#এক_পশলা_বৃষ্টি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩
মিলি শুধু এটুকুই জানালো। আর কিছু বলার প্র্য়োজন মনে করলোনা। একসময় সাদ’কে ও নিজের বড় ভাইয়ের জায়গায় বসিয়েছিলো। খুব সম্মান করতো। কিন্তু এখন ওর আফসোস হয়। নিজে এতো বিচক্ষণ হয়েও কী করে মানুষরুপী জানোয়ারটাকে চিনতে পারলোনা। নিজের প্রিয় বান্ধবীকে ওই বিষাক্ত কীটের থেকে দূরে রাখতে পারলোনা। আজ নিজের জীবনের সাথে লড়াই করছে শোভা, শুধু এই কাপুরুষের জন্য।
শোভাও এতো দুর্বল হয়ে পড়লো কেন মিলি বুঝতে পারছেনা। মেয়েটা নিজেই বলেছিলো সাদ’কে উচিৎ শাস্তি দিবে। কিন্তু সাদের বিয়ের কথা শুনে কেন নিজেকে আটকাতে পারলোনা? কেন গেলো সুসাইড করতে? আজকের যুগে এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। মেয়েরা অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ে। এতো করে বোঝানোর পরেও যদি কেউ ভুল পথে পা বাড়ায় তাহলে আর কী-ই বা করার থাকতে পারে?
ক্ষণে ক্ষণে কান্না পায় মিলির। কপালের শিরা ভেসে উঠে। ইচ্ছে হয় এক কোপে এসব নরপুরুষদের বলি দিতে। কান্নাটা কষ্টের নয়, রাগের। রাগ হলে মিলির চোখে পানি আসে। কিছু করতে পারছেনা এটা ও মানতে পারছেনা। ইচ্ছে হচ্ছে দুনিয়া উলটপালট করে দিতে। বুক থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস! জীবন বড়ই কঠিন। যেখানে বাঁচার আশায় মানুষ প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে, সেখানে সবকিছু পেয়েও শুভির মতো নরম মনের মেয়ে কেন যায় সুসাইড করতে? তাও ওই সাদ নামক জানোয়ারটার জন্য? সেতো ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছে। ছিঃ! ঘেন্না হচ্ছে মিলির, শোভা আর সাদ দুজনের উপরই। তবে আলাদা কারণে। সাদকে ঘেন্না হচ্ছে চরিত্রহীনতার জন্য, শোভাকে ঘেন্না করার একমাত্র কারণ ওই সাদের জন্য মরতে যাওয়া।
এইতো আজকে রাতের ঘটনা। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা।
শোভার পাঁচমাস চলছে। সাদের সাথে দেখা নেই তিনমাস। সেদিনের পর দুজন দুজনের চেহারা মাড়ায়নি। কথাও হয়নি। সব স্বাভাবিক চলছিলো। শোভা মনমরা থাকলেও নিজেকে সামলে নিয়েছিলো মূলত মিলির প্রাণান্তকর চেষ্টায়। ডিভোর্স লেটার এখনো পায়নি, সময় লাগবে। তাই এখনো তারা স্বামী-স্ত্রী। শাফিন বোনকে আগলিয়ে রাখছে।
কিন্তু রাতে হঠাৎ শাহানা ফোন করে জানালো সাদের আজ হলুদ। ব্যস! শুভি উদ্বিগ্ন হয়ে গেলো। কাউকে কিছু না বলে ঘরে গিয়ে হাতের শিরা কেটে ফেললো। শাফিন রাতে শোভার ঘরে উঁকি দিতে গিয়ে দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। রক্তে বিছানা ভেসে গেছে। তাড়াতাড়ি বাসার সবাইকে ঘুম থেকে তুললো। শোভার মায়ের কান্নায় আবহাওয়া ভারী হয়ে উঠলো। রমজান সাহেব ভাবতে পারেননি তাঁর মেয়ে এমন কিছু করবে। শাফিন উপায় না পেয়ে মিলিকে ফোন করলে মিলি দ্রুত হসপিটাল নিয়ে আসতে বলে। নিজেও হোস্টেল থেকে চলে আসে।
আসার পথেই কথা হয় সাদ চৌধুরী নামক মানুষটার সাথে। খবরটা জানিয়ে দিলো। আচ্ছা, ওই অমানুষটা কী এই খবর শুনে খুশি হয়েছে? হওয়ারই কথা।
মিলি পৌঁছে দেখে ডাক্তার শোভাকে এডমিট করতে চাচ্ছেনা। পুলিশ কেইস, হ্যানত্যান বলে ঝামেলা করছে। এমনিতেই মিলির রাগ বেশি। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ইয়াং ডাক্তার সাইফের গালে চড় বসিয়ে দিলো। চিৎকার করে বললো, ‘এক্ষুনি যদি শুভির চিকিৎসার ব্যবস্থা না করেন আপনাকে আমি খুন করবো।’
ডাক্তার সাইফ হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এতো মানুষের সামনে একটা মেয়ে তাঁর গালে চড় মেরেছে ভেবে সে হতভম্ব। এই অপমান সহ্য করতে পারছেনা, মিলির টুটি চেপে ধরতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু মানসম্মানের ভয়ে পারছেনা।
যে মেয়ে একবার থাপ্পড় মারতে পারে, সে দ্বিতীয়বারও মারতে পারে ভেবে সাইফ আর কথা বাড়ালোনা। এদিকে নীরবতা সহ্য হচ্ছেনা মিলির। সে হুট করে সাইফের কলার চেপে ধরে বললো, ‘শুভির যদি কিছু হয় হারামি, তোরে আমি বলি দিবো।’
ধাক্কা মেরে ফ্লোরে ফেলে দেয় সাইফ। রাগে গা কেঁপে উঠে। তেড়ে এসে মিলির হাত চেপে ধরলো। তারপর সাথে থাকা ডাক্তাদের বললো, ‘ আপনারা মেয়েটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।’
অন্যান্য ডাক্তাররা মিলির ভয়ে মাথা নাড়িয়ে শোভাকে নিয়ে গেলো। শাফিন সব ফর্মালিটি পূরণে ব্যস্ত। রমজান সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে শোভার কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলেন।
ডাক্তার সাইফ! হার্ট ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। ড্যাফোডিল হসপিটালের অন্যতম ভালো একজন ডাক্তার। দু’মাস হলো নতুন জয়েন করেছে, চারদিকে নাম হয়ে গিয়েছে। সবাই ওকে খুব সমীহ করে চলে। অথচ মিলি ওর উপর হাত তোলার দুঃসাহস করেছে। সাইফের তীক্ষ্ণ ভয়ানক দৃষ্টি দেখে অবাক হলোনা মিলি। ডাক্তারদের তো এমনই মানায়। সাইফ হুংকার ছেড়ে বললো, ‘ হু আর ইউ মিস? আমার গায়ে হাত তোলার সাহস কোথায় পেলেন?’
‘ আমার সাহসের কথা আপনাকে চিন্তা করতে হবেনা। ডাক্তার হয়েছেন সেই দায়িত্ব পালন করুন।’
‘ সেটাই পালন করছিলাম।’
‘ রিয়েলি? আপনি মৃত্যুর মুখে আমার শুভিকে ফেলে রেখে ডাক্তারের দায়িত্ব পালন করছিলেন? গ্রেট!’
‘ শুনুন! আমরা ডাক্তার আমাদেরও কিছু নিয়ম মেইনটেইন করতে হয়। সুসাইড এ্যাটেম্প করতে চেয়েছে আপনার রোগী, আর এটা পুলিশকে জানানো আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কেননা, এটা খুনের চেষ্টাও হতে পারে।’
‘ রাখুন আপনার এসব নিয়ম। একটা মানুষ মরার পথে, আর আসছেন নিয়ম দেখাতে।’
‘ শুনুন আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন।’
‘ বাড়াবাড়ি আমি করেছি? তো বেশ করেছি। আচ্ছা আপনারা ডাক্তাররা কী মানুষকে সেবা দিবেন বলে ডাক্তার হয়েছেন? নাকি টাকা কামাতে?’
‘ অবশ্যই সেবাধর্ম পালন করতে।’
‘ এতোক্ষণে পয়েন্টে এলেন। তাহলে মনুষ্যসেবা না করে আইনিসেবা নিয়ে আপনি ভাবছেন কেন? সে দায় আইনের। আমার বা আপনার নয়। হোক সেটা খুন বা সুসাইড কেস। ডাক্তারদের একমাত্র কাজ রোগীকে সারিয়ে তোলা। আর আপনার মতো বিজ্ঞ লোক এই ভুলটা করেছেন সো থাপ্পড় খেতেই হবে। মার না খেলে কী কিছু মনে থাকে? ছোটবেলায় দেখতেন না পড়া না পারলে বা ভুল করলে শিক্ষকরা মেরে শিখাতো! আমিও আপনাকে একটা শিক্ষা দিলাম, কখনোই ভুলবেন না। ওকে?’
সাইফের মাথার উপর দিয়ে কথাগুলো যাচ্ছে। তাঁর মনে হচ্ছে এই কথাগুলো সার্জারির চেয়েও বেশি কঠিন। সে বুঝতে পারছেনা। মিলি হুংকার ছেড়ে বললো, ‘আমার হাত ছাড়বেন মিস্টার? নাকি পেটে লাথি খাবেন?’
সাইফ ভয়ে হাত ছেড়ে দিলো। মেয়ে তো নয়, যেন বাঘিনী। মেরে দিলেও দিতে পারে লাথি। গতকালই ওর পেটের অসুখ সেরেছে, আজ আর কোনো রিস্ক নিতে চায়না। শেষে দেখা যাবে লাথি খেয়ে আর কোনোদিন পেটব্যথা সারতেই চাইবেনা। এই মেয়ের সাথে কথা বলার চেয়ে একঘন্টায় তিনটে সার্জারী করা অনেক সোজা।
মিলি করিডোরে চিন্তিত মুখে বসে রইলো। এলোই না সাদ? শুভির এতো বড় বিপদ শুনেও তার মন গললো না? পুরুষ জাতি কী এমন? নাকি কাপুরুষ জাতি বলে এদের! শিট..শুভি…শিট। এর জন্য মরতে চাইছিস, এর জন্য! ভুল তুই ভুল শুভি। এ ভালোবাসার দায়িত্ব যেমন পালন করতে পারেনি, স্বামী হিসেবে কিঞ্চিৎ দায়িত্বও পালন করতে পারেনি।
_________
ওদিকে সাইফ বিছানায় শুয়েও শান্তি পাচ্ছেনা। শোভার কথাটাও মিলি পুরোপুরি বললো না। কিন্তু কিছু একটা যে হয়েছে বেশ বুঝতে পারছে। ধুর! ওই মেয়ের চিন্তা করে কী হবে, সেতো নিজের জীবন গোছাতে চলেছে। তাও, পিছুটান বড় খারাপ জিনিস। জানে সে বাবা হতে চলেছে। কিন্তু চায়না এইসব। ডিভোর্সটা হয়ে গেলে ওদিকে আর ফিরেও তাকাবেনা সাদ। টিনার সাথে আনন্দে জীবন কাটাতে চায় সে, বাবা-মাও এটাই চায়। বাবা-মায়ের খুশিতেই সাদ খুশি।
এই মুহূর্তে কারো সাথে ওর চিন্তাগুলো শেয়ার করা দরকার। কার সাথে করবে? টিনার সাথে? হুম করাই যায়, টিনা ওর আর শোভার ব্যাপারটা জানতে পেরেছে। সাদ’ই বলেছে। যার সাথে বিয়ে হবে তাকে সবটা জানালো দরকার বলেই জানিয়েছে। চায় না কোনো মিথ্যে থাকুক দুজনের ভেতর। সব শুনে টিনা মেনে নিয়েছে, পাশে দাঁড়িয়েছে সাদের। পাত্তাই দেয়নি, এমন ভুল নাকি হয়ই! অনেক ভেবে সাদ ফোন লাগালো টিনাকে।
‘ হ্যালো।’
‘ বলো জান।’
‘ কী করো।’
‘ কিছুনা, তুমি?’
‘ শুয়ে পড়েছি, ঘুম আসছেনা।’
‘ তাই বুঝি আমার কথা মনে পড়েছে।’
‘ বলতে পারো।’
‘ আচ্ছা, আমিও তোমার কথাই ভাবছিলাম।’
‘ কেন?’
‘ বারে! তুমি আমার হবু বর, কাল আমাদের বিয়ে! তারপর সারাজীবন একসাথে থাকবো।’
‘ ওহহ!’
‘ তুমি খুশি না সাদ?’
‘ খুশি!’
‘ তবে আমার কেন মনে হয় তুমি খুব আপসেট?’
‘ জানোই তো। আমি ওই ব্যাপারটা ভুলতে পারছিনা।’
‘ ভুলার চেষ্টা করো।’
‘ অন্তত ডিভোর্সটা হয়ে গেলে আমি রিল্যাক্স হতে পারতাম।’
‘ হয়ে যাবে। তাছাড়া শোভা মেয়েটিও তো চায় ডিভোর্স হোক।’
‘ আমি কিছু ভুল করছিনা তো?’
‘ না। ওই মেয়েকে বিয়ে করাটাই তোমার ভুল, ডিভোর্স একদম ঠিক সিদ্ধান্ত।’
‘ বলছো!’
‘ হুম জান।’
সাদ চুপ করে রয়েছে। টিনা বললো, ‘আচ্ছা এসব কথা বাদ। আমাদের বিয়ের পরবর্তী প্ল্যান বলো।’
‘ আমি কী বলবো। তুমিই করো।’
টিনা বললো, ‘হুম। আমি ঠিক করেছি হানিমুনে সুইজারল্যান্ড যাবো। আর শুনো বাড়ির কাজ করতে আমি পারিনা, ওসব করবোনা।’
‘ তাহলে কে করবে?’
‘ কাজের লোক রেখে দেবো!’
‘ আচ্ছা!’
‘ বেবি তাড়াতাড়ি নিবোনা, দুই-তিন বছর পর নেবো।’
‘ কেন? আমার আব্বু তো নাতি-নাতনির আশায়ই বিয়ে করাচ্ছে!’
টিনা বিরক্ত হলো। বললো, ‘ধুর বাদ দাও। ওনি চাইলেই তো আর হবেনা। আমারও একটা মতামত আছে, তাইনা।’
‘ ঠিক আছে।’
‘ তোমার কী প্ল্যান সাদ?’
সাদ ভাবে কী তার প্ল্যান। এসব কথা তো শুধু শোভাকেই বলেছিলো সে। শোভা অক্ষরে অক্ষরে সাদের প্রতিটি কথা মেনেছে। শোভা চেয়েছিলো স্বামীর বাড়ির প্রতিটি মানুষ তাঁর আপন, সবাইকে আগলে রেখে নিজের সর্বস্ব দিয়ে ওদের সেবা করবে। নিজ হাতে রান্না করবে। ফুটফুটে একটা বাচ্চা থাকবে ওর। সাদ অফিস থেকে ফিরলে ওকে লেবুর শরবত এগিয়ে দেবে, যা সাদের খুব পছন্দ। ছোট্ট সংসারে নিজের জন্য কিছুই চাইনি শোভা। অথচ টিনার সাথে শোভার কত পার্থক্য। দুজনের ভাবনা চিন্তা সম্পূর্ণ আলাদা। টিনার সাথে কেন ভালো থাকবে কী সাদ? শোভাকে কী বোকাটাই না বানালো। মেয়েটাকে কিছু বললেই কেঁদে দিতো বাচ্চাদের মতো। সেই মেয়েই আজ মা হতে চলেছে। ছোট্ট শোভার কোলজুড়ে থাকবে ছোট্ট সাদ! মনে মনে এটাই চাইছে নাকি ও?
চলবে…..ইনশাআল্লাহ! ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।