#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৪
‘ রাফু তুমি কিন্তু বড্ড দুষ্ট হচ্ছো।’
রাফু গাল ফুলিয়ে বলল,
‘ আমি দুষ্ট নই।’
‘ তাহলে এরকম ভিজলে কীভাবে?’
রাফু মাথা নিচু করে রইলো। শোভা ধমক দিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো,
‘ বল!’
‘ সাইফ আংকেল।’
শোভা অবাক হয়ে বলল,
‘ কী করেছে?’
‘ ওনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে এভাবে বৃষ্টির পানি দিয়ে ছিঁটাছিঁটি করছিলো। আমি ওখানে গেলে আংকেল বলল এটা নাকি অনেক মজার খেলা। বৃষ্টির সাথে খেলা না করলে নাকি জীবন সুন্দর হয়না।’
শোভা ছেলের মুখে পাকাপাকা কথা শুনে মাথায় হাত দিলো। তার শান্ত, ভালো বাচ্চাটা আজকাল বড্ড চটাশ চটাশ কথা বলা শিখেছে। শোভা হেসে তোয়ালে দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে বলল,
‘ ঠিকই বলেছে। কিন্তু বৃষ্টির সাথে খেলা করতে হয় বড় হলে।’
‘ কত বড়?’
‘ এই ধরো আমার মতো।’
‘ তোমার মতো বড় হতে তো আরও অনেক বছর লাগবে। ততোদিন কী আমি বৃষ্টিতে ভিজবো না?’
‘ ভিজবে, কিন্তু অল্প!’
‘ তুতুল ও ভিজবে?’
‘ হুম। মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসে।’
‘ তুমিও!’
শোভা উত্তর দিলোনা। কারণ বৃষ্টিতে ভিজার মন সেদিনই মরে গিয়েছিলো যেদিন ওর রঙিন জীবনটা
সাদ নামক মানুষটার হাতে মরে গিয়েছিলো। হঠাৎ চোখের কোণ মুছে ড্রইংরুমের কর্ণারে রাখা টিস্যু পেপারের বক্সটা আনতে ঘুরলো তখনই ওর চোখ গেলো দরজার দিকে। আবছা আলোয় একটা সুঠামদেহী পুরুষের অবয়ব মেঝেতে লুকোচুরি খেলছে। শোভা ধীরপায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো। দুরু দুরু বুক নিয়ে যেই না সামনে এগুলো, তখনই দেখতে পেলো একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে।এবং লোকটা আর কেউ নয় ওর অতিপরিচিত, একসময়ের প্রিয় মানুষ, ভালোবাসার মানুষ, শোভার প্রাক্তন স্বামী সাদ চৌধুরী। পরনের বসন ভেজা। মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কিন্তু শোভা সে দৃষ্টিকে প্রাধান্য দিল না। কারণ এখন শুধুই তার প্রাক্তন। ওর সাথে কোন সম্পর্ক হবার দ্বিতীয় কোনো সুযোগ নেই। তারচেয়ে বড় কথা এই লোকটা একটা প্রতারক এইসব ভেবে ভাবতে-ভাবতে শোভা একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখা এক পশলা বৃষ্টি ওর কাছে ভয়ানক হয়ে উঠল। শোভা ভাবনার জগৎে ঢুকে প্রাণপণে চাইছে মুছে যাক এই এক পশলা বৃষ্টি পৃথিবীর বুক থেকে। দীর্ঘ কয়েকটা ক্ষণ এভাবেই কেটে গেলো।
এই অন্ধকার রাত্রিতে শোভা যখন দরজার সামনে সাদ কে দেখতে পেল তখন সে চমকে উঠলো! মনে হলো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, একি দেখছে ও? আদৌ সত্যি এটা? নাকি চোখের ভুল! এতোক্ষণ ভেবেছিলো এটা বুঝি হ্যালুসিলেশন। কিন্তু অবয়বটা তো ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি সতেজ।
তাহলে কী সত্যি! যদি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে কেন এসেছে মানুষটা ওর গোছানো জীবনটা তছনছ করতে আবারো? সাদ কী এখনো শান্তি পায়নি শোভার জীবন নষ্ট করে।
সাদ নিজেকে ধাতস্থ করলো। কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলো,
‘শোভা?’
কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শোভা ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আপনি?’
‘হুম আমি।’
‘আপনি কী সত্যিই এসেছেন?’
‘হুম।’
‘একটা খারাপ মেয়ের কাছে কী দরকারে?’
সাদ বলার ভাষা খুঁজে পেলোনা। ভেজা গায়ে বেশিক্ষণ থাকার ফলে হাঁচি-কাশি দিতে লাগলো। শোভা হাতে থাকা তোয়ালেটা ছুঁড়ে মারলো ওর উপর। মুখে বলল,
‘ মুছে নিন।’
সাদ নিলো তোয়ালেটা। মাথার চুলগুলো মুছে সেভাবেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলো।
‘ আপনি কী এখন চলে যাবেন? বাইরে যেহেতু আবহাওয়া খারাপ, একটু পরে গেলে ভালো হয়। বসুন।’
‘ আসলে তোমার সাথে আমার খুব প্রয়োজন আছে।’
‘ কী প্রয়োজন?’
‘ বাসায় কী আর কেউ নেই?’
‘ আছে। অনেক মানুষ আছে, ভেতরের ঘরে।’
‘ ওহহ!’
শোভা বলল,
‘ বাসায় অনেক মেহমান আছে। আশা করি আপনি এমন কিছু করবেন না যাতে সিনক্রিয়েট হয়।’
‘ কী হয়েছে বাসায়?’
‘ মিলির বিয়ে।’
‘ মিলি মানে? আমাদের মিলি?’
‘ আমাদের নয়, আমার মিলি।’
সাদ চুপ করে রইলো। এতোক্ষণ শোভা ওর সাথে নম্রভাবেই কথা বলেছে। সাদ চাইছে এভাবেই ওকে শান্ত রাখতে। কারণ ওকে উত্তেজিত করলে পরিস্থিতি উল্টোদিকে চলে যাবে। সাদ সোফায় বসলো। ভেতরের ঘরগুলো থেকে মানুষের কোলাহল ভেসে আসছে। কারেন্ট এখনো আসেনি, যার ফলে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। আর মোমবাতির আলোয় যতটুকু
দেখা যাচ্ছে তাতে শোভার অবয়ব শুধু ছায়ার মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে। ওর চেহারা সাদ দেখতে পাচ্ছেনা, কারণ শোভা আগেই ওর মুখ ঢেকে নিয়েছে। লোকটাকে নিজের মুখ দেখাতে ও চায় না। সাদ বুঝতে পারলো এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
কিন্তু রাফু এতোক্ষণ মাকে একটা অচেনা লোকের সাথে কথা বলতে দেখে চুপ হয়ে ছিলো। শোভা ওকে নিজের সাথে আগলে রেখেছিলো। ও ভাবতেও পারছেনা সাদ এখানে অবধি পৌঁছে গিয়েছে। বুকের ভেতর ভয়ের বিশাল একটা দেয়াল তৈরি হলেও নিজেকে যথাসম্ভব ঠান্ডা রেখে ও লোকটার সাথে কথা বলছে। পাছে না রাফুকে চিনে ফেলে। এটারই আভাস পাচ্ছিলো কী শোভা? পুরোনো স্মৃতিগুলো একারণেই মস্তিষ্কে নাড়া দিচ্ছিলো! এইসব খারাপ স্মৃতি কেন মুছে না ওর জীবন থেকে? অভিশপ্ত অতীতের থেকে যেন পালানোর কোনো পথ নেই।
শোভা রাফুকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়লো। সাদ একা সোফায় বসে আগের দিনগুলোর কথা ভাবছে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। আনন্দও হচ্ছে। আচ্ছা ওর বাচ্চাগুলো কোথায়? এতোক্ষণ তো ওদের কথা মনেই পড়েনি। আরে, শোভা যে বাচ্চাটার মাথা মুছে দিচ্ছিলো ওটাই! ওয়েট ওয়েট…ডিজগাস্টিং। এটা নিশ্চয় ওর সন্তান। এত কাছাকাছি থেকেও সাদ বাচ্চাটার দিকে একবার তাকালো না, ড্যাম ইট! ওর রাগ হতে লাগলো। কিন্তু এখন রাগলে চলবেনা। এখানে যেহেতু এসেছে ড্যাম শিওর বাচ্চাদের নিজের কাছে পাবেই। তাই সাদ রিল্যাক্স হয়ে বসলো। বাইরে এখনো ঝড়ো বৃষ্টি। সাদের বুকে জমে আছে হাজারো মেঘের টুকরো। শোভাকে যদি সবসময় ও কাছে পেতো, চিরদিন যদি একসাথে থাকতে পারে এটাই বোঝাবে ও শোভাকে। ও নিশ্চয়ই রাজি হবে। জানালার দিকে একমনে তাকিয়ে সাদ গুনগুনিয়ে গান ধরলো!
“কেন মেঘ আসে হৃদয়ও আকাশে
তোমারে দেখিতে দেয়না,
মোহ মেঘে তোমারে দেখিতে দেয়না
🍁
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না?”
____________________
মিলি বসে আছে সোফায়। সামনে খাটে বসে আছে সাইফ। দুজনেই চুপ। মিলি বসে মোবাইল স্ক্রল করছিলো। সাইফ ভয়কে জয় করে বলল,
‘ মিলি!’
মিলি সাইফের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ কী?’
‘ মানে বলতে চাইছিলাম আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলেন কেন?’
‘ আপনি যে কারণে রাজি, আমিও সেকারণেই।’
‘ বুঝতে পারলাম না।’
‘ আপনার আম্মু খুব করে আমাকে পছন্দ করেছে, আমাকে নিজের মেয়ে ভেবে নিয়েছে, ওনি খুব করে চায় যাতে আমি আপনাকে বিয়ে করি, শুভিও চায়। আমার সন্তানেরাও মত দিয়েছে আপনাকে বিয়ে করতে। আন্টি-আংকেলরাও চায়। সবচেয়ে বড় কথা আপনার আম্মুর চিন্তাভাবনা আর আমার চিন্তাভাবনা এক, আমাদের মাঝে কোনো ফারাক নেই। আমি এমন একজনকে মা হিসেবে পেয়ে খুবই খুশি। এসব কারণেই আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।’
সাইফ একটু রাগলো। সবার চাওয়া-পাওয়া মিলি দাম দিলো। কিন্তু প্রথম থেকেই যে সাইফ ওকে পছন্দ করে, ভালোবাসে, ওর জন্য পাঁচটা বছর অপেক্ষা করেছে সেটা কী মিলির কাছে কিছুই নয়? মিলি এতো নিষ্ঠুর? সাইফের জন্য কী ওর মনে একটু জায়গাও নেই? এতগুলো বছরেও সাইফ ওর জীবনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি? মিলিকে বিয়ে করে কী ও কোনো ভুল করেছে!
এসব ভেবেই একপ্রকার রাগের মাথায় সাইফ মিলিকে বলল,
‘ আপনি সবার কথাই বললেন। কিন্তু আমার কথা তো একবার ভাবলেনও না আপনি প্রিয়তা! আমি যে আপনার জন্য এতগুলো বছর অপেক্ষা করলাম, সেগুলোর কোনো দাম নেই? দেখুন, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি আপনার প্রতীক্ষায় রয়েছি। আমি আপনাকে ভালোবাসি, আপনি কেন বুঝেও না বোঝার ভান করেন? কেন?’
মিলি প্রথমে অবাক হয়ে সাইফের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর দ্বিতীয়বারের মতো থাপ্পড় পড়লো সাইফের গালে। ভেজা চোখ নিয়ে সাইফ মিলির ফিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সাইফের কাছে এগিয়ে এসে ওর ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
‘ বিশাল বড় ভাষণ দিতে পারেন, আর এই ছোট্ট কথাটা বলতে পারেন না যে “আমি আপনাকে ভালোবাসি?” এটা বলতেই আপনার পাঁচ বছর খরচ হয়ে গিয়েছে?’
সাইফ অবাক হয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আপনি ভালোবাসার কথায় বিশ্বাস করেন না বলেই বলিনি।’
‘ তাহলেও বলতে হয়।’
‘ বলতে গেলেই আপনার হাতের থাপ্পড়ের শিকার হতাম। নয় কী?’
‘ হুম। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটির হাতে থাপ্পড় খাওয়াও সৌভাগ্যের ব্যাপার।’
সাইফ হাসলো। মিলিকে বলল,
‘ আপনাকে এখন সত্যি সত্যি আমার মনে হচ্ছে।’
‘ তাই নাকি?’
‘ হুম।’
মিলি ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ প্রিয়তা কে?’
‘ আমি যাকে পছন্দ করি সে কল্পিত আপনি!’
মিলি কিছু ব্যাঙ্গাত্মক কথা বলতে রেডি হচ্ছিলো, কিন্তু তা হলোনা। কারণ বাইরের ঘর থেকে চেঁচামেচি আসছে। শোভার চেঁচামেচি। মিলি বুঝতে পারলো না বৃষ্টিভেজা এই মুহূর্তে, এতো রাতে, শোভা ঘরভর্তি মেহমান রেখে কীভাবে চেঁচামেচি করছে। কিন্তু কিছু একটা না হলে শোভা কখনো এমন করবেনা। সাইফও অবাক হলো। দুজনে নিজেদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দরজা খুলে ড্রইংরুমে গেলো। এবং অন্ধকারে টর্চ লাইটের আলোয় যাকে দেখলো সেটার জন্য ওরা কেউই প্রস্তত ছিলো না।
চলবে….ইনশাআল্লাহ!