#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে:ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪
শোভার জ্ঞান ফিরেছে সকালে। রমজান সাহেব বিরস মুখে মেয়ের হাত ধরে বসে আছেন, সালমা বেগম মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। সবাই-ই চুপ, কেউ কথা বলছেনা। শাফিন ঔষধ কিনতে বাইরে গেছে, জানেনা বোনের জ্ঞান ফিরেছে। মিলি খবরটা নার্সের কাছ থেকে জেনে কেবিনের দিকে পা বাড়ালো। হাতটা নিশপিশ করছে।
কেবিনে ঢুকেই সরাসরি থাপ্পড় বসিয়ে দিলো শোভার গালে। শোভার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি বেয়ে পড়লো। মাথা নিচু করে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। রমজান সাহেব, সালমা বেগম অবাক হয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে আছেন।
‘ লজ্জ্বা করছেনা? একটুও লজ্জ্বা করছেনা তোর শুভি? তুই এতো নির্লজ্জ, বেহায়া কবে হলি?’
শোভা চুপ।
‘ এখন চুপ করে আছিস কেন? কথা বল, কথা বল!’
শোভা মাথাটা আরো নিচু করলো। কান্না করছে।
মিলি এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসলো। তারপর শোভার পেটের উপর হাত রেখে বললো, ‘এর কথাটাও তুই একবার ভাবলি না শুভি? তুই কী রে?’
শোভা অবাক হয়ে বললো, ‘ কী হয়েছে?’
‘ তোর বাচ্চাটা মরে গেছে।’
‘ কী বলছিস তুই?’
‘ এটাই তো চাইছিলি তুই, সফলও হয়েছিস।’
‘ মিলি!’
‘ একদম চুপ।’
শোভা জোরে জোরে কান্না শুরু করেছে। মিলির বিরক্ত লাগছে। ও এসব আর নিতে পারছেনা। এ কী মেয়ে? কী ধাতু দিয়ে তৈরি এই মেয়ে? নারীশক্তির ছিঁটেফোঁটা এই মেয়ের মধ্যে নূন্যতম মাত্রায়ও নেই।
‘ শুভি প্লিজ তোর ন্যাকামি বাদ দে।’
‘ ত ততুই কী বলছিস? আ আমারর ববাচ্চাটা নেই?’
‘ না নেই। কারণ তুই খুন করেছিস!’
শোভা পাগল হয়ে উঠলো। বিকারগ্রস্ত রোগীর মতো বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ও ক কী বলছে মা?’
রমজান সাহেব এবং সালমা বেগম দুজনেই চুপ। তারা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শোভা সিট থেকে উঠে যেতে চাইলে মিলি ওকে আটকায়। শোভা মিলিকে জিজ্ঞেস করে, ‘আব্বু আম্মু কথা বলছেনা কেন?’
মিলি অকপটে বলে উঠলো, ‘কারণ ওরাও মরে গেছে। আর কে মেরেছে জানিস? তুই! তুই মেয়ে, মা, নারী হিসেবে কলঙ্ক। আর ওদের কাছে কী জানতে চাইছিস, ওরা তো মৃত।’
শোভা কানে হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো, ‘চুপ কর প্লিজ।’
মিলি রেগে অগ্নিমূর্তি হয়। বলে, ‘এখন এতো খারাপ লাগছে কেন শুভি? সুসাইড করতে যাওয়ার আগে এই মানুষগুলোর কথা একবারও ভেবে দেখেছিস? বল তোর জন্য কী না সহ্য করেছে ওরা? তোকে ছোট থেকে আদর দিয়ে বড় করেছে, খাইয়েছে, পড়ালেখা শিখিয়েছে, যা চেয়েছিস তাই দিয়েছে, হোস্টেলে যেতে চেয়েছিস তাও দিয়েছে, সব তোকে ভালোবেসে করেছে। কিন্তু বিনিময়ে? বিনিময়ে কী পেয়েছে ওরা? তুই ওদের না জানিয়ে সাদ চৌধুরীর সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিস, বিয়ে করেছিস, বাচ্চা পয়দা করেছিস, ভাইকে কষ্ট দিয়েছিস, তোর জন্য তোর বাবা সাদ নামক অমানুষটার কাছে গিয়ে হাত-পায়ে ধরেছে, সাদিদ চৌধুরীর কাছে লাঞ্চিত হয়েছে, সমাজের কাছেও ছোট হয়েছে, ওদের স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়েছিস তুই।’
শোভা চুপ হয়ে শুনে যাচ্ছে। মিলি যেগুলো বলেছে সব ঠিক।
‘ এরপরেও যে তোকে ওরা লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দেয়নি সেটাই বেশি৷ কিন্তু নাহ, তুই তো লোভী, অকৃতজ্ঞ! তুই ওই সাদ নামক কু* বাচ্চার জন্য হাত কেটে বাংলা সিনেমা দেখাইছিস ওদের। সারারাত টেনশনে রাখছিস! শাফিন ভাই নাওয়া-খাওয়া ভুলে দৌড়াদৌড়ি করছে। আর তোর জামাই? সে? সে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ের গাড়িতে করে বউ আনতে যাচ্ছে। হাহ, তুই মৃত্যুপথযাত্রী শুনেও এলোনা। যা না এখন! দেখি কত ভালোবাসা দুইজনের। যে তোরে ভালোই বাসেনা তার জন্য তুই নিজের জান দিতে যাচ্ছিলি, ব্যাপারটা নাটকীয় হয়ে গেলোনা শুভি?’
শোভা অবাক হয়। সে ভেবেছিলো সাদ নিশ্চয়ই ওর কাছে ছুটে আসবে। অন্তত ওর মৃত্যুর খবরটা শুনে। কিন্তু কী হলো? সাদ এলোই না, বিয়ে করতে যাচ্ছে? ইশ, কী বোকা শুভি। ওর তো আগেই ভাবা উচিত ছিলো যে নিজের সন্তানকে অস্বীকার করতে পারে, তার দ্বারা সব করা সম্ভব। এতো বোকা কেন ও? বাবা-মা, ভাইয়ের ছায়া থাকা স্বত্ত্বেও আবেগের বশে ওই অমানুষের জন্য মরতে বসেছিলো? ছিহ ছিহ। নিজের উপর ঘেন্না হচ্ছে। মাঝখান থেকে ওর.. ওর বাচ্চাটাকে হারালো, মনে পড়তেই ঘর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। পেটে হাত দিয়ে বলতে লাগলো, ‘আমার বাচ্চা! আমি ভুল করেছি, ক্ষমা করে দিস মাকে!’
অনেকক্ষণ কাঁদার পর মিলির হাতের ছোঁয়া পেলো মাথায়। মিলি মিষ্টি হেসে বললো, ‘ও ঠিক আছে।’
কথাটা যেন অলৌকিক। যেন কোনো বার্তা শুনছে বাতাসে। শোভা আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে দুরুদুরু বুক নিয়ে তাকায় বাবা-মায়ের দিকে। ওরা মাথা নাড়িয়ে জানায় বাচ্চা ঠিক আছে। শোভা খুশিতে মিলিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। মিলি ওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো, ‘যার জন্য এমন করেছিস সে একদিন নিশ্চয়ই শাস্তি পাবে। তুই তোর বাচ্চার খেয়াল রাখ আর লক্ষ্যে এগিয়ে যা। পাশে তো সৃষ্টিকর্তা আছে, আমরা আছি। তুই সাদ অমানুষটাকে দেখিয়ে দে তুই বেঁচে আছিস, ভালোভাবে আছিস, সুখে আছিস। তোর জীবনে লোকটার প্রয়োজন নেই, তুই দামী, হীরের চেয়েও দামী। যা পেয়েও হারালো সাদ চৌধুরী।’
শোভা চোখ মুছলো। জীবনের মানেটা খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে। শাফিন ফিরে এসে বোনকে দেখে সে কী কান্না! শোভা আশ্বস্ত করেছে এরকম আর করবেনা, দেখিয়ে দেবে সাদকে ও নিজের পরিচয়ে, নিজের সন্তানকে বড় করেছে। একাই পারবে নিজেকে সামলাতে!’
এতোক্ষণ পুরো দৃশ্যটা দেখেছে ডাক্তার সাইফ। এ যেন অবিশ্বাস্য। মিলি নামক মেয়েটা খুবই ডেঞ্জেরাস বুঝতে পারছে। তবে খুব নরম মনের সেটাও বুঝে গেছে। মেয়েদের এমনই হওয়া উচিৎ। নয়তো বেঁচে থাকার লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হতে হবে। সে মনে মনে পুলকিত হয়, কাল রাতের থাপ্পড়ের কথাটা মনে পড়তেই হেসে ওঠে। গালে হাত বুলায়। থাপ্পড়টাকে ওর মিষ্টি মনে হচ্ছে। ওর মা-ও এমনই বাঘিনী টাইপ মহিলা। মিলি আর মায়ের মধ্যে অদ্ভুত এক মিল খোঁজে পায় সাইফ। তাঁর নানাকে যখন কোনো হসপিটালে এডমিট করতে চাইছিলোনা, তখন ওর মা মালিনীও ডাক্তার জুবায়েরের গালে থাপ্পড় মারে, পরবর্তীতে তাঁর মায়ের সাথেই নাকি ডাক্তার জুবায়েরের বিয়ে হয় এবং বর্তমানে সাইফের বাবা-ই জুবায়ের। বাবা তাঁর মাকে খুব ভয় পায়। সাইফও পায়। তবে আজকের ঘটনা মনে পড়তেই মাকে ফোন করে জানাতে ইচ্ছা করছে। বলতে ইচ্ছা করছে, ‘বাঘিনীকে আমি পেয়ে গেছি, মা শুনছো?’
_____
একটু আগেই চৌধুরী ভবনে পা রেখেছে নতুন বউ। আনন্দে হইহই রব চারদিকে। সবার মুখে মুখে এক কথা , বউ খুব সুন্দরী। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সোনায় মুড়ানো৷ তবে মনমেজাজ সোনার মতো হলেই হলো।
সাদ ড্রইংরুমে টিনার পাশে বসে ছবি তুলছে। মেহমানরা চারদিকে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে। সাদিদ সাহেব খুব খুশি। মনের মতো ছেলের বউ পেয়েছেন। হাসি নেই রোমেলার মুখে। তাঁর ছেলে একটা বউ রেখে কীভাবে পারলো অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে? এই শিক্ষা কোথায় পেলো? মা হিসেবে নিজেকে খুব ছোট, হীন, কীট মনে হচ্ছে। কিছু কর্তে পারেনি শোভার জন্য। অথচ সে দাদী হতে চলেছে। আর টিনার মতো অহংকারী মেয়ে এনে তাঁর ছেলে যে কী বড় ভুল করেছে সেদিন আর কিছুই করার থাকবেনা। সব জেনেও রোমেলা বেগম চুপ। সংসারে তার কোনো কথার কোনো দাম নেই। তিনি চুপচাপ সব সহ্য করছেন।
তিনি সাদিদ সাহেবকে একপাশে ডেকে বললেন, ‘কাজটা কী করলে তুমি?’
‘ কীসের কাজ?’
‘ মেয়েটাকে ঠকালে!’
‘ কোন মেয়ে?’
‘ ভুলে গেলে?’
‘ পরিষ্কার কথা বলো।’
‘ শোভা। সাদের বউ!’
সাদিদ সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কে বউ। ও একটা ভুল করেছিলো, শুধরেও নিয়েছে।’
‘ এমন পাপ আল্লাহ সহ্য করবেনা।’
‘ চুপ করোতো।’
‘ চুপই ছিলাম, আর পারলান না!’
‘ কী বলতে চাও তুমি?’
‘ বলতে চাই তোমরা অন্যায় করেছো।’
‘ সাদের কিন্তু বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে।’
‘ ভালো তো। টিকতে পারলে হয়। এই মেয়ে আমাদের সংসার বাঁচালে হয়। শেষ বয়সে না আমাদের আবার ঝামেলা মনে করে ভিক্ষুকের মতো তাড়িয়ে দেয়।’
সাদিদ সাহেব বিরক্ত হয়ে ধমক দিলেন। তারপর চলে গেলেন। কিন্তু কথাটা মনে ঢুকে গেছে। টিনা এমনিতেও অন্য ধাঁচের মেয়ে। মানিয়ে না নিতে পারলে ওদের কপালে দুঃখ আছে। হঠাৎ কেমন অনুশোচনায় ভুগতে থাকেন তিনি। কিন্তু বাইরে প্রকাশ করলেন না। কৃত্রিম হাসির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেলো অনুশোচনার ছোট্ট ছোট্ট কণাগুলো। মনকে মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন করে দিতে লাগলো।
টিনা ছবি তুলতে তুলতে বিরক্ত। সে সাদকে বলে, ‘প্লিজ আমাকে ঘরে নিয়ে যাও।’
‘ ঠিক আছে, চলো।’
‘ চলো মানে? নতুন বউ আমি। কোলে করে ঘরে নিয়ে যাও!’
‘ এভাবে?’
‘ হুম।’
‘ কিন্তু?’
‘ কীসের কিন্তু?’
‘ এতো লোকজনের মধ্যে দিয়ে?
‘ নয়তো কীভাবে?’
সাদ আর কথা না বাড়িয়ে টিনাকে পাজাকোলা করে তুলে নিলো। হাঁটা ধরলো ঘরের উদ্দেশ্যে। যে ঘরটাকে কোলে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা দিয়েছিলো শোভাকে, সেই ঘরে আজ অন্য কেউ, অন্য মানুষ সংসার করার উদ্দেশ্যে পা বাড়াচ্ছে।
কিছু গঠনমূলক মন্তব্য পেতে পারি কী? গল্পটা নিয়ে আমি কনফিউজড।
চলবে…..ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।