#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ০৬
ভোরের ফুড়ফড়ে আলো ফুটেছে ধরণী জুড়ে। আদ্রিতা কিছু ভাবছে, ঘুমের ঘোরে কাল রাতের কথা মনে পড়ছে। কাল রাতে তার আচরণ কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল। সে যেমনটা নয় তেমনটা আচরণ করেছিল ফারিশের সাথে। কোথাও গিয়ে একটা গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়েদের মতো সে আচরণ করেছে। আদ্রিতা চোখ খুলে চাইলো তার মনে পড়লো সে ফারিশের সাথে কাল রাতে যে ব্যবহার করছে সেটা বেশিই আবেগ এবং ন্যাকামো টাইম। যেটা সে মোটেও নয়। ফারিশ কি তাকে বাজে মেয়ে ভাবলো! ভাবতেই পারে কাল রাতে মদ’টদ খেয়ে ফেলেছিল নাকি আদ্রিতা, নাকি ঘাবড়ে গিয়ে উল্টো পাল্টা বলেছে, নাকি অত্যাধিক সাহসী দেখাতে গিয়েছিল। আদ্রিতা চরম বিরক্ত নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো তার মাথা ঘুরছে। দু’দিন যাবৎ তার সাথে সব উল্টো পাল্টা ঘটছে। কাল রাতে আদ্রিতার কিছু হয়েছিল কোথাও গিয়ে মনে হয়েছে ফারিশের ওপর তার অধিকার আছে। অথচ এমনটা মনে হওয়ার আধও কোনো কারণ নেই। আদ্রিতা অবাক হয়ে বললো,“কাল আমার হয়েছিল কি?” এই ফারিশ নামক ছেলেটার ধারে কাছেও আর ঘেঁষবে না আদ্রিতা। ছেলেটার আচরণ অদ্ভুত টাইপ। বাড়িতে রিভলবার নিয়ে থাকে। আদ্রিতার টনক ছেলেটা সত্যি মাফিয়া ছিল না তো, কিন্তু পুলিশ তো বললো একজন ব্যবসায়ী। না আদ্রিতা আর ভাবতে পারছে না।
দরজায় কলিং বেল বাজলো। আদ্রিতা দ্রুত বিছানা ছেড়ে নামলো। বাবা মা আর ভাইটা বুঝি এলো। আদ্রিতা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল্লো সত্যি তার বাবা মা আর ভাই এসেছে। আদ্রিতা সব ভুলে মিষ্টি এক হাসি দিয়ে বললো,“কেমন আছো তোমরা?”
মেয়ের হাসি দেখে তিন’জনেই মুগ্ধ হলো
বললল,“ভালো আছি তুই?”
“আমিও ভালো” বলতে বলতে বাবার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ভিতরে যেতে যেতে বললো আদ্রিতা,“তোমাদের তো কাল বিকেলে আসার কথা ছিল এলে না কেন?”
আদ্রিতার মা ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় বসলেন। গায়ের বোরকা খুলে বললেন,
“আর বলিস না তোর মামা আসতেই দিতে চায় নি। তুই যাস নি বলে রাগ করেছে।”
আদ্রিতা তাকালো অন্য সোফায় বসে থাকা তার অনার্স পড়ুয়া ছোট ভাই রাফিনের দিকে। মাথায় একটা টোকা মেরে বললো,
“কিরে এসে থেকে তো কথাই বলছিস না ব্যাপার কি তোর?”
“আর বলো না আপু লায়লা আমার সাথে দু’দিন যাবৎ কথা বলছে না।”
হোঁচট খেলো আদ্রিতা। হাসতে হাসতে বললো,
“কেন বলছে না?”
“জানি না।”
হাসলো আদ্রিতা। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,“টেনশন নিস না বলবে নে।”
রাফিন কিছু বলে না। লায়লা রাফিনের চাচার মেয়ে দুজনেই সেইম ইয়ারে আছে। তারা রিলেশনে আছে বাড়ির সবাই এটা জানে। তাদের কোনো আপত্তি নেই বিয়েতে। ভাবা হয়েছে এদের পড়াশোনা শেষ হলেই এদের বিয়ে দেয়া হবে।”
আদ্রিতা রান্নাঘরে এগিয়ে গেল। চুলায় চা বসিয়ে বাবা আর মাকে পানি দিল। পানি খেয়েই আদ্রিতার মা বলে উঠলেন,“তোর মামা তোর জন্য একটা ছেলে দেখেছে ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। তোর কি মত?”
আদ্রিতা কিছু বলে না। অনেকক্ষণ চুপ থাকে। আদ্রিতার মা বলে,
“কি হলো তুই কথা বলছিস না কেন?”
“কবে দেখা করতে হবে?”
আদ্রিতার মা খুশি হলেন। বললেন,“শীঘ্রই।”
আদ্রিতা আর কিছু না বলে চলে যায় রান্নাঘরের দিকে। এই মুহূর্তে মাকে বিয়েতে না করার মতো কোনো অজুহাত নেই আদ্রিতার। ডাক্তার হওয়ার আগে অনেক কারণ ছিল এখন আর নেই। বিয়েটা এবার করতেই হয়। এই এখন যদি আদ্রিতা বিয়েতে না করতো মায়ের সাথে ঝগড়া হতো। যা আদ্রিতার এই মুহূর্তে পছন্দ হচ্ছে না। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জীবনটা পুরো ডাক্তার হওয়া আর পড়াশোনা করতে করতেই চলে গেল। আদ্রিতা মনে মনে লাভ ম্যারেঞ্জ করবে এমন পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মনের মতো পুরুষ এখনো পায় নি। হয়তো তার ভাগ্যে পারিবারিক ভাবে বিয়েই লেখা আছে।’
——
বিকেল ৫ টা! হসপিটালের ক্যান্টিনে গোল হয়ে বসে আছে আশরাফ, মুনমুন, মৃদুল, রনি আর চাঁদনী। আদ্রিতা এখনও আসে নি। বিকেলের এই সময়টায় প্রায় একসাথে কাটায় তারা। মাঝে মধ্যে একটু সিরিয়াস কন্ডিশন হলে হয় না। আর সপ্তাহের শুক্রবারটা হসপিটালের বাহিরে কাটে। তবে ঢাকার বাহিরে যাওয়া হয় না। নিরবতা কাটিয়ে মৃদুল বলে উঠল,
“দোস্তরা জীবনের অর্ধেক সময় তো ডাক্তারি আর পড়াশুনা করেই কাটিয়ে দিলাম এবার আমাদের উচিত এক এক করে বিয়ে করা। আর দুটো করে মুরগীর রোস্ট খাওয়া।”
চাঁদনী তেতে উঠলো। বললো,
“তোর তো সারাদিন খালি খাওন আর খাওন। তোর আসলে খাবারের ডাক্তার হওয়ার উচিত ছিল ফরেনসিক ডক্টর হতে কে বলেছিল।”
“তোর আব্বায়?”
চাঁদনী রেগে গেল। বললো,
“একদম বাপ তুলে কথা বলবি না মৃদুল।”
“বাপ তুলে কি বললাম?”
“আমার বাপে বলেছিল তোকে ফরেনসিক ডাক্তার হতে?”
“কইছিল তো। খালি যেদিন কইছিল ওইদিন তুই বাসায় ছিলি না।”
মৃদুলের কথা শুনে হেঁসে ফেলে সবাই। চাঁদনীও না চাইতেই হেঁসে ফেলে এই ছেলে চরম পাঁজী। এবার রনি বললো,“বিয়ের কথা যেহেতু উঠেছে তখন আমার আর মুনমুন দিয়ে শুরু করলে কেমন হয়?”
মুনমুন মুখ খুললো। বললো,“তোকে কে বিয়ে করবে?”
রনি ভাব নিয়ে বললো,“কেন তুই?”
মুনমুন নাক ছিটকে বললো,“ইয়াক থুঁ।”
আশরাফ বললো,“তোদের থুঁ টুঁ শেষ হলে ভালো কথা বলা যায়?”
সবাই দৃষ্টি রাখলো আশরাফের দিকে। বললো,
“কিসের ভালো কথা?”
“না ভাবছি সবাই মিলে তিনদিনের একটা সফরে গেলে কেমন হয়?”
শুরুতে সবাই খুশি হলো। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো, একসাথে এতজনকে ছুটি দিবে।”
মুখ কালো হয়ে গেল সবার। হসপিটালে জয়েন্ট হওয়ার পর তারা কেউই তেমন ছুটি পায় না। যার ফলে বহুদিন হলো তারা একসাথে কোথাও যেতে পারে না। মৃদুল মুখ কালো করে বললো,
“একবার সজল স্যারের সাথে কথা বললে কেমন হয়?”
“স্যার কি মানবেন?” (মুনমুন)
“একবার বলে তো দেখা যায়। আমরা তো এতদিনে একবারও ছুটি নেই নি। ট্রাই একটা করাই যায়।” (রনি)
“সবই বুঝলাম কিন্তু আদু এখনও আসছে না কেন?” (আশরাফ)
“হয়তো কোনো ইমারজেন্সি পড়ে গেছে।” (চাঁদনী)
—–
বিস্মিত নজরে তাকিয়ে আছে আদ্রিতা ফারিশের দিকে। ঘড়িতে পাঁচটা পনের বাজে। আদ্রিতা মাত্রই নিজের কক্ষ থেকে বের হতে নিয়েছিল এরই মাঝে ঝড়ের গতিতে ফারিশ হাজির। পাশেই আদিব দাঁড়ানো। আদ্রিতা নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বললো,“আপনারা এখানে?”
আদিব মুখ খুললো। বললো,“ফারিশ ভাইকে একটু দেখবেন আপনি। ওনার পিঠের ক্ষতটা দিয়ে আপনাআপনি রক্ত পড়ছে।”
আদ্রিতা দ্রুত এগিয়ে গেল। তাকে উত্তেজিত দেখালো। ফারিশ ঠায় দাঁড়িয়ে। সে আসতে চায় নি আদিব একপ্রকার জোর করেই তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। কতক্ষণ আগে আদিব আর ফারিশ কোথাও একটা যাচ্ছিল। ফারিশের পড়নে নেভি ব্লু কালার চেক শার্ট আর কালো জিন্স। গাড়িতে বসেই ফারিশ বলছিল,“আদিব সে হারামিটা পালিয়েছে তার কি কোনো খবর পাওয়া গেছে?”
আদিব গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বললো,
“না ভাই। তবে চিন্তা করবেন না খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবো।”
“আচ্ছা আদিব তোমার কি মনে হয় গাড়িতে মেয়ে রাখার বিষয়টায় শুধু কি পালিয়ে যাওয়া ছেলেটারই হাত আছে নাকি তার পাশাপাশি অন্য কারোও হাত আছে।”
আদিব কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“আমার তো মনে এর পিছনে অন্য কারোও হাত আছে।”
“আমারও তাই মনে হয়।”
হঠাৎই আদিব খেয়াল করে ফারিশের শার্ট বেয়ে রক্ত পড়ছে সঙ্গে সঙ্গে সে গাড়ি থামালো আতঙ্কিত স্বরে বললো,“ভাই আপনার পিঠ।”
ফারিশ হাত দিলো। রক্ত দেখেও বললো,“কিছু হবে না তুমি গাড়ি চালাও।”
কিন্তু আদিব শোনে না একটু জোর করেই নিয়ে আসে ফারিশকে হসপিটাল।”
“কি করে হলো?”
হঠাৎই আদ্রিতার কণ্ঠ শুনে ভাবনায় ছেদ পড়লো ফারিশের। সে সরাসরি তাকালো আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতাও তাকালো। চোখাচোখি হলো দুজনের। আদিব বললো,“আপনাআপনি ঘটেছে গাড়ি করে যাচ্ছিলাম হঠাৎ দেখি পিঠ বেয়ে রক্ত ঝড়ছে।”
আদ্রিতা খানিকটা রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,“ঝড়বেই তো ওনায় বলেছিলাম ক্ষতটা গভীর সেলাই করতে হবে কিন্তু উনি শোনে নি হন হন করে ভাব নিয়ে চলে গেছিল।”
আদিব কিছু বলে না। ফারিশ বলে,
“আমি এখানে আসতে চাই নি নেহাত আদিব নিয়ে এসেছে তাই এসেছি।”
“তা আসবেন কেন ডাক্তারদের কাছে আসতে তো আপনার মেইবি এলার্জি আছে।”
ফারিশ কিছু বলে না চুপ থাকে। এই মেয়েটার সাথে কথা বলতেই তার বিরক্ত লাগে। অবশ্য শুধু আদ্রিতা না পুরো মেয়েজাতির সাথেই কথা বলতেই বিরক্ত লাগে ফারিশের।”
আদ্রিতা একটা বেড দেখিয়ে বললো,“ওখানে শুয়ে পড়ুন?”
ফারিশ শুতে চাইলো না কিন্তু আদিব শোয়ালো। ফারিশের শার্ট খোলা হয়েছে। আদ্রিতা হাতে গ্লাভস পড়ে। পুরো জায়গাটা দেখলো দু’দিনে একটুও সারে নি উল্টো আরো ঘা হয়ে গেছে। আদ্রিতা বুঝে না এই ছেলের ব্যাথা ট্যাথা কিছু করে না নাকি। না হলে এমন আহত হয়ে কি করে স্বাভাবিক থাকতে পারে। আদ্রিতা হাতে ইনজেকশন নিলো। তা দেখেই আদিব ঘাবড়ে গেল। বললো,“আমি বাহিরে আছি আপনি প্লিজ ওনায় পুরোপুরি চিকিৎসা না করে বাহিরে যেতে দিবেন না। আমি এসব দেখতে পারি না। আমি দরজার কাছেই আছি। ভাই আপনি কিন্তু পুরোপুরি চিকিৎসা না করে বের হবেন না।”
কথাগুলো থরথর করে বলেই বেরিয়ে গেল আদিব। ফারিশ হেঁসে বললো,“ছেলেটা এত ভীতু কেন?”
আদ্রিতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আদিবের কান্ড দেখলো। আদিব বের হতেই বললো,
“উনি এমন পালিয়ে গেলেন কেন?”
“আপনি ইনজেকশন নিয়েছেন না ওর ইনজেকশনে ভয় খুব।”
“দেখেই ভয় পেল।”
“হুম।”
আদ্রিতা অবাক হলো। ইনজেকশন দেখেই ভয় পেয়ে গেল। সত্যি সত্যি দিলে তো মনে খবর হয়ে যেত।”
—–
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে চাঁদনী সামনের পুরুষটির দিকে। এভাবে দৌড়ে আদ্রিতাকে ডাকতে এসে তারই কেভিনের সামনে একটা পুরুষের গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে আগে জানলে কখনোই আসতো না। লোকটা কি ভাবলো তাকে?” নিশ্চয়ই নিলজ্জ টাইপ কিছু!’
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। ]