এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-০৩

0
441

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ০৩

চোখ বড় বড় করে টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে আদ্রিতা। তার যেন এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। রাতের ওই ছেলেটি দেশ বিরোধী এক মাফিয়া হবে। ছেলেটাকে দেখে তো তেমন মনে হলো না। হ্যা শুরুতে একটু ছেলেটাকে দেখে ভয় পেয়েছিল আদ্রিতা। তার গলায় ছুরি ধরার বিষয়টাতেও বেশ চমকে যায়। কিন্তু তার কেন যেন মনে হয়েছিল ছেলেটা মেইবি বিপদে পড়েছে। আর ওই লোকগুলোই বাজে ছিল বোধহয়। কিন্তু এখন কি বের হলো। ওই লোকগুলো সত্যিই পুলিশ ছিল। ইস তারা যদি একবার বলতো তারা পুলিশ তাহলে চোখের ইশারায় হলেও আদ্রিতা দেখিয়ে দিত পিছনের ছেলেটিকে। আদ্রিতার আফসোস হলো আবার ভাবলো এমনটা নাও হতে পারে। অন্যকেউ তো হতে পারে। তাদের হসপিটালেই ঢুকেছিল এমনটাও তো বলে নি অন্য হসপিটালও হতে পারে। মুখ নাকি ঢাকা ছিল কিন্তু ফারিশের মুখ তো ঢাকা ছিল না। খানিকটা বিপর্যস্ত ছিল কিন্তু মাফিয়া টাইপ এমন কিছু মনে হয় নি। আদ্রিতার ফোনে তখন লাউড স্পিকারে মৃদুল ওরা সবাই ছিল। অনেকক্ষণ যাবৎ হ্যালো হ্যালোও করছে কিন্তু আদ্রিতা কিছু বলছে না। মৃদুলের বিরক্ত লাগলো সে একটা ধমক দিয়ে বললো,“ওই হালার পো হালা তুই কি আছিস নাকি মইরা ভূত হইয়া গেছিস। সামনে পাইলে এমন বাইরান বাইরামু যে জামাইর নাম মনে রাখতে পারবি না। আদ্রিতার বাচ্চা।”

আদ্রিতার হুস আসলো। স্তব্ধ সুরে থমথমে গলায় বললো,
“হুম বল।”
“মইরা গেছিলি নাকি?’
“আমার তেমনটাই লাগছে।”

আদ্রিতার কথা শুনে সবাই চিন্তিত হলো তবে কি তাদের ধারনাই ঠিক হলো। মাফিয়াটি কি তাদের হসপিটালেই গিয়েছিল। কাল সবাই একটু ব্যস্ত থাকায় যে যার বাড়ি চলে যায় আদ্রিতা কাল অনেক রাত অবদি হসপিটাল ছিল তাই তারা চিন্তিত হয়ে তাকে ফোন করে। মুনমুন ধীর স্বরে বললো,
“আমরা কি তোর বাসায় আসবো আদু?”

আদ্রিতা আনমনেই বলে উঠল,“আয়।”
ফোন কাটলো আদ্রিতা। চেয়ে রইলো টিভির পর্দার দিকে। এখনো যেন কানে বাজছে দেশ বিরোধী মাফিয়া,,
—-
নিজের কক্ষে আয়নার সামনে কালো শার্টের অর্ধেক খুলে পিঠটাকে আয়নার দিকে ঘুরিয়ে ক্ষত স্থানটি দেখার চেষ্টা করলো ফারিশ। অনেকটা জখম হয়েছে। তার মনে পড়লো কেউ একজন ধারালো ছুরি দিয়ে তার পিঠে খুব গভীরভাবে পোঁচ দিয়েছিল। লোকটি পিছন থেকে পোঁচটা দেয় ফারিশকে। ফারিশ তার গায়ে শার্টটা জড়ালো। উচ্চ স্বরে ডাক দিয়ে বললো,“আদিব।”

ফারিশের এক ডাকেই দরজা না খুলেই আদিব ঢুকতে নিলো কক্ষে সঙ্গে সঙ্গে একটা বারি খেল মাথায়। ‘আহ্’ শব্দ বের হলো মুখ দিয়ে। সে কপাল ডলতে ডলতে বললো,“ভাই দরজা বন্ধ তো।”

ফারিশ বিরক্ত নিয়ে বললো,“উল্টোদিকে টান দেও ইডিয়েট।”

আদিব ঠোঁটে কামড় দিল। যে বার বার ভুলে যায় ফারিশের রুমের দরজার সাইড বাহির দিকে। আদিব দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,“সরি ভাই।”

ফারিশ তাকালো আদিবের দিকে। বললো,
“নতুন যুক্ত হওয়া সব কয়টাকে আধঘন্টার মধ্যে আমার চাই আদিব।”

আদিব মাথা দুলিয়ে বললো,
“আচ্ছা ভাই। কোথায় আনবো?”
“অফিসে নিয়ে আসো।”
“ঠিক আছে।”

বেরিয়ে গেল আদিব। আদিব হলো ফারিশের এসিস্ট্যান্ট। ছোট বেলা থেকেই তারা দুজন একসাথে আছে। আদিব প্রথম প্রথম ফারিশকে তুই তুই করে বলতো। কিন্তু চোখের সামনে একটা ঘটনা দেখার পর থেকে সে তুমি করে বলে অজানা কারণে ফারিশকে সে ভয়ংকরভাবে ভয় পায়। ফারিশ তার সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করলেও আদিবের ভয় আর কাটে না। ছোটবেলার ভয়টা কিছুতেই যাচ্ছে না। তবে ফারিশ জানে এই দুনিয়ায় তাকে যদি নিজের থেকেও কেউ বেশি ভালোবেসে থাকে সে হলো আদিব। এমনও দিন গেছে তারা দুটো জুতো পালিশ করে একটা রুটি কিনে দুজনে ভাগ করে খেয়েছে।

ফারিশ তার ফোনটা তুললো। কাউকে কল করে বললো,“কালকের কিছু সিসিটিভি ফুটেজ আমার চাই রফিক। আধঘন্টার মধ্যে জোগাড় করে আমায় পাঠাও।”

ফারিশের কথা শুনে রফিকও বললো,“আচ্ছা বস।”
—-
চিন্তিত চেহারা নিয়ে সোফায় গোল হয়ে বসে আছে পাঁচজোড়া চোখ। তাদের সবার চেহারাই থমথমে। তারা তাকিয়ে আছে আদ্রিতার মুখশ্রীর দিকে। কিছু যে একটা ঘটেছে এটা বুঝতে তাদের বাকি নেই। আশরাফ, মুনমুন, মৃদুল, রনি আর চাঁদনী এরা সবাই একেকজন একেক বিষয়ের ডক্টর। আশরাফ অর্থোপেডিস্ট, মুনমুন ডার্মাটোলজিস্ট, মৃদুল ফরেনসিক ডাক্তার, রনি পেডিয়াট্রিশিয়ান, চাঁদনী ডেন্টিস্ট, আর আদ্রিতা সার্জারীর ডাক্তার। সব ধরনের সার্জারীর কাজই সে করে। মৃদুল নীরবতা কাটিয়ে বলে উঠল,
“তুই কি কিছু বলবি নাকি ঠাটিয়ে একটা দিবো গালে?”

আদ্রিতা অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকালো মৃদুলের দিকে। মুনমুন আর চাঁদনী আদ্রিতার দু’পাশে বসলো। দুজনে দুইদিক দিয়ে দুইহাত ধরে বললো,
“এভাবে চুপচাপ বসে আছিস কেন কিছু কি হয়েছে?”

আদ্রিতা এবার মুখ খুললো। বললো,
“কাল রাতে।”

সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো আদ্রিতার দিকে। রনি বললো,
“কি হয়েছে কাল রাতে?”

আদ্রিতা রনির দিকে তাকিয়েই বলা শুরু করলো,
“কাল রাতে আমি তিনটা অবদি হসপিটাল ছিলাম তারপর হঠাৎ লোডশেডিং হয়। তখন আমার কেভিনে একটা ছেলে আসে। যতটুকু জেনেছি ছেলেটার নাম ফারিশ মাহমুদ। কিন্তু ছেলেটাকে কোনো এঙ্গেল থেকে মাফিয়া মনে হয় নি।”

সবার চোখে মুখে বিস্ময়ের চাহনী। আদ্রিতা ধীরে সুস্থে কাল রাতের সব ঘটনা খুলে বললো সবাইকে। আশরাফ তো বলেই উঠলো,“আমাদের এক্ষুণি পুলিশ স্টেশন যাওয়া উচিত।”

আশরাফের কথা শুনে মুনমুন বললো,
“কিন্তু ছেলেটা তো মাফিয়া না হয়ে অন্যকেউও হতে পারে।”

আবার ভাবনায় পড়লো সবাই। মৃদুল বললো,“আমি তো ৯০% শিওর ওই ছেলে মাফিয়াই হবে। আদু তোর কি ছেলেটার চেহারা মনে আছে?”

আদ্রিতা দু’মিনিট ভেবে বললো,“হুম।”

চাঁদনী এক্সাইটিং নিয়ে বললো,“কেমন দেখতে রে শয়তান টাইপ। দাঁতগুলো নিশ্চয়ই কালা, হাতে ট্যাটুম্যাটু ছিল আদু। আমি কোথায় যেন পড়েছিলাম মাফিয়াদের সারা শরীরে নাকি ট্যাটু থাকে। ফারিশ মাহমুদের গায়ে ছিল নাকি।”

আদ্রিতা বেশি সময় না নিয়েই বললো,“না ওসব তো ছিল না। মাথায় ঝাকড়া চুল, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের অধিকারি পুরুষটির বড় বড় চোখ ছিল, চোখের মনির অত্যাধিক কালো,গাল ভর্তি চাপ দাঁড়ি, চোখের পাশে কাটা দাগ, গায়ে কালো জ্যাকেট জড়ানো ছিল। সুদর্শন যুবক বলা যায়।”

মুনমুন চেঁচিয়ে বললো,“আরেহ বাস আমি তো বর্ণনা শুনেই প্রেমে পড়ে গেলাম। না এ ছেলে মাফিয়া হতে পারে না।”

মুনমুনের কথা রনি চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
“তুই থামবি মুন কথা নেই বার্তা নেই যারে দেখে তারই প্রেমে পড়ে। এটায় তো না দেখেই প্রেমে পড়ে গেছে।”

মৃদুল হেঁসে বললো,“ওটা তো ওমনই পাগল যেন কোথাকার। মাফিয়ারও প্রেমে পড়ে কিছুদিন পর দেখবি ঝালমুড়ির বিক্রেতারও প্রেমে পড়ছে।”

সবাই হেঁসে দিল। শুধু হাসলো না আশরাফ। সে একটু সিরিয়াস টাইপ ছেলে। কোনো বিষয় মাথায় একবার ঢুকলে সেটা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তার মাথা শান্ত হয় না। আশরাফ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,“তোরা হাসাহাসি বাদ দিবি।”

সবাই চুপ হয়ে গেল। আশরাফ আবার বললো,“আদু আর দেরি নয় এক্ষুণি আমরা পুলিশ স্টেশন যাবো। তুই তৈরি হয়ে আয়।”

আদ্রিতা চিন্তিত স্বরে বলে,
“সত্যি যাবি।”
“হুম তাড়াতাড়ি যা।”

আদ্রিতা উঠে গেল। চাঁদনী বললো,“কিন্তু ওই ছেলেটা সত্যিই যদি মাফিয়া না হয় তখন?”

আশরাফ বললো,“আমার এমনটা মনে হয় না চাঁদ। কেননা ছেলেটা আদুর পিঠে ছুরি ধরেছিল যাতে ওর কথা পুলিশদের না বলে। যদি কোনো অপরাধ না করে থাকে তবে এমনটা করবে কেন?”

আশরাফের কথায় যুক্তি আছে। মৃদুলও সায় দিয়ে বললো,“আমারও মনে হয় পুলিশদের এই বিষয়টা জানানো উচিত। দেশ বিরোধী মাফিয়া। চেহারা চিনে রাখলেও তাদের খুঁজতে সুবিধা হবে।”

সবাই সায় দিয়ে বললো,“ঠিক।”
রনি আবার বললো, “টিভিতেও ছেলেটার ছবি দেখালে সাধারণ মানুষও সতর্ক হয়ে যেতে পারবে।”
—–
একটা বড়সড় অফিস কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে ফারিশ। তার সামনেই গত মাসে আসা দশজন ছেলে দাঁড়ালো। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। সবার মুখেই একটাই কথা তারা কিছু করে নি। আদিব ফারিশের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,“ভাই টোটাল এগারোজন ছিল একজনকে কাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।”

ফারিশ তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“কোথায় গেছে?”
“জানি না ভাই তবে খোঁজ লাগিয়েছি আশা করি দু’চারদিনের মধ্যে পেয়ে যাবো।”
“হুম।”

আদিব সরে গেল। ফারিশ এবার এগিয়ে গেল ছেলেগুলোর দিকে। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,“ট্র্যাকে মেয়ে আসলো কোথা থেকে?”

একজন ভয়ে ভয়ে বললো,“আমরা কিছু জানি না বস আমরা তো শুধু ওই ঔষধের মালগুলোই ট্র্যাকে উঠিয়ে ছিলাম মেয়ের ব্যাপারটা সত্যি জানি না।”

ফারিশ শুনলো কিছু বললো না। আবার হাঁটলো ছেলেগুলোর চারপাশে। কিছু সময় যায় কিন্তু কিছু বলে না শুধু পায়চারি করে। হঠাৎ একটা ছেলের হাতের ব্যাচলেটের দিকে নজর পড়লো ফারিশের এটা যেন চেনা চেনা লাগছে। ফারিশ তার জুতোর ঠক ঠক শব্দ করে এগিয়ে গেল ছেলেটার কাছে। ছেলেটা থর থর করে কাঁপছে। ফারিশ বললো,
“নাম কি?”

ছেলেটা চমকে উঠলো। ভয়ে ভয়ে বললো,
“জি।”
“নাম কি?”
“কাওসার।”
“বাড়ি কই?”
“টাঙ্গাইল।”
“হাতের ব্যাচটা কোথা থেকে কিনেছো?”
“কিনি নাই আপা গিফট করছিল।”

মনে মনে হাসলো ফারিশ। কপাল চুলকে বললো,
“কাল রাতে ব্যাচটা পড়েছো ঠিক আছে কিন্তু আজ পড়ে এসে মনে হচ্ছে না ভুল করেছো।”

সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীর সমেত কেঁপে উঠলো কাওসারের। সে ধরা পড়ে গেছে। উত্তেজনার চক্করে সে ভুল করে কাল রাতের হাতের ব্যাচটা পড়ে এসেছে। কাওসার আচমকাই পায়ের কাছে পড়লো ফারিশের। বললো,“ভুল হইয়া গেছে বস আর এমন হইবো না।”

হাসলো ফারিশ। বললো,“তার মানে আমার পিঠের পোঁচটা তুই দিয়েছিলি?”

ছেলেটা আরো ভয় পেয়ে গেল। বললো,“আর কোনোদিন এমন হইবো না বস আমারে মাফ কইরা দেন।”

ফারিশ শুনলো না। পকেট থেকে পিস্তল বের করে পরপর তিনটে গুলি পিঠে ঢুকিয়ে দিলো কাওসারের। ছেলেটা গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে লাগলো নিচে। বাকি সবাই তা দেখে ভয়ে কেঁপে উঠলো। ফারিশ হাতের ইশারায় বাকিদের যেতে বলে সবাই চলে যায়। শুধু দাঁড়িয়ে থাকে আদিব। ফারিশ সামনের চেয়ারে বসে। রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। ফারিশ পকেট থেকে সিগারেট বের করে সেটা জ্বালিয়ে কয়েকটা টান দিলো। ফুঁ উড়িয়ে আদিবকে বললো,“যেটা পালিয়েছে ওটাকে আমার কালকের মধ্যে চাই আদিব। বেইমানদের জায়গা আমার কাছে নেই।”

আদিব থরথর করে বললো,“দেখছি ভাই।”

ফারিশের ফোনটা বেজে উঠলো। ফারিশ সিগারেটে আবার টান দিয়ে ফোনটা তুললো। বললো,“কি হয়েছে?”

অপরপ্রান্তের লোকটি কিছু বললো। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুখ আরো শক্ত হয়ে গেল ফারিশের। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে বললো,“আপনায় বলেছিলাম আমায় মনে না রাখতে কিন্তু আপনি রেখেছেন। এখন এর পরিণাম কতটা ভয়ানক হতে পারে তা কি আপনি বুঝচ্ছেন ডাক্তার ম্যাডাম!”

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে