এক পশলা বৃষ্টি পর্ব-০৫

0
3290

#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে:ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫

সময় খুব দ্রুত বদলায়। জীবন যেখানে থমকে দাঁড়ায়, সেখান থেকেই সামনে পথচলার শক্তিটুকু অর্জন করে নিতে হয়। নইলে এ জগতে টিকে থাকা আর সূর্যে গিয়ে বসবাস করা একই কথা। এতো অবাস্তব কিছু আর দ্বিতীয়টি নেই। শোভাও নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে, সামনে মাসেই একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে। আশা করা যায় চাকরিটা হয়ে যাবে, সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এর মাঝেই ঘটে গেলো আরেক কান্ড! সকালবেলা বাথরুমে পিছলে পড়ে গিয়ে প্রচন্ড ব্যথা পেলো পেটে।

তাড়াতাড়ি করে নিয়ে আসা হলো হসপিটালে। চেক আপ করে ডাক্তার শোভাকে এডমিট হয়ে যেতে বললো, কারণ ডেলিভারির ডেইট দুদিন আগেই ছিলো। ডাক্তারের এমন কথায় রমজান সাহেব খুব ভয় পেয়ে গেলো। অবশেষে এডমিট করানো হলো শোভাকে। আপাতত স্যালাইন লাগিয়ে রাখা হয়েছে। বারোটার দিকে অপারেশন। সিজার করতে হবে।

সালমা বেগম বাসায় গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এলেন। মিলিও এলো। সে শোভাকে বোনের মতো এতোটা দিন আগলিয়ে রেখেছে, সাহস জুগিয়েছে। মাথায় আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় শোভা জিজ্ঞেস করলো, ‘মানুষটার সাথে তোর যোগাযোগ আছে রে মিলি?’

মিলি অবাক হয়ে বলে, ‘কোন মানুষটা?’

‘ সাদ!’

মিলি রাগলেও কিছু প্রকাশ করলো না। বলল, ‘ যোগাযোগ নেই।’

‘ কোনো খবর জানিস?’

‘ শুনেছি বউ সুইজারল্যান্ড ঘুরে এসেছে। ইন্সট্রাতে ছবি আপ দিয়েছিলো, কে যেন আমাকে দেখিয়েছিলো। বউ নিয়ে সুখেই আছে।’

‘ ওহহ!’

‘ হুম।’

‘ মিলি?’

‘ বল!’

‘ আমার বাচ্চাটা কাকে বাবা ডাকবে?’

মিলি থমকায়। বলে, ‘তুই নিজেই ওর মা, নিজেই ওর বাবা।’

‘ লোকটা আমার সাথে কেন এমন প্রতারণা করলো বলতে পারিস? আমি কী খুব খারাপ ছিলাম?’

‘ তুই কেন খারাপ হবি? খারাপ তো সে, আর তার ভাগ্য!’

‘ তাহলে লোকটা আমাকে এখনো কেন ডিভোর্স দেয়নি?’

‘ হয়তো ভুলে গিয়েছে যে সে একটা বিয়ে করেছিলো, তার একটা বউ আছে।’

‘ মিলি!’

‘ হুম!’

‘ এমন একটা ব্যবস্থা কর যাতে ডিভোর্সটা হয়ে যায়। আমার অসহ্য লাগছে।’

মিলি আশ্বস্ত করে শোভাকে যে ডিভোর্সটা হবেই। পাঁচমাসেও কী ওদের সময় হয়নি এটা শেষ করার? যত্তসব! শোভা ঘুমিয়ে পড়েছে, সেদিকে তাকিয়ে মিলি ভাবে কেন শুভিকে এতো কষ্ট পেতে হচ্ছে। ভালোবাসা কী শুধু কষ্ট দিতেই জানে? মিলি জানে, শুভি সাদকে এখনো পাগলের মতো ভালোবাসে। সেই ভালোবাসাটা বিষাদে ছেয়ে আছে। এতো সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা কেমন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। সেদিনের শুভিটার আজ বাচ্চা হবে। একটা প্রিন্স নয়তো প্রিন্সেস আসবে। কোথায় পাবে বাচ্চাটা তাঁর বাবাকে? জন্মের আগেই বাবা তাঁদের ছেড়ে চলে গেলো, এমন দিনও দেখতে হলো ওর!

ঘুমন্ত শোভার মুখের দিকে তাকিয়ে মিলির মায়া হয়। মনে পড়ে তার বড় বোন ঝিলি’র কথা, সেও শোভার মতো এমন ভুল করে। যার ফল গুনতে হয় মিলির পুরো পরিবারকে। সমাজের মানুষের কাদা ছিঁটাছিঁটিতে ওর বোনটা গলায় ফাঁস দিয়ে সুসাইড করে। মেয়ের এসব দেখে মিলির বাবাও সেদিন হার্ট-অ্যাটাকে দুনিয়া ছাড়ে। স্বামী-সন্তানের এমন নির্মম মৃত্যু দেখে বিকারগস্ত হয়ে পড়ে মিলির মাও। ছয়মাস পর মা-ও ছেড়ে চলে যায় মিলিকে। এতিম হয়ে পড়ে মিলি। সেই থেকেই ঘেন্না এসে পড়ে মানুষের প্রতি। হোস্টেলে উঠার পরে অহরহ এসব কাহিনী দেখে মিলির রক্ত টগবগ করে ফুটতো। এমন ভুলভাল কাজে মেয়েরাও যে সায় জানায় সেটাও দেখেছে মিলি। এতসব সহ্য করে আজ এতো কঠিন মিলি। বুকের ভেতর চেপে রাখা কষ্টটা সে কাউকে জানায়নি, শুধু শুভি ছাড়া। একটা পরিবার ধ্বংস করার জন্য কিছু অমানুষ, আর সমাজই যথেষ্ট। অথচ ভাগ্যের পরিহাসে শুভিও এমন কাহিনীর শিকার, অবশেষে সেই কাহিনীরও ইতি ঘটতে চলেছে ডিভোর্সের মাধ্যমে।

_____

সাদ অফিস থেকে ফিরেছে মাত্র! ক্লান্ত শরীরটা নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক’দিন যাবৎ বেশ চাপ পড়েছে অফিসে। হানিমুনে একমাস কাটিয়ে এসে সে যে কী ভুল করেছে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। এতোদিন থাকতো না, কিন্তু টিনার জেদ। সে একমাস না থেকে কিছুতেই ফিরবেনা, অগত্যা থাকতেই হলো।

টিনা গ্লাসে পানি ঢেলে সাদের দিকে এগিয়ে ধরলো। সাদ উঠে বসলো। ঢকঢক করে পানিটা খেয়ে নিয়ে গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখলো। টিনা অভিযোগের সুরে বললো, ‘কতদিন হয়ে গেলো বাইরে যাইনা।’

সাদ বলে, ‘কেন? কী হয়েছে বউটার?’

‘ উফফ,, এসব কী বলো তুমি?’

‘ কী বললাম?’

‘ বউ বলবেনা, নাম ধরে বলবে।’

‘ তুমি তো আমার বউই!’

‘ জানি। কিন্তু বউ ডাকটা গেঁয়ো, ব্যাপারটা কেমন ব্যাকডেটেড।’

‘ ওহহ, আচ্ছা।’

সাদ ভাবনায় পাড়ি দেয়। শোভার সাথে বিয়ে হওয়ার পর সাদ যখন ওকে “আমার বউ” বলে ডেকেছিলো শোভা লজ্জ্বায় মাথা তুলে তাকায়ইনি। বউ বললেই মেয়েটার গাল লাল হয়ে যেতো, মিষ্টি দেখাতো খুব। সবসময় নরম গলায় ওর সাথে কথা বলতো, সাদ যা বলতো তা-ই করতো। কখনো বলেনি নিজের শখ-আহ্লাদের কথা। অথচ টিনার শখ আহ্লাদ পূরণ করতে করতে আজকাল নিজের শখগুলোর কথা সে ভুলেই গিয়েছে। কী তফাৎ নিজের দুই বউয়ের মাঝে।

টিনা সাদের বুকে মাথা রেখে বলে, ‘চলোনা আজ ডিনারে যাই,কতদিন যাইনা!’

ভাবনা থেকে ফিরে আসে সাদ। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বাসায় এসেও দুদন্ড শান্তি নেই। গত পরশুই টিনাকে নিয়ে বেরিয়েছে। শপিং সেরে ডিনার সেরে এসেছে। যেনতেন ডিনার নয়। একদম রাজকীয় ভোজ ছিলো। সেটাই টিনার কাছে অনেকদিন মনে হচ্ছে? বলে কী মেয়ে!

‘ এ্যাই, কিছু বলছোনা কেন?’

‘ আমি খুব কান্ত।’

টিনা মুখ ফুলিয়ে বললো, ‘ কিছুই তো করোনি, অফিসেই তো ছিলে। তাহলে ক্লান্ত হলে কী করে? এই তুমি আবার অন্য কোনো মেয়ের কাছে যাওনাতো?’

সাদ অবাক হয়ে বললো, ‘মানে?’

‘ তোমার আরেকটা বউ আছেনা? ওর কাছেই নিশ্চয়ই যাও?’

‘ কী বলছো তুমি?’

‘ ঠিকই বলছি। ওর তো বাচ্চা হবার কথা ছিলো, তুমি কী আবার ওই বাচ্চার কাছে যাও নাকি?’

সাদের মগজে কথাটা ঠোক্কর খায়। আরে, সে তো বাবা হতে চলেছিলো। পরমুহূর্তেই সেসব ভুলে টিনাকে বাহুডোরে আগলে নেয়। কপালে ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে বলে, ‘এতো সুন্দরী বউ থাকতে অন্য কারো কাছে কেন যাবো?’

টিনা ওর বুকে কিল দিয়ে বলে, ‘ওই মেয়েটাও নাকি সুন্দরী ছিলো, তাও তো ফেলে চলে এলে।’

সাদ আহত হয়। তবুও টিনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলে, ‘আমার তো তোমাকেই চাই।’

টিনা হাসে। বলে, ‘জানিতো বাবুমশাই। এবার বলো ডিনারে যাচ্ছি কিনা।’

সাদ ক্লান্ত গলায় বললো, ‘কাল যাই?’

‘ না আজ।’

‘ উহু, এখন শুধু তোমাকে চাই।’

বলে টিনার ওষ্ঠজোড়া দখল করে নেয় সাদ। কেমন অদ্ভুত লাগে। একসময় শোভার ঠোঁটের ছোঁয়া পেতে কতই না কসরত কর‍তে হতো ওকে। আজ! আজ শোভাও নেই, আর বাঁধাও নেই। সুখেই তো আছে ও, খুব সুখে। টিনা ওকে সুখেই রেখেছে, তবে শারীরিকভাবে। মনটা তো কবেই অসুস্থ হয়ে গিয়েছে অন্য কারো চিন্তায়, অন্য কারো ভাবনায়।

_______

সাদিদ সাহেব ইজি চেয়ারে বসে চোখবুঁজে আছেন। মাথাটা বড্ড ধরেছে। গরম একমগ কফি হলে ভালো লাগতো। তিনি রোমেলাকে ডাক দেন। রোমেলা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন, হাতে মশলা লেগে আছে। কপালের ঘাম মুছার ব্যর্থ চেষ্টা কর‍তে করতে জিজ্ঞেস করেন, ‘ডাকছো কেন?’

‘ কফি দাও!’

‘ কফি তো বানাইনি।’

‘ মানে? তুমি জানোনা সন্ধ্যায় আমি কফি খাই?’

‘ মনে ছিলোনা।’

‘ ভুলে গেলে কীভাবে? রান্নাঘরেই তো ছিলে?’

‘ টিনা তার বান্ধবীদের দাওয়াত করেছে। রাতের এতোসব আয়োজন আমাকে একা কর‍তে হচ্ছে। বিকাল থেকে একাই সব করছি। আমার তো দশটা হাত নেই যে সবদিক সামলাবো।’

‘ কেন? টিনা কই? রান্না করবেনা সে?’

‘ কোনোদিন দেখেছো নিজের খাবারটা নিয়ে খেতে? বিয়ের পাঁচমাসে একদিন রান্নাঘরে ঢুকতে দেখেছো?’

‘ না!’

‘ তাহলে আশা করো কীভাবে সে রান্না করবে?’

সাদিদ সাহেব রেগে যান। বাড়ির বৌ কী সামান্য কাজও করতে পারেনা নাকি? রোমেলা এই বয়সে একা একা দশজনের রান্না করতে পারবে নাকি! কাজের বুয়াও আর আসেনা, ছেলে বিয়ে করিয়েছে কী এই দিন দেখার জন্য! তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কোথায় টিনা?’

‘ সে ঘরে। সাদ এসেছে অফিস থেকে।’

‘ আচ্ছা তুমি যাও। আমি আসছি!’

রোমেলা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। সাদিদ সাহেব উঠে রওনা দিলো সাদের ঘরের দিকে। ঘরের দরজা বন্ধ। তিনি টোকা দিতে গিয়ে থমকে যান। দুজন হাসাহাসি করছে। সাদ কিছু একটা বলছে, আর টিনা জোরে জোরে হাসছে। ঘরের ভেতর কী হচ্ছে তার আভাস পেয়ে তিনি লজ্জ্বা পেয়ে যান। উল্টো ঘুরে নিজের ঘরেই ফিরে আসেন।

ভাগ্য! ছেলে-ছেলের বউ থাকতে আজ তাঁর বউকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। এটি প্রকৃতির প্রতিশোধের শুরু।

______
চলবে…..ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে