রাফু ড্রইংরুমে চলে আসে। ওর কৌতূহল হয় সোফায় বসে থাকা লোকটার প্রতি। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে রাফু সাদের কাছে আসে। সাদ চোখ বন্ধ করে ছিলো বিধায় রাফুকে দেখতে পায়নি।
রাফু সাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কে আপনি?’
সাদ চোখ খুলে রাফুকে দেখে। দ্রুত নিজের কাছে টেনে নেয়। অদ্ভুত অনুভূতি হয় ওর। রাফুর মায়াভরা মুখটা দেখে ও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। শোভার সাথে প্রচুর মিল চেহারায়। তাহলে এটা কী ওরই ঔরসজাত সন্তান? ওর ছেলে?
সাদ জিজ্ঞেস করে,
‘ আমি সাদ চৌধুরী। তুমি কে?’
‘ আমি আল-রাফি। সবাই রাফু বলে ডাকে।’
‘ বয়স কত তোমার?’
‘ আম্মু বলে পাঁচ।’
‘ কীসে পড়ো?’
‘ বলবো না।’
সাদ হেসে বললো,
‘ আচ্ছা, আচ্ছা।’
‘ আপনি কে বললেন না তো?’
‘ একটু আগে যে মেয়েটা তোমার চুল মুছে দিচ্ছিলো ওনি কে হন তোমার?’
‘ আমার আম্মু।’
‘ তোমার আব্বু নেই?’
‘ আছে।’
‘ কী করে সে?’
‘ জানিনা। আমি কখনো দেখিনি।’
সাদ এবার নিশ্চিত হয় যে রাফু ওরই সন্তান। সে ওকে বুকে আগলে নেয়। তার আগে রাফুর বয়স যাচাই করে নিশ্চিত হয় যে শোভার দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছে কিনা। কারণ নিয়ন বলেছিলো শোভাকে বিবাহিত লাগে। যদিও সাদের সেরকম মনে হয়নি।
রাফুর প্রচন্ড অস্বস্তি হতে লাগলো। সে শুনেছে যারা বাচ্চাদের সাথে বেশি ঘেঁষতে চায়, ওরা ছেলেধরা হয়। তাই রাফু বলল,
‘ আমাকে ছাড়ুন।’
সাদ ওকে ছেড়ে দিয়ে গালে আর কপালে চুমু এঁকে দিয়ে নিচু গলায় বলল,
‘ আমার ছেলে।’
রাফু শুনতে পেলোনা। ও নিজের গাল মুছতে মুছতে বলল,
‘ আপনি কে হন আমার আম্মুর?’
সাদ কিছুই বলল না। রাফুর দিকেই তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর বলল,
‘ তোমার আম্মুর খুব কাছের একজন।’
‘ বুঝিনি।’
‘ মানে খুব গভীর সম্পর্ক আমাদের।’
‘ আমি আপনার কথা বুঝতে পারছিনা আংকেল। আপনার কথাগুলো ভালো না। আপনি কী কোনো চোর-ডাকাত?’
সাদ ধাক্কা খেলো ছেলের কথা শুনে।
রাফু ওর থেকে দূরে সরে যেতে চাইলো। বৃষ্টি কমে গিয়েছে একটু। রাফুর মুখে ভয় ফুটে উঠলো। লোকটা আবার সত্যিই ছেলেধরা নয় তো? রাফুর ভয়ার্ত দৃষ্টি সাদের চোখ এড়ালোনা। চট করেই মাথায় একটা প্ল্যান খেলে গেলো সাদের। ভাবলো, এখন যেহেতু ওর আশেপাশে কেউ নেই, রাফুকে নিয়ে চলে গেলেই তো পারে। বাই চান্স যদি শোভা ওর সাথে যেতে বা থাকতে রাজি না হয় তাহলে তো একূল-ওকূল সবকূলই হারাবে। শোভাও সতর্ক হয়ে যাবে বা অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে এই কাজটা করে ফেলাই বেটার। দুজন সন্তান না হোক, একজনকে নিজের কাছে রাখতে পারলেও অন্তত সাদের বুকটা কিছুটা হালকা হবে। আর শোভা! প্রথম কিছুদিন ছেলেকে ছাড়া থাকতে হয়তো একটু কষ্ট হবে, কান্না করবে৷ তারপর ভুলে যাবে। হুম, প্ল্যানটা বেশ ভালো।
যেই ভাবা সেই কাজ। সাদ রাফুর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো। বলল,
‘ এদিকে আসো তো একটু।’
‘ কেন?’
‘ ভয় পাচ্ছো কেন? আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি।’
‘ তাহলে কেন এসেছেন?’
‘ বন্ধুত্ব করতে।’
‘ কার সঙ্গে?’
‘ তোমার সঙ্গে। আচ্ছা, তোমার আরও একটা ভাই আছে তাইনা?’
‘ না না। বোন।’
‘ নাম কী ওর?’
‘ উম্মে রুফি। সবাই তুতুল বলে ডাকে।’
‘ বাহ! কিউট নেইম।’
এভাবেই রাফুকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, গল্প করে দীর্ঘ পাঁচমিনিট যাবৎ। কৌতুক বলে রাফুকে হাসায়। জাদুকরের মতোই মিশে যায় রাফুর সাথে। বাচ্চাদের ইম্প্রেস করার জন্য একেবারে পারফেক্ট সাদ। রাফুও সহজেই মিশে যায় লোকটার সাথে। এরই সুযোগ কাজে লাগায় সাদ।
‘ রাফুবাবা!’
‘ জ্বি!’
‘ বৃষ্টি ভালো লাগে?’
‘ হুম।’
‘ ভিজবে?’
‘ নাহ।’
‘ কেন?’
‘ আম্মু না করেছে। ছোটআম্মু বকা দেবে।’
‘ কেউ কিছু বলবেনা৷ আমার সাথে চলো।’
রাফু আঁৎকে উঠে বলল,
‘ কোথায়?’
সাদ হেসে বললো,
‘ ছাদে। বৃষ্টিতে ভিজতে হয় বাবা, নইলে তুমি এর মজাই বুঝবেনা। এতো এতো পানি কী আল্লাহ তায়ালা এমনি এমনি ফেলছে? আমাদের জন্যই তো ফেলছে যাতে আমরা আনন্দ করতে পারি। তুমি কী এই আনন্দ উপভোগ করতে চাওনা?’
রাফু গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসলো। সাদ যেহেতু বলেছে ওর সাথে ভিজলে মা কিছু বলবেনা, তাহলে নিশ্চয়ই কিছু বলবেনা। ও ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘ চাই।’
সাদ মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
‘ তাহলে দেরি কেন? চলো।’
ওদিকে থালাগুলো ধুয়ে শোভা মুছে রেখে দিলো। কফির পানিটা ফ্লাস্কে ঢেলে নিয়ে পেছনে ফিরে দেখলো রাফু টুলের উপর বসা নেই। টুলটা একটু উঁচু হওয়ায় রাফু নামতে পারেনা সেখান থেকে। এজন্যই শোভা নিশ্চিত মনে কাজ করছিলো। তাহলে নামলো কীভাবে? সাদ! ওহ মাই গড। ভেবেই দৌড়ে করিডোর আর বারান্দা পেরিয়ে ধুপধাপ করে ড্রইংরুমের দিকে ছুট লাগালো শোভা।
হাত থেকে টর্চটা যেন পড়ে যাবে। শরীর কাঁপছে। কেউ তো জানেই না সাদ এখানে, তাহলে এতোক্ষণে ওকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিতো সবাই। নাহ, ভুলটা শোভারই। সাদকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া বা বসতে দেওয়াটাই ওর সবচেয়ে বড় ভুল। কীভাবে পারলো এই মস্ত বড় ভুল করতে? এতোটাও নির্বোধ ও হলো কী করে?
একছুটে ড্রইংরুমে এসে শোভা দেখলো সাদ নেই। রাফুকে খুঁজে দেখলো সেও নেই। দরজা হাট করে খোলা, শোভা দ্রুত সিঁড়িঘরে এলো। ভেজা জুতোর কর্দমাক্ত পায়ের ছাপ সিঁড়িতে। দ্রুত নামার চিহ্ন ফুটিয়ে তুলেছে। শোভা একপ্রকার দৌড়ে নামলো নিচে। গিয়ে দেখে রাস্তার ওপাশে রাখা একটা গাড়িতে একটা লোক উঠছে। কোলের বাচ্চাটা দেখে শোভা বুঝতে পারলো এটাই সাদ। রাফুকে নিয়ে পালাতে চাইছে!
বৃষ্টির ঝাপটার তোয়াক্কা না করেই শোভা সেদিকে ছুট লাগালো। হুমড়ি খেয়ে পড়লো একবার রাস্তায়। উঠে আবারও ছুট লাগালো এবং সাদকে একটা ধাক্কা মারলো। ফলে রাফু সাদের কোল থেকে আলগা হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। লোহার শিকে লেগে ওর হাত কেটে গেলো, তবে সামান্যই।
আচমকা সাদ হকচকিয়ে উঠলো। টাল সামলে ঘুরে দেখলো শোভা। রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে সাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এবার সরাসরি দুজন দাঁড়িয়ে আছে। সাদ অনেকবছর পর শোভাকে লক্ষ্য করতে পারলো। ভীষণ সুন্দর হয়েছে শোভা, ভীষণ! চোখ ফেরানো দায়। শাড়িতে আর এলোমেলো চুলে বৃষ্টিতে ভেজা শোভাকে যে এই অন্ধকারেও কেমন লাগছিলো সেটার বর্ণনা করার শক্তিটুকু পর্যন্ত পেলোনা সাদ। কষে একটা থাপ্পড় মারলো শোভা ওর গালে। ভাতের হোটেলের ছাউনির নিচে রাফুকে বসিয়ে দিয়ে দোকানের কাছে পড়ে থাকা একটা ছোটখাটো লাঠি এনে সাদের পিঠ বরাবর কয়েকটা বারি মারলো। রাগে শোভা এতোটাই জর্জরিত যে এটা যে রাস্তা ও বেমালুম ভুলে গেলো।
এদিকে সাদের ভাবান্তর নেই। বুঝে গিয়েছে যে প্ল্যান ফ্লপ করেছে। তাই এভাবেই দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো শোভার সুন্দর মুখপানে। রাফু যে ব্যথায় কাঁদছে সেদিকেও শোভার হেলদোল নেই। সাদকে ইচ্ছেমতো মেরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো রাস্তায়। তারপর রাফুকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় চলে এলো। একটা কথা পর্যন্ত বললো না শোভা।
সাদ শোভার পেছন পেছন গেলো। ডাকছে, দাঁড়াতে বলছে শোভাকে।
‘ প্লিজ দাঁড়াও, শুভি।’
শোভা দাঁড়ালোনা। দৌড়ে বাসার ভিতর ঢুকে পড়লো। সাদও গেলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শোভাকে প্রায় ধরেই ফেললো সাদ। আঁচলে টান দিবার চেষ্টা করতে লাগলেই শোভা চেঁচামেচি করতে লাগলো। আর মায়ের কোলে রাফু ভয় পেয়ে সিঁটিয়ে আছে। এতোক্ষণে বুঝে ফেলেছে যে এই লোকটা একটা ছেলেধরা।
শোভার চেঁচামেচি যখন পৌঁছালো মিলি আর সাইফের কানে, আর তক্ষুণি ওরা ছুটে এলো। এসে সাদকে দেখে ওরা রীতিমতো অবাক হলো। শোভাকে এরকম করতে দেখে দুজনেই ঘাবড়ে গেলো। মিলি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
‘ আপনি এখানে কেন?’
সাদ বলল,
‘ সেই কৈফিয়ত আমি তোমাকে কেন দেবো?’
‘ কারণ আপনার কোনো অধিকার নেই আমার শুভিকে এভাবে হেনস্তা করার!’
‘ আমি কাউকে হেনস্তা করিনি।’
শোভা সাইফের কোলে রাফুকে দিয়ে ধাক্কা দিলো সাদকে। বলল,
‘ তাহলে আমার বাচ্চাকে কেন চুরি করতে এসেছেন?’
মিলি অবাক হয়ে বলল,
‘ মানে?’
শোভা কাঁদতে কাঁদতে পুরো ঘটনাটা বললো মিলিকে। শুনে মিলি রেগে শোভাকেই চড় মেরে বলল,
‘ কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না, জানার পরেও তুই একে খাতির করে ঘরে ঢুকিয়েছিস? তোর বোধবুদ্ধি কবে হবে? তুই এতো সরল, এতো ভালো কেন? এজন্যই সবাই তোকে ঠকাতে চায়।’
‘ আমি পারিনা মিলি। আমি কাউকে কষ্ট দিতে চাইনা। কিন্তু ওনি বারবার আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছেন। আমার থেকে সব কেড়ে নিয়েছে কিছু বলিনি, কিন্তু আমার সন্তানদের দিকে হাত বাড়ালে সেই হাত আমি কেটে রেখে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো। ভালো শুভি যেমন নরম, খারাপ শুভি ঠিক ততোটাই কঠিন। এবার আমি আর কোনো কম্প্রোমাইজ করবোনা, নিজ হাতে শাস্তি দিবো।’
সাদ শোভাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল,
‘ ওদের প্রতি তো আমার অধিকার আছে। তা নয় কী?’
‘ নাহ। কোনোদিনই ছিলোনা। আপনি ভুল করছেন। তাছাড়া আপনার নিজের এখন সংসার আছে, নিশ্চয়ই বউ-বাচ্চা, বাবা-মাকে নিয়ে সুখেই আছেন। তাহলে আমার রক্তজল করা বাঁচার প্রেরণাটা বারবার কেন খুন করতে আসেন?’
‘ আমার এখন কেউ নেই শোভা। না হলো ঘর-সংসার, না হতে পেরেছি বাবা। না নিজের বাবা-মায়ের খেয়াল রাখতে পেরেছি। আমার সব এমনিতেই ধ্বংস হয়ে গেলো।’
অট্টহাসিতে মেতে উঠলো মিলি। একেই বোধহয় বলে রিভেঞ্জ অব নেচার বা যেমন কর্ম তেমন ফল। মিলির চোখের কোণে পানি জমে গেলো।
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। ভুল-ভ্রান্তি মাফ করবেন। রি-চেইক করিনি।
চলবে….ইনশাআল্লাহ!