এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-০৮

0
3102

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে: ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮

সাদ নামক অমানুষটা শোভার পিছু ছাড়লো না। হসপিটালে যে ক’দিন রাখা হলো সেই ক’দিন নিয়মিত গিয়ে ঝামেলা করে আসতো। ওর এসবে অতিষ্ঠ হয়ে রিলিজ করার একদিন আগেই শোভাকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। কারণ সাদের হাত অনেক লম্বা। যদি ওদের কিছু করে বসে? তখন কোনোকিছু করার থাকবেনা। শোভা জাস্ট এসব সহ্য করতে পারছেনা। লোকটা কেন তার জীবন নিয়ে আবারও ছিনিমিনি খেলতে চাইছে? সে কী বুঝতে পারছে না শোভা আর ওকে চায়না! এক বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা দূর অনুভূতিটুকুও নেই। শোভা এখন তাঁর সন্তানদের নিয়ে বাঁচতে চায়।

মিলিও শোভার বাসায় শিফট করেছে। সে নিজ হাতে বাচ্চাদের খাবার বানিয়ে দিচ্ছে, খেয়াল রাখছে। একজনকে ঘুম পাড়িয়ে অন্যজনকে নিয়ে ঘরে হাঁটাহাঁটি করছে। নিজের সন্তান হলে যেরকম করতো, সেভাবেই শোভার বাচ্চাদের দেখে রাখছে।
শোভার মেয়ের হার্টের প্রবলেমটা এখন আর অতোটা নেই৷ ডাক্তার সাইফই সবকিছু দেখেছেন, চিকিৎসা করেছেন। সেদিন এটা জানার জন্যেই মিলি সাইফের কাছে গিয়েছিলো। অশান্ত মনটা বারবার জানিয়ে দিচ্ছিলো এই বুঝি শোভার মেয়েটার কিছু হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এতোটাও কঠিন হননি। সুস্থ রেখেছেন আলহামদুলিল্লাহ।

শোভা একটু একটু হাঁটার চেষ্টা করে। পেটের সেলাইগুলো মোটামুটি শুকিয়ে এসেছে। আজকালের মধ্যে ড্রেসিং কর‍তে যেতে হবে হসপিটালে। মিলি ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ঘরময় পায়চারি করছিলো। তখুনি সালমা বেগম এসে বললেন, ‘কী রে মিলি তুই? এখনো সকালের খাবারটা মুখে দিসনি?’

‘ এই তো যাচ্ছি। পুচ্চুটা ঘুমিয়ে নিক।’

‘ আমার কোলে দে। শিগগির খাবারটা খেয়ে নে মা। নইলে পেটে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হবে!’

‘ তুমি খেয়েছো? শুভি খেয়েছে?’

‘ হুম। তুইই বাকি। যা না মা!’

মিলি সালমা বেগমের তোড়জোড়ে একপ্রকার বাধ্য হয়ে ডাইনিংয়ে গেলো। সে সকালে নাস্তা খেতে পারেনা। ভাত আর আলুভাজি মেখে খেতে শুরু করলো। এমন সময়ই ফোন বাজতে লাগলো। সালমা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘মেয়েটাকে কেউ দু-দন্ড শান্তি দিচ্ছেনা। খেতে বসেছে এখনও ফোন করছে।’

মিলি ফোনটা রিসিভ করলো। ম্যাজিস্ট্রেট রিপার ফোন। মিলির খুব পরিচিত। মিলির কথায়ই শোভার ডিভোর্স পেপারগুলো তিনি রেডি করে রেখেছিলেন। এখন সেইমতোই কাজ চলছে। মিলি খেতে খেতে বললো, ‘বলুন!’

‘ ব্যস্ত নাকি?’

‘ না আপু, খাচ্ছিলাম।’

‘ আচ্ছা, তুমি আমার সাথে দেখা করিও।’

‘ কোনো সমস্যা?’

‘ আরেহ না। জানোই তো এসবে কত ফর্মালিটি আছে। শোভা তো আসতে পারছেনা, ও-ই বললো তোমাকে পাঠাবে। এসে কাগজপত্র গুলো নিয়ে যেতে।’

‘ ওহহ আচ্ছা। আমি আসবো।’

‘ তাহলে বিকেলের দিকে এসো।’

‘ আচ্ছা। রাখি।’

মিলি ফোন রেখে খাওয়ায় মন দিলো। সম্প্রতি ডাক্তার সাইফের সাথে যোগাযোগ রক্ষার খাতিরে মিলি তাঁর সাথে ম্যাসেঞ্জারে কানেক্ট হয়েছে। ওদিকে সাইফ তো সুযোগ পেয়েছে মিলির চোখে নিজেকে সেরা প্রমাণ করার। তাই ম্যাসেজ করলো মিলিকে।

‘ হাই!’

খাওয়ার মাঝখানে ম্যাসেজ আসায় মিলি খুব বিরক্ত হলো। এসব কী? ওই হাঁদা ডাক্তার ওকে কেন হাই পাঠাবে? মিলির সাথে কী ওর “হাই/হ্যালো” করার সম্পর্ক নাকি? বিরক্ত মিলি কাঁচামরিচে কামড় দিয়ে ফোনটা দূরে ঠেলে দিলো। ধীরেসুস্থে খাওয়া সেরে শোভার ঘরে গিয়ে দেখে পুচ্চু-পুঁচকি দুজনেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। শোভা শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। বারান্দার দরজা দিয়ে ফুরফুরে বাতাস আসছে, মিলি দরজাটা আটকে দিলো।

ড্রইংরুমে এসে বসলো একটু। রান্নাঘরে সালমা বেগম দুপুরের রান্না করছেন, টুংটাং শব্দ আসছে। কোনো কাজটাজ নেই বলে মিলি ফোনটা হাতে নিলো। সাইফ ইতিমধ্যে আরও একবার “হাই” লিখে পাঠিয়েছে। মিলি রেগে সরাসরি ফোন করলো।

সাইফ এবার একটু বোকা বনে গেলো। ভেবেছিলো চ্যাটের মাধ্যমে ভাব জমাবে। কিন্তু এই তেজী ঘোড়া তো সরাসরি ফোন করে বসলো। ইতস্তত করে ফোন ধরে বললো, ‘জি বলুন।’

মিলি রেগে বললো, ‘আপনি কী আমার দুলাভাই বা বফ লাগেন?’

আপনাআপনি সাইফের ঠোঁট উল্টে গেলো। ভীত গলায় বললো, ‘না।’

‘ তাহলে বারবার “হাই/হ্যালো” পাঠাচ্ছেন কেন?”

‘ তাহলে কী পাঠাবো?’

‘ মুসলমান হিসেবে সালাম বিনিময় করবেন।’

‘ ওহহ আচ্ছা। ঠিক আছে!’

‘ আচ্ছা আপনি কী নকল করে পাশ করেছিলেন? একজন ডাক্তারের তো এই হাল হওয়ার কথা নয়। ডাক্তারদের এটিটিউডই আলাদা থাকে, আর আপনি? দেখলেই মনে হয় মাকাল ফল!’

‘ আ আসলে আমি ওরকমই!’

‘ না। আপনার বাইরেরটা যাই হোক না কেন, মনে মনে আপনি একটা মিচকা শয়তান। আর কিছু বলার আছে আপনার?’

সাইফ অপমানিত বোধ করলো। কোনোমতে বলল, ‘বেবিরা কেমন আছে?’

‘ ভালো।’

‘ আচ্ছা রেখে দিই।’

‘ আল্লাহ হাফেজ।’

ফোন রেখে সাইফ একগ্লাস পানি ঢকঢক করে খেলো। ও আসলেই বাইরে-ভিতরে দুরকম। ভিতরে ভিতরে মিলিকে ভালোবাসে, বাইরে এমন একটা ভাব যেন প্রেম নামক জিনিসটা ও বুঝেইনা। এই মিলিটা বড্ড ভয়ানক। মুখের উপর এমনসব কথা বলে দেয়, যাতে করে উত্তর দেওয়ার জো পাওয়া যায়না। পরবর্তী প্যাশেন্টেকে ভেতরে ডেকে নিলো সে।

এদিকে সাইফের সাথে কথা শেষ করেই মিলি আবার শোভার ঘরে গেলো। শোভা চুল আঁচড়াচ্ছে। মিলি ধমকে বললো, ‘আমাকে বললে আমি কী বেঁধে দিতাম না?’

শোভা হেসে বললো, ‘তোরা সবাই কী আমাকে কোলে করে রাখবি, পাগল। সব কাজ তোরাই করছিস আর আমি বসে বসে আলুর বস্তা হচ্ছি।’

মিলি চিরুনিটা নিয়ে শোভার চুল আঁচড়ে বিনুনি কাটতে লাগলো। শোভা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। বাচ্চাদেরকে মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে মিলিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘শোন না মিলু।’

‘ বল।’

‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’

‘ হাজারটা করতে পারিস।’

‘ তুই রাগবি না তো?’

‘ রাগার মতো না বললে অবশ্যই রাগবোনা।’

‘ প্রশ্নটা সাদ আর আমাকে নিয়ে।’

মিলি সহজভাবেই বললো, ‘বল।’

শোভা জিজ্ঞেস করলো, ‘বাচ্চারা কার মতো হয়েছে রে? আমার মতো নাকি সাদের মতো?’

মিলিও বাচ্চাদের দেখলো। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলতে লাগলো, ‘ছেলেটা পুরো তুই। আর পুচকির চেহারায় সাইদ্দার চেহারার ছাপ আছে, নাকটাও ওনারই মতো। এককথায় মেয়েটা ওই সাইদ্দার কাটিংকুটিং পাইসে।’

শোভা হেসে বললো, ‘আমার ধারণাটা তাহলে ঠিক?’

‘ কীসের ধারণা?’

‘ আমিও পুঁচকির সাথে ওই লোকটার মিল পেয়েছি। তাই তো তোকে জিজ্ঞেস করলাম।’

মিলি শোভাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই এখনো ওনাকে ভালোবাসিস, তাইনা?’

শোভা উত্তর দিলোনা। কিন্তু সত্যিই কী সাদকে ভালোবাসে মনে মনে? না কখনো নয়। ও শুধু ঘৃণা পাবার যোগ্য। যেটা শোভা আজীবন করে যাবে। বললো, ‘আগে বাসতাম। এখন একফোঁটাও না।’

‘ অনেক ভালো। এটাই তো চাই।’

‘ এটাই সত্যি। মেয়েরা যেমন নরম হতে পারে, ততোধিক কঠিনও হতে পারে। আঘাত পেলে মেয়েরা যে পাথরের মতো কঠিন হয়ে বিপদের মোকাবেলা করতে পারে, সেটা আমি জেনে গিয়েছি!’

‘ তোর অনেক ভালো হবে শুভি।’

‘ এজন্য যে তোর কাছে আমি ঋণী!’

‘ মোটেও না। আমি তোর বন্ধু। সেই দায়িত্ব পালন করেছি!’

‘ এরচেয়েও বেশিকিছু করেছিস। নিজের আপন না ভাবলে কেউ কারো জন্য অতোটা লড়াই কর‍তে পারেনা। আজ আমি বেঁচে আছি, বাচ্চারা বেঁচে আছে সবটার ক্রেডিট একমাত্র তোর।’

_________

সাদের এসব কান্ডকীর্তি কেউ জানতে পারেনি। টিনা অতোটা পাত্তাও দেয়নি, সে এখন বাইরে গিয়েছে ইফতির সাথে দেখা করতে। যদিও সবাই জানে শপিংয়ে গিয়েছে। সাদিদ সাহেব বিকেলবেলা হালকা নাস্তা খেয়ে বারান্দায় বসে আছেন। এমন সময় সাদ এলো। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সাদিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘অফিস যাওনা কেন?’

‘ এমনি।’

‘ এমন করলে তো হবেনা। নিয়মিত অফিস যাবে।’

‘ আব্বু।’

‘ কিছু বলবে?’

‘ হুম!’

‘ কী বিষয়ে?’

‘ শোভার বিষয়ে?’

‘ কে শোভা?’

‘ ভুলে গেলেন? রমজান আঙ্কেলের মেয়ে, আমার প্রথম স্ত্রী শোভা।’

হঠাৎ মনে পড়লো শোভার কথা। একদম ভুলেই গিয়েছিলো। ওদের ডিভোর্সটা বাকি রয়েছে। সাদিদ সাহেব ভাবেন রমজান যতোই শত্রু হোক, মানুষটা ভালো, আত্মসম্মান প্রবল। আর সেই রমজানের মেয়ে কিনা গোপনে সাদকে বিয়ে করলো৷ আবার কার সাথে নষ্টামি করে বাচ্চা পয়দা করে সাদের উপর দোষ চাপায়। নষ্ট হয়ে গিয়েছে মেয়েটা। অতিরিক্ত আদরে বাঁদর বানিয়ে ফেলেছিলো এখন তো মজা বুঝতেই হবে রমজানকে।

‘ হুম। কী হয়েছে ওর?’

‘ বাচ্চা হয়েছে!’

সাদিদ সাহেব নাক সিঁটকালেন। বললেন, ‘কার বাচ্চা জানা গেছে?’

‘ জি।’

‘ কার?’

‘ আমার।’

সাদের অকপট স্বীকারোক্তিতে সাদিদ সাহেব চমকে উঠলেন। তিনি নিজের দু’কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানে?’

‘ মানে শোভার গর্ভে আর কারোর নয়, আমার অংশ ছিলো।’

‘ সাদ!’

‘ জি আব্বু।’

‘ তাহলে তুমি অস্বীকার করলে কেন?’

‘ কারণ আমি তখন শোভাকে চাইনি। আমি আপনার কাছে ছোট হতে চাইনি। কিন্তু আজ!’

‘ কী আজ? কী এমন হলো যে, তুমি এতোদিন পর আমাকে এসব বলছো?’

‘ শোভা আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে, তার উপর বাচ্চাদের কাস্টাডি সে নিজের নামে করে নিয়েছে।’

‘ বাচ্চাদের মানে?’

‘ আব্বু আমার দুই-দুইটা সন্তান এসেছে পৃথিবীতে। আমি ওদেরকে চাই।’

সাদিদ সাহেব বিষম খেলেন। পুরো বিষয়টা ওনার মাথা উল্টাপাল্টা করে দিলো। ভাবনার শক্তিটুকুও নেই। একসাথে দু-দুজন বংশের প্রদীপ এসেছে অথচ তার অন্তরালে। আর তিনি কিনা এতক্ষণ শোভাকে খারাপ বলছিলেন! তিনি রেগে বললেন, ‘কী বলতে চাও তুমি?’

‘ আমি টিনাকে ছেড়ে দিতে চাই।’

সাদিদ সাহেব কষে থাপ্পড় মারলেন সাদের গালে। রেগে বললেন, ‘তুমি জীবনটাকে খেলনা পেয়েছো? যখন যা ইচ্ছা হবে তুমি তা-ই করছো। এতোই সোজা সবকিছু?’

‘ আব্বু শোভা আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে, আমিও প্রতিশোধ নিতে চাই। আমি ওর কাছ থেকে আমার বাচ্চাদের কেড়ে নিতে চাই।’

সাদিদ সাহেব আবারও থাপ্পড় দিলেন। বললেন, ‘ছিঃ! জারজ সন্তান হিসেবে পরিচয় করিয়ে তুই আবার বড়বড় কথা বলছিস?’

‘ আমার তখন ভুল হয়েছিলো। কিন্তু এখন আমি চাই ওদের।’

‘ চাইলেই তো আর হবেনা। টিনা তোমার বর্তমান স্ত্রী। ওর বাবাকে তো চেনো কীরকম মানুষ। যদি শোনে তোমার আগের স্ত্রী,বাচ্চা আছে তাহলে সোজা জেলে ঢুকাবে আমাদের। সমাজে আমাদের রেপুটেশন কোথায় নামবে ভাবতে পারছো? তার চেয়ে যা হবার হয়ে গিয়েছে। চুপচাপ থাকো। ভুলেও একথা টিনাকে বলে বসোনা।’

এদিকে সাদ নাছোড়বান্দা। সে যে করেই হোক বাচ্চাদের চায়। হঠাৎ এতো দরদ কোত্থেকে এসেছে সাদিদ সাহেব বুঝতে পারছেন না। ওনার এসব অশান্তি আর ভালো লাগছেনা। বিরক্ত হয়ে সাদকে দুটো থাপ্পড় মেরে তিনি ঘরে চলে গেলেন। সাদ থাপ্পড় খেয়ে আরো হিংস্র হয়ে ওঠে। ভাবে যে করেই হোক ও বাচ্চাদের নিয়ে আসবে, দরকার হলে শোভাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে চুরি করে নিয়ে আসবে। তবুও ওদের চাই, চাই এবং চাই। সে নিজেও বুঝতে পারছে না এতো পিতৃত্বের অধিকার নিতে ওর কেন মন চাইছে। শুধুই কী প্রতিশোধের নেশায়?

চলবে…..ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে