#এক_আকাশ_দূরত্ব (২৮)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
শান্ত বিছানায় গাল ফুলিয়ে বসে আছে, আবরার নাজিয়ার সাথে দেখা করতে পারলেও ওহ কিন্তু শ্রেয়ার সাথে দেখা করতে পারেনি এমনকি কাল থেকে শ্রেয়া ফোনটাও রিসিভ করছে না। আর করবেই না কিভাবে ফোনটা ওর কাছে থাকলে তো। শয়তান কাজিনগুলো শ্রেয়া ও নাজিয়ার ফোন নিজেদের কাছে আটকে রেখেছে ওদের একটাই কথা, আগে প্রচুর প্রেম করছ আমরা কেউই বাঁধা দিইনি এখন দুইদিন প্রেম- ট্রেম বাদ। শ্রেয়া ফোন দেওয়া নিয়ে বকাবকি করলেও নাজিয়া লজ্জায় কিছু বলতে পারেনি। শ্রেয়ার অনেক বলার পরেও ফোন ফেরত পায়নি এইটা নিয়ে বেচারীর ভীষন মনখারাপ।
হেনা শ্রেয়ার পাশে বসে বলল,
– “দ্যাখ শ্রেয়া’দি বরের সাথে আজীবন প্রেম করতে পারবি, কথা বলতে পারবি কিন্তু বল আমাদের কি আর এইভাবে একসাথে পাবি!”
শ্রেয়া রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
– “তোদের মতো কাজিন থাকলে জীবনে আর শত্রুর প্রয়োজন হবে না।”
হেনা কিছুটা ভাব নিয়ে বলল,
– “তাহলে ভাব আমরা কতটা স্পেশাল।”
শ্রেয়ার ইচ্ছা করছে হেনাকে দুচারটে ধরিয়ে দিতে, এই মেয়েটাই সবার লিডার। কিন্তু প্রচুর আত্মীয় স্বজন আছে, এখন যদি হবু বরের সাথে কথা বলার জন্য বোনের সাথে মারামারি করে তাহলে আর কারোর সামধে মুখ দেখাতে হবে না। মানসম্মানের ভয়ে শুধু চুপ করে আছে।
হেনা শ্রেয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
– “সন্ধ্যায় সারপ্রাইজ আছে।”
সারপ্রাইজ! আবার কি সারপ্রাইজ দেবে কে জানে।
সন্ধ্যাবেলা,
নাজিয়া ও শ্রেয়ার হাতে মেহেন্দি পড়ানো হচ্ছে। ওইদিকে আবরার আর শান্ত মেহেন্দি পড়তে নারাজ। শান্ত তবুও বা রাজি হয়েছিল কিন্তু আবরার ওহ কিছুতেই পড়বে না।
– “আমি মেয়েদের মতো হাতে মেহেন্দি দিয়ে বসে থাকতে পারব নাহ, তোরা ফট এইখান থেকে।”
হেনা মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,
– “মেহেন্দি না পড়লে বউয়ের দেখাও পাবে না।”
আবরার নড়েচড়ে বসে পাশে থাকা শান্তর দিকে তাকাল।
– “বউয়ের দেখা পাবো না মানে?”
– “শুনে কি লাভ! তোমরা তো বলেই দিয়েছ মেহেন্দি পড়বে না।”
– “পড়ব না বলছিলাম কিন্তু এখন তো রাজি হতেও পারি।কি বলবি ভনিতা না করে বলে ফেল।”
– “আমরা ঠিক করেছি মেহেন্দি অনুষ্ঠানের পর সবাই মিলে ছাদে একটু আড্ডা দেব, এটা নিয়ে বড়োদের পারমিশনও নেওয়া হয়ে গেছে।সেখানে বর-কনেরাও থাকবে, কিন্তু তোমরা মেহেন্দি না পড়লে তোমাদের যাওয়া হবে না।”
আবরার হেনার দিকে বাঁকা হেসে বলল,
– “মেহেন্দি পড়লে বউয়ের হাত থেকেই পড়ব, সেটা যদি ম্যানেজ করতে পারিস তো মেহেন্দি করব। আর যদি ভাবিস আমাদের ছাড়াই আড্ডা দেবার প্ল্যান করবি তাহলে ছাদ থেকে সবকটাকে ছুঁড়ে নীচে ফেলে দেব।”
শেষের কথাটা রাগ নিয়ে বলল, এদের অত্যাচার আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আবরার ভালো করেই জানত ওর কাজিনমহল এইরকম করবে তাই তো বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না।
হেনা সহ বাকিরা আর কিছু বলল না, কাল থেকে ওদেরকে কম জ্বালাচ্ছে না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঝামেলা হয়ে যাবে আর তখন বকুনিটা ওরাই খাবে তাই চুপ থাকাই ভালো বলে মনে হলো।
রাতের খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ করার পর দুই বউকে নিয়ে হেনাদের টিম ছাদে উপস্থিত হলো। আড্ডা দেবার বিষয়টা নাজিয়া ও শ্রেয়া জানত না ওটা ওদের জন্য সারপ্রাইজ ছিল।
ছাদে এসে দুই বরকে দেখে ওরা সত্যিই সারপ্রাইজড হলো, যে কাজিনমহল ঠিক করে ফোনেই কথা বলতে দিতে নারাজ তারাই আবার ছাদে এনেছে এর পেছনে কিছূ মতলব নেয় তো!
নাজিয়া ও শ্রেয়াকে আবরার আর শান্তর মুখোমুখি বসানো হলো। বাকিরা ওদের পাশাপাশি গোল হয়ে বসল।হেনা বক্তৃতা দেবার মতো ভান করে বলল,
– “গাইস আমরা এখন ট্রুথ ও ডেয়ার খেলব। যাকে যা দেওয়া হবে তাকে কিন্তু সেইটা কমপ্লিট করতে হবে।”
কেউ দ্বিমত পোষণ করল না। ট্রুথ ডেয়ার শুরু হলো, প্রথমেই দান পড়ল আবরারের।
– “ডেয়ার।”
হেনা শয়তানি হেসে বলল,
– “তোমার ডেয়ার হচ্ছে এখুনি নিজের বেডরুম থেকে ঘুরে আসবে।”
আবরার বসা থেকে উঠতে উঠতে বলল,
– “এটা তো কোনো ব্যাপার না।”
আবরারের আরেক কাজিন টুসি বলল,
– “আরে আবরার’দা তোমার এই বেডরুম না, তোমার বাড়ির নিজস্ব বেডরুম।”
– “কি! এইটা কিভাবে পসিবেল?”
হেনা শয়তানি হেসে বলল,
– “ডেয়ার কমপ্লিট করতে না পারলে ১হাজার টাকা ফাইন।”
আবরার মুখ কুঁচকে ফেলল, ভালো মতোই বুঝল এরা পকেট ফাঁকা করার প্ল্যান নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন তো বেডরুমে যাওয়া সম্ভব না তাই বাধ্য হয়ে ১হাজার টাকা দিতে হলো। আবরারের করুন মুখ দেখে নাজিয়ার প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে কিন্তু সবার সামনে হাসতেও পারছে না।
পরের দান অন্য এক কাজিনের হলো। তাকে ডেয়ার দেওয়া হলো গান করার জন্য। এইভাবে খেলা চলার মাঝে শ্রেয়ার দান পড়ল, শ্রেয়া ডেয়ার নিতেই আবরার চেঁচিয়ে উঠল,
– “এই আমি ডেয়ার দেব।”
শ্রেয়া মনে মনে ঢোক গিলল। না জানি আবার কি বাঁশ দেয়।
– “শ্রেয়ার ডেয়ার হচ্ছে এখন এইমুহুর্তে শান্তকে আমাদের সবার সামনে প্রোপজ করতে হবে।”
বাকিরা চেঁচিয়ে উঠল, শ্রেয়া কিছুটা লজ্জা পেল। একটা মেয়ে হয়ে এতজনের সামনে প্রোপজ করতে হবে! সবাই শ্রেয়াকে করার জন্য বলছে, আবরার শ্রেয়া আর শান্তকে ওদের গোলের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয়। শ্রেয়া শান্তর দিকে কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থাকে তারপর হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
– “আমার হাতটাকে ধরে রাখার সিদ্ধান্ত তো অনেক আগেই নিয়েছ, নতুন করে হাত ধরার কথা আর বলব না। বারবার মুখে ভালোবাসি কথাটা বলার জন্যও অনেকখানি আবদার করব না, শুধু একটা জিনিস চাইব কখনো কোনো কারনে আমাকে অবিশ্বাস করো না। ভুল করলে রাগ না দেখিয়ে শুধরে দিও, প্রয়োজনে শাসন করো তবুও অবহেলা করো না আমি মেনে নিতে পারব না। অবশেষে বলব ভালোবাসতাম, ভালোবাসি আর আজীবন ভালোবাসব।”
সবাই হইহই করে উঠল। শান্ত নিজেও হতবাক। শ্রেয়ার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে হাতদুটোকে শক্ত করে ধরে বলল,
– “জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তোমার সাথে বাঁচতে চাই। কথা দিলাম, তোমাকে নিয়ে ছোট সুখের ঘর বাঁধব যেখানে কোনো ভুল বোঝাবুঝির ঠাঁই থাকবে না। আমিও বলব, ভালোবাসতাম, ভালোবাসি আর আজীবন ভালোবাসব।”
শ্রেয়া ইমোশনাল হয়ে শান্তকে জড়িয়ে ধরল। মুহূর্তটা ক্যামেরাবন্দি করতে ভুলল না কাজিনমহল।
আবরার শান্তর পিঠ চাপড়ে বলল,
– “ভাই পুরো ফাঁটিয়ে দিয়েছিস।”
শান্ত লাজুক হাসল। খেলা আবারো শুরু হলো, নাজিয়ার দান আসলে ওহ ডেয়ার নেয় কারন এদের বিশ্বাস নেয় কখন কি করতে বলে কে জানে।
হেনা কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল,
– “আবরার’দার কি দেখে তোমার ভালো লেগেছিল?”
– “জানি না।”
– “জানো না! তবুও কিছু বলো কিছু তো একটা দেখে প্রেমে পড়েছিলে?”
নাজিয়া আবরারের দিকে একপলক তাকিয়ে হেনার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
– “আমি তার প্রেমে পড়িনি বরং ভালোবেসেছি।”
ওওওওও কাজিনমহলের সবাই আবারো চেঁচিয়ে উঠল। শান্ত আবরারকে খোঁচা দিয়ে বলল,
– “আহা গো কত ভালোবাসা দেখেছিস!”
আবরার উত্তর না দিয়ে মৃদু হেসে নাজিয়ার দিকে তাকাল। মেয়েটা যে ওকে বড্ড ভালোবাসে এটা বুঝতে অসুবিধা নেয়।
এইবার ভাগ্যক্রমে দান পড়ল হেনার কাছে। আবরারের মুখে শয়তানি হাসি লেগে আছে। শয়তানি হেসে বলল,
– “কি নিবি বল! আর তুই যা ভীতু ডেয়ার নিতেই পারবি না।”
হেনা নাক ফুলিয়ে বলল,
– “নাও ডেয়ারই নিলাম।”
আবরারের মুখের হাসি আরো কিছুকা চওড়া হলো, বাঁকা হেসে বলল,
– “তুই এখন এই মুহূর্তে আমাদের সবার সামনে কান ধরে ১০০টা উঠবস করবি।”
– “কি!”
– “ইয়েস। অনেক জ্বালিয়েছিস এইবার বোঝ।”
শ্রেয়াও বলল,
– “হ্যাঁ হেনা শুরু কর।”
কাঁদো কাঁদো মুখ করেও হেনা আবরার আর শ্রেয়ার মন গলাতে পারল না। কান ধরে উঠবস করতে লাগল, ওর গ্যাং এর বাকিদের মুখটা চুপসে গেছে। আবরার যে এইভাবে প্যাচে ফেলবে সেটা বুঝতে পারেনি। হেনা ২০টার মতো উঠবস খাবার পর আবরার ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
– “থাক আর করতে হবে না। এইবারের মতো ছেড়ে দিলাম, পরেরবার আমার সাথে লাগতে এলে সাবধানে আসবি।”
হেনা মুখ বেঁকিয়ে বলল,
– “তোমাকে দেখে নেব।”
আড্ডা ওইখানেই শেষ হয়ে যায়। পরেরদিন সকালে অনেক কাজ আছে তাই সবাই ঘুমাতে চলে গেল।
—-
পরেরদিন,
বিয়ের আয়োজন পুরোদমে চলছে। শ্রেয়া আর নাজিয়াকে বউ সাজানো হচ্ছে। আর ওদিকে শান্ত আর আবরাররাও রেডি হচ্ছে।
– “এই ভাই আমার কিরকম একটা লাগছে।”
আবরার ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “কীরকম!”
– “অন্যরকম, প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে কি হবে?”
– “আরে চিল মুডে থাক কিছু হবে না।”
– “শালা তোর তো এইটা দুই নম্বর বিয়ে তোর আর কি টেনশান!”
আবরার ভাব নিয়ে বলল,
– “তাহলে ভাব আমি কতটা লাকি!”
আবরার আর শান্ত দুজনেই হেসে উঠল। সময় পেরিয়ে গেল, শ্রেয়া আর নাজিয়াকে স্টেজে বসানো হয়েছে। লোকজন আসতে শুরু করে দিয়েছে, শ্রেয়া ও নাজিয়া স্মাইল দিতে দিতে গাল ব্যথা করে ফেলেছে।
শ্রেয়া নাজিয়াকে খোঁচা দিয়ে বলল,
– “এই আর কতক্ষন এইভাবে থাকব! বিয়ে কখন হবে?”
– “কে জানে। দাঁত বার করতে করতে আমার গাল ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।”
ওদের দুজনের কথার মাঝে একটা চেনা কন্ঠস্বর শুনে দুজনে মাথা তুলে তাকিয়ে চমকে উঠল। শ্রেয়া ও নাজিয়া একসাথে বলে উঠল,
– “আপনি!”
#চলবে…
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।